Loading AI tools
ঊনবিংশ শতাব্দীর বাঙ্গালী কবি ও সাহিত্যিক। উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (৬ মার্চ ১৮১২ - ২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯) ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন বাঙালি কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক। তিনি সংবাদ প্রভাকর (বা 'সম্বাদ প্রভাকর') এর সম্পাদক। কিন্তু ব্যাপকার্থে তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর একজন কবি ও সাহিত্যিক। তিনি বাংলা সাহিত্যের যুগসন্ধিক্ষণের কবি হিসেবে খ্যাত।[2] তাঁর হাত ধরেই বাংলা কবিতা জগৎ মধ্যযুগীয় সীমানা অতিক্রম করে আধুনিকতার পথে পা বাড়িয়েছিল। তিনি "গুপ্ত কবি" নামেও পরিচিত ছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ তাঁর পরবর্তী বহু সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে 'গুরু'পদে বরণ করেন। এছাড়া নানাবিধ পত্র-পত্রিকা সম্পাদনার কাজেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত | |
---|---|
জন্ম | ৬ মার্চ ১৮১২ |
মৃত্যু | ২৩ জানুয়ারি ১৮৫৯ ৪৬) | (বয়স
নাগরিকত্ব | ব্রিটিশ ভারত |
পরিচিতির কারণ | বাঙালি কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিক |
সঙ্গী | দুর্গামণি দেবী রেবা |
তাঁর জন্ম উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার কাঞ্চনপল্লী (বর্তমানে কাঁচড়াপাড়া) গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত বৈদ্য পরিবারে, যা বর্তমান পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। তাঁর প্রপিতামহ নিধিরাম দাশগুপ্ত ছিলেন নামকরা কবিরাজ এবং তার পিতা হরিনারায়ণ দাশগুপ্ত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ছিলেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল শ্রীমতি। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তাঁর পারিবারিক পদবী দাশগুপ্ত পরিবর্তন করে গুপ্ত করেছিলেন। তাঁর বয়স যখন দশ তখন তার মা পরলোকগমন করেন। পিতা ২য় বিয়ে করলে এর পর থেকে তিনি কোলকাতার জোড়াসাঁকোতে মামার বাড়িতে বাস করতে শুরু করেন। মাত্র ১৫ বৎসর বয়সে তার বিয়ে হয় গৌরহরি মল্লিকের কন্যা দুর্গামণি দেবী রেবার সঙ্গে।[3]
তাঁর যখন মাত্র দশ বছর বয়স, তখন হঠাৎই তাঁর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। অকালেই প্রয়াণ ঘটে মা শ্রীমতী দেবীর। মাতৃবিয়োগের পর ঈশ্বরচন্দ্রকে কলকাতায় চলে আসতে হয়। আশ্রয় নেন জোড়াসাঁকোয় মামারবাড়িতে। শৈশবকালে লেখাপড়ার প্রতি অমনোযোগিতার কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশিদূর না অগ্রসর না হলেও, অসাধারণ মেধা ও স্মৃতিশক্তির জোরে ঈশ্বরচন্দ্র নিজ চেষ্টায় বাংলা,সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষা শেখেন এবং বেদান্তদর্শনে যথেষ্ট পারদর্শিতা অর্জন করেন।
সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশের প্রেরণায় এবং বন্ধু যোগেন্দ্রমোহন ঠাকুরের আনুকূল্যে ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তিনি সংবাদ রত্নাবলী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। সংবাদ প্রভাকর ছিল একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা,কিছু দিন বন্ধ থাকার পর পত্রিকাটি ১৮৩৬ সালে পুনরায় চালু হয়। তিনি এটিকে দৈনিকে রূপান্তর করেন ১৮৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে সাপ্তাহিক পাষণ্ড পত্রিকার সঙ্গে সম্পাদক হিসাবে সংযুক্ত। পরবতী বৎসর তিনি সংবাদ সাধুরঞ্জন পত্রিকার দায়িত্বভার পালন করেন। তিনি গ্রাম গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন এবং কবিগান বাঁধতেন। প্রায় বারো বৎসর গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে ঘুরে তিনি প্রাচীন কবিদের তথ্য সংগ্রহ ক'রে জীবনী রচনা করেছেন। [3][4]
আধুনিক বাংলার সমাজ গঠনে সংবাদ প্রভাকরের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরচন্দ্র প্রথমে নব্যবঙ্গ আন্দোলনের বিরুদ্ধে রক্ষণশীলদের পক্ষভুক্ত ছিলেন। তিনি হিন্দু কলেজের শিক্ষাপদ্ধতিরও বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু নবপর্যায়ে সংবাদ প্রভাকর সম্পাদনার সময় থেকে তার মনোভাবের পরিবর্তন হতে থাকে। তিনি দেশের প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দু থিয়ফিলানথ্রফিক সভা এবং তত্ত্ববোধিনী সভায় তিনি বক্তৃতাও করতেন। প্রথম দিকে তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনের বিরোধিতা করে এ বিষয়ে নানা ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করলেও পরে স্ত্রীশিক্ষার সমর্থন, ধর্মসভার বিরোধিতা, দেশের বৈজ্ঞানিক ও বাণিজ্যিক উন্নয়ন প্রচেষ্টা এবং দরিদ্র জনগণের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে উদার মনোভাবের পরিচয় দেন। এমনকি তিনি অক্ষতযোনি বিধবার বিবাহেও আর আপত্তি করেননি।
