এসপ্ল্যানেড হল মধ্য কলকাতার একটি অঞ্চল। এটি আক্ষরিক অর্থে "এসপ্ল্যানেড" নয়; কারণ এই অঞ্চলটি কোনো জলাশয়ের ধারে অবস্থিত নয়। যদিও হুগলি নদী এই অঞ্চলের কিছু দূর দিয়েই প্রবাহিত হয়। এসপ্ল্যানেড শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এটি শহরের অন্যতম ব্যস্ত এলাকা।
এসপ্ল্যানেড | |
---|---|
কলকাতার অঞ্চল | |
স্থানাঙ্ক: ২৩.৮° উত্তর ৮৮.২৫° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
শহর | কলকাতা |
ওয়ার্ড |
|
নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন | এসপ্ল্যানেড |
উচ্চতা | ৩৬ ফুট (১১ মিটার) |
সময় অঞ্চল | ভারতীয় সময় (ইউটিসি+৫:৩০) |
পিন | ৭০০০৬৯ |
এলাকা কোড | +৯১ ৩৩ |
ইতিহাস
কলকাতার ময়দান অঞ্চলটি অতীতে ছিল জঙ্গল এলাকা। এই জঙ্গলের উত্তর অংশটিকে এসপ্ল্যানেড নাম দেওয়া হয়। পুরনো কলকাতার ধর্মতলা (অধুনা লেনিন সরণি) থেকে হুগলি নদীর তীরবর্তী চাঁদপাল ঘাট পর্যন্ত এসপ্ল্যানেড বিস্তৃত ছিল। ওয়ারেন হেস্টিংসের সময় এই অঞ্চলটি ব্রিটিশদের প্রমোদ ভ্রমণের জন্য প্রিয় রাস্তায় পরিণত হয়। ১৭৮০ সালে সোফিয়া গোল্ডবর্ন লিখেছেন, কলকাতার পাঁচটি প্রধান রাস্তা এই অঞ্চলটি ঘিরে ছিল।অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগের এসপ্ল্যানেডের ছবি এঁকেছেন ড্যানিয়েল ও উইলিয়াম বেইলি। পুরনো গভর্নমেন্ট হাউস ও কাউন্সিল হাউসকে প্রতিটি ছবিতেই দেখা যায়। ড্যানিয়েলের ছবিতে এখানে দর্শকদের ভিড়ের মধ্যে দুটি হাতির ছবিও দেখা যায়।[1] ১৮৬৭ সালে ব্রিটিশ ফটোগ্রাফার স্যামুয়েল বর্ন ও চার্লস শেফার্ডের স্থাপন করা ফটোগ্রাফি স্টুডিও বর্ন অ্যান্ড শেফার্ড এখনও আছে।
পলাশীর যুদ্ধের পর ব্রিটিশদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে ১৭৫৮ সালে এসপ্ল্যানেডের কাছেই ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয়। এরপর কলকাতায় ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর বসতি ছোটো অঞ্চল ছেড়ে ধীরে ধীরে ময়দানের আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।[2]
পার্শ্ববর্তী এলাকা
একাধিক রাস্তা এসপ্ল্যানেডের অঙ্গ। এগুলির মধ্যে কয়েকটি প্রধান রাস্তার বর্ণনা দেওয়া হল:
এসপ্ল্যানেড রো
এসপ্ল্যানেড রো নামক রাস্তাটির উল্লেখ ১৭৮৪ সালের মানচিত্রেও পাওয়া যায়। এটি ধর্মতলা থেকে চাঁদপাল ঘাট পর্যন্ত বিস্তারিত ছিল। রাস্তাটি রাজভবন ও কাউন্সিল হাউসের দক্ষিণ দিক দিয়ে গিয়েছে। এরই সঙ্গে গভর্নমেন্ট হাউসের বাগানটিকে এটি দুটি অংশে ভাগ করেছে - এসপ্ল্যানেড (ইস্ট) ও এসপ্ল্যানেড (ওয়েস্ট)।[1] এখন এসপ্ল্যানেড রো (ওয়েস্ট) গভর্নমেন্ট প্লেস (ওয়েস্ট) ও স্ট্র্যান্ড রোডের মাঝখানে কলকাতা হাইকোর্টের পাশ দিয়ে প্রসারিত। এসপ্ল্যানেড রো (ইস্ট) রাস্তাটির এখন নাম সিধু কানু ডহর। এটি ময়দানের উত্তর সীমা।[3]
অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয়দের বসতি এলাকার বিস্তারের ফলে এসপ্ল্যানেড রো নতুন চেহারা পেয়েছিল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি বাড়িগুলি এবং কিছু সুদৃশ্য বেসরকারি ভবন এসপ্ল্যানেডের উত্তরে দক্ষিণে ময়দানের দিকে মুখ করে গড়ে ওঠে। মিসেস ফে লিখেছেন, "এসপ্ল্যানেড রোকে মনে হয় প্রাসাদ দিয়ে গড়া।"[5]
ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট
ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিট রাস্তাটি এসপ্ল্যানেড রো (ইস্ট) বা সিধু কানু ডহরের সঙ্গে বিবাদীবাগ (আগেকার নাম ডালহৌসি স্কোয়ার) অঞ্চলকে যুক্ত করছে। এখন যেখানে সেন্ট জনস চার্চ, অতীতে সেইখানে ছিল ওল্ড কোর্ট হাউস। সেই থেকেই এই রাস্তাটির নামের উৎপত্তি। এই রাস্তার উত্তর দিকে বিবাদীবাগ (পূর্ব)। ১৭৮১ সাল নাগাদ এই রাস্তাটি তৈরি হয়। এর শেষ প্রান্তটি নবগঠিত ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়ে শেষ হত। কর্নেল হেনরি ওয়াটসন কলকাতার অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে সঙ্গে এসপ্ল্যানেড অঞ্চলেরও অনেক উন্নতি বিধান করেছিলেন। এই রাস্তাটির সম্প্রসারিত অংশের নাম রেড রোড।[1] ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রিটের যে অংশটি গণেশ অ্যাভিনিউ বা বিবাদীবাগের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ওয়াটারলু স্ট্রিট পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছে, তার নতুন নামকরণ করা হয়েছে হেমন্ত বসু সরণি। ওয়াটারলু স্ট্রিটের মোড় থেকে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউ-এর মোড় পর্যন্ত প্রসারিত অংশটির নতুন নাম হয়েছে মার্ক্স-এঞ্জেলস বিথী।[6]
কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট
কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট রাস্তাটি বিবাদীবাগের পশ্চিম অংশকে এসপ্ল্যানেড রো-র সঙ্গে যুক্ত করেছেন। গভর্নমেন্ট হাউসের পশ্চিম অংশে ছিল পুরনো কাউন্সিল হাউসটি। সেই থেকেই এই রাস্তাটির নামের উৎপত্তি। কাউন্সিল হাউসটি বন্ধ হয়ে যায় ১৮০০ সালে। এই রাস্তার দক্ষিণ অংশটির নাম গভর্নমেন্ট প্লেস ওয়েস্ট।[1] কাউন্সিল হাউস স্ট্রিটেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ অবস্থিত ছিল।[7]
ডেকার্স লেন
এসপ্ল্যানেড রো (ইস্ট) ও ওয়াটারলু স্ট্রিটের মাঝে ছোটো গলিটির নাম ডেকার্স লেন। এটি অতীতে ছিল অভিজাত এলাকা। এই রাস্তার নামকরণ হয়েছে ১৭৭৩ সালে কলকাতার কালেক্টর ও পরবর্তীকালে কাউন্সিল সদস্য ফিলিপ মিলনার ডেকার্সের নামানুসারে।[1] বর্তমানে এই রাস্তাটির নাম জেমস হিকি সরণি। এখানে অনেক খাবারের দোকান থাকার জন্য রাস্তাটি লোকমুখে টিফিন গলি নামেও পরিচিত।
টিপু সুলতান মসজিদ
এসপ্ল্যানেড রো (ইস্ট) ঈ ধর্মতলা স্ট্রিটের সংযোগস্থলে টিপু সুলতান মসজিদ অবস্থিত। এটি টিপু সুলতানের অষ্টম পুত্র গোলাম মহম্মদের স্থাপন করা একটি মসজিদ।[8] কলকাতা পৌরসংস্থা এই মসজিদটিকে একটি ঐতিহ্যবাহী ভবন ঘোষণা করেছে।[4]
গ্যালারি
- চৌরঙ্গী স্কোয়ার
- মেট্রোপলিটান বিল্ডিং
- ভিক্টোরিয়া হাউস
ফুটবল খেলা
১৮৫৮ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এসপ্ল্যানেডে যে ফুটবল খেলাটি হয়েছিল সেটাই কলকাতার প্রথম নথিভুক্ত ফুটবল ম্যাচ। খেলা হয় ক্যালকাটা ক্লাব অফ সিভিলিয়ানস ও জেন্টলমেন অফ ব্যারাকপুর দলদুটির মধ্যে। তবে এর আগেই এখানে ফুটবল খেলা হয়েছিল, যেগুলির কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় না।[9] এই অঞ্চলে রাস্তাঘাট তৈরি হওয়ার পর এখানে খেলাধুলা কমে যায়। খেলাধুলার জন্য ময়দানের ব্যবহার শুরু হয়।
