ভারতীয় মৃত্তিকা জীববিজ্ঞানী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৯ - ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪) ছিলেন একজন মৃত্তিকা জীববিজ্ঞানী[১] এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ জামাতা। ছোটদের জন্য বাংলা ভাষার প্রথম বার্ষকী পার্বণী র সম্পাদনা করেন তিনি।[২]
নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় | |
---|---|
জন্ম | নীতু (ডাকনাম) ১৮৮৯ |
মৃত্যু | ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৪ |
পেশা | মৃত্তিকা জীববিজ্ঞানী |
দাম্পত্য সঙ্গী | মীরা দেবী (বি.১৯০৭) |
সন্তান | নীতিন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (পুত্র) নন্দিতা গঙ্গোপাধ্যায় (কৃপালনী) (কন্যা) |
পিতা-মাতা | বামনচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (পিতা) |
নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ব্রিটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায়। পিতা বামনচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বরিশালের সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। তবে ব্রাহ্ম ধর্মভুক্ত হওয়ার কারণে তিনি পিতৃভূমি বরিশালের আলতা গ্রাম পরিত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন।[৩] তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। পরিবারের আর্থিক অসঙ্গতির জন্য বামনচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে ঋণগ্রস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ নগেন্দ্রনাথের অগ্রজ উপেন্দ্রনাথ এবং অনুজ ধীরেন্দ্রনাথের (যিনি পরবর্তীতে ডি.জি নামে সুপরিচিত ভারতীয় চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব হন), শান্তিনিকেতনে থাকা ও খাওয়ার দায় বহন করেন। অন্যদিকে নগেন্দ্রনাথ পারিবারিক উন্নতির আশায় আমেরিকায় গিয়ে উচ্চ শিক্ষা নিতে চান। তৎকালীন বাংলার ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে অর্থসাহায্য চেয়ে অপমানিত হন। পরে রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এলে রবীন্দ্রনাথ নগেন্দ্রনাথের মধ্যে তেজস্বিতা উপলব্ধি করেন। কনিষ্ঠা কন্যা মীরার (১৮৯৪ - ১৯৬৯) (অপর নাম অতসীলতা) জন্য তাকে সুপাত্র বিবেচনা করে ব্রাহ্মসমাজের নিয়ম মেনে শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে বিবাহ দেন ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন (১৩১৪ বঙ্গাব্দের ২৩ শে জ্যৈষ্ঠ)। কবি নগেন্দ্রনাথকে বিবাহের পর আমেরিকায় পড়তে পাঠানোর ব্যয় বহনের প্রতিশ্রুতি দেন এবং প্রত্যাশা করেন যে, বিদেশে কৃষিবিদ্যা শিক্ষা লাভের পর নগেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে পল্লি-উন্নয়ন ও কৃষিসেবার কাজ করবে। নগেন্দ্রনাথ মানসিক বিরোধিতা সত্ত্বেও বিদেশে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্যেই বিবাহ করেন, কিন্তু বিবাহ বাসরের প্রথা ও স্ত্রী-আচার ইত্যাদি লঙ্ঘন করে উপস্থিত সকল সুধীজনের বিরাগভাজন হন। রবীন্দ্রনাথও নগেন্দ্রনাথের ব্যবহারে অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং সারা জীবন অনুতাপ করেন।
নগেন্দ্রনাথ ১৮১০ খ্রিস্টাব্দে কৃষি বিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে আমেরিকা হতে দেশে ফেরেন।[৪]
রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ মত নগেন্দ্রনাথ বিদেশের পাঠ বাস্তবে কাজে লাগাননি। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন কৃষি-পদ্ধতির মানোন্নয়নে এবং নতুনতর গবেষণায় রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে কাজ করবেন। কিন্তু তা' না করে নিরুদ্বেগে, নিশ্চিন্তে দিনযাপনের বাসনায় চাকরি খুঁজেছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে কবির সৌহার্দময় সম্পর্ক ছিল। কবির অনুরোধ আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার চাকরি করে দিয়েছিলেন নগেন্দ্রনাথকে।[৫] ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি-অর্থনীতির ‘খয়রা অধ্যাপক পদে ছিলেন তিনি। পরে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনে চলে যান এবং শেষ জীবনের বাইশটি বৎসর অতিবাহিত করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি স্বরাজ হাউস’ ও ‘ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টস হোস্টেল’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বহু বক্তৃতা করেন এবং পরের বছর তিনি শেষবার কলকাতায় এসেছিলেন।[২]
নগেন্দ্রনাথের স্বেচ্ছাচারিতা, অধৈর্য, অসহিষ্ণুতা, দুর্দান্ত ক্রোধ, রবীন্দ্রনাথকে যেমন পীড়া দিয়েছে, মীরা দেবীও তার ঔদ্ধত্য, বর্বরতা মুখ বুজে সহ্য করেছেন। সকলের বিরাগভাজনের কারণে নগেন্দ্রনাথের যে পৃথক সাহিত্যিকসত্তা ছিল তা আড়ালেই রয়ে গেছে। যে সময়ে তিনি কাজ না করে দিশাহীন অবস্থায় ঘুরে বেড়িয়েছেন, সে সময়ে তিনি ছোটদের উপযোগী শারদ সংকলন প্রকাশের পরিকল্পনা করেন। তার চিন্তা-ভাবনায় ছিল - "ছোটরা আনন্দ না পেলে কোন উৎসব পূর্ণতা পায় না"। তাই বাংলার শ্রেষ্ঠ শারদীয় উৎসবে চাই ছোটদের উপযোগী শারদীয় সংকলন গ্রন্থ - পূজার ছুটি। তিনি রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, জগদানন্দ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,অবনীন্দ্রনাথ, রথীন্দ্রনাথ, ইন্দিরা দেবী, সীতা দেবী, প্রিয়ংবদা দেবী, শিবনাথ শাস্ত্রী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী প্রমুখের কাছ থেকে রচনা সংগ্রহ করে এবং নিজের তিনটি রচনা সহ একটি পূজা বার্ষিকী তৈরি করেন। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত অবশ্য নামটি পরিবর্তন করে সংকলনটির নাম রাখেন পার্বণী। শিশুসাহিত্যের প্রথম বার্ষকী পত্রিকাটি ১৩২৫ বঙ্গাব্দের পয়লা আশ্বিন প্রকাশিত হয় নগেন্দ্রনাথের সম্পাদনায়। বার্ষিকীটি সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জ্ঞানদানন্দিনী দেবীর নাতনি তথা সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সংজ্ঞা দেবীর এগারো বৎসরের কন্যা মঞ্জুশ্রীকেই উৎসর্গ করেন তিনি। গগনেন্দ্রনাথ ও সুরেন্দ্রনাথ করের আঁকা সাদা-কালো ও রঙিন ছবিসহ দেড় টাকা মূল্যের ১৭২ পৃষ্ঠার পার্বণী ছাপা হয়েছিল সুকুমার রায়ের তত্ত্বাবধানে তাদের বিখ্যাত ইউ রায় অ্যান্ড সন্স ছাপাখানায়। সম্পাদকীয় বৈঠকে নগেন্দ্রনাথ লেখেন—
“সকল দেশেই পূজাপার্ব্বণ প্রভৃতি আনন্দোৎসবে ছেলেমেয়েদের উপভোগ্য নানারকম আয়োজন করা হইয়া থাকে, কেননা ইহাদের তরুণ মুখশ্রীতে হাসি না ফুটিলে উৎসব-দেবতার পূজা সম্পূর্ণ হয় না।”
[২] রবীন্দ্রনাথ বার্ষিকী পড়ে নগেন্দ্রনাথের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বার্ষিকীটির মাত্র দুটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে ছাপাখানার কর্মী বিক্ষোভে প্রকাশ সম্ভব হয় নি। দ্বিতীয় ও শেষ সংখ্যাটি অবশ্য মহাসমারোহে প্রকাশিত হয় ১৩২৭ বঙ্গাব্দে এবং নগেন্দ্রনাথ নিজের পুত্র নীতিন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করেন।
নগেন্দ্রনাথ ছোটদের জন্য বাংলা ও ইংরাজীতে বেশ কয়েকটি গল্প সংকলন রচনা করেন। উল্লেখ্যযোগ্য কয়েকটি গ্রন্থ হ'ল—
