Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
টুসু সত্যাগ্রহ ভারতের বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বৃহৎ মানভূম অঞ্চলের জনগণ নিজেদের সাংস্কৃতিক অভিজাত্যকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে রাস্তায় নামে। তারা প্রতিবাদী ভঙ্গিতে টুসু গান গেয়ে আন্দোলন শুরু করে। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটা দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন।
১৯১২ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ভাষার উপর হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রতিবাদে মানভূম অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ সালের মধ্যে এই আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। তৎকালীন সময়ে জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে বাংলাভাষী জনগণ হিন্দি ভাষার বিরুদ্ধে আন্দোলন করার চেষ্টা করলেও তাদের দাবি প্রতিষ্ঠিত হয় না। জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের নাগপুর অধিবেশনে ভাষাভিত্তিক প্রদেশ পুনর্গঠনের দাবী আনুষ্ঠানিক ভাবে গৃহীত হলেও ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বিহারে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীত্ব লাভ করার পর ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের সভাপতিত্বে 'মানভূম বিহারী সমিতি' নামক এক সংগঠন গড়ে ওঠে।[1] এর বিপরীতে মানভূম জেলার বাঙালিরা ব্যারিস্টার পি আর দাসের সভাপতিত্বে 'মানভূম সমিতি' নামক সংগঠন তৈরী করেন এবং পাকবিড়রায় জাতীয় কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন ভজহরি মাহাতো, অতুলচন্দ্র ঘোষ, অন্নদাপ্রসাদ চক্রবর্তী, লাবণ্যপ্রভা ঘোষ, অরুণচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সহ ৩৭ জন কংগ্রেস সমর্থক এবং লোকসেবক সঙ্ঘ গঠন করেন।[2] ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের৩০ এপ্রিল বান্দোয়ানের জিতান গ্রামে মানভূম জেলা কংগ্রসের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে দীর্ঘ আলোচনার ‘মানভূম বাংলা ভাষাভাষী’ এই দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।[3][4]
বাংলা ভাষার দাবিতে লোকসেবক সঙ্ঘের নেতৃত্বে সত্যাগ্রহ শুরু হলে সত্যাগ্রহীদের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নেমে আসে। ঝালদা, পুরুলিয়া ও সাঁতুরির জনসভায় পুলিশ লাঠিচার্জ করলে ও মহিলানেত্রীদের উপর অকথ্য নির্যাতন করলে সাধারণ জনগণ ক্ষোপে ফেটে পরে। তারা মানভূমের নিজস্ব গান, টুসু গানকে কেন্দ্র করে টুসু সত্যাগ্রহ শুরু করে। টুসু সত্যাগ্রহ তিনটি পর্যায়ে সংঘটিত হয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৯ - ১৯ জানুয়ারী প্রথম পর্যায়, ২০ - ২৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় পর্যায় এবং ২৭ জানুয়ারী থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তৃতীয় পর্যায়ে টুসু সত্যাগ্রহ চলেছিল। এরপরেও পুরুলিয়ার বঙ্গ অন্তর্ভুক্তির আগে পর্যন্ত এই সত্যাগ্রহের প্রভাব বর্তমান ছিল।[5] সেই সময় ভজহরি মাহাতো সহ অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের লেখা টুসু গানে মানভূম বইটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।