উইলিয়াম শেকসপিয়রের যৌনতা একটি বহুল বিতর্কিত বিষয়। জানা যায়, শেকসপিয়র জনৈকা অ্যানি হ্যাথাওয়েকে বিবাহ করেছিলেন এবং তাদের তিনটি সন্তানও হয়েছিল। কিন্তু গবেষকদের অনুমান, এর পাশাপাশি একাধিক নারীর সঙ্গে শেকসপিয়রের প্রণয়ঘটিত সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এমনকি পুরুষদের প্রতিও যৌন আকর্ষণ বোধ করতেন শেকসপিয়র। তবে তার ব্যক্তিগত জীবনী সংক্রান্ত প্রত্যক্ষ ও নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণের স্বল্পতার কারণে এই তত্ত্ব প্রকৃতিগতভাবে একান্তই আনুমানিক। কিছু পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণ এবং তাঁর সনেটের ব্যাখ্যা থেকে কৃত সিদ্ধান্তই এই তত্ত্বের উৎস। পাঠক ও গবেষক মহলে শেকসপিয়রের একাধিক প্রণয়িনী থাকার বিষয়টি বহুচর্চিত। তেমনি শেকসপিয়রের যৌনচেতনায় অ-বিষমকামী উপাদান তাকে যে সাংস্কৃতিক বিশিষ্টতা দান করেছে তাও যথেষ্ট বিতর্কিত। যাই হোক, প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী উইলিয়াম শেকসপিয়র ছিলেন উভকামী।[1]
শেকসপিয়রের বৈবাহিক জীবন
মাত্র আঠারো বছর বয়সে অ্যানি হ্যাথাওয়েকে বিবাহ করেছিলেন শেকসপিয়র। হ্যাথাওয়ের বয়স তখন ২৭ বছর। ১৫৮২ সালের ২৭ নভেম্বর ডায়োসিস অফ ওরসেস্টরের কনসিস্টরি কোর্ট একটি বিবাহ অণুজ্ঞাপত্র জারি করে। বিবাহে কোনো দেনাপাওনাই বাকি নেই – এই মর্মে পরদিনই একটি বন্ড প্রকাশ করেন হ্যাথাওয়ের দুই প্রতিবেশী।[2] নববিবাহিত দম্পতি অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে বিবাহ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। কারণ ওরসেস্টর চান্সেলর একবার মাত্র বিবাহ ঘোষণাপত্রটি পাঠ করার অনুমতি দেন। সাধারণত এই ঘোষণা তিন বার পাঠ করা হত।[3][4][5] এই ব্যস্ততার কারণ সম্ভবত হ্যাথাওয়ের গর্ভাবস্থা। বিবাহের ছয় মাস পরেই তিনি কন্যাসন্তান সুসানার জন্ম দেন।[6] এর প্রায় দুই বছর পরে জন্ম হয় যমজ সন্তান পুত্র হ্যামলেট ও কন্যা জুডিথের।[7]
সম্ভবত প্রথম দিকে হ্যাথাওয়েকে ভালবাসতেন শেকসপিয়র। তার এক সনেটের (সনেট ১৪৫) আদি সংযোজনের একটি পাঠে তিনি অ্যানির নামোল্লেখ করে তাকে তার জীবনদাত্রী বলে উল্লেখ করেছেন। (পঙ্ক্তি 'I hate from hate away she threw/And saved my life, saying "not you."')।[8] যদিও বিবাহের তিন বছর পরেই পরিবার-পরিজনদের ত্যাগ করে তিনি চলে আসেন লন্ডনে। এর সম্ভাব্য কারণ, নিজেকে হ্যাথাওয়ে কর্তৃক আবদ্ধ মনে করতে শুরু করেছিলেন।[9] অপর একটি প্রমাণ এই যে, তাদের দুজনকেই পার্শ্ববর্তী অথচ পৃথক সমাধিস্থলে সমাহিত করা হয়। উইলে স্ত্রীকে ‘আসবাব সহ দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শয্যাটি’ ('the second best bed with the furniture') ছাড়া কিছুই দিয়ে যাননি শেকসপিয়র। এই দানকে কেউ কেউ সামান্য দান মনে করলেও ঐতিহাসিকদের মতে ‘দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শয্যাটি’ আসলে বিবাহশয্যা। কারণ শ্রেষ্ঠ শয্যাটি অতিথিদের সেবায় ব্যবহৃত হত।