বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম গৌড়েশ্বর কংসনারায়ণ রায় রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের রাজা এবং পরবর্তীকালে গৌড়ের সম্রাট । তিনি বারেন্দ্র ব্রাহ্মণকুলের প্রধান সংস্কারক এবং সেই সময়ের বাঙ্গালী হিন্দু সমাজের নেতা ছিলেন। তিনি বাংলায় আধুনিক দুর্গাপুজা শুরু করেন। সমগ্র বাংলার রাজারা অবনত তার উপদেশ গ্রহণ করতেন।[1]তিনি ১৬ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী রাজা যিনি সুলতানের শাসনে থাকা রাজধানী গৌড়কে শাসন করার জন্য বরেন্দ্র অঞ্চলের ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে একত্রিত করেন।তিনি ১৬ শতাব্দীর শেষভাগে সর্বশেষ হিন্দু রাজা এবং বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় থেকে চতুর্থ ব্যক্তি যিনি তা করতে পেরেছিলেন।[2]
বংশ
বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কুলভূষণ বিজয় লঙ্কর তাহিরপুরের জমিদারীর প্রতিষ্ঠাতা। কথিত আছে, তিনি দিল্লীশ্বর বা বঙ্গের কোন স্বাধীন সুলতানের কাছ থেকে বঙ্গের পশ্চিম দ্বার রক্ষার ভারপ্রাপ্ত হন। তিনি ২২ পরগণা এবং “সিংহ" উপাধি লাভ করেন। বারাহী নদীর তীরে রামবাম তার রাজধানী ছিল। তার পুত্র উদয় নারায়ণ । এই উদয়ের পৌত্র হল বিখ্যাত কংসনারায়ণ।[1]
বংশধর
কংসনারায়ণের দুই ছেলে মুকুন্দরাম রায় ও নরেন্দ্রনারায়ণ রায় । নরেন্দ্রনারায়ণ রায় সম্পত্তির দশ আনার উত্তরাধিকারী হন। রাজা কংসনারায়ণের পুত্র নরেন্দ্রনারায়ণের কন্যা উমাদেবীর সাথে আনন্দীরাম রায়ের বিয়ে হয়। বংশের শেষ রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। বংশের পুত্রসস্তান না থাকায় আনন্দীরামের দশ আনা সম্পত্তির অধিকারী বিনোদরাম হলেন। সম্প্রতি জলপাইগুড়ির এক চক্রবর্তী পরিবার নিজেদের তাঁর বংশধর দাবি করে।[3][4]
বারেন্দ্র কুলীন সমাজে অবদান
উদয়নারায়ণ কুলীন ব্রাহ্মণগণের মধ্যে নিরাবিল পক্টর সৃষ্টি করে ছিলেন। কূলজ্ঞ উদয়ণাচার্য্যের নিয়ম অনুসারে কুলীন-কন্যার শ্রোত্রিয়ের সঙ্গে বিয়ে হতে পারত না এবং কুলানদের বিবাহে কুশবারি সংযুক্ত প্রতিজ্ঞা করতে হত, কেবল বাগদানে কার্য হত না। এই নিয়মের জন্য বহু কুলীনের কুল নষ্ট হল এবং তারা কাপ - হতে লাগল। রাজা কংসনারায়ণ দেখলেন যে এরূপ প্রথা চললে কুলিনদের বংশ একেবারে লুপ্ত হবে। তিনি বহু অর্থ ব্যয় করে কাপ ও কুলীনদেরকে একত্র করে দিলেন। তিনি কাপ ও কুলীনের মধ্যে কন্যা আদান প্রদান ও কুলীনে শ্রোত্রিয়ের কন্যা গ্রহণ বিধিবদ্ধ করলেন। কংসনারায়ণ স্বীয় বংশের কন্যা কাপে প্রদান করলেন ।[4]
আফগানদের সাথে বিরোধিতা
তার সময়ে বাংলার মসনদে অধিষ্ঠিত ছিল নবাব সুলেমান কররানি।যার সেনাপতি কুখ্যাত কালাপাহাড়।যে কিনা হিন্দু বিদ্বেষী ছিল। হিন্দুদের উপর সে ভয়াবহ অত্যাচার চালায়।পুরির জগন্নাথ মন্দিরেও সে হামলা করেছিল। বাংলা জুড়ে তখন চলছিল অত্যাচার। তরুণ কংসনারায়ণ ফৌজদার ছিলেন। তিনি পরিস্থিতি দেখে কালাপাহাড়ের অত্যাচারের প্রতিবাদ করলেন ও বিচার চাইলেন। কিন্তু নবাব কংসনারায়ণের কথা শুনলেন না।বরং রেগে গেলেন তিনি ।এতে তিনি পদত্যাগ করলেন ফৌউদার পদ থেকে।
