আবু তাহের মোহাম্মদ হায়দার (এ টি এম হায়দার) (জন্ম:১২ জানুয়ারি, ১৯৪২ - মৃত্যু: ৭ই নভেম্বর, ১৯৭৫)ছিলেন একজন বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা, যিনি প্রথমে দুই নং সেক্টরের সহ-অধিনায়ক ও পরে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। একজন গেরিলা কমান্ডার হিসাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অভূতপূর্ব অবদান রাখার জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন।[১]
এ.টি.এম হায়দার | |
---|---|
জন্ম | ১২ জানুয়ারি ১৯৪২ |
মৃত্যু | নভেম্বর ৭, ১৯৭৫ ৩৩) ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত (১৯৪৭ সাল পর্যন্ত) পাকিস্তান (১৯৭১ সালের পূর্বে) বাংলাদেশ |
পেশা | সাবেক সেনাকর্মকর্তা |
পরিচিতির কারণ | মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার, বীর উত্তম |
আত্মীয় | সিতারা বেগম (বোন) |
ব্যক্তিগত জীবন
১৯৪২ সালের ১২ জানুয়ারি, কলকাতার ভবানীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আলহাজ মোহাম্মদ ইসরাইল। তিনি ব্রিটিশ ও পাকিস্তান পুলিশ বিভাগের ইন্সপেক্টর হিসাবে চাকুরি করতেন। মা আলহাজ হাকিমুন নেসা একজন গৃহিনী। পরিবারের দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে লে. কর্নেল হায়দার ছিলেন দ্বিতীয়। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার করিমগঞ্জ উপজেলার জয়কা ইউনিয়নের কান্দাইল গ্রামে। তার বোন ডা. সিতারা বেগম, বীর প্রতীক।[২] এ.টি.এম হায়দার স্কুল জীবন শুরু করেন পাবনার বীণাপানি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পরে কিশোরগঞ্জ রামানন্দ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় [বর্তমান কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়]থেকে ১৯৫৮ সালে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এস.এস.সি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রজীবন থেকেই হায়দার একজন ভালো খেলোয়াড়, সাতারু ও স্কাউট ছিলেন। তিনি ১৯৫৮ সালে একজন স্কাউট হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর জাম্বুরীতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে হায়দার কিশোরগঞ্জ সরকারি গুরুদয়াল কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক (আই.এ) পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর হায়দার উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে চলে যান। সেখানের লাহোর ইসলামিয়া কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে বি.এস.সি. ডিগ্রী লাভ করেন। পরে লাহোরস্থ পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিদ্যায় ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স প্রথম পর্ব পড়াকালীন সেনাবাহিনীতে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। এবং পাকিস্তান সামরিক বাহিনীতে কমিশনের জন্য মনোনীত হন।
সামরিক জীবন
১৯৬৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। হায়দার পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমী কাকুলে ট্রেনিং করেন এবং কমিশন প্রাপ্তির পর গোলন্দাজ বাহিনীর অফিসার হিসাবে নিয়োজিত থাকেন। পরে তিনি চেরাটে S.S.G. (Special service group) ট্রেনিং-এ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। উল্লেখ্য, চেরাটের এই ট্রেনিংটি ছিল মূলত গেরিলা ট্রেনিং। এখানে ৩৬০ জন অফিসারের মধ্যে বাঙালি ছিলেন মাত্র দুইজন। ট্রেনিং শেষ করার পর মুলতান ক্যাণ্টনমেন্টে তার প্রথম পোস্টিং হয় এবং ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই অবস্থান করেন। তৃতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের একজন ক্যাপ্টেন হিসাবে ১৯৬৯ সালের শেষে অথবা ১৯৭০ সালের প্রথম দিকে এ. টি.এম হায়দারকে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়োগ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে তাকে পুনরায় বদলি করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ১৫/২০ দিন পর তাকে আবার কুমিল্লায় নিয়োগ দেয়া হয়
