শি চিনফিং[টীকা 1] (বানানভেদে শি জিনপিং বা সি চিন পিং[1]; জন্ম: ১৫ জুন, ১৯৫৩) গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রপতি। অধিকন্তু তিনি একাধারে চীনের রাষ্ট্রীয় কেন্দ্রীয় সামরিক পরিষদের প্রধান, চীনের সাম্যবাদী দলের মহাসচিব এবং সাম্যবাদী দলের কেন্দ্রীয় সামরিক পরিষদের চেয়ারম্যান।
শি চিনফিং দীর্ঘকাল যাবত সক্রিয় ও চীনের সাম্যবাদী দলের প্রয়াত নেতা শি চুংশুনের সন্তান। চিনফিং তার জন্মস্থান ফুচিয়েন প্রদেশে রাজনৈতিক জীবনের সূচনা করেন। পরে তিনি পার্শ্ববর্তী চচিয়াং প্রদেশের দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। চিনফিং দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের রাজনীতিতে আসেন পরে সাংহাইয়ের দলীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের মাধ্যমে।
শি চিনফিং দুর্নীতির বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান এবং রাজনৈতিক ও বাজার অর্থনীতির সংস্কার প্রসঙ্গে উদার নীতির জন্য খ্যাত।[2] বর্তমান দায়িত্বসমূহ ও বিশেষ নীতির কারণে তাকে চীনের সাম্যবাদী দলের মহাসচিব মনোনীত করা হয়।[3]
জীবনী
প্রাথমিক জীবন
শি চিনফিং ১৫ জুন ১৯৫৩ তারিখে বেইজিংয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস হনান প্রদেশের তেংচু জেলার শিয়িং শহরে।[4] তিনি উত্তর চীনের শানসি প্রদেশে কমিউনিস্ট গেরিলা আন্দোলনের অন্যতম নেতা, পরবর্তীতে চীনের উপ-প্রধানমন্ত্রী শি জোংশুনের দ্বিতীয় সন্তান। চিনফিংয়ের জন্মগ্রহণের সময়ে জোংশুন কমিউনিস্ট পার্টির প্রপাগান্ডা বিভাগের প্রধান ছিলেন। এবং পরে ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। চিনফিংয়ের ১০ বছর বয়সে তার বাবা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে রাজনৈতিক কোন্দলের শিকার হন এবং প্রতিহিংসাবশত বদলির ফলে হেনান প্রদেশের লুইয়াং শহরের একটি কারখানায় নিযুক্ত হন।[5] ১৯৬৮ সালের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে জোংশুন আবারও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হন ও এবার গ্রেপ্তার হন, যখন চিনফিংয়ের বয়স ১৫। এসময়ে বাবার ছত্রচ্ছায়ার বাইরে আসতে বাধ্য চিনফিং মাও সেতুং-এর ডাউন টু দ্য কান্ট্রিসাইড (গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা) কর্মসূচীতে অংশ নেন ও ১৯৬৯ সালে শানসি প্রদেশের ইয়ানানে ইয়াঞ্চুয়ান শহরে বসবাস করতে যান। তিনি সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির উৎপাদন বিষয়ক উপদলের প্রধান নিযুক্ত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি যখন এই কর্মসূচি থেকে বেরিয়ে আসেন তখন তার বয়স মাত্র ২২ বছর। কর্মসূচিটিতে যোগ দেয়ার অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে চিনফিং এক সাক্ষাৎকারে বলেন[6],
এটি একটি আবেগময় অভিজ্ঞতা ছিল। অংশ নেয়ার সময়ে আমাদের অন্যরকম এক মনোভাব ছিল। পরে যখন সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে আর বাস্তবায়ন করা গেল না, তখন আমরা বুঝলাম আমরা আসলে একটা ঘোরের মাঝে ছিলাম।
চিনফিং ১৯৭৫ সালে রসায়ন প্রকৌশল অধ্যয়নের জন্য চীনের বিখ্যাত কিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৭৯ সালে উত্তীর্ণ হন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুবার পর তিনি তার বাবার রাজনৈতিক অনুসারী, তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় সামরিক পরিষদের মহাসচিব জেঙ্গ বিয়াওর সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বে বহাল ছিলেন। শি চিনফিং ১৯৮৫ সালে মার্কিন কৃষিব্যবস্থা বিষয়ে গবেষণারত একটি চীনা প্রতিনিধি দলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া অঙ্গরাজ্যের মুস্কাটিন শহর ভ্রমণ করেন।[7]
