Loading AI tools
বাংলার লৌকিক শিল্প উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বাংলার পুতুল বাঙ্গালীর অন্যতম প্রাচীন ঘরোয়া শিল্পকর্ম। সুপ্রাচীন কাল থেকেই বাংলার ঘরে ঘরে পুতুল তৈরি করা হয়ে থাকে। মায়েরা বালিকাদের খেলার জন্য কাপড়ের পুতুল বানিয়ে দেন। মাটির পুতুল গড়ে দেন। নানা কাজের মিস্ত্রীরা পুতুল গড়ে, বাজারে নিয়ে যায়। এলাকা ভেদে পুতুলের গড়নে বৈশিষ্ট্য লক্ষিত হয়। কোনো কোনো এলাকায় পুতুল তৈরীর দক্ষ কারিগরের উদ্ভব হয়। তাদের পেশাদারী হাতে পুতুল রীতিমতো শিল্পকর্ম হয়ে ওঠে।
এই নিবন্ধ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ উভয় বঙ্গের পুতুল নিয়ে লিখিত হতে হবে। উদাহরণ এবং দৃষ্টিভঙ্গিসমূহ সম্ভবত বিষয়বস্তুটিকে বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে উপস্থাপন করছে না। (অক্টোবর ২০১৮) |
বাংলার পুতুল | |
---|---|
উৎপত্তিস্থল | বাংলাদেশ |
উপাদান | পোড়ামাটি, কাঁচামাটি, তালপাতা, তালের এটি, নারকেলের ছোবা, পাট, গালা, কাপড়, পিতল ইত্যাদি |
আকৃতি | মনুষ্য মূর্তি, হাতি, ঘোড়া, দেব-দেবী |
উচ্চতা | ২ ইঞ্চি - ৫ ফুট |
রং | লালচে খয়েরি, কালো, সাদা লাল ডোরা কাটা |
ব্যবহার | ঘর সাজানো, বাচ্চাদের খেলনা, পুজো পার্বন |
সংশ্লিষ্ট উৎসব | পহেলা বৈশাখ, ঈদুল আজহা, মহররম, ঈদুল ফিতর, ওরস, দুর্গা পূজা, জন্মাষ্টমী, টুসু উৎসব, গাজন |
সারা পৃথিবীতেই পুতুল তৈরী হয় আদিকাল থেকে কিন্তু বাংলার পুতুলের কিছু বিশেষত্ব আছে। এই বিশেষত্ব বাংলার পুতুলকে বাকি স্থানের পুতুলের থেকে আলাদা করেছে। বাংলার বিভিন্ন জায়গায় প্রত্ন খনন কার্য চালিয়ে পোড়া মাটির পুতুল পাওয়া গেছে। সেগুলোই বাংলার পুতুল শিল্পকে প্রাচীনত্ব দিয়েছে। প্রাপ্ত সামগ্রীর মধ্যে নারী মূর্তি গুলো অন্যতম। উর্বরতার ও শক্তির প্রতীক নারী মূর্তি গুলি আজও সমান ভাবে বাংলার জনসমাজে সমান জনপ্রিয়। বাংলার জনসমাজকে পুতুলের মাধ্যমে চিত্রিত করার এক প্রবণতা সুপ্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। কাঁঠালিয়ার পুতুল বাংলার সমাজ জীবনের অন্যতম নির্দেশক পুতুল। এছাড়া রানি পুতুল ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী।[1][2]
বিভিন্ন বিষয়কে উল্লেখ করে বাংলায় পুতুল তৈরি হয়। বাংলার শ্রমজীবি মানুষের প্রতীক হিসাবে বাংলার পুতুল তৈরি হয়। যা বাংলার সমাজজীবনকে প্রতিভাত করে। আবার ঐতিহাসিক বিষয়ও পুতুলের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। এছাড়া আদিবাসী দেবতাদের উদ্দেশ্যে যেমন পুতুল তৈরি হয়েছে, আবার সে রকম ভাবেই মনসা দেবীর বা শিবের উদ্দেশ্যেও পুতুল তৈরি করা হয়েছে। বাংলার লৌকিক ধর্মের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।[3]
উপকরণের ওপর ভিত্তি করে পুতুলকে নয় ভাগে ভাগ করা যায়।