পরিবহন
এসপ্ল্যানেড একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন কেন্দ্র। ১৯০২ সালে প্রথম ইলেকট্রিক ট্রাম এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর অবধি চলেছিল। ১৯৮৪ সালে প্রথম মেট্রো রেল চলেছিল এসপ্ল্যানেড থেকে টালিগঞ্জ অবধি। বর্তমানে এসপ্ল্যানেড একটি ব্যস্ত ট্রাম টার্মিনাস ও ব্যস্ত মেট্রো স্টেশন।
২০০২ সালের হিসেব অনুযায়ী, ব্যস্ত সময়ে ২০০,০০০ থেকে ৩০০,০০০ যানবাহন এসপ্ল্যানেডের পাশ দিয়ে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, কলকাতার ৫০-৬০ % বায়ুদূষণ হয় যানবাহনের ধোঁয়া থেকে। যানবাহনের সংখ্যাবৃদ্ধির ফলে দূষণ বৃদ্ধি পায়।[10] গড় মানুষের কানে শব্দের সহ্যমাত্রা হল ৬০-৬৫ ডেসিবেল। বসতি এলাকায় এই মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল ও শিল্প এলাকায় সর্বাধিক ৮৫ ডেসিবেল হওয়া কাম্য। এসপ্ল্যানেড এলাকায় শব্দের মাত্রা ৭৫-৮৪ ডেসিবেল।[11]
কলকাতা মেট্রোর প্রস্তাবিত দ্বিতীয় লাইনটি এসপ্ল্যানেড অবধি প্রসারিত হবে না। এটি সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশনেই প্রথম লাইনের সঙ্গে মিলিত হবে।[12]
রাজ্য সরকার এসপ্ল্যানেড অঞ্চলের ট্রাফিক সমস্যার সমাধানকল্পে পার্ক স্ট্রিট ফ্লাইওভারের দুটি উত্তরমুখী ফ্ল্যাঙ্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই ফ্ল্যাঙ্ক দুটির একটি চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ ও অন্যটি বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে অবতরণ করবে।[13]
রাজনৈতিক সমাবেশ
১৯৫৭ সালের পর থেকে কলকাতায় বামফ্রন্ট তথা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকে। এই সময় বিভিন্ন বামপন্থী দল সরকার-বিরোধী অবস্থান ও বিক্ষোভের জন্য এসপ্ল্যানেড অঞ্চলটিকে বেছে নিতে শুরু করে। এসপ্ল্যানেড ইস্ট, শহীদ মিনার ময়দান ও ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সভাসমিতি আয়োজিত হতে থাকে। এই অঞ্চলে পুলিশ ও বিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক দলগুলির সমর্থকদের মধ্যে অনেক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।[14]
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীনও বাম ও দক্ষিণপন্থী দলগুলি এই অঞ্চলে অনেক সমাবেশের আয়োজন করেছিল।[15][16] শাসক দলগুলি এখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ও নীতির বিরুদ্ধে সভাসমিতির ডাক দিয়েছে।[17]
ধর্মীয় উৎসব
রাজনৈতিক সমাবেশ ছাড়াও মহরম, ঈদ প্রভৃতি ইসলামি ধর্মীয় উৎসবে এই অঞ্চলে বহু মানুষ নামাজ পড়তে আসেন। সেই সময় এই অংশের যানবাহন নিয়ন্ত্রিত রাখা হয়।[18] রথযাত্রা, দুর্গাপূজা সহ অন্যান্য পূজার বিসর্জন শোভাযাত্রাও এসপ্ল্যানেডের পাশ দিয়ে যায়। [19]
মূর্তি
এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে অনেক মূর্তি আছে। তার কয়েকটির ছবি দেওয়া হল।
- লেনিন-মূর্তি, এসপ্ল্যানেড ও লেনিন সরণির মোড়ের কাছে
- হরিরাম গোয়েঙ্কা
- সরোজ দত্ত
পাদটীকা
আরও দেখুন
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.