উত্থান
চিনফিং ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট ইউথ লিগে যোগদান করেন এবং ১৯৭৫ সালে সেখান থেকে কমিউনিস্ট পার্টি অফ চায়নায় যোগ দেন। ১৯৮২ সালে দলের একজন সম্পাদক হিসেবে তাকে হাবেই প্রদেশের চেঙ্গডিং জেলায় পাঠানো হয়েছিল। রাজনৈতিক জীবনে চিনফিং চারটি প্রদেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন- শানশি, হুপেই, ফুচিয়েন ও চচিয়াং।
চিনফিং ফুচিয়েন প্রদেশের ফুৎসু পৌর শহর কমিউনিস্ট পার্টির একাধিক পদে বহাল ছিলেন ও ১৯৯০ সালে ফুৎসু দলীয় বিদ্যালয়ের সভাপতি হন। ১৯৯৯ সালে তিনি ফুচিয়েন প্রদেশের ডেপুটি গভর্নর নিযুক্ত হন, এবং পরের বছর গভর্নর ঘোষিত হন। ফুচিয়েনের গভর্নর থাকাকালীন চিনফিং মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেন এবং বিনিয়োগের জন্য তাইওয়ানের উদ্যোক্তাদেরকে আমন্ত্রণ করেন।
২০০০ সালের ফেব্রুয়ারিতে গভর্নর চিনফিং ও প্রদেশের দলীয় সম্পাদক চেন মিঙ্গয়ি বহুল আলোচিত ইয়ানহুয়া কেলেংকারি প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা দিতে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ চার নেতা- তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও মহাসচিব জিয়াং জেমিন, প্রধানমন্ত্রী চু জুংচি, উপ-রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও এবং প্রধান শৃঙ্খলা পরিদর্শক ওয়েই জিয়ানসিঙ্গের দ্বারা গঠিত একটি বোর্ডের সামনে উপস্থিত হন।[8]
২০০২ সালে চিনফিং চচিয়াং প্রদেশের শীর্ষ একাধিক রাজনৈতিক ও সরকারি পদে নিযুক্ত হন। এ বছরই ভারপ্রাপ্ত গভর্নর থাকা অবস্থায় তিনি অর্থনৈতিকভাবে সফল এই উপকূলীয় প্রদেশটির কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান নিযুক্ত হন।
শি চিনফিং ১৫তম সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির একজন বিকল্প সদস্য হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি ১৬তম সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন এবং এর মধ্য দিয়ে চীনের কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বে তার প্রবেশ ঘটে।
চচিয়াং প্রদেশ, যেটি অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত সফল ও অধুনা চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়, সেখানকার শীর্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে চিনফিং সেখানে স্বাস্থ্যকর অর্থনৈতিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। তার দায়িত্বপালনকালে প্রাদেশিক অর্থনীতিতে ১৪ শতাংশেরও বেশি হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। চচিয়াংয়ে দায়িত্ব পালনকালে চিনফিং দুর্নীতিবিরোধী কঠোর ও অকপট নেতা হিসেবে একই সাথে জাতীয় গণমাধ্যম ও কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের মনযোগে আসেন।
