Loading AI tools
মনসামঙ্গল কাব্যে বর্ণিত ব্যক্তি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
চন্দ্রধর বনিক,চাঁদ বেনে বা চাঁদ সওদাগর মনসামঙ্গল কাব্যধারার একটি কিংবদন্তি চরিত্র। তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের চম্পক নগরের একজন ধনী ও ক্ষমতাশালী বণিক।[1] বিপ্রদাস পিপলাই তার মনসামঙ্গল কাব্যে উল্লেখ করেছেন যে, চন্দ্রধর বণিক বাণিজ্যতরী সপ্তগ্রাম ও গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত ত্রিবেণী হয়ে সমুদ্রের পথে যাত্রা করত।[2] চন্দ্রধর বণিকের উপাখ্যানের সঙ্গে পৌরাণিক নাগদেবী মনসার পূজার প্রচারের লৌকিক গল্প কাহিনিটি জড়িত করা হয়েছিল।[1]
হিন্দু লোককথা অনুযায়ী, চাঁদ সদাগর ছিলেন শিবের ভক্ত। মনসা চাঁদের পূজা কামনা করলে শিবভক্ত চাঁদ তাকে প্রত্যাখ্যান করেন। মনসা ছলনার আশ্রয় নিয়ে চাঁদের পূজা আদায় করার চেষ্টা করলে, চাঁদ শিবপ্রদত্ত ‘মহাজ্ঞান’ মন্ত্রবলে মনসার সব ছলনা ব্যর্থ করে দেন। তখন মনসা সুন্দরী নারীর ছদ্মবেশে চাঁদের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তার গুপ্তরহস্য জেনে নেন। এর ফলে চাঁদ মহাজ্ঞানের অলৌকিক রক্ষাকবচটি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু এরপরেও চাঁদ সদাগর তার বন্ধু ধন্বন্তরীর অলৌকিক ক্ষমতাবলে নিজেকে রক্ষা করতে থাকেন। ধন্বন্তরী চাঁদের থেকেও অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। তাই ছলনা করে মনসা তাকে হত্যা করেন। এরপর চাঁদ যথার্থই অসহায় হয়ে পড়েন।[1]
এরপরেও চাঁদ মনসার পূজা করতে অস্বীকার করলে, মনসা সর্পাঘাতে চাঁদের ছয় পুত্রের প্রাণনাশ করেন। ভগ্নহৃদয় চাঁদ এতে বাণিজ্যে যাওয়ার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু শত দুঃখকষ্টের মধ্যেও তিনি আবার বাণিজ্যে বের হন। সফল বাণিজ্যের পর তিনি যখন ধনসম্পদে জাহাজ পূর্ণ করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করছেন, তখনই মনসা প্রচণ্ড ঝড় তুলে তার বাণিজ্যতরী শেরপুর শহরের অদূরে গরজরিপার অন্তর্গত কালিদাস সাগর ডুবিয়ে দেন। চাঁদের সঙ্গীরা মারা গেলেও চাঁদ প্রাণে বেঁচে যান। দুর্গা চাঁদকে রক্ষা করতে যান কালিদাস সাগরে। কিন্তু মনসার অনুরোধক্রমে শিব তাকে বারণ করেন। এরপর মনসা চাঁদকে ভাসিয়ে সমুদ্রের তীরে চন্দ্রকেতুর কাছে পৌঁছে দেন।[1]
চন্দ্রকেতু চাঁদকে দিয়ে মনসার পূজা করানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু চাঁদ তাতে সম্মত হন না। তাকে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণ করতে হয়। তা সত্ত্বেও তিনি শিবদুর্গার পূজা করে চলেন। মনসা তখন স্বর্গের দুই নর্তক-নর্তকীর সহায়তা নেন। তাদের একজন চাঁদ সদাগরের পুত্র রূপে এবং অপর জন চাঁদের বন্ধু সয়া বেনের কন্যা রূপে জন্মগ্রহণ করেন।[1]
চম্পক নগরে ফিরে এসে চাঁদ কোনোক্রমে নিজের জীবন পুনরায় সাজিয়ে তুলতে সক্ষম হন। তার লখিন্দর নামে একটি পুত্র জন্মে। এদিকে সয়াবেনের স্ত্রী একটি কন্যার জন্ম দেয়, তার নাম রাখা হয় বেহুলা। দুজনে একসঙ্গে বেড়ে ওঠেন। তাদের অভিভাবকেরা দুজনের বিবাহের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু কোষ্ঠী মিলিয়ে দেখা যায়, বিবাহরাত্রেই বাসরঘরে সর্পাঘাতে লখিন্দরের মৃত্যুর কথা লেখা আছে। কিন্তু মনসার ভক্ত বেহুলা ও লখিন্দর ছিলেন রাজযোটক। তাই শেষ পর্যন্ত উভয়ের বিবাহ স্থির হয়। লখিন্দরের প্রাণরক্ষা করতে চাঁদ একটি লৌহবাসর নির্মাণ করে দেন।[1]