শেষোক্ত গল্প বইটির বেশিরভাগই সাঁওতালদের উপকথা থেকে নেওয়া। এক বুড়ো সাঁওতালের গল্প বলার ভঙ্গিমাতে নগেন্দ্রনাথ ছোটদের মত করে লিখেছেন।প্রকাশিত হয়েছিল কলকাতার শিশির পাবলিশিং হাউস থেকে।[২] এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি ও ছিন্নপত্র বইদুটি ১৩১৯ বঙ্গাব্দে ব্যয়বহুল গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন নগেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। তিনি ১৩১৯ বঙ্গাব্দেরই জ্যৈষ্ঠ মাস থেকে আদি ব্রাহ্মসমাজের সম্পাদক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
কবির আহ্বানে নগেন্দ্রনাথ পল্লি-উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করবেন বলে আশ্বাস দিয়েও অংশগ্রহণ করেন নি। কিন্তু ১৩৩৮ বঙ্গাব্দে তিনি পল্লি-সংস্কার সমস্যার আলোচনার প্রসঙ্গে রচনা করেন এক অসাধারণ গ্রন্থ- জাতীয় ভিত্তি। বইটির ভূমিকা লেখেন কবিগুরু। পরমপূজনীয় বিশ্ববরেণ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে নগেন্দ্রনাথ লেখেন -
রবীন্দ্রনাথ সমবায়ের যে আদর্শ উপস্থিত করেছেন, তার মূলে আছে শুভবুদ্ধি, খাঁটি স্বদেশ-প্রীতি ও মনুষ্যত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। সমবায়ের দ্বারাই আমাদের কর্ম্মচেষ্টা সার্থকতা লাভ করবে, কেননা বিচিত্র জনসঙ্ঘের মধ্যে শৃঙ্খলা স্থাপন করার আর প্রকৃষ্ট উপায় নেই।"
বিশ্বকবির নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির টেলিগ্রাম কলকাতায় প্রথম পান নগেন্দ্রনাথ। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ নভেম্বর সকাল ৭ টা ১০ মিনিটে তিনি কবিকে টেলিগ্রাম পাঠান :
Following cable received midnight Swedish Academy awarded you Nobel Prize literature please wire acceptation Swedish minister -nagen-
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নগেন্দ্রনাথের মতান্তর ও বিরোধ থাকলেও, কবি কিন্তু নগেন্দ্রনাথকে নিজের কর্মের সহযোগী করতে চেয়েছিলেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ তাকে যে ১৬৩ টি চিঠি লিখেছিলেন, সেগুলির মধ্যে বেশ কিছু চিঠিতে কবির জন্য নগেন্দ্রনাথের যথেষ্ট উদ্বেগ যেমন প্রকাশ পেয়েছে তেমনই অনেক চিঠিতে সময়ে-অসময়ে কবির অকৃত্রিম স্নেহ, আশা-ভরসা, প্রীতি, বিশ্বাস, নির্ভরতার বহু কথাও প্রকাশ পেয়েছে। মীরাকে লেখা চিঠিতেও কবি মীরাকেও অনেক সময়ে স্বামীর প্রতি অনুগত ও ভক্তিপরায়ণ হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন।[২]
১৯০৭ খ্রিস্টাব্দের ৬ জুন বিবাহের সময় থেকেই নগেন্দ্রনাথ ও মীরার বিবাহিত জীবন ধারাবাহিক মতবিরোধ ও অশান্তিতে কেটেছে। মীরার জীবনে সুখ ছিল না নগেন্দ্রনাথের স্বেচ্ছাচারিতা আর উদ্ধত ব্যবহারের কারণে। তার উপর কবির সঙ্গে মতান্তর ও মনান্তরের কারণে অবশ্যম্ভাবী পরিণাম নেমে আসে তার। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দ হতেই অত্যাচারের ফলে মীরা চলে আসেন পিতার আশ্রয়ে। শেষে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে আইন সম্মতভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। নগেন্দ্রনাথের বিচ্ছেদ ঘটে স্বদেশের সঙ্গে, স্থায়ী বাস হয় লন্ডনে। তাদের পুত্র নীতীন্দ্রনাথ (১৯১২-৩২) যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে একুশ বৎসর বয়সে মারা যায়। কন্যা নন্দিতার বিবাহ হয় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণ কৃপালনীর সঙ্গে। নগেন্দ্রনাথ ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১ ফেব্রুয়ারি পরলোক গমন করেন। মৃত্যুকালে লন্ডনে অবশ্য তার পাশে ছিলেন কন্যা নন্দিতা কৃপালনী।[২]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.