উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
তিরুপ্পবাই (তামিল: திருப்பாவை, রোমান: Tiruppāvai) হলো তামিল হিন্দু নারী কবি-সাধিকা অন্ডাল রচিত স্তবগানের একটি সংকলন[১]
তিরুপ্পবাই | |
---|---|
তথ্য | |
ধর্ম | হিন্দুধর্ম |
রচয়িতা | অন্ডাল |
ভাষা | তামিল |
যুগ | খ্রিস্টাব্দ ৯ম-১০ম শতাব্দী |
শ্লোক | ৩০ |
তিরুপ্পবাই ত্রিশটি স্তবক নিয়ে গঠিত পেরুমলের স্তবগান। একে পশুরামও বলা হয় [২] এটি নালায়রা দিব্য প্রবন্ধমের একটি অংশ। দিব্য প্রবন্ধ আলবর নামে বিখ্যাত দ্বাদশ কবি-সাধুর রচনা সংগ্রহ, যা তামিল সাহিত্যের ভক্তিমূলক ধারার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তিরুপ্পবাই তেলুগুতে অনুবাদ করেছেন মুল্লাপুদি ভেঙ্কটরমনা। তেলুগুতে এর নাম মেলুপালুকুলা মেলুকোলুপু । [৩] এই স্তবগানে অন্ডাল সমস্ত মানুষকে বিষ্ণুর নাম ও মাহাত্ম্য পাঠ করার আহ্বান জানান। [৪]
তিরুপ্পবাই পাভাই ধারার গানের অন্তর্গত। এই ধারাটি অবিবাহিত মেয়েদের মারগাহি মাস জুড়ে তাদের কর্ম সম্পাদনের একটি ব্রত পালনের তামিল ঐতিহ্যের পরিচায়ক। [৫] মার্গাইয় মাসের এই ব্রতটির বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে: এই মাসের প্রতিটি দিনের নাম ত্রিশটি শ্লোক থেকে পাওয়া যায়। সঙ্গম যুগের শেষের দিকের তামিল প্রথম শ্রেণীর সংকলনে এই ব্রতের উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে পারিপাতাল বলা হয়। [৬]
অন্ডালের ত্রিশটি গানে মারগায় মাসে বৈষ্ণব ধর্মের মূল নীতির পরিচয় পাওয়া যায়। অন্ডাল গোপী ভাবে ভাবিত হয়ে এই ত্রিশটি পদ রচনা করেছিলেন। অন্ডাল বিষ্ণুকে বিবাহ করে তার চিরস্থায়ী সঙ্গ লাভের উদ্দেশ্যে একটি বিশেষ ধর্মীয় ব্রত পালন করার জন্য অভিপ্রায় প্রকাশ করেছিলেন, তিনি তার সখীদের বিষ্ণুর সেবা করার জন্য তার সাথে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান। [৭]
ধর্মীয় স্তোত্র অনুসারে অন্ডালের তার সখীদের জেগে তোলা ও কৃষ্ণকে অন্বেষণ অনুরোধের পশ্চাতে প্রতীকী অন্তর্নিহিত বৈশিষ্ট্যসমূহ বৈষ্ণব ঐতিহ্যের তিনটি মৌলিক মন্ত্রের সারমর্মকে সমন্বিত করে,তা হলো - তিরুমন্ত্রম্, দ্বয়ম এবং চরম শ্লোক। এই মন্ত্র পরম সত্যকে নির্দেশিত করে। পরম সত্তা সব কিছুর মাঝেই বিরাজ করেন। ২৭ তম পশুরমে একটি প্রচ্ছন্ন অর্থ রয়েছে, উদাহরণস্বরূপ, অন্ডাল একজন আচার্যের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করেছেন, কারণ তার নির্দেশনা একজন শিষ্যকে এই ত্রয়ী মন্ত্রগুলি হৃদয়ঙ্গম করতে সাহায্য করে।