[3] টুসু গানকে ঘিরে নতুনভাবে আন্দোলনে প্রাণ আসে। ফলে বিহার সরকার টুসু গানের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং টুসু গান গাওয়ার জন্য অনেককে কারারুদ্ধ করে। ১৯৫৪ সালের ৯ জানুয়ারি রঘুনাথপুরে হেমচন্দ্র মাহাতোর নেতৃত্বে লোকসেবক সঙ্ঘের সদস্যরা শহর পরিক্রমা শুরু করে। বিহার সরকার নিরাপত্তা আইনের নামে তাদের গান গাওয়া বন্ধ করে এবং ৮ জনকে প্রেপ্তার করে।[6] পরবর্তীতে ৫ হাজার টাকার জামিনে তাদের মুক্তু দেওয়া হয়। রঘুনাথপুরে তাদের অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১০ জানুয়ারি অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বাধীনে ১১ জন বিকেলবেলা টুসু গান গাইতে গাইতে প্রতিবাদ করে। তাদের কেউ গ্রেপ্তার করা হয় এবং মাথাপিছু ৩ হাজার টাকার জামিনে তাদের মুক্তি দেওয়া হয়।[7] এই ঘটনায় জেলার মানুষ বিহার সরকারের প্রতি ধিক্কার জানাতে শুরু করে। এরপর ১২ জানুয়ারি অতুলচন্দ্র ঘোষ সরকারি বাধা উপেক্ষা করে টুসু গানে জেলাকে মুখরিত করার নির্দেশ দেন। তারপর থেকে মানভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে টুসু সত্যাগ্রহ ছড়িয়ে পরে।[8] বিহার সরকার নিরাপত্তা আইনের অজুহাতে জেলাবাসীর স্বাধীনতা বিন্সত করার জন্য মামলা শুরু করলে সত্যাগ্রহীরা স্বেচ্ছায় কারাবরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২২ জানুয়ারি লাবণ্যপ্রভা দেবী ও ভজহরি মাহাতো এবং ২৫ জানুয়ারি সমরেন্দ্রনাথ ওঝা, কুশধ্বজ মাহাতো, কালীরাম মাহাতো ও ভাবিনী দেবী স্বেচ্ছায় কারাববরণ করেন। টুসু সত্যাগ্রহের আগামী পদক্ষেপ বুলেটিন প্রকাশের মাধ্যমে জানানো হত। সপ্তম বুলেটিনে বলা হয় সাধারণত অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে শ্রীপঞ্চমী পর্যন্ত টুসু গান গাওয়া হয়। তাই টুসু গান উদযাপনের কার্যকাল শ্রীপঞ্চমী বলে তারা শ্রীপঞ্চমী পর্যন্ত সত্যাগ্রহের সময়কাল ধার্য করেন। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি টুসু সত্যাগ্রহ শেষ হলে বিহার সরকার তাদের উপর অত্যাচার আরও তীব্র করে।[6]
বিহার সরকার যে জোর করে বাঙালিদের তথা মানভূমবাসীদের উপর হিন্দি চাপিয়ে দিয়েছিল, মধুসূদন মাহাতোর প্রতিবাদীকণ্ঠে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে[7]-
মন মানে না রে হিন্দি সইতে।
ভাষা মোদের হরে নিল হিন্দীতে।।
মাতৃভাষা হরে যদি
আর কি মোদের থাকে রে।
(তাই) মধু বলে মাতৃভাষারধ্বজা হবে বহিতে।।
— মধুসূদন মাহাতো (বাঁশবুরু)
বিহারের অত্যাচারী সরকারের বিরুদ্ধে ভজহরি মাহাতোর প্রতিবাদী গান-
শুন বিহারী ভাই
তোরা রাখতে নারবি ডাঙ্গ দেখাই।
(তোরা) আপন স্বার্থে ভেদ বাড়ালি
বাংলা ভাষায় দিলি ছাই।
ভাইকে ভুলে করলি বড়
বাংলা-বিহার বুদ্ধিটাই।।
বাঙালী বিহারী সবাই
এক ভাষাতে আপন ভাই।
বাঙালীকে মারলি তবু
বিষ ছড়ালি হিন্দী চাই।।
বাংলা ভাষার দাবীতে ভাই
কোন ভেদের কথা নাই।
এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়েমাতৃভাষার রাজ্য চাই।।
— ভজহরি মাহাতো
অরুণচন্দ্র ঘোষ তার গানের মাধ্যমে বিহারের হিন্দিভাষী কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দের ঘৃণ্য রাজনীতির কথা প্রতিবাদী ভাষায় টুসু সঙ্গীতের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন[6]
আমার বাংলা ভাষা প্রাণের ভাষা রে।
(ও ভাই) মারবি তোরা কে তারে।।
বাংলা ভাষা রে।।
এই ভাষাতে কাজ চলছে
সাত পুরুষের আমলে।
এই ভাষাতেই মায়ের কোলে
মুখ ফুটেছে মা বলে।।
এই ভাষাতেই পরচা রেকর্ড
এই ভাষাতেই চেক কাটা
এই ভাষাতেই দলিল নথি
সাত পুরুষের হক পাটা।।
দেশের মানুস ছাড়িস যদি
ভাষার চির অধিকার।
দেশের শাসন অচল হবেঘটবে দেশে অনাচার।।
— অরুণ চন্দ্র ঘোষ
