ইলোরা গুহাসমূহ
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিমি দূরে অবস্থিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ইলোরা ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের আওরঙ্গবাদ শহর থেকে ৩০ কিমি (১৮.৬ মাইল) দূরে অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। রাষ্ট্রকুট রাজবংশ এই নিদর্শনের স্থাপনাগুলো নির্মাণ করেছিল। এখানে রয়েছে প্রচুর স্মৃতিসংবলিত গুহার সারি। এটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান মর্যাদায় ভূষিত হয়েছে।
ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান | |
---|---|
মানদণ্ড | সাংস্কৃতিক: (i)(iii)(vi) |
সূত্র | বি ২৪৩ |
তালিকাভুক্তকরণ | ১৯৮৩ (৭ম সভা) |
ভারতের শিলা কেটে কোনো কিছু তৈরি করার প্রাচীন প্রতিরূপ স্থাপত্যটি এখানে অণুসৃত হয়েছে। এখানে মোট ৩৪টি গুহা রয়েছে যেগুলো চরনন্দ্রী পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। গুহাগুলোতে হিন্দু, বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মন্দিরের স্বাক্ষর রয়েছে। ৫ম থেকে ১১ম শতাব্দীর মধ্যে এই ধর্মীয় স্থাপনাগুলো নির্মিত হয়েছিল। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের ১২টি, হিন্দু ধর্মের ১৭টি এবং জৈন ধর্মের ৫টি মন্দির রয়েছে। সব ধর্মের উপাসনালয়ের এই সহাবস্থান সে যুগের ভারতবর্ষে ধর্মীয় সম্প্রীতির নিদর্শন বহন করে।
ইলোরা–কে ভেলুরা অথবা এলুরা বলা হয়। এটি প্রাচীন এলাপুরা নামের বিকৃত শব্দ[1]
ইলোরা গুহা মন্দির কালাচুরি, চালুক্য ও রাষ্ট্রকুট শাসনামলে তৈরী হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন মন্দিরের জন্য বিখ্যাত। নবম শতাব্দীতে রাষ্ট্রকুটের শাসনামলে তৈরী হয় জগন্নাথ সভা (পাঁচটি জৈন মন্দিরের সমষ্টি)[2]
এই গুহাসমূহ খ্রিষ্টাব্দ ৫ম-৭ম শতাব্দীতে স্থাপিত হয়। ধারণা করা হয় যে, বৌদ্ধ গুহাসমূহ প্রাথমিক স্থাপনারগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। প্রথম পর্যায়ে ১-৫ নং গুহা (৪০০-৬০০ খ্রিষ্টাব্দ) এবং পরবর্তী পর্যায়ে ৬-১২ নং গুহা (মধ্য ৭ম-মধ্য ৮ম খ্রিষ্টাব্দ)। কিন্তু বর্তমানে আধুনিক বিশেষজ্ঞদের কাছে এটা নিশ্চিত যে, হিন্দুগুহা ( ২৭, ২৯, ২১, ২৮, ১৯, ২৬, ২০, ১৭ এবং ১৪ নং. গুহা) এর আগে তৈরী। সর্বপ্রথম স্থাপিত বৌদ্ধগুহা ৬ নং গুহা। ডান পাশের ৫, ২, ৩, ৫ এবং ৪, ৭, ৮, ১০ ও ৯ নং. ব্লক। আর সর্বশেষ স্থাপিত গুহা হল ১১ ও ১২ নং. গুহা। সকল বৌদ্ধগুহা স্থাপিত হয় ৬৩০-৭০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।[3]
