Loading AI tools
বাঙালি রাজনীতিবিদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মুজাফফর আহমদ (৫ আগস্ট ১৮৮৯-১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩) ভারতীয় উপমহাদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রদূত এবং বঙ্গে এই আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা।
মুজাফফর আহ্মদ | |
---|---|
জন্ম | সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম জেলা (তৎকালীন নোয়াখালী জেলার অন্তর্গত), বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (বর্তমান বাংলাদেশ) | ৫ আগস্ট ১৮৮৯
মৃত্যু | ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৩ ৮৪) | (বয়স
অন্যান্য নাম | কাকাবাবু |
নাগরিকত্ব | ভারতীয় |
প্রতিষ্ঠান | বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি |
পরিচিতির কারণ | কমিউনিস্ট আন্দোলন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন |
রাজনৈতিক দল | ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি |
১৯১৭ সালে রাশিয়ায় জার শাসনের অবসান ঘটে এবং লেনিন-স্টালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক অভ্যুত্থান সফলতা লাভ করে। রাশিয়াতে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠিত হয়। এর ঢেউ খুব দ্রুত অন্য সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তৎকালীন ভারতেও ব্যতিক্রম হয়নি। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তারিখে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। গঠন করেছিলেন বাঙালি নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়। এর মাত্র একমাসের মধ্যে বঙ্গদেশেও সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়। এই সংগঠনের পুরোধা ছিলেন মুজাফফর আহমদ। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন তার হাত ধরেই যাত্রা শুরু করে।
মুজাফফর আহমদ ১৮৮৯ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপের মুসাপুর গ্রামে এক দরিদ্র কিন্তু অভিজাত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মনসুর আলি এবং মা'র নাম চুনাবিবি। চুনাবিবি তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। মনসুর আলি সন্দ্বীপের এক স্বল্প আয়ের মোক্তার ছিলেন। তার দাদা আর নানার নাম ছিল যথাক্রমে মুহম্মদ কায়েম ও রেশাদ আলী ঠাকুর। পারিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় কৈশোরে মুজাফফর আহমদকে চাষাবাদের কাজেও সাহায্য করতে হয়েছিল। বহির্মুখী মুজাফরর আহমদকে গৃহমুখী করার উদ্দেশ্যে পারিবারিক চাপ প্রয়োগে ১৯০৭ সালে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। তার স্ত্রীর নাম হাফেজা খাতুন। নিয়মিত সাংসারিক জীবন তিনি পালন করেননি। ১৯৩৫ সালে নজরবন্দি থাকার সময় ১৪ বছর পর পরিবারের সাথে দেখা হয়। এ সময় তিনি তার একমাত্র কন্যা আফিকা খাতুনের সাথে কবি আবদুল কাদিরের সঙ্গে সন্দ্বীপে বিয়ে দেন। [1]
মুজাফফর আহমদ তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন বাংলা ভাষা শিক্ষার দ্বারা। ১৮৯৭ সালে তিনি গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৮৯৯ সালে তিনি হরিশপুর মিডল ইংলিশ স্কুলে (পরে কাগিল হাইস্কুল) ভর্তি হন। পিতার মোক্তারি ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্কুল থেকে তার নাম কেটে দেওয়া হয়। সে সময় মাদ্রাসা শিক্ষা অবৈতনিক হওয়ায় তিনি মাদ্রাসায় লেখাপড়া শুরু করেন। ১৯০৫ সালে পিতার মৃত্যুর সময় তিনি নোয়াখালীর বামনী মাদ্রাসায় পড়ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর মুজাফফর আহমদ কিছুকাল বরিশালে গৃহশিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি আবার নিজ গ্রামে ফিরে স্কুলে ভর্তি হন।