এত সুরক্ষা সত্ত্বেও মনসা ঠিক পথ বের করে একটি সাপ পাঠিয়ে লখিন্দরের প্রাণনাশ করেন। সেযুগে প্রথা ছিল, সর্পদংশনে মৃত্যু হলে মৃত ব্যক্তিকে দাহ না করে কলার ভেলায় করে ভাসিয়ে দেওয়া হত। বেহুলা তার মৃত স্বামীর সঙ্গ নেন। সকলেই তাকে বারণ করেন। কিন্তু বেহুলা কারোর নিষেধ শোনেন না। ছয় মাস ধরে বেহুলা ভেলায় ভাসতে থাকেন। তিনি গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে চলেন। লখিন্দরের মৃতদেহে পচন ধরে। গ্রামবাসীরা তাকে উন্মাদ মনে করেন। বেহুলা মনসার কাছে প্রার্থনা করতে থাকেন। কিন্তু মনসা শুধু ভেলাটিকে ডুবে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা ছাড়া কিছুই করেন না।[1]
কলার ভেলা ভাসতে ভাসতে মনসার সহচরী নেতার ঘাটে এসে ভিড়ল। সেই ঘাটে কাপড় কাচত নেতা। বেহুলার প্রার্থনা শুনে নেতা ঠিক করেন যে তাকে নিয়ে যাবেন মনসার কাছে। নিজের অলৌকিক ক্ষমতাবলে তিনি বেহুলা ও মৃত লখিন্দরকে স্বর্গে উপস্থিত করেন। মনসা বেহুলাকে বলেন, “যদি তোমার শ্বশুরকে দিয়ে আমার পূজা করাতে পারো, তবে তুমি তোমার স্বামীর প্রাণ ফিরে পাবে।” [1]
বেহুলা শুধু বলেন, “আমি করবই।” আর তাতেই তার মৃত স্বামীর দেহে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। তার পচাগলা দেহের অস্থিমাংস পূর্বাবস্থায় ফিরে আসেন। তিনি চোখ মেলে তাকান এবং বেহুলার দিকে তাকিয়ে হাসেন।[1]
নেতা তাদের মর্ত্যে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন। বেহুলা তার শাশুড়িকে সব ঘটনা বিবৃত করেন। তিনি চাঁদ সদাগরকে গিয়ে সব কথা জানান। চাঁদের পক্ষে আর না বলা সম্ভব হয় না।[1]
প্রতিমাসের কৃষ্ণা একাদশী তিথিতে চাঁদ সদাগর মনসার পূজা করতে সম্মত হন। কিন্তু মনসা তাকে যে কষ্ট দিয়েছিলেন, তা তিনি সম্পূর্ণ ক্ষমা করতে পারেন না। তিনি বাম হাতে প্রতিমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মনসাকে পূজা করতে থাকেন। মনসা অবশ্য তাতেই সন্তুষ্ট হন। এর পর চাঁদ সদাগর ও তার পরিবার সুখে শান্তিতে বাস করতে থাকে। চাঁদ-এর ছয় পুত্রকেও মনসা জীবন দান করেন। চাঁদ সদাগরের মতো ধনী ও প্রভাবশালী বণিক মনসার পূজা করায় মনসার পূজা বৃহত্তর জনসমাজে প্রচার লাভ করে।[1]
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দর মনসামঙ্গলে আছে-
"চম্পক নগরে বৈসে চাঁদ সদাগর৷ মনসা সহিত বাদ করে নিরন্তর৷৷"[3]
অনেকে মনে করেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলাতে অবস্থিত চম্পাইনগরী বা কসবা-চম্পাইনগরীই হল চাঁদ সদাগরের চম্পকনগরী৷[4] [5]তাঁদের মতে চাঁদ সদাগর ও মনসাদেবীর দ্বন্দ্বের কাহিনীটি গড়ে উঠেছিল একালের কসবা-চম্পাইনগরী গ্রামকে ঘিরেই৷ "আইন-ই-আকবরী"তে সরকার মাদারণ-এর অন্তর্গত চম্পাইনগরী পরগণারও উল্লেখ পাওয়া যায় যা বর্তমানের পূর্ব বর্ধমান জেলাতে অবস্থিত৷ বর্ধমান শহরের ষোল ক্রোশ পশ্চিমে ও বুদবুদের দক্ষিণে দামোদর নদের উত্তর তীরে কসবা-চম্পাইনগরী অবস্থিত ৷ মনসামঙ্গলের কাহিনি থেকে আমরা জানি, চাঁদ সদাগর ছিলেন পরম শৈব এবং তিনি তাঁর বসতভিটায় শিবমন্দির তৈরি করে শিবের আরাধনা করতেন। কিম্বদন্তী অনুসারে বর্ধমানের এই গ্রামে দুটি প্রাচীন শিবমন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দুটি শিবলিঙ্গ (যার মধ্যে একটি হল রামেশ্বর শিবলিঙ্গ) স্বয়ং চাঁদ সদাগরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত৷[6] ডিভিসি ক্যানেলের দক্ষিণদিকে একটি উঁচু ঢিবিতে রয়েছে একটি সুন্দর শিবমন্দির। এক বিশাল অশ্বত্থ গাছের পাশে অবস্থিত শিবমন্দিরটিতে রয়েছে গৌরীপট্টহীন এক বিশাল শিবলিঙ্গ, যেটি রামেশ্বর নামে পরিচিত৷ এছাড়াও গ্রামের মধ্যে দুটি তৃণগুল্মাচ্ছিত উঁচু ঢিবি আছে যার একটিকে বেহুলার বাসরঘর (সতীতীর্থ) ও চাঁদ সদাগরের বাসগৃহের ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করা হয় এবং অপরটি স্থানীয় লোকেরা সাঁতালী পর্বত বলে মনে করে৷[7]