এই বিশাল স্থাপনাটি বেশিরভাগ বিহার ও মঠের সমন্বয়ে গঠিত। এর মধ্যে বড়ো, পাহাড়ের গায়ে খোদাইকৃত বহুতল ভবন (বাসস্থান, শোবার ঘর, রান্নাঘর এবং অন্যান্য কক্ষ) বিদ্যমান। এই স্থাপনার কিছু গুহাতে পাহাড়ের গায়ে খোদাইকৃত গৌতম বুদ্ধ, বোধিসত্ত্ব ও পন্ডিতদের প্রতিমাসংবলিত মন্দির বিদ্যমান।[4]
সবচেয়ে বিখ্যাত বৌদ্ধগুহা হল ১০ নং গুহা, এটি চৈত্য হল (চন্দরশালা) অথবা বিশ্বকর্মা গুহা, যা “কারপেন্টার’স কেভ” ('Carpenter's Cave') নামে সর্বাধিক পরিচিত। এই গুহাটিতে অনেকটা গির্জার মত একটি বিশাল হল বিদ্যমান যার নাম চৈত্য, যার ছাদ এমনভাবে খোদাইকৃত যে দেখতে অনেকটা কাঠের বিমের মত। এই গুহার ঠিক মধ্যখানে একটি ১৫ ফুট লম্বা আসনকৃত বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে। অন্যান্য বৌদ্ধগুহার মধ্যে ১-৯ নং গুহা হল মঠ এবং দো-তাল (১১ নং গুহা) ও তিন-তাল (১২ নং গুহা) তিনতলা।
গুহা-১০ একটি বিহার যা আটটি ক্ষুদ্র কক্ষবিশিষ্ট। যার চারটি ক্ষুদ্র কক্ষ সামনের দেয়ালের সাথে লাগানো বাকি চারটি ক্ষুদ্র কক্ষ পিছনের দেয়ালের সাথে লাগানো। এই গুহার সামনে একটি ক্ষুদ্র কক্ষসহ খোদাইকৃত স্তম্ভ আছে।[3] সম্ভবত এই গুহাটি অন্যান্য বিহারের সরবরাহকৃত খাদ্যভান্ডার হিসেবে ব্যবহৃত হত।
বৌদ্ধগুহাসমূহের মধ্যে বিশ্বকর্মা একমাত্র চৈত্যগৃহ। এই গুহা স্থানীয়ভাবে বিশ্বকর্মা বা সুতার কা ঝপদা (Sutar ka jhopda/ carpenter's hut) নামে ডাকা হয়। এই গুহার নকশা দেখতে অনেকটা অজন্তা গুহাসমূহের মন্দিরের ১৯ ও ২৬ নং গুহার মত। ৭০০ খ্রিষ্টাব্দতে এই গুহা স্থাপিত হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। চৈত্যগুহায় একসময় একটি বড়ো দেয়াল ছিল, যা বর্তমানে নেই। এই গুহার প্রধান হল একটি চক্রাকারে তৈরী এবং এর চারপাশে অষ্টভুজাকৃতির ২৮ স্তম্ভ বিদ্যমান।
হিন্দুগুহাসমূহ স্থাপিত হয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে অষ্টম শতাব্দীর শেষ সময়ের মধ্যে। প্রাথমিক গুহাসমূহ (১৭-২৯ নাম্বার গুহা) তৈরী হয় কালাচুরির শাসনামলে। সর্বপ্রথম নির্মাণ করা হয় ২৮, ২৭ ও ১৯ নাম্বার গুহা।[5] এই গুহাগুলো নির্মাণ করা হয় প্রাথমিক পর্যায়ে নির্মিত ২৯ ও ২১ নাম্বার গুহার নির্মাণকৌশল অবলম্বন করে। ১৪, ১৫ ও ১৬ নাম্বার গুহা তৈরী হয় রাষ্ট্রকূটের শাসনামলে।[5] সকল স্থাপনা বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ও সুচারু দক্ষতার পরিচায়ক। কিছু কিছু স্থাপনা এতটাই জটিল যে এর নির্মাণকাজ সমাপ্ত করতে কয়েক বংশপরম্পরা পরিকল্পনা ও পরিচালনার প্রয়োজন হয়েছিল।
|
|
|