বাংলাদেশে পুতুল নির্মাণের উপকরণ হিসেবে মাটিই প্রধান। এ দেশে মাটির পুতুলই সবচেয়ে আদিমতম পুতুল।
পোড়ামাটির বিভিন্ন ধরনের পুতুল বাংলাদেশের পুতুলশিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে। কবে, কখন, কিভাবে মাটির পুতুল তৈরি হয়েছে সেটা জানা না গেলেও নদীমাতৃক এ দেশের মৃিশল্পীরা সহজলভ্য ও উপযুক্ত মাটি ব্যবহার করেই পুতুলশিল্পের সূচনা করেন। আর মাটির পুতুল তৈরি শিল্পীরা মূলত পাল, মালাকার প্রভৃতি বংশভুক্ত। শত শত বছর ধরে উল্লিখিত শ্রেণিভুক্ত মৃিশল্পীরা বাংলাদেশের এই প্রধানতম লোকশিল্প ‘পুতুল’ তৈরি করে যাচ্ছেন।
বাংলার কুমোররা নরম এঁটেল মাটি দিয়ে হাতের নৈপুণ্য ও কারিগরি জ্ঞানের মাধ্যমে টিপে টিপে এই পুতুল তৈরি করে। হাত দিয়ে টিপে তৈরি করে বলে এ পুতুলকে টেপা পুতুল বলে।
টেপা পুতুল বাংলার ঐতিহ্যেরও একটি অংশ। বাংলাদেশে মূলত মেয়েরাই টেপা পুতুল তৈরি করে। তবে বর্তমানে পুরুষরাও এ কাজে জড়িত হচ্ছে। এ পুতুল বানাতে কারিগরকে নিজস্ব মেধা ও দক্ষতা প্রয়োগ করতে হয়। পুতুলের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হাতের সাহায্যেই গড়ে তোলা হয়। মাটির বুটি দিয়ে বা কাঠির রেখা টেনে এ পুতুলের অলংকার ও পোশাকের আভাস ফুটিয়ে তোলা হয়। পরে রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। শুকানো হয়ে গেলে পোড়ানো হয় আগুনে। এভাবেই টেপা পুতুল বানানো হয়।[4]
এককাঠের পুতুল বাংলাদেশের অপার ঐতিহ্য। একটা সময় ছিল যখন শৈশবের খেলনা বলতে কাঠের তৈরি ঢেঁকি, আলনা, আলমারি, চেয়ার, টেবিল, সোফা, খাট-পালঙ্ক, রঙ্গিন ঘোড়া, হাতি , লম্বা লাঠি লাগানো হেলিকপ্টার, মাটির চাকা দেওযা টমটম গাড়িসহ আরও অনেক কিছু বোঝাত। আর এই ধরনের খেলনা মূলত বিভিন্ন মেলায় পাওযা যেত। এই ধরনের খেলনা কেনার জন্য বছরে একবার হলেও বৈশাখী মেলায় যাওয়া হতো। যা এখন প্রায় বিলুপ্তের পথে। বদলেছে যুগ। সেই সঙ্গে বদলে গিয়েছে মানুষের রুচি এবং চাহিদাও। স্বাধীন বাঙালি মুসলমান রাষ্ট্রের একসময়কার রাজধানী সোনারগাঁওয়ের প্রাচিনতম শিল্প এটি। মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাংলার ঐতিহ্য শিল্প বড় আকারে চিত্রিত করার সময় এই পুতুলো তুলে ধরা হয়।[5]
পাট হলো এক প্রকার তন্তু জাতীয় ফসল, যার উৎপাদনের শীর্ষে অবস্থান করে ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশ। বিভিন্ন পরিবেশ বান্ধব আইটেম যেমন ব্যাগ, ড্রেস মিটারিয়াল, জুতো, গহনা, ঘর সাজানোর জিনিসপত্র, পুতুল প্রভৃতি এই ফসল দ্বারা তৈরি করা হয়। পাটের পুতুল প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় তৈরি করা হয়। মজার ব্যাপার এটাই যে, এই পুতুল গুলি তৈরি হয় অবশিষ্ট পাট থেকে, যেগুলি পাটের তৈরি অন্যান্য যে কোন জিনিসের থেকে বেশি কদর পায়। পাটের পুতুল তৈরির পদ্ধতিটি হল: প্রথমে পাট দিয়ে পুতুলের শরীর তৈরি করা হয়, তারপর বিভিন্ন রঙে সেটিকে রাঙানো হয় এবং এরপর সুতো দিয়ে তার চোখ ও মুখ তৈরি করা হয়। এইসব পুতুল তৈরির সময় ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ী পাট ব্লিচ করা হয় অথবা করা হয় না। ব্লিচ করা পুতুলের উজ্জ্বলতা বেশি হওয়ার ফলে তাদের মূল্য বেশি হয়ে থাকে। 