২০০৬ সালে একটি অর্থ কেলেংকারির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে সাংহাই কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান চেন লিয়াঙ্গয়ুকে বহিষ্কার করা হলে তার জায়গায় পরের বছর চিনফিংকে সেখানে পাঠানো হয়। সাংহাইর দলীয় প্রধান, যেটি চীনের রাজনৈতিক কাঠামোতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচিত হয়, এখানে শি চিনফিংয়ের নিয়োগের ফলে তার উপর কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় শীর্ষ পর্যায়ের আস্থার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠে। সাংহাইতে দায়িত্ব পালনকালে চিনফিং সকল বিতর্ক এড়িয়ে সতর্কভাবে দায়িত্ব পালন করেন। চিনফিংয়ের রাজনৈতিক জীবনের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এত গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্ব পালন করা অবস্থায় তিনি কখনও কোন রাজনৈতিক বিতর্ক, কেলেঙ্কারি ও কোন্দলের মুখে পড়েননি।
কার্যকরী কমিটিতে যোগদান ও উপ-রাষ্ট্রপতিত্ব
সাংহাই কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক পদে নিয়োগের মধ্য দিয়েই এটি স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে শি চিনফিং চীনের পঞ্চম প্রজন্মের নেতৃত্বের অংশ হতে যাচ্ছেন। ২০০৭ সালের অক্টোবরে সিপিসির ১৭তম কংগ্রেসে ৯-সদস্য বিশিষ্ট পলিটব্যুরো কার্যকরী কমিটিতে তার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এটি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠে। চিনফিং পলিটব্যুরোতে লি কেকিয়াঙ্গের উপরে স্থান লাভ করেন এবং এর মধ্য দিয়ে এটা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়- শি চিনফিংই হতে যাচ্ছেন চীনের পরবর্তী প্যারামাউন্ট লিডার বা ‘একচ্ছত্র নেতা’। একই সময়ে চিনফিং কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় সচিবালয়ের প্রধান নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালের মার্চে সিপিসির ১১তম জাতীয় গণসম্মেলনে চিনফিং গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হলে ‘একচ্ছত্র নেতা’ হওয়ার ক্ষেত্রে তার সম্ভাবনা আরও জোরদার হয়।[9] ধারণা করা হয়ে থাকে, চিনফিংয়ের উজ্জ্বল সম্ভাবনার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে তার সাথে বর্তমান রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও ও উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে তার পূর্বসূরী জেং কিংহঙ্গের, অর্থাৎ চীনা রাজনীতির বহুমুখী নেতৃত্বের সুসম্পর্ক।
কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে আসীন হওয়ার পর থেকে চিনফিং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল হয়েছেন বা দায়িত্ব লাভ করেছেন। তিনি ২০০৮ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আয়োজক দলের নেতৃত্ব দেন। একই সাথে তিনি হংকং ও ম্যাকাও বিষয়ক দপ্তরেরও দায়িত্বে ছিলেন। তাকে কেন্দ্রীয় দলীয় বিদ্যালয়, যেখান থেকে সিপিসির আদর্শগত শিক্ষা দেয়া হয় এবং ক্যাডাররা প্রশিক্ষণ লাভ করে, এই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০০৮ সালে সিচুয়ান ভূমিকম্পের পর তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে শাংসি ও গানসু প্রদেশ পরিদর্শন করেন। উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে চিনফিং তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে ২০০৮ সালের মে মাসে মাত্র ৮ দিনের মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, সউদি আরব, কাতার ও ইয়েমেন ভ্রমণ করেন। গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক শেষ হওয়ার পর চিনফিংয়ের উপর গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপনের মহোৎসব আয়োজনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।[10]