অনেকে মনে করেন, চম্পক নগর বঙ্গদেশে অবস্থিত ছিল।[8] মহাস্থানগড়ের ৩ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং বগুড়া শহরের ৯ কিলোমিটার উত্তরে বগুড়া-রংপুর সড়ক থেকে ১ কিলোমিটার দূরে গোকুল মেধ নামে একটি জায়গা রয়েছে। এই জায়গাটির স্থানীয়ভাবে বেহুলার বাসরঘর বা লখিন্দরের মেধ নামে পরিচিত। ১৯৩৪-৩৬ সালে এখানে খননকার্যের সময় একটি সারিবদ্ধ অঙ্গনে ১৭২টি আয়তাকার বদ্ধঘরের সন্ধান মিলেছে। এটি খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ অথবা সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত হয়। স্থানীয় লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই স্থানটি বেহুলা ও লখিন্দরের সঙ্গে যুক্ত। মহাস্থানগড়ের চেঙ্গিসপুর গ্রামে ধ্বংসস্তুপের উত্তর-পশ্চিম কোণ থেকে ৭০০ মিটার পশ্চিমে একটি মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটিকে খুল্লনার ঢিবি বলা হয়। এই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতোয়া নদী এখন শীর্ণকায়া হলেও অতীতে এই নদী বিশালাকার ছিল বলে জানা যায়।[9]
বগুড়ার অনেক উত্তরে অসমের ধুবড়ি জেলায় একটি অঞ্চল আছে। এই অঞ্চলটি মনসার সহচরী নেতার স্মৃতিবিজড়িত বলে মনে করা হয়। কলকাতার পার্শ্ববর্তী হাওড়ার একটি মন্দিরকে চাঁদ সদাগরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বলে মনে করা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের গৌড়ের নিকট একটি ধ্বংসস্তুপকে চাঁদ সদাগরের বাড়ি মনে করা হয়।[10]
১৯২৭ সালে মন্মথ রায় তার চাঁদ সদাগর নামক পৌরাণিক নাটকে চাঁদের বিদ্রোহী সত্ত্বাটিকে অঙ্কিত করেন।[11]
১৯৩৪ সালে প্রফুল্ল রায় চাঁদ সদাগর নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য (লখিন্দর), অহীন্দ্র চৌধুরী (চাঁদ সদাগর), দেববালা (মনসা), শেফালিকা দেবী (বেহুলা), জহর গঙ্গোপাধ্যায় (কালু সর্দার), ইন্দুবালা (গায়িকা), নীহারবালা (নেতা ধোপানি), পদ্মাবতী (সনকা) ও উষারানি (অমলা)। কাহিনিকার ছিলেন মন্মথ রায়। সম্পাদনা করেন অখিল নিয়োগী।[12][13]
এছাড়া বিশিষ্ট নাট্যকার শম্ভু মিত্র "চাঁদ বনিকের পালা" নামে একটি নাটক রচনা করেন যেখানে মনসামঙ্গলের কাহিনির চমতকার বিনির্মাণ লক্ষ করা যায় এবং চাঁদ সওদাগর চরিত্রের বিশিষ্টতা আরও বলিষ্টভাবে ফুটে উঠতে দেখা গেছে।
২০১০ সালে, স্টার জলসা 'বেহুলা' নামক ধারাবাহিক নাটক তৈরি করেছে।
২০০১ সালে মধ্য কলকাতার সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের দুর্গাপূজা মণ্ডপটি তৈরি করা হয়েছিল চাঁদ সদাগরের বাণিজ্যতরী মধুকর-এর আদলে।[14]
ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতার বিশিষ্ট ধনী ভোলা দত্ত নিজেকে চাঁদ সদাগরের বংশধর বলে দাবি করতেন। তিনি মনসামঙ্গলে বর্ণিত ‘শঙ্কর ভবানী’ মূর্তি পূজা করতেন। তার বংশধরেরা আজও সেই শিবদুর্গা মূর্তিরই পূজা করে পাশে বসে থাকে কার্তিক গণেশ ও লক্ষ্মী ও সরস্বতী মায়ের ছেলে মেয়েরা আসছেন। এই মূর্তিতে দুর্গা শিবের কোলে বসে থাকেন; দেবী সপরিবারে থাকলেও মহিষাসুর থাকে না; দেবীও সিংহের পরিবর্তে শিবের বৃষস্কন্ধে বসে থাকেন।পায়ের তলায় নিজে বসে দেবীর বাহন বীর কেশর সিংহ[15]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.