তিরুপ্পবাই কে 'বেদম আনাইথুক্কুম ভিথাগুম' বলা হয় যার অর্থ 'এটি বেদের বীজ'।[৮] সকল বৃক্ষ ও তা থেকে উৎপন্ন বৃক্ষসমূহ যেমন সূক্ষ্ম বীজের মধ্যে লুকিয়ে আছে, তেমনি বেদের সমগ্র সারাংশ লুকিয়ে আছে তিরুপ্পবাই-এর স্তবগানে যা কেবলমাত্র একজনে আচার্যের নির্দেশে শিষ্যের হৃদয়ে প্রকাশিত হতে পারে। আচার্য বা গুরু তাকেই বলা হয় যিনি বৈদিক শাস্ত্রে পারদর্শী।
এই সম্পূর্ণ প্রচ্ছন্ন সারাংশটি পদ্যাকারে অন্ডালের শ্লোকগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথম পাঁচটি স্তবকে স্তবগানের মূলভাব, এর নীতি ও উদ্দেশ্যের একটি ভূমিকা প্রদান করা হয়েছে। অন্ডালের মতে, এই ঋতুতে বিলাসিতা ত্যাগ করা উচিত। ঈশ্বরের কাছে আন্তরিক প্রার্থনা প্রচুর বৃষ্টি ও সমৃদ্ধি আনয়ন করবে। কৃষ্ণকে নবীন পুষ্প অর্পণ করলে পূর্বে কৃত পাপ ও ভবিষ্যতে যে পাপ হতে পারে তার মোচন হয়ে যাবে।
পরবর্তী দশটি স্তবকে তিনি সংঘবদ্ধ অংশগ্রহণের গুরুত্ব বর্ণনা করেছেন। তিনি তার সখীদের পুষ্প চয়নের আমন্ত্রণ জানান ও গ্রাম্য পরিবেশ, পাখির কলরব, রঙিন ফুল, দধি-মন্থনের সুরেলা শব্দ, ঘণ্টাধ্বনি সহ গবাদি পশুর পাল ও মন্দিরের শঙ্খের শব্দ নিরীক্ষণ করেন ।
তিনি প্রতিটি গৃহ পরিদর্শন করেন এবং তার সমস্ত সখীদের একটি পুকুরে স্নানের জন্য তার সাথে যোগ দিতে জাগ্রত করে তোলেন। তিনি বিষ্ণুর অবতারদেরও প্রশংসা করেন। পরবর্তী পাঁচটি স্তবক তার সখীদের সাথে মন্দিরে যাওয়ার বর্ণনা দেয়। তিনি দেবতাকে জাগানোর জন্য সুপ্রভাথম নিবেদন করতে চান। রমণী দলটি মন্দিররক্ষকদের অনুমতি নিয়ে মন্দিরে প্রবেশ করে, কৃষ্ণের পিতামাতার প্রশংসা করে ও কৃষ্ণ ও বলরামকে জাগানোর জন্য প্রার্থনা করে। তারপর তারা দেবতার সহধর্মিণী নীলাদেবীর নিকট গমন করে৷ [৯]
শেষ নয়টি স্তবক দেবতার মহিমার বর্ণনা দেয়। তার আশীর্বাদ পেয়ে অন্ডাল তার ঈপ্সিত বস্তুর তালিকা করেন,যেমন; 'ব্রতের' জন্য দুধ, শ্বেত শঙ্খ, প্রদীপ, পুষ্প, সমৃদ্ধ আভরণ ও অলঙ্কার, প্রচুর ঘৃত ও ননী। সমাপ্তিসূচক স্তবকটি তাকে বিষ্ণুচিত্তরের (পেরিয়ালবর) কন্যা হিসাবে চিহ্নিত করে যিনি ৩০ টি পশুরমের এই মাল্য তৈরি করেছিলেন। তিনি বলেছেন যারা ভক্তি সহকারে এই পশুরম পাঠ করবেন তারা কৃষ্ণের কৃপা প্রাপ্ত হবেন। [১০]