এছাড়াও অনানুষ্ঠানিকভাবে প্রচারিত আছে, শি চিনফিং ৬৫২১ প্রজেক্ট নামে সিপিসির সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি গোপন কমিটির প্রধান ছিলেন, যে কমিটির দায়িত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ চারটি দিবস (গণপ্রজাতন্ত্রের ৬০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, তিব্বত বিদ্রোহের ৫০তম বার্ষিকী, তিয়ানামেন স্কয়ার আন্দোলনের ২০তম বার্ষিকী ও ফালুন গং দমনের ১০ম বার্ষিকী- অনানুষ্ঠানিক প্রজেক্টটি নামকরণ হয়েছে বার্ষিকীগুলোর আদি সংখ্যা থেকে) উপলক্ষে সরকারবিরোধীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।[11]
চীনের শুরুর দিককার প্রসিদ্ধ ও অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদদের সন্তানদের যারা রাজনীতিতে এসেছেন, তাদের মধ্যে শি চিনফিংকে সবচেয়ে সার্থক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর চীনবিষয়ক নীতিনির্ধারক ও প্রতিনিধিদের মধ্যে শি চিনফিংয়ের জনপ্রিয়তা রয়েছে। সিঙ্গাপুরের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লী কুয়ান ইউ চিনফিং সম্পর্কে বলেন, “তিনি একজন চিন্তাশীল মানুষ যিনি রাজনৈতিক জীবনে বহু পরীক্ষা ও পর্যায় পার হয়ে এই অবস্থানে এসেছেন”।[2] ইউ আরও বলেন, “আমি তার রাজনৈতিক সত্তাকে নেলসন ম্যান্ডেলার সাথে এদিক থেকে তুলনা করি, যে তিনি আবেগের দিক থেকে একজন স্থিতিশীল মানুষ যিনি নিজের বিচার বিবেচনাকে ব্যক্তিগত ভোগান্তি বা দুর্ভোগের দ্বারা প্রভাবিত হতে দেন না। এক বাক্যে শি চিনফিং একজন সন্তোষজনক মানুষ।”[12]
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থ মন্ত্রী (সেক্রেটারি অফ ট্রেজারি) হেনরি পলসন চিনফিংকে এভাবে বর্ণনা করেন, “এমন একজন মানুষ যিনি জানেন কীভাবে লক্ষ্যে পৌঁছতে হয়”।[13]
উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিদেশ সফর
২০০৯ সালে যখন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কট তুঙ্গে, তখন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি চীনের উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে শি চিনফিং ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আমেরিকা সফর করেন। তিনি চীনের কূটনৈতিক তৎপরতাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে একাধারে মেক্সিকো, জ্যামাইকা, কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা ও ব্রাজিল সফর করেন। ভেনিজুয়েলা সফরে তার সাথে হুগো চাভেজের বৈঠক হয়।
১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে মেক্সিকো সফরকালে চিনফিং অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনে চীনের ভূমিকা তুলে ধরতে গিয়ে বলেন,[14]
“অর্থনৈতিক সঙ্কট নিরসনে চীনের ভূমিকা ছিল সমগ্র মানবজাতির প্রতি এর অবদানগুলোর মাঝে অন্যতম, যার ফলে বিশ্বব্যাপী ১৩০ কোটি মানুষের ক্ষুধা নিবারণ সম্ভব হয়েছে”।
চীনের বৈদেশিক ও অর্থনৈতিক নীতিমালায় বৈদেশিক হস্তক্ষেপের নিন্দা, যেটি সাধারণত চীনের রাজনীতিতে একটি স্পর্শকাতর বিষয়, এ প্রসঙ্গে চিনফিং সরাসরি মন্তব্য করে বলেন,[15][16]
“কিছু নিষ্কর্মা বিদেশী আছে, যাদের পেট সব সময়ে ভরা থাকে, তারা আর কোন কাজ না পেয়ে শুধু চীনের উপর দায় চাপিয়ে দেয়। এক্ষেত্রে বক্তব্য হচ্ছে- প্রথমত, চীন বিশ্বে বিপ্লব রপ্তানি করছে না; দ্বিতীয়ত, চীন বিশ্বে ক্ষুধা আর দারিদ্র্যও রপ্তানি করছে না; তৃতীয়ত, তোমাদের মাথাব্যথার কারণ সৃষ্টি করার কোন উদ্দেশ্যও চীনের নেই। এরপর আমরা আর কী বলতে পারি?”