১৬ নাম্বার গুহা, যা কৈলাশ অথবা কৈলাশনাথ নামেও পরিচিত, যা অপ্রতিদ্বন্দ্বীভাবে ইলোরার কেন্দ্র। এর ডিজাইনের জন্য একে কৈলাশ পর্বত নামে ডাকা হয়, যা শিবের বাসস্থান, দেখতে অনেকটা বহুতল মন্দিরের মত কিন্তু এটি একটিমাত্র পাথরকে কেটে তৈরী করা হয়েছে। এর আয়তন এথেন্সের পার্থেনন এর দ্বিগুণ।[6] প্রধানত এই মন্দিরটি সাদা আস্তর-দেওয়া যাতে এর সাদৃশ্য কৈলাশ পর্বতের সাথে বজায় থাকে। এর আশেপাশের এলাকায় তিনটি স্থাপনা দেখা যায়। সকল শিবমন্দিরের ঐতিহ্য অনুসারে প্রধান মন্দিরের সম্মুখভাগে পবিত্র ষাঁড় “নন্দী”–র ছবি আছে।
প্রধান মন্দির নন্দী মন্ডপ-এ লিঙাম অবস্থিত। নন্দী মন্ডপ ১৬ টি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে আছে যার উচ্চতা ২৯.৩ মি.। নন্দী মন্ডপে একটি বিশাল আকৃতির পাথরের তৈরী হাতি বিদ্যমান। একটি জীবন্ত পাথরের সেতু দ্বারা নন্দী মন্ডপ ও শিব মন্দিরের যোগাযোগ সাধিত হয়েছে। এই স্থাপনাটি তৎকালীন শিল্পীদের প্রতিভার সাক্ষর বহন করে। এই মন্দির তৈরী হয় ২,০০,০০০ টন পাথর কেটে, যার জন্য সময় লেগেছিল ১০০ বছর।
দশাবতার (১৫ নং. গুহা) প্রাথমিকভাবে ছিল বৌদ্ধমন্দির। এই মন্দিরটির গঠনগত দিক থেকে ১১ ও ১২ নং গুহার সাথে সাদৃশ্য আছে। দেয়ালের খিলান থেকে মেঝের উপরের অংশের একটি বিশাল স্থাপত্যকলা বিদ্যমান যা বিভিন্ন দৃশ্য দিয়ে সাজানো। এই দৃশ্যের মধ্যে বিষ্ণুর দশাবতার-চেহারা অন্তর্ভুক্ত আছে।
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য হিন্দুমন্দিরগুলো হল রামেশ্বর (২১ নং গুহা), যার প্রবেশদ্বারের সম্মুখে গঙ্গা ও যমুনা মূর্তি খচিত। ধুমুর লিনা (২৯ নং গুহা) যা দেখতে অনেকটা মুম্বাইয়ের নিকটে অবস্থিত এলিফ্যান্ট দ্বীপের গুহার মত। অপর দুইটি মন্দির হল, রাভন কি খাই (১৪ নং গুহা) এবং নীলকণ্ঠ (২২ নং গুহা) যেখানে অনেক স্থাপত্যের নিদর্শন বিদ্যমান। অন্যান্য হিন্দুগুহাগুলো হল : কুম্ভারব্দা (২৫ নং গুহা) এবং গোপেলিনা (২৭ নং গুহা), এতে তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন নেই।
ইলোরাতে মোট পাঁচটি জৈনগুহা আছে যা খ্রিষ্টীয় নবম থকে দশম শতাব্দীর মধ্যে স্থাপিত। এর সবগুলো গুহা দিগম্বরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত।[7] জৈনগুহাগুলো জৈন দার্শনিক ও ঐতিহ্যের ধারক। এই গুহাগুলো কঠোর তপস্যার অনুভূতির প্রতিফলন ঘটায়। কিন্তু এসব এখন অন্যান্য গুহার তুলনায় তেমন বৃহৎ নয়। কিন্তু এসব গুহা বিভিন্ন শিল্পকলার পরিচয় বহন করে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জৈনমন্দিরগুলো হল : ছো্টো কৈলাশ (৩০ নং গুহা), ইন্দ্রসভা (৩২ নং গুহা) এবং জগন্নাথসভা (৩৩ নং গুহা)।[8] ৩১ নং গুহাও জৈনগুহা কিন্তু এটি একটি অসমাপ্ত চার স্তম্ভবিশিষ্ট হল এবং একটি মন্দিরের সমন্বয়ে গঠিত। ৩৪ নং গুহাটি আয়তনে ছোটো যা ৩৩ নং গুহার বামদিকে অবস্থিত। অন্যান্য ভক্তিমূলক খোদাইচিহ্ন, একটি স্থান যার নাম সামভতস্বর্ণ যা ইলোরায় বিদ্যমান। সামভতস্বর্ণ জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি বিশেষ স্থান।[9]