[2] ১৯১০ সালে তিনি কাগিল হাইস্কুল ছেড়ে নোয়াখালী জেলা স্কুলে চলে যান। ১৯১৩ সালে সেখান থেকে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১৩ সালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের হুগলি কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু সেখানে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ায় তিনি সে বছরই চলে যান বঙ্গবাসী কলেজে। এ কলেজ থেকে আই এ পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হন এবং সেখানেই তার লেখাপড়ার ইতি ঘটে। ১৯১৩ থেকেই তিনি কলকাতার অধিবাসী।[3] সন্দ্বীপের কাগিল হাইস্কুলে পড়ার সময়ই মুজাফফর আহমদের সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি হয়। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সম্পাদিত 'সাপ্তাহিক সুলতান' পত্রিকায় সন্দ্বীপের স্থানীয় খবর পাঠাতেন।
১৯১১ সালে কলকাতায় অবস্থানরত বিভিন্ন মুসলিম ছাত্রের উদ্যোগে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতি গঠিত হয়। কলকাতার ৩২ কলেজ স্ট্রিটে এ সাহিত্য সমিতির অফিস ছিল। ১৯১৮ সালে সমিতির উদ্যোগে বের হয় "বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা"। ১৯১৮ সালে সমিতির সব সময়ের কর্মী হিসেবে তিনি এর অফিসেই থাকা শুরু করেন। তিনি ছিলেন সমিতির সহকারী সম্পাদক। পত্রিকার কাজ পরিচালনার সময় চিঠিপত্রের মাধ্যমে তার কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে পরিচয় হয়। ১৯২০ সালের শুরুর দিকে ৪৯ নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে নজরুলের সৈনিক জীবনের অবসান ঘটে এবং তিনি কলকাতায় মুজাফফর আহমদের সাথে সাহিত্য সমিতির অফিসে থাকতে শুরু করলেন।[4]
সক্রিয় রাজনীতিতে যোগদানের পূর্বে মুজাফফর আহমদ কিছুদিন চাকরিতে নিয়োজিত ছিলেন। বাংলা সরকারের ছাপাখানায় মাসিক ত্রিশ টাকা বেতনে তিনি চাকরি করেছিলেন। বাংলা সরকারের অনুবাদ বিভাগেও তিনি মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে একমাস উর্দু থেকে বাংলায় অনুবাদ করার কাজে চাকরি করেন। একমাস তিনি প্রেসিডেন্সি বিভাগের স্কুলসমূহের ইনস্পেক্টর হিসেবেও কাজ করেন। কলেজে পড়ার সময় খিদিরপুর জুনিয়র মাদ্রাসায় তিনি শিক্ষকতা করেন আর একমাস ছুটিতে তিনি কলকাতা সিটি কর্পোরেশনে কাজ করেন। ১৯০৬ সাল থেকে ১৯০৮ সালের অধিকাংশ সময় তিনি কোন না কোন লোকের বাড়িতে গৃহশিক্ষকতা করে থাকা খাওয়া অথবা অর্থ রোজগার করতেন।[5]
কৈশোরে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করলেও ১৯১৬ সাল থেকে মুজাফফর আহমদ বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক আলোচনা, সভা-সেমিনার-মিছিল যোগদান প্রভৃতি শুরু করেন। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কলকাতার অনুষ্ঠিত আন্দোলনে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ১৯২০ সালে বঙ্গীয় খেলাফত কমিটির সদস্য মনোনিত হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯২০ সালের শুরুতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে রাজনীতিই হবে তার জীবনের মূল পেশা। তিনি কাজী নজরুলের সাথে ঠিক করেন একটি ভিন্নধর্মী বাংলা দৈনিক বের করার। এ বিষয়ে তারা ফজলুল হক সাহেবের (পরবর্তীতে শেরেবাংলা) সাথে দেখা করেন। হক সাহেব তার নিজের টাকায় পত্রিকা বের করার প্রস্তাব করেন। ১৯২০ সালের ১২ জুলাই মুজাফফর আহমদ ও কাজী নজরুল ইসলামের যুগ্ম সম্পাদনায় "নবযুগ" নামক সান্ধ্য পত্রিকা বের হয়।[6] সেখানে তিনি দ্বৈপায়ন ছদ্মনামে লিখতেন।[7][8]
মুজাফফর আহমদের ছাত্রাবস্থায় বাংলায় সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের শুরু হয়। এ সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন শুধু হিন্দু আন্দোলন ছিল না, আসলে তা ছিল বর্ণ হিন্দুদের আন্দোলন। তার মতে, একধরনের রোমাঞ্চের জন্য শিক্ষিত যুবকেরা এতে অংশ নিলেও এর পিছনে ছিল একটা গভীর নৈরাশ্য। যদিও তিনি এই আন্দোলনের জন্য জীবন উৎসর্গকারীদের শ্রদ্ধা করতেন।[9] অন্যদিকে মুসলীম লীগ ও কংগ্রেসকে তিনি ধনীক শ্রেণীর স্বার্থে ধনীক শ্রেণীর রাজনৈতিক দল বলে মনে করতেন। কংগ্রেসের ঘোষণাপত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা থাকলেও এ দল ধীরে ধীরে হিন্দু জাতীয়তাবাদের বিশ্বাসী নেতাদের কর্তৃত্বাধীন হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগের অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক হলেও ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করতেন। মূলতঃ ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতিতে হিন্দু সুবিধাভোগী শ্রেণীর একাধিপত্যকে রোধ করার জন্যই মুসলিম সুবিধাভোগী ও ভোগেচ্ছুদের রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের জন্ম হয়।[10]
তার পিতার পেশা মোক্তারি হলেও তার পরিবার ছিল মূলতঃ কৃষক পরিবার। তাছাড়া তাদের গ্রামের অর্থনীতিও ছিল কৃষিভিত্তিক। কলকাতা জীবনের শুরু থেকেই নাবিকদের সাথে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণে শ্রমিক শ্রেণীর দুঃখ-দুর্দশার সাথে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সে সময় সন্দ্বীপের অনেক লোক কলকাতা বন্দরে কাজ করতেন। আধুনিক শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংবাদিকতার আকর্ষণ এবং বুদ্ধিজীবীদের সাহচর্য লাভ তাকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও কৃষক-শ্রমিক শ্রেণীর মুক্তির রাজনীতিতে আগ্রহী করে তুলেছিল। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের সাফল্য তাকে উদ্দীপ্ত করে। ১৯২১ সাল থেকে তিনি মার্কসবাদ চর্চা ও মার্কসবাদী রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন।[10]
১৯২২ সালে তিনি নজরুল সম্পাদিত 'ধূমকেতু' পত্রিকায় দ্বৈপায়ন ছদ্মনামে ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা এবং কৃষক ও শ্রমিকদের সমস্যা নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক রচনা লেখেন।[8][7] ১৯২৩ খ্রি. প্রথম গ্রেপ্তার হন। ১৯২৪ খ্রি. কানপুর বলশেভিক (কমিউনিস্ট) ষড়যন্ত্র মামলায় তাঁর চার বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় ১৯২৫ খ্রি. ছাড়া পান। এই সময় আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করেন। ১৯২৬ খ্রি. তাঁর সম্পাদনায় দলের প্রথম বাংলা পত্রিকা 'গণবাণী' প্রকাশ লাভ করে।[11] এই সময় তিনি, আবদুল হালিম এবং আবদুর রেজ্জাক খান বাংলার সাম্যবাদী আন্দোলনের নেতা হয়ে উঠেছিলান।[12]
১৯২৯-৩৩ খ্রি, এই পত্রিকাতেই আন্তর্জাতিক সংগীতের ও কমিউনিস্ট ইস্তাহারের বঙ্গানুবাদ প্রথম ছাপা হয়। শ্রমিক-কৃষকের সমস্যা, মার্কসীয় দর্শন প্রভৃতি নিয়েও এতে নিয়মিত আলােচনা চলত। ১৯২৯-৩৩ খ্রি. ঐতিহাসিক মিরাট যড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি হিসেবে তিনি তিন বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন। ১৯৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত সারা ভারত কৃষক সভার প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। ২৫.৩.১৯৪৮ খ্রি. কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি হলে নিবর্তনমূলক আটক আইনে তিনি ১৯৫১ খ্রি. পর্যন্ত আটক থাকেন। ১৯৬২ খ্রি. চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় তাঁকে ভারত-রক্ষা আইনে দু-বছর আটক রাখা হয়।[11] ১৯৬৪ সালে পার্টি ভাগ হলে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র সাথে যুক্ত হন।
৪০ বছর ধরে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ন্যাশনাল বুক এজেন্সির একজন প্রধান সংগঠক ছিলেন। গণশক্তি প্রিন্টার্স প্রেস তিনিই গড়ে তােলেন। 'কাকাবাবু' নামে তিনি কর্মী ও নেতাদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন।[11]
রচিত গ্রন্থ : 'নজরুল স্মৃতিকথা', 'ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস' প্রভৃতি।[11]
আহমদ ১৯৭৩ সালে কলকাতায় মারা যান, তাঁর বয়স ৮৪ বছর বয়সে।[11]
পশ্চিমবঙ্গে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) এর সদর দফতর তাঁর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়াও, কলকাতার রিপন স্ট্রিটের নামকরণ করা হয়েছে "মুজাফফর আহমদ স্ট্রিট"।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.