Loading AI tools
একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
চাক বাংলাদেশের একটি আদিবাসী । বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, নাইক্ষ্যংছড়ি চাক ও মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে তাদের বসবাস রয়েছে। চাকরা যে ভাষায় কথা বলে সেটি চাক ভাষা নামে পরিচিত। চাকদের ভাষায় 'চাক' শব্দের অর্থ 'দাঁড়ানো'। চাকরা নিজেদের নামের শেষে চাক লিখলেও আরাকানিরা চাকদের 'সাক' (Sak) এবং কখনো কখনো মিঙসাক বলে ডাকে। চাকরা অবশ্য নিজেদের বলে 'আচাক'। বান্দরবান বোমাং সার্কেলের বোমাং রাজপুস্তিকায় ও রাজ্য অভিষেক অনুষ্ঠানে চাকরা ‘মিঙসাক’ নামে তালিকাভুক্ত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দশ ভাষা-ভাষী তেরো-চৌদ্দটি জাতির মধ্যে চাক জাতি অন্যতম। 'চাক' জাতির রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা, ধর্ম, সংস্কৃতি, লোককথা, গান, ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী বাংলাদেশে চাকদের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার, মিয়ানমারে ২০ হাজার (বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, ২০০২) হলেও তা এখন বাংলাদেশের সংখ্যা প্রায় পাচ হাজার (৫০০০)। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাইশারি, নাইক্ষ্যংছড়ি, আলিখ্যং, কামিছড়া, কোয়াংঝিরি, বাকখালী, দোছড়ি, বাদুরঝিরি, ক্রোক্ষ্যং প্রভৃতি জায়গায় চাক জনগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। নামগত সাদৃশ্য ছাড়া চাকমাদের সাথে এদের ভাষা বা সংস্কৃতিগত কোনো মিল নেই। চাকরা মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। তবে অনেক খ্রিষ্টধর্মালম্বীও আছেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকদের মধ্যে প্রধাণত দুটি গোত্র দেখা যায়ঃ 'আন্দো' ও 'ঙারেখ'। এই দুটি প্রধান গোত্রের মধ্যে আবার অনেকগুলো উপগোত্র আছে। একই গোত্রের মধ্যে ছেলেমেয়েদের বিয়ে নিষিদ্ধ। দৈহিক গড়নে মঙ্গোলয়েড শাখার অন্তর্ভুক্ত চাকদের গায়ের রং হলদে পীতাভ, নাক মোটা ও থ্যাবড়া, মুখমন্ডল মধ্যমাকৃতির, ভাঁজযুক্ত চোখের পাতা। চাক সমাজ প্রধানত ২টি গোত্রে বিভক্ত। যা আবার কয়েকটি উপগোত্রে বিভক্ত। গোত্রীয় প্রতীক জালোয়া বা পইত্যা (পাকানো সুতার রশি)।
চৈনিক ইতিহাসে য়ূনাং-এ বসবাসরত চাকদের বড় কান জাতি বলে আখ্যায়িত করা হয় থোয়াইং শৈ খাইন। কান বড় করে চাক রমণীদের অলংকার ব্যবহার করার প্রচলন বর্তমানেও পরিলক্ষিত হয়। গবেষক অংসা উ এবং থোয়াইং শৈ খাইন-এর মতে চাকরা য়ুনাং হতে সরে বর্তমান মায়ানমার এবং উত্তর সীমান্ত অঞ্চল হুগোং-এ অবস্থান নেয়। ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণ বৃত্তান্ত Francis Buchanon in South East Bengal (1798)-এ ‘চাক’ জনগোষ্ঠীর উল্লেখ পাওয়া যায়। চৌদ্দ-পনের শতকে ব্রহ্মদেশ ও আরাকানে এক ভয়ানক রাজনৈতিক সংকটের সময় নিরাপত্তাহীনতার কারণে চাক জনগোষ্ঠীর একাংশ বর্তমান রাখাইন প্রদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত কালাদেং নদী পার হয়ে এবং চেঙদাং পর্বত অতিক্রম করে বর্তমান বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলের লামা ও য়েছোয় অবস্থান নেয়।
চাকদের জীবনধারা বৈচিত্র্যপূর্ণ ও ঐতিহ্যমন্ডিত। শিশুর জন্ম ও নামকরণ সংক্রান্ত অনুষ্ঠানাদির মধ্যে নাইংছাঙাহাং-এ অবস্থান, পুতরংবুওয়ে (জন্মপরবর্তী অনুষ্ঠান), ভেগলুংশাত পো (চুংবংলং উচ্ছেং ছাহেকা) উল্লেখযোগ্য। বিবাহ সংক্রান্ত প্রথার মধ্যে আচাংগায়ুগা (কনে দেখা), চাঁগায়ুগা (কোষ্ঠী বিচার)-সহ আরো অনেক প্রথা পালন করা হয়। এছাড়াও মৃত্যুপরবর্তী আচার, কাবাকে শয়ন, তালাহ্-তে স্থাপন, দাহকার্য, কাঙবোয়েং (শুদ্ধকরণ), ছানিংওয়াক্ সভীক ফ্রেহ, সাইন্ বলব্ (পুনঃজন্ম কামনা) চাকদের নিজস্ব সংস্কৃতিগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