বিহারের কংগ্রেসরা বাঙালিদের বিরুদ্ধে যে ষড়যন্ত্র করেছিল তারই ক্ষোভ ও অভিমান জগবন্ধুর গানে পাওয়া যায়[7]-
প্রাণে আর সহে না
হিন্দি কংগ্রেসীদের ছলনা।
ইংরেজ আমলে যারা গো
করতো মোসাবিয়ানা
এখন তার হিন্দি-কংগ্রেসিমানভূমে দেয় যাতনা।
— জগবন্ধু
বিহার সরকার টুসু সত্যাগ্রহ দমনের জন্য ১৯৫৪ সালের ফেব্রুয়ারি – মার্চ মাসে তথাকথিত নিরাপত্তা আইনে পাঁচটি টুসু দলের ৪০ জন সত্যাগ্রহী এবং লোকসেবক সঙ্ঘের অতুলচন্দ্র ঘোষ, তার স্ত্রী লাবণ্য প্রভা ঘোষ, লোকসভার সদস্য ভজহরি মাহাতো, সাংবাদিক অশোক চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ বান্দোয়নের মধুপুর গ্রামে অবস্থিত লোকসেবক সঙ্ঘের অফিস ভাঙচুর করে পুলিশ প্রায় ২২৫০ কপি টুসু গানে মানভূম বই বাজেয়াপ্ত করে।[5] ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের ২১ মার্চ হবিবুল্লা নামক এক সাব-ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট সশস্ত্র পুলিশ নিয়োগ করে মানবাজার থানার পিটিদারি গ্রামে টুসু সত্যাগ্রহীদের কাছ থেকে জরিমানা আদায়ের অজুহাতে তাদের বাড়ি ভাঙচুর, সম্পত্তি লুট[9] এবং মহিলাদের উপর অকথ্য-অশালীন অত্যাচার করে।[7] এইসময় পুলিশি অত্যাচারের সঙ্গে সঙ্গে বিহার সরকার মানভূমের জনসাধারণকে প্রলোভনস্বরূপ হিন্দিভাষা প্রচার ও প্রসারের নামে ৩০ লক্ষ টাকা অনুদান মঞ্জুর করেছিল। ৯ জুলাই বিহার কংগ্রেসের নেতা বিনোদানন্দ ঝায়ের নেতৃত্বে পুরুলিয়ার বন্দোয়ানে বন্দোয়ান-কল্যাণ সমিতি সভায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে প্রচার চালানো হয় যে– ‘‘মানভূম বঙ্গাল মে নহী জায়েঙ্গে, জানে পর খুন কে নদী বহা দোঙ্গে।’’ মানবাজারেও হিন্দিতে প্রচার করা হয়– ‘‘মানবাজারবাসী বোল রহা বিহার মে রহেঙ্গে’’ এবং সর্বত্র প্রচার করা হয়– ‘‘মানভূম কা জনতা বোলতা হামরা বিহার মে রহেঙ্গে।’’[7]
তত্পরবর্তীকালে পুরুলিয়া উকিল বার-অ্যাসোসিয়েশন, মানভূম জেলা বাঙালি সমিতি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান পঞ্চাশ পাতার এক স্মারকলিপি রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাশে পেশ করে। তাতে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ থেকে কীভাবে মানভূমকে বিহারের সঙ্গে যুক্ত করে নতুন প্রদেশ গঠনের চেষ্টা করা হচ্ছে, কীভাবে মানভূমবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাতৃভাষার বদলে হিন্দি ভাষা তাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। এছাড়াও মানভূম ও ধলভূমের বাংলা ভাষার সঙ্গে সম্পর্ক – এই সকল বিষয়েও বলা হয়।[10] বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘মুক্তি (পত্রিকা)’ আন্দোলন ও বিহার সরকারের অত্যাচার সম্পর্কে নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতে থাকে।[11] বিহার সরকার পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তির বিরুদ্ধে জনমত সমর্থনের চেষ্টায় বিশেষ প্রভাব খাটিয়ে হরতাল ডাকে, যদিও তারা জনমত সমর্থন আদায়ে অসমর্থ হয়। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল অতুলচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে টুসু গান ও 'বাংলার মাটি বাংলার জল' গানকে পাশে নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে পদযাত্রা শুরু হয়।[5] দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১ নভেম্বর পুরুলিয়ার বঙ্গভুক্তি ঘটে।[12]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.