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ
বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সেনাবাহিনীর ১ম কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের কর্মকর্তা হায়দার কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে ২৬ মার্চ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং শুরু থেকেই ২নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ এর সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মেলাঘরে অবস্থিত প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে সকল মুক্তিযোদ্ধাকে কমান্ডো, বিস্ফোরক ও গেরিলা ট্রেনিং সহ হায়দার মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ গ্রহণ করাতেন। মেলাঘরে হায়দার প্রথম একটা স্টুডেন্ট কোম্পানি গঠন করেন। এই কোম্পানিকে তিনিই ট্রেনিং প্রদান করতেন। কিশোরগঞ্জ -ময়মনসিংহ মহাসড়কের উপর তারের ঘাটপুল ও মুসল্লি রেলপুল, ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় ফেনিতে অবস্থিত বড়পুল ধবংসসহ একাধিক অপারেশনের নেতৃত্ব দেন মেজর হায়দার। অক্টোবরের ৭ তারিখে খালেদ মোশাররফ নিয়মিত ব্রিগেড কে' ফোর্সের কমান্ড গ্রহণ করলে তিনি সেক্টর অধিনায়কত্ব লাভ করেন । ১৬ ই ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তিনি উপস্থিত ছিলেন । ঐদিন প্রথম ঢাকা বেতারে ও টিভি থেকে ঘোষণাপাঠ করেন -"আমি মেজর হায়দার বলছি -মুক্তিবাহিনীর প্রতি নির্দেশ " । গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে তাকে বীর উত্তম উপাধীতে ভুষিত করেন ।
এ.টি.এম. হায়দারের ছোট বোন ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম ও একমাত্র ছোট ভাই এ.টি.এম সফদার (জিতু) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এ.টি.এম সফদার ভারতের মেলাঘরে অবস্থিত ট্রেনিং ক্যাম্প থেকে প্রশিক্ষণ নেন এবং শালদানদী এলাকায় বিভিন্নযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ভারতের আগরতলাস্থ ৯২ বি. এস. এফ. ক্যাম্পের সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধ বিষয়ক যোগাযোগ ও খবরাখবর (অফিসিয়াল) আদান-প্রদান করতেন। ক্যাপ্টেন সেতারা বেগম বিশ্রামগঞ্জে বাংলাদেশ হাসপাতালে কাজ করতেন। পাঁচশত বেডের এই হাসপাতালে তিনি একজন কমান্ডিং অফিসার হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। হাসপাতালটি সম্পূর্ণভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত ছিল। ১৪ ডিসেম্বর তিনি সেক্টর ২ এবং এর রাজনৈতিক উপদেষ্টার, আর কে চৌধুরীর সাথে বাংলাদেশে ফিরে আসেন। জনতা তাকে নিয়ে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় আনন্দিত করে, তাদের কে মাথায় তুলে। তিনি মুক্তিযুদ্ধে বীর প্রতীক খেতাব পান ।
স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে
স্বাধীন দেশে মেজর হায়দার কুমিল্লা সেনানিবাসে ১৩ ইস্টবেঙ্গল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি লেফটেন্যান্ট কর্ণেল পদে উন্নীত হন ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে ৮ম বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। ১৯৭৫ সালের নভেম্বরে পিতার জরুরি টেলিগ্রাম পেয়ে ঢাকায় আসেন এবং যুদ্ধকালীন সহযোদ্ধা জেনারেল খালেদ মোশাররফের সাথে সাক্ষাৎ করতে যান।
মৃত্যু
১৯৭৫ সালের ৭ই নভেম্বর আবু তাহেরের নেতৃত্বে পাল্টা অভ্যুত্থানে (সিপাহি বিপ্লব) তিনি নিহত হন। ১১ই নভেম্বর, ১৯৭৫ রোজ মঙ্গলবার কিশোরগঞ্জের খড়মপট্টি এলাকায় সমাহিত করা হয়।
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.