[10] ক্যারোল অ্যান ডাফির 'অ্যানি হ্যাথওয়ে' নামক কবিতাটি এই তত্ত্বের সমর্থনে রচিত। এই কবিতায় বর্ণিত হয়েছে কেমন করে শেকসপিয়র ও তার স্ত্রীর কাছে এই ‘দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ শয্যাটি’ হয়ে উঠেছে ‘সুতোয় গ্রথীত হতে থাকা বন, দুর্গের বিশ্ব’ ('a spinning world of forests, castles');আর ‘অন্য শয্যাটিতে, শ্রেষ্ঠ শয্যাটিতে আমাদের অতিথিরা ঝিমোন, সেখানে লালার মতো ঝরে তাদের গদ্য’ ('In the other bed, the best, our guests dozed on, dribbling their prose')। অ্যানির ভাইয়ের সম্পত্তির তালিকায় একটি শয্যার উল্লেখ ছিল না। এটি তার পিতার উইল সংক্রান্ত একটি বিবাদের ফলে বাদ দেওয়া হয়। এর থেকে অণুমিত হয় শয্যাটি ছিল হ্যাথাওয়ে পরিবারের পারিবারিক সম্পত্তি। এটি ফিরিয়ে দেওয়ারই কথা ছিল।[11] সমসাময়িক আইন অনুসারে, কোনো ব্যক্তির বিধবা পত্নী তার স্বামীর সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশের উত্তরাধিকারিণী ছিলেন। এই কারণেই শেকসপিয়র তার উইলে নিজের স্ত্রীকে নির্দিষ্ট করে কিছু দিয়ে যাননি।[11]
সম্ভাব্য নারীঘটিত প্রণয়
লন্ডনে বসবাসকালে শেকসপিয়রের সঙ্গে একাধিক নারীর প্রণয়সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। আইনের ছাত্র জনৈক জন ম্যানিংহ্যাম তার ডায়েরিতে লেখেন যে রিচার্ড দ্য থার্ড মঞ্চায়নের সময় শেকসপিয়রের সঙ্গে এক নারীর স্বল্পকালীন প্রণয়সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল।[12]
Upon a time when Burbage played Richard the Third there was a citizen grew so far in liking with him, that before she went from the play she appointed him to come that night unto her by the name of Richard the Third. Shakespeare, overhearing their conclusion, went before, was entertained and at his game ere Burbage came. Then, message being brought that Richard the Third was at the door, Shakespeare caused return to be made that William the Conqueror was before Richard the Third.[13]
সমসাময়িক ব্যক্তিদের রচনা থাকে শেকসপিয়রের যে অল্প কয়েকটি বর্ণনা পাওয়া যায়, এটি তার মধ্যে অন্যতম। তবে এর প্রামাণিকতা নিয়ে গবেষকরা নিঃসন্দেহ নন। [14] তবুও এই বর্ণনা অনুসারে বলা যায় যে তার অন্তত এক জন সমসাময়িক তাকে বিষমকামী মনে করতেন। আর এও জানা যায় যে ‘মাঝে মাঝে বিবাহ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গের ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিলেন না’ ('averse to an occasional infidelity to his marriage vows') শেকসপিয়র।[15]
শেকসপিয়রের ছাব্বিশটি সনেট তার নারীঘটিত প্রণয়ের অন্যতম প্রমাণ। এই প্রেমের কবিতাগুলি তথাকথিত কোনো ডার্ক লেডির উদ্দেশ্যে রচিত।