ইন্দ্রসভা (৩২ নং গুহা) দ্বীতলবিশিষ্ট গুহা যাতে একটিমাত্র পাথর কেটে তৈরী মন্দির বিদ্যমান। এর ছাদের দেয়ালে অপূর্ব সুন্দর করে কাটা পদ্মফুল বিদ্যমান।
অন্যান্য জৈনগুহাগুলোও জটিল শিল্পকলায় পরিপূর্ণ। অনেক স্থাপনার ছাদ খুবই উচ্চমানের ছবিসংবলিত, যার অনেকগুলো অংশ এখনো বিদ্যমান।
ইলোরা ওয়েস্টার্ন ঘাটের সমতল ভূমি দখল করে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন প্রাচীন আগ্নেয়গিরি কর্মকান্ডের ফলে এই এলাকায় বিভিন্ন স্তরে গঠিত, যা ডেকান ফাঁদ (Deccan Traps) নামে পরিচিত। ক্রেটাচিয়াসের সময় একটি আগ্নেয়গিরি ইলোরা দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গঠিত হয়েছিল।[10]
ইলোরায় খ্রিষ্টাব্দ ষষ্ঠ শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর অনেক খোদাইচিহ্ন বিদ্যমান। তাদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল রাষ্ট্রকুট দান্তিদুর্গা (৭৫৩-৭৫৭ খ্রিষ্টাব্দ) যা ১৫ নং গুহার মন্ডপের পেছনের দেয়ালে খোদাইকৃত। এটি খোদাই করা হয় রাষ্ট্রকুটের বিজয়ানন্দে।[11] কৈলাশ মন্দিরের খোদাইচিহ্নগুলো খ্রিষ্টাব্দ ৯-১৫ শতাব্দীর মধ্যে অঙ্কিত। জৈনগুহার জগন্নাথসভায় তিনটি খোদাইচিহ্ন আছে। পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত পার্সভান্ত মন্দিরে একাদশ শতাব্দীর একটি খোদাইচিহ্ন আছে। মহা কৈলাশ (১৬ নং গুহা) কৃষ্ণা (খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫৭-৮৭ খ্রিষ্টাব্দ) দিগ্বিবিজয়ী এবং দান্তিদুর্গার চাচা তার সম্মানার্থে তৈরী হয়। কার্কা (খ্রিস্টপূর্ব ৮১২-১৩ খ্রিষ্টাব্দ) এর অনুদানে ইলোরার একটি পাহাড়ে মহান স্মৃতিচিহ্ন খোদাইকৃত একটি তামার থালা স্থাপিত হয়।অজন্তা গুহার ন্যায়, ইলোরা গুহাসমূহ কখনো ধ্বংসের সম্মুখীন হয়নি। বিভিন্ন লেখা ও ভ্রমণকাহিনি থেকে পাওয়া যায় যে, ইলোরায় নিয়মিত পরিদর্শন করা হত। তার মধ্যে প্রথমে লেখা পাওয়া যায় আরব ভূতত্ত্ববিদ আল-মাসা'উদি, যা লেখা হয় খ্রিষ্টাব্দ দশম শতাব্দীতে। ১৩৫২ সালে সুলতান হাসাব বাহ্মী, যিনি এই স্থানে কিছুকাল অবস্থান করেন ও পরিদর্শন করেন। অন্যান্যের মধ্যে ফিরিশ্তা, থেভেনট (১৬৩৩-১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দ), নিকালো মানাউচি (১৬৫৩-১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দ), চার্লস ওয়্যার ম্যতালেট (১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ), এবং সেলী (১৮২৪ খ্রিষ্টাব্দ)।[12]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.