ঈশ্বরচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যুগসন্ধির কবি হিসেবে পরিচিত, কারণ তিনি সমকালের সামাজিক ও ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করলেও তার ভাষা, ছন্দ ও অলঙ্কার ছিল মধ্যযুগীয়। মঙ্গলকাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্রের সাহিত্যাদর্শ যখন লুপ্ত হয়ে আসছিল, তখন তিনি বিভিন্ন বিষয় অবলম্বনে খণ্ডকবিতা রচনার আদর্শ প্রবর্তন করেন। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপই ছিল তার রচনার বিশেষত্ব। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের এ ভঙ্গি তিনি আয়ত্ত করেছিলেন কবিয়ালদের নিকট থেকে। ব্যঙ্গের মাধ্যমে অনেক গুরু বিষয়ও তিনি সহজভাবে প্রকাশ করতেন।
স্বদেশ ও স্বসমাজের প্রতি ঈশ্বরচন্দ্রের অনুরাগ ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি বাংলা ভাষার উন্নয়নের জন্য যে আন্দোলন করেছেন তা আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি সবসময় ইংরেজি প্রভাব বর্জিত খাঁটি বাংলা শব্দ ব্যবহার করতেন। ভাষা ও ছন্দের ওপর তার বিস্ময়কর অধিকারের প্রমাণ পাওয়া যায় তার বোধেন্দুবিকাশ (১৮৬৩) নাটকে।
ঈশ্বরচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি হলো ভারতচন্দ্র রায়, রামপ্রসাদ সেন, নিধুগুপ্ত, হরু ঠাকুর ও কয়েকজন কবিয়ালের লুপ্তপ্রায় জীবনী উদ্ধার করে প্রকাশ করা। পরবর্তীকালের বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, দীনবন্ধু মিত্র, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ লেখকের জন্য একটি উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করার কৃতিত্বও তার। যদিও ঈশ্বরচন্দ্রের কাব্যরীতি পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে আর অনুসৃত হয়নি, তথাপি এ কথা স্বীকার্য যে, ভবিষ্যৎ বাংলা সাহিত্যের জন্য তার গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আদর্শ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
বাংলা সাহিত্যে তার চিরস্থায়ী আসনলাভ সম্ভব হয়েছে কারণ একদিকে মধ্যযুগের দেবমাহাত্ম্য ব্যঞ্জক বিষয় থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করে তিনি যেমন অনায়াসে 'পাঁঠা', 'আনারস', 'তোপসে মাছ' ইত্যাদি বিষয় অবলম্বনে কবিতা লেখেন; তার কবিতায় উঠে আসে সমসাময়িক রাজনইতিক,সামাজিক ঘটনাবলির চিত্ররূপ তার নিজের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। তৎকালীন কবিওয়ালা দের জিম্মা থেকে বাংলা কবিতাকে তিনি নাগরিক বৈদগ্ধ ও মার্জিত রুচির আলোয় নিয়ে আসেন। সাংবাদিক রূপেও ঊনবিংশ শতকের এই আধুনিক মানুষটি যথাযোগ্য কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন।সাহিত্য অঙ্গনে তার আবির্ভাব মধ্যযুগের শেষ ও আধুনিক যুগের শুরুর পর্যায়ে । বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাকে "খাঁটি বাঙালি কবি" বলে অবহিত করেছেন । তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মঃ রামপ্রসাদ সেন কৃত কালীকীর্তন(১৮৩৩), কবিবর ভারতচন্দ্র রায় ও তার জীবনবৃত্তান্ত(১৮৫৫), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্যসংগ্রহ(১৮৯২) । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাহার স্থান অসাধারণ।
যমক (একই বর্ণসমষ্টি একাধিকবার একাধিক অর্থে প্রয়োগ করা) ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের একটি প্রিয় কাব্যকৌশল। কতগুলো নমুনাঃ
১। অতনু শাসনে তনু তনু অণুদিন (১ম তনু= দেহ, ২য় তনু= কৃশ)
২। ভাবে নাহি ভাবি ভাবি (১ম ভাবি= ভাবনা করি, ২য় ভাবি= ভবিষ্যৎ)
৩। আনা দরে আনা যায় কত আনারস (১ম আনা= টাকার ১/১৬ অংশ, ২য় আনা= আনয়ন করা)
৪। প্রকাশিয়া প্রভাকর শুভ দিন দিন (১ম দিন= দিবস, ২য় দিন= প্রদান করুন)
৫। মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে (১ম ভ্রমে= ভুলে, ২য় ভ্রমে= ভ্রমণ করে)
৬। দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ, নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ (১ম দেহ= প্রদান কর, ২য় দেহ= শরীর)
৭। ওরে ভণ্ড হাতে দণ্ড এ কেমন রোগ।
দণ্ডে দণ্ডে নিজ দণ্ডে দণ্ড কর ভোগ।।
(অর্থঃ দণ্ডে দণ্ডে= সময়ে সময়ে, নিজ দণ্ডে= নিজের ডাণ্ডায়, দণ্ড= শাস্তি)
৮। কয় মাস খাও মাস উদর ভরিয়া।
(অর্থঃ ১ম মাস= ৩০ দিন, ২য় মাস= মাংস)
৯। চিত্রকরে চিত্র করে করে তুলি তুলি।
(অর্থঃ চিত্রকরে = চিত্রকর+ ৭মী বিভক্তি। চিত্র করে = ছবি আঁকে। করে= হাতে। ১ম তুলি = উত্তোলন করে, ২য় তুলি= আঁকার কাঠি)
১০। সেতার অনেক আছে, সে তার ত নাই।
(অর্থঃ সেতার= বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, সে তার= সেই তন্ত্র)
১১। তানপুরা আছে মাত্র, তান পুরা নাই।
(অর্থঃ তানপুরা= বাদ্যযন্ত্রবিশেষ, তান পুরা= সম্পূর্ণ তান)
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.