সম্ভাব্য সমপ্রেম
শেকসপিয়রের সনেটগুলিকে তার উভকামিতার অন্যতম প্রমাণ রূপে ধরা হয়। সম্ভবত তার অনুমতি ছাড়াই ১৬০৯ সালে এই সনেটগুলি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল।[16] এর মধ্যে একশো ছাব্বিশটি সনেট 'ফেয়ার লর্ড' বা 'ফেয়ার ইউথ' নামে সম্ভাষিত কোনো যুবকের উদ্দেশ্যে রচিত। কবিতাগুলি উৎসর্গিত হয়েছে জনৈক 'Mr W.H.'-এর উদ্দেশ্যে। মনে করা হয়, ইনিই কবিতায় উল্লিখিত সেই যুবক।[17] এই ব্যক্তি ঐতিহাসিক হলে এঁর পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে যায়। এই নামের দুই সম্ভাব্য জনপ্রিয় দাবিদার হলেন শেকসপিয়রের দুই পৃষ্ঠপোষক, হেনরি রিওথিসলি, সাউদাম্পটনের তৃতীয় আর্ল এবং উইলিয়াম হারবার্ট, পেমব্রোকের তৃতীয় আর্ল।ই দুজনেই তাদের যৌবনে সুদর্শন ছিলেন।[18]
কামকেলি বা শারীরিক কামচেতনার একমাত্র স্পষ্ট উল্লেখ মেলে ডার্ক লেডি সনেটগুলি। এখানে স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে কবি ও ডার্ক লেডি দুই প্রণয়ী। তবে ফেয়ার লর্ডের উদ্দেশ্যে সম্ভাষিত সনেটগুলির একাধিক পঙক্তিতেও উক্ত যুবকের প্রতি যৌন আকর্ষণের ভাব প্রকাশিত হয়েছে।[19] সনেট ১৩-এ তাকে বলা হয়েছে ‘প্রিয় হে আমার’ ('dear my love')। সনেট ১৫-এ কবি তার প্রেমে সময়ের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন ('war with Time for love of you.')। সনেট ১৮-এ কবি জিজ্ঞাসা করেছেন, তোমার তুলনা কি বসন্তের দিন?/তুমি যে আরও সুন্দর, আরও মধুর’ ('Shall I compare thee to a summer’s day?/Thou art more lovelঊy and more temperate')। সনেট ২০-তে কবি সেই যুবককে বর্ণনা করেছেন ‘আমার প্রেমের রমণীপ্রভু’ ('master-mistress of my passion')। এই কবিতাগুলিতে রয়েছে বিনিদ্র রজনী, যুবকের জন্য বিরহবেদনা ও ঈর্ষার কথা। আর আছে সেই যুবকের সৌন্দর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা। সনেট ২০-তে কবি উক্ত যুবককে এমন এক নারীর সঙ্গে তুলনা করেছ জননী প্রকৃতিও যাঁর প্রেমে পড়েছেন। নারী সমকামিতার উভয়সংকটাবস্থা কাটাতে কবি এখানে একটি পুরুষাঙ্গেরও উল্লেখ করেছেন। ('pricked thee out for women's pleasure')। লিখেছেন, ‘আমার সুখের জন্য কিছুই না’ (to my purpose nothing')। বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে স্যামুয়েল শেওনবম বলেন, ‘এটি বিষমকামীতার জয়গানকারীদের পক্ষে সর্বাপেক্ষা দুর্ভাগ্যজনক’ ('worse luck for [the] heterosexual celebrant')।[17] আবার সনেট ৫২-এর মতো কোনো কোনো সনেটে যৌন কৌতুক বেশ প্রকট: 'So is the time that keeps you as my chest, Or as the wardrobe which the robe doth hide, To make some special instant special blest, By new unfolding his imprisoned pride.' সনেট ২০-তে কবি যুবককে নারীর সঙ্গে রতিক্রিয়া করতে বললেও ভালবাসতে বলেছেন কেবল তাকেই: 'mine be thy love and thy love's use their treasure'।