গৌড় আক্রমণ
কালাপাহাড়কে থামাতে সিন্দুরীর রাজা ঠাকুর কালীদাস রায়, সাঁতোরের রাজপুত্র গদাধর সান্যাল ও দিনাজপুরের রাজভ্রাতা গোপীকান্ত রায়ের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। অনেক যুক্তি পরামর্শ করে তিনি গেলেন দিল্লিতে। সম্রাট আকবর তখন বাদশা হয়েছেন। কংসনারায়ণ সম্রাটকে জানালেন, পাঠান শাসনে নবাবের সেনাপতি কালাপাহাড় অত্যাচার চালাচ্ছে । নিজ বুদ্ধিবলে সম্রাটের সমর্থন লাভ করলেন । সুলেমান কররানির মৃত্যুতে তখন বাংলার নবাব সুলেমান কররানির পুত্র দাউদ খাঁ । ঠাকুর কালীদাস রায়, গদাধর সান্যাল, গোপীকান্ত রায়ের সাথে কংসনারায়ণ এর মিলিত সৈন্যবাহিনী একত্রে গৌড় আক্রমণ করে । ভীষণ যুদ্ধের পর পতন হলো কালাপাহাড়ের। ১৫৭৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজমহলে মোগলদের কাছে পরাজিত ও নিহত হলেন দাউদ খাঁ। মুনেম খাঁ কে সিংহাসনচ্যূত করে গৌড়ের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হলেন মহারাজা কংসনারায়ণ রায় । বাঙ্গালায় পুনরায় শান্তি ফিরল।
নববিজিত রাজ্যের জমিজমার বন্দোবস্ত করার কাজে রাজা টোডরমলকে সাহায্য করলেন কংসনারায়ণ। কংসনারায়ণের সুদক্ষ সহযোগিতায় সুবে বাংলার জমিজমার জরিপ ও বন্দোবস্ত পুরোদমে চলছিল। তখন এক বিশেষ প্রয়োজনে রাজা টোডরমলকে ডেকে পাঠালেন সম্রাট। রাজা টোডরমল এই গুরুতর দায়িত্বপূর্ণ অসমাপ্ত কাজ কংসনারায়ণের ওপর অর্পণ করে চলে গেলেন আগ্রায়। কংসনারায়ণ অবশিষ্ট কাজ সুচারুভাবে শেষ করে সমস্ত হিসাবপত্র, চিঠা-পৈঠা ও নকশা পাঠিয়ে দিলেন সম্রাটের কাছে।
বঙ্গের দেওয়ান ও সুবেদার
সম্রাট আকবর টোডরমলের সহায়তায় সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখলেন। সন্তুষ্ট হলেন সার্বিকভাবে। স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মানুষ তখন আশা পোষণ করলেন যে বাঙালি যুবক কংসনারায়ণকেই নির্বাচিত করা হবে বাংলার সুবেদার পদে। কিন্তু মোগল সম্রাট আকবর বিশিষ্ট দূত মারফত বাঙালি কংসনারায়ণের জন্য পাঠালেন নানা রকম মূল্যবান উপহার, ‘রাজা’ খেতাব এবং সুবে বাংলার দেওয়ানের পদ। মনঃক্ষুণ্ন কংসনারায়ণ সসম্মানে সম্রাটের উপহার ও খেতাব গ্রহণ করলেন, তবে সুবে বাংলার দেওয়ানের পদ প্রত্যাখ্যান করলেন সবিনয়ে।গৌড়ের মহামারীতে মুনেম খাঁর মৃত্যু হইলে, তিনি অস্থায়ীভাবে কিছুকাল সুবেদারী করিয়া গৌড়েশ্বর হইয়াছিলেন। পরে তিনি কেবলমাত্র বঙ্গের দেওয়ান ছিলেন।
বাঙালির দুর্গোৎসব
কংসনারায়ণ তাহিরপুরে তার সুবিস্তৃত জমিদারির উন্নতি বিধানের প্রতি পুরোপুরি মনোনিবেশ করলেন। রাজসিকভাবে শুরু করলেন দুর্গাপুজা। মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে সম্ভবত ১৫৮২ সালে শরৎকালে প্রথম দুর্গা পুজো করেন তিনি।[5] তান্ত্রিক রমেশ শাস্ত্রীর বিধানে প্রণীত হলো শাস্ত্রানুমোদিত আধুনিক দুর্গোৎসব পদ্ধতি। পরিবারসমন্বিতা প্রতিমায় বাংলাদেশেই প্রবর্তিত হলো প্রথম শারদীয় দুর্গোৎসব।