তিরুপ্পবাইতে তিনটি তানিয়ান (আক্ষরিক অর্থে, 'একক' বা স্বতন্ত্র পদ) অন্তর্ভুক্ত রয়েছে যা পরবর্তী লেখকদের দ্বারা পুরানো পুঁথিগুলি প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়েছে। সংস্কৃতে প্রথম তানিয়ান নীলা তুঙ্গস্তানা... রচনা করেছিলেন পরাশর ভট্ট। পরের দুটি তানিয়ান ', 'আন্না ভয়াল পুধুভাই...' এবং চুডি কদুথা...' (নিম্নে অনুবাদিত) শ্রী উয়্যাকোন্ডার রচিত।
তানিয়ান এর [১১] এই গানটি তিরুপ্পাবাইয়ের একটি ভূমিকা। এটি তিনটি তানিয়ানের মধ্যে একটি।
রাজহংস থেকে অন্ডাল পদুবাই পূর্ণ করেছেন,
তিনি তার মিষ্টি কন্ঠে গান গেয়েছেন,
বেশ কিছু মুগ্ধকর মিষ্টি পদ প্রভুর উদ্দেশ্যে,
পাভাইয়ের পূজা ও শ্রদ্ধা করার জন্য।
গীতগুলি তার কাছে মালার মতো,
তার কাছ থেকে তিনি প্রথমে এগুলি পরেছিলেন,
তাদের তাঁর কাছে নিবেদন করার আগে।
তিরুপ্পাবাই-এর প্রতিটি পশুরমের নামকরণ (পেরুমলের প্রতি) সাধারণত স্তোত্রটির প্রথম কয়েকটি শব্দ দ্বারা করা হয়েছে। শিরোনামগুলো প্রথমে দেওয়া হয়েছে ও তারপর দেওয়া হয়েছে পদগুলোর অনুবাদ:-
স্তোত্রের নাম | অনুবাদ |
---|---|
১।'মার্গাই টিংগাল | এই মারগাই(অগ্রহায়ণ) মাসে
পূর্ণিমার শুভ দিনে, |
২। ভাইয়াথু ভার্গাল' ' |
ওহে এই পৃথিবীর মানুষ, সেই তপস্যার কথা শুনে খুশি হও, |
৩।'ওঙ্গি উলাগালান্ধা | আমরা তাঁর গুণগান গান করি, তিনি বৃহৎ আকার ধারণ করে বিস্তৃত পৃথিবীকে পরিমাপ করেছেন, |
৪।'আহি মাই কান্না | দয়া করে আমাদের ইচ্ছা পূর্ণ করুন, হে বর্ষানাথ, আপনি সমুদ্র থেকে এসেছেন, |
৫।'ময়নাই মান্নু | সকল যাদু রয়েছে তাঁর কাছে, তিনি লীলাদেব, উত্তরের মথুরা কিশোর, |
'৬। পুলুম চিলাম্বিনা | তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না পক্ষী উচ্চ শব্দে কলরব করছে, তুমি কি শুনতে পাওনি মন্দিরে শ্বেত শঙ্খ নাদ করছে |
৭। কিসু কিসু | তুমি কি শুনতে পাওনি ওহে ধীর বুদ্ধি বালিকা, ভোরের ভরদ্বাজ 'অল্লিয়ন' পক্ষীর চঞ্চুর শব্দ, |
৮। কিহ বনম | পূর্ব আকাশ শ্বেত হয়ে গেছে, সর্বত্র ধেনু ও মহিষগুলি স্বাধীনভাবে বিচরণ করছে, |
৯। তুমানি মাদাথু' | ওহে আমার মামার মেয়ে, তুমি ঘুমাচ্ছো, নরম তুলোর বিছানায়, |
১০। নত্রু স্বর্গম | ওহে সজনী, কে স্বর্গে প্রবেশ করেছে, গত জন্মে করা তপস্যার কারণে, |
১১। কাতরু কারাভাই | শত্রুবিদারক গোপগণ, ধেনু দোহন করে, |
১২। কানাইথিলাম কাটেররুমাই | আরে প্রগতিশীল গোপের ভগিনী, বাছুড়ের স্নেহের বশে ধেনু বৎস স্মরণ |
১৩। পুলিন বাই কিন্দানাই | সে বকাসুর" পক্ষীর বৃহৎ চঞ্চু ভেঙে ফেলেছে, |