যদিও কেউ কেউ মনে করেন যে এই পঙক্তিগুলি দৈহিক প্রেমের পরিবর্তে প্লেটোনিক বন্ধুত্বেরই অভিপ্রকাশ। ১৯৬১ সালে পেলিকান সংস্করণের মুখবন্ধে ডগলাস বুশ লিখেছেন: 'Since modern readers are unused to such ardor in masculine friendship and are likely to leap at the notion of homosexuality (a notion sufficiently refuted by the sonnets themselves), we may remember that such an ideal, often exalted above the love of women, could exist in real life, from Montaigne to Sir Thomas Browne, and was conspicuous in Renaissance literature.'[20] বুশ সনেটের প্লেটোনিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে মন্টেনের কথা উল্লেখ করেছেন যিনি ‘অন্যান্য অনৈতিক গ্রিক প্রেমের’ থেকে বন্ধুত্বকে পৃথক করেছিলেন।[21]
অন্য একটি ব্যাখ্যা অনুসারে কবিতাগুলি আত্মজৈবণিক নয়, বরং কল্পকাহিনিমূলক। এগুলি শেকসপিয়রের "নাট্য চরিত্রায়ণ"-এর অন্যতম উদাহরণ। তাই এই সনেটগুলি শেকসপিয়রের নিজের জবানিতে লিখিত নয়।[17][22]
১৬৪০ সালে জন বেনসন সনেটগুলির একটি দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেন। এই সংস্করণে তিনি প্রায় সকল সর্বনামে এমন পরিবর্তন আনেন যে লোকে মনে করে সব কটি সনেটই ডার্ক লেডির উদ্দেশ্যে লিখিত। বেনসনের পরিবর্তিত পাঠটি বহুল পরিচিতি লাভ করে। পরে ১৭৮০ সালে এডমন্ড মেলোন মূলপাঠ অনুযায়ী সনেটগুলি পুনঃপ্রকাশ করেন।[23]
১৭৮০ সালে এই সনেটগুলির রচয়িতার যৌন অভিমুখিতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা শুরু হয়। এই সময়, যুবকের বর্ণনায় শেকসপিয়রের 'master-mistress' কথাটি পড়ে জর্জ স্টিভেনস মন্তব্য করেন, 'it is impossible to read this fulsome panegyrick, addressed to a male object, without an equal mixture of disgust and indignation'.[24] অন্যান্য বিশেষজ্ঞরা আবার তাদের জাতীয় নায়ককে ‘পায়ুকামী’ ('sodomite') রূপে কল্পনা করতে দ্বিধাবোধ করেছেন।
১৮০০ সাল নাগাদ স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ মন্তব্য করেন শেকসপিয়রের প্রেম ছিল ‘বিশুদ্ধ’ ('pure') এবং তার সনেটগুলি ছিল 'not even an allusion to that very worst of all possible vices'। [25] উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ শেকসপিয়রের সনেট সম্পর্কে লেখেন, 'with this key [the Sonnets] Shakespeare unlocked his heart'। প্রত্যুত্তরে রবার্ট ব্রাউনিং তার বিখ্যাত হাউস কবিতায় লেখেন, 'If so, the less Shakespeare he!'[26]। বিংশ শতাব্দীতেও এই বিতর্ক বজায় ছিল। ১৯৪৪ সালে সনেটগুলির ভ্যারিওরাম সংস্করণে একটি পরিশিষ্টে প্রায় চল্লিশজন টীকাকারের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য সংযোজিত হয়।
আরও দেখুন
পাদটীকা
আরও পড়ুন
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.