2-3 ফুট উচ্চতার পুতুলের মূল্য প্রায় 400-500 টাকা এবং এর থেকে ছোট আকারের পুতুল বা চাবির রিং যুক্ত পুতুলের মূল্য প্রায় 40-60 টাকা। সারা বাংলায় এই পুতুলের চাহিদা অনেক বেশি থাকায় প্রায় প্রতিটি হস্তশিল্প মেলা ও সরকারি শোরুমে এগুলির বিক্রি হয়। আপনি অনলাইন স্টোর থেকেও এই পাটের পুতুল সংগ্রহ করতে পারেন।
কাপড়ের পুতুল তৈরিতে উপকরণ হিসেবে প্রয়োজন রঙিন কাপড়, তুলা, সুতা, তার, আঠা, কৃত্রিম চুল, উল, রং, জরি, জরির পাড় ও কাঠ। যন্ত্রপাতি হিসেবে দরকার হবে কাঁচি, হাতুড়ি, সুঁই ও তার কাটার যন্ত্র। এ ছাড়া কাপড়ে পুতুলের ফর্মা আঁকার জন্য লাগবে পেনসিল, ফিতা ও রাবার। পুতুলের নানা চরিত্র থাকে; যেমন- চুড়িওয়ালা, ফেরিওয়ালা, রাজকন্যা, কলসি কাঁখে বধূ, জেলে, বর-কনে, গ্রাম্য বধু। এগুলো ছাড়া হাতি, ঘোড়া, বাঘ, হরিণ, মুরগি, কচ্ছপসহ বিভিন্ন ধরনের পুতুলও বানানো যায়।[6]
বাংলাদেশে তালপাতা দিয়ে বানানো তেমন একটা দেখা যায়না। তালপাতার সিপাই শিশু মনের চিত্তাকর্ষক খেলনা। ... ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার গুসকরায় তৈরি তালপাতার সিপাই।
গালার পুতুল’ নামে এই শিল্পের পরিচয় ঠিক পুরোটা ধরা পরে না। কারণ, শুধুমাত্র গালা দিয়ে নির্মিত হয় না এই পুতুল। অত্যন্ত পরিশ্রম করে জটিল পদ্ধতিতে বানানো হয়, তার জন্য প্রয়োজন একাগ্র মনোযোগ এবং অসীম ধৈর্য।
ধামরাই এলাকা কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। ওই সময় শুধু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল এর প্রচুর চাহিদা। এ ছাড়া বিদেশী পর্যটকেরা একসময় কাঁসা-পিতলের মধ্যে কারুকাজখচিত বিভিন্ন দেবদেবী ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্রগুলো নিয়ে যেত। কাসা পিতলের পুতুল পাওয়া যায়।
যাদুবিদ্যায় পুতুলকে কালো পুতুল বলা হয়
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ক্ষীরের পুতুল গল্পে পুতুলের উল্লেখ আছে। এখানে দুয়োরানি ক্ষীর দিয়ে তার পুত্র তৈরী করে বিয়ে করাতে পাঠিয়েছেন এবং ষষ্ঠী ঠাকুর সেই ক্ষীরের পুতুল খেয়ে ফেলায় পরে একটা পুত্র উপহার দেন।
পুতুল নাচের ইতিকথা বাঙালি হিন্দু সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত উপন্যাস। বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৬ সালে। পুতুলনাচ নিয়ে উপন্যাসটি না হলেও রূপক হিসাবে পুতুল নাচের উল্লেখ করা হয়েছে।[7]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.