চাক জনগোষ্ঠী সিনো-টিবেটান পরিবারের তিববতি-বর্মণ শাখার সাক বা লাই দলভুক্ত ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশে বসবাসকারী চাকদের কোনো লিখিত বর্ণমালা ছিল না। তবে আজ চাকদের বর্ণমালার কথা সবাই কিছুটা হলেও শুনেছেন। চাকদের এই বর্ণমালা আবিষ্কার করেছেন মংমং চাক। তিনিই প্রথম চাকদের বর্ণমালা উদ্ভাবন এবং চাক শব্দটি পুস্তকে লিপিবদ্ধ করেন। এর আগে নিজেরা চাক বললেও অফিস আদালতে নামের শেষে টাইটেল চাক শব্দটি লিখিত ছিল না। এছাড়া মংমং চাকই চাকদের মধ্যে সর্বপ্রথম বিএ পাশ করেন।
চাক কবি ও গীতিকারদের মধ্যে ওয়াং চিংচাক, চামাপ্রু চাক, নাংউচাক, চাইছাঅং চাক, মংনু চাক, এম আর চাক, মং কোচিং চাক, মংমং চাক প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে লাংখোয়া সো (করতাল), পাইয়া (বড়ঢোল), পুং (ছোট বাদ্যযন্ত্র), বাঁশি-পুলী, হন-সানাহ, পালাক, গঙ্গ বা মঙ্গ বা দার খোয়াং- অষ্টধাতুর তৈরি গোলাকার ঘণ্টা জাতীয় ভারি যন্ত্র রয়েছে।
১৯৫৯ সালে চাক ধর্মগুরু মহাথেরো গন্ধর্ব ওয়েংসার এর প্রচেষ্টায় চাক সমাজে শিক্ষার বিস্তার ঘটে। ১৯৬৬ সালে প্রথমে একজন স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। বর্তমানে এ সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে অনেকেই সরকারি ও বেসরকারি চাকুরি করছে। নিজেদের তৈরি বস্ত্র তারা পরিধান করে। পুরুষদের পোশাকের মধ্যে কোতুংপাংরে (ধুতি), আপং (মাথার পাগড়ি) এবং নারীদের পোশাকের মধ্যে নাফিং (এক প্রকার স্কার্ট) ও রাংকেং (বক্ষবন্ধনী) উল্লেখযোগ্য। এছাড়া চাকরা মোটা নকশাযুক্ত কম্বল বুনন করে থাকে। নিজস্ব ডিজাইনে তৈরি অলংকার চাকরা ব্যবহার করে। বিভিন্ন অলংকারের মধ্যে রয়েছে বড় (কানবালা নাতং বেং চিংজু), কাঠের কানফুল (টাংগাচাংনাতং), পায়ের খাড়ু (আতাপাইসাং)। বড় কানবালা তাদের পরিচায়ক অলংকার হিসেবে পরিগণিত।
পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের দশ ভাষা-ভাষী তেরো-চৌদ্দটি জাতির মধ্যে চাক জাতি অন্যতম। চাক জাতির রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা,ধর্ম,সংস্কৃতি,লোককথা,গান,ছড়া,কবিতা,প্রবন্ধ লাব্রে (অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা), সাংগ্রাই, কাথিং পোয়ে (কঠিন চীবর দান) উৎসব, কাতাং য়িশু পোঃ, তেংছংবুক লাব্রে (কার্তিক পূর্ণিমা), আংনাইবুক পোয়ে (নবান্ন উৎসব) অনুষ্ঠিত হয়। পিতৃতান্ত্রিক পরিবার কাঠামোতে চাকদের মাঝে তিন ধরনের পরিবার লক্ষ্য করা যায়। সরকার কর্তৃক ভাতাপ্রাপ্ত হেডম্যান যোগ্যতা ও উত্তরাধিকারের ভিত্তিতে নিয়োজিত হন। সম্পত্তির উত্তরাধিকারী শুধু ছেলেরা।
মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে চাকদের জুমচাষ ও হালচাষের প্রচলন থাকলেও বর্তমানে জুমচাষের ফলন হ্রাস পেয়েছে। চাক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব উপকরণে বাসগৃহ ও মন্দির বা প্রার্থনাগৃহ নির্মাণ করে। চাকরা বাড়িকে কিং এবং গ্রামকে থিং বলে। চাকরা ভাত, শাকসবজি, শুঁটকি, মাছ ও মাংস খায়।চাকদের প্রিয় খাদ্য কাইংরাবুং ও কাইংদাক
গোত্র প্রথার মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের ও নবজাত শিশুর মঙ্গল কামনার্থে যে সংগীত পরিবেশন করা হয় তা স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে। এছাড়া জীবনের বিভিন্ন ধাপে পালিত কৃষ্টির মাধ্যমে চাকরা নিজেদেরকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.