১৪। উঙ্গাল পুইক্কাদাই | তোমার গৃহের অঙ্গনে পুকুরে লাল পদ্ম খেলা করছে, |
১৫। এলে ইলাম কিলিয়ে | দুই দলের সংবাদঃ
"আরে, ছোট্ট পাখি, তুমি কি এখনো ঘুমাচ্ছো?" |
১৫। নয়াগানাই নিরা | আমাদের রক্ষক নন্দগোপ রায়ের মন্দিরের |
১৭। আম্বারামে তন্নিরে | সকলের বস্ত্র,জল,ভোজনদাতা জননায়ক নন্দগোপ, |
১৮। উন্ধু মাধ কালীত্রান | নন্দ গোপের বেশ কয়েকটি হাতি আছে, এবং তিনি একজন মহান বীর যিনি কখনও তার শত্রুদের কাছ থেকে পালিয়ে যাননি, |
১৯। কুট্টু ভিলাকেরিয়া | তৈল প্রদীপের আলোয়, শোভাময় চতুষ্পদ হাতির দাঁতের খাটের উপর, |
২০। মুপ্পাতু মুভার |
তেত্রিশ "কোটি" দেবতার জাতি ভয় দূরকারী আপনি, |
২১। ইট্রা কালাঙ্গাল | ওই তার পুত্র,
যিনি বেশ কিছু গাভীর অধিপতি ছিলেন, |
২২। অঙ্গন মা জানালাথু | সকল বিখ্যাত রাজাদের মত বিস্তৃত বিশ্বের তিনিই একমাত্র সুন্দর, |
২৩। মারি মালাই মুইনজিল | এই পদে রয়েছে লক্ষ্মী-নৃসিংহের বন্দনাঃ বর্ষা কাল, পর্বত গুহায় তিনি |
২৪। আনরু ইভভুলাগাম | আমরা তোমার চরণকে পূজা করি যা তখন পৃথিবী পরিমাপ করেছিল, আমরা দক্ষিণ লঙ্কার রাজাকে জয়ের কারণ আপনার যশের পূজা করি, |
২৫। ওরুতি মাগানাই পিরান্দু | এক নারীর নিকট জন্ম নিয়ে, এবং একই রাতে আত্মগোপন করে |
২৬। পুরুষ ! মানিভান্না | ওহে বিষ্ণু, হে প্রভু নীলকান্তমণি, |
২৭। কুদারাই ভেলুম | হে গোবিন্দ, যিনি শত্রুর প্রতি বিজয়ের জন্য পরিচিত, |
২৮। কারাভাইগাল পিন চেন্দ্রু | গোগণের পশ্চাদবর্তী কাননে, আমরা ভোজন করি |
২৯। চিত্রম চিরু কালে | কৃপা করে শুনুন, এই খুব ভোরে, |
৩০। বঙ্গ কদল কদাইন্থ | যে ভ্রান্তি ছাড়াই গান করে, মিষ্টি তামিল ভাষায় তিরিশটি স্তব, |
থাইল্যান্ডের দৈত্যাকার দোলনা ত্রিয়ম্পাবাই-ত্রিপাভাই নামে পরিচিত এক বার্ষিক অনুষ্ঠান প্রধান শহরগুলিতে ১৯৩৫ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছিল, পরে নিরাপত্তার কারণে এটি বাতিল হয়ে যায়। অনুষ্ঠানের নাম দুটি তামিল হিন্দু মন্ত্র: তিরুবেম্পাবাই (মানিক্কাবাকার এর একটি শৈব স্তোত্র) ও তিরুপ্পবাই থেকে নেওয়া হয়েছে। জানা যায় যে তিরুবেম্পাবাই - কবি প্রতু শিবালাই ("শিবের প্রাসাদের মুক্তদ্বার") - এর তামিল শ্লোকগুলি এই অনুষ্ঠানে পাঠ করা হতো, পাশাপাশি থাই রাজার অনুষ্ঠানেও পাঠ করা হতো। [১২] টি.পির মতে, মীনাক্ষীসুন্দরম উৎসবের নামটিও বোধহয় তিরুপ্পাবাই পাঠের সূত্র থেকে এসেছে। [১৩]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.