তাৎক্ষণিকভাবে এই বক্তব্যটি শুধু স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রচারিত হলেও পরে একে কেন্দ্র করে চীনের ইন্টারনেট মহলে আলোচনার ঝড় উঠে।[17]
দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও শি চিনফিং আরও কিছু দেশ সফর করেছেন। রাজনৈতিক ধারাভাষ্যকাররা মন্তব্য করেন, এগুলো মূলত চীনের আগামী ‘একচ্ছত্র নেতা’ হিসেবে শি চিনফিংয়ের কূটনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করার প্রচেষ্টার অংশ।
২০০৯ সালের অক্টোবরে পাঁচদিনের আন্তর্জাতিক সফরে চিনফিং বেলজিয়াম, জার্মানি, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি ও রোমানিয়া সফর করেন।[18] ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে তিনি জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, কম্বোডিয়া ও মায়ানমার সফর করেন।[19]
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চিনফিং যুক্তরাষ্ট্র, আয়ারল্যান্ড ও তুরস্ক সফর করেন। যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময়ে তিনি হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ও ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে বৈঠিক করেন।[20] জো বাইডেনের ২০১১ সালের চীন সফরের সূত্রে তার সাথে চিনফিংয়ের পূর্ব ঘনিষ্ঠতা ছিল।[21] চিনফিং যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় ক্যালিফোর্নিয়া যান। তিনি আইওয়া রাজ্যের মুস্কাটিন শহরেও যান, যেখানে তিনি ১৯৮৫ সালে একটি কৃষি পরিদর্শন দলের সদস্য হিসেবে এসেছিলেন। তিনি তার তখনকার আতিথ্যদানকারী পরিবারগুলোর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।
রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ
শি চিনফিং ২০০৯ ও ২০১১ সালে টাইম ম্যাগাজিন ঘোষিত বিশ্বের ১০০ জন সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষের তালিকায় ছিলেন।[22] ২০১০ সালে তিনি ব্রিটিশ ম্যাগাজিন নিউ স্টেটসম্যান ঘোষিত ৫০ জন সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষের তালিকায় চতুর্থ স্থানে ছিলেন।[23]
আশা করা হয়েছিল ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে সিপিসির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব পরিবর্তনে শি চিনফিং সামরিক পরিষদে গুরুত্বপূর্ণ পদ লাভ করবেন। কিন্তু তার বদলে অপর এক নেতাকে কেন্দ্রীয় সামরিক পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ঘোষণা করা হলে চিনফিংয়ের রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে কেউ কেউ সংশয় প্রকাশ করেন। চীন বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্লেষক চেং লি মন্তব্য করেন, সামরিক পরিষদে চিনফিংয়ের এই স্থান না পাওয়া প্রমাণ দেয় যে সিপিসির শীর্ষ নেতারা তাদের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্ধারণে আরও বেশি চুলচেরা বিশ্লেষণ চালাচ্ছে।[24] অবশ্য ইতোমধ্যেই চিনফিং সংশয়ের ঊর্ধে আশাবাদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাধর একাধিক পদে আসীন ছিলেন। এছাড়াও ২০১০ সালের অক্টোবরে চিনফিংকে সিপিসির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, ১৯৯৯ সালে যে পদটিতে আসীন ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি হু জিনতাও।[25][26][27][28]
২০১০ সালের শেষ নাগাদ এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায় যে শি চিনফিং ২০১২ ও ২০১৩ সালে যথাক্রমে সিপিসির মহাসচিব ও গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাষ্ট্রপতি হিসেবে হু জিনতাওর স্থলাভিষিক্ত হতে যাচ্ছেন।[29][30]
ব্যক্তিগত জীবন
শি ১৯৮০ সালে কে লিংলিংকে বিয়ে করেন। তিন বছর পর তাদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। ১৯৮৭ সালে চিনফিং বিখ্যাত লোকগায়িকা পেং লিউয়ানকে বিয়ে করেন। উল্লেখ্য বিয়ের সময় পেং লিউয়ান চীনে তার স্বামী শি চিনফিংয়ের চেয়ে অনেক বেশি বিখ্যাত ও পরিচিত মুখ ছিলেন। স্বামী ও স্ত্রীর ভিন্নধারার জীবনের জন্য দীর্ঘ সময়ে তাদেরকে আলাদা থাকতে হয়। শি মিংসে নামে তাদের একটি কন্যা আছে।[31] মিংসে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশুনা শুরু করেন।[32]
শি চিনফিং রসায়ন প্রকৌশল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেছেন।[33]
স্ত্রী পেং লিউয়ান চিনফিংকে একজন কঠোর পরিশ্রমী, পরিমিত ও সাধাসিধে মানুষ হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, “তিনি যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, তখন তার উপস্থিতি কখনওই জানান দেয় না যে একজন এত বড় মাপের রাজনৈতিক নেতা বাড়িতে অবস্থান