[6] ১৫৮০ খ্রিষ্টাব্দে রাজা কংসনারায়ণ প্রায় নয় লক্ষ টাকা ব্যয় করে দুর্গাপূজা করেছিলেন।[7] প্রভাতরঞ্জন সরকার তাঁর বাংলা ও বাঙালী গ্রন্থে বলেছেন, কংসনারায়ণ পাঠান যুগে প্রথম দুর্গা পূজা প্রচলন করেন এবং এতে তিনি সাত লক্ষ টাকা খরচ করেন।[8] তিনি রাজসূয় যজ্ঞ বা অশ্বমেধ যজ্ঞ করতে চাইছিলেন। পন্ডিতেরা বললেন, কলিযুগে অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্ভব নয়। মার্কন্ডেয় পুরাণে যে দুর্গার কথা আছে তার পূজা করুন। এভাবেই তিনি প্রথম দুর্গা পূজা আরম্ভ করেন।[8]
কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা
কংসনারায়ণ এর বহুকাল আগে থেকেই বঙ্গদেশে দুর্গাপুজোর প্রচলন থাকলেও, কংসনারায়ন বিপুল অর্থ ব্যয়ে বঙ্গদেশে যে দুর্গোৎসবের সূচনা করে তা বাঙালি সমাজে কিংবদন্তি তৈরি করেছিলো। কাজেই কংসনারায়ণ রীতি সমগ্র বঙ্গদেশে ছড়িয়ে পড়ে।এই রীতির প্রধান বৈশিষ্ট হলো একচালার দুর্গাপ্রতিমার চালি উপরের দিকে লক্ষ্মী ও সরস্বতী এবং নিচে গণেশ ও কার্তিকের অবস্থান। প্রতিমার পেছনে অর্ধ চন্দ্রাকার চালি তথা চালচিত্রের ব্যবহার। যে চালিতে মূলত দশমহাবিদ্যা ও মহাদেবের অবস্থান। এই ধরনের চালিকে বাংলা চালি বলা হয়। প্রতিমার মুখের আদলে থাকে অভিনবত্ব। দেবী প্রতিমায় থাকতো টানাটানা চোখ ও টিয়াপাখির ঠোঁটের মত বাঁকানো নাক। দেবীর দুই গাল সামান্য চাপা । এই ধরনের মুখের আদলকে বলা হয় বাংলা মুখ । দেবী প্রতিমার বর্ন গাঢ় হলুদ।
অষ্টধাতুর মূর্তি
অষ্টধাতুর দুর্গা বিগ্রহের বয়স প্রায় ১২০০ বছর। তৎকালীন রাজসাহীর রাজা কংসনারায়ণ রায় নাকি এই বিগ্রহের পূজা শুরু করেছিলেন। বাংলাদেশের মাটিতে যে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল, কালের কপোলতলে আজ সেই বিগ্রহই রয়েছে জলপাইগুড়ির পান্ডাপাড়া কালীবাড়ি এলাকার চক্রবর্তী পরিবারে। বিগ্রহের ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে রাজ্যের সবচেয়ে প্রাচীন পুজো তাদেরই, । হুসেন শাহের আমল থেকেই এই অষ্টধাতুর দুর্গামূর্তি পূজিত হয়ে আসছে বলে দাবি তাদের। বাংলাদেশের হরিপুরের পাবনাতে এই পুজোর সূচনা করেন কংসনারায়ণের ছেলে মুকুন্দরাম রায়। সেই সময় হুসেন শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পরে রাজা শ্রীহট্ট সেনের বাড়িতে বিগ্রহ নিয়ে টাঙ্গাইলে আসেন মুকুন্দরাম। এবং রাজচক্রবর্তী উপাধি নিয়ে বসত শুরু করেন। কেবলমাত্র এই বিগ্রহটি বাঁচানোর জন্য তিনি তার উপাধি পরিবর্তন করেন। মুকুন্দরাম রায় থেকে চক্রবর্তী হন। তার পরে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িয়ে ফের যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। এবং যুদ্ধে জয়ীও হন ।ঐতিহাসিক এই দুর্গামূর্তিতে লক্ষ্মী-সরস্বতী নেই। আছেন কার্তিক ও গণেশ। নিত্যপুজোয় ৯ রকমের ভাজা দিয়ে ভোগ দেওয়া হয় মাকে। দুর্গাপুজোর সময় অষ্টধাতুর মূর্তির পাশে মৃণ্ময়ী মূর্তি পূজিতা হন। [9]
আরও দেখুন
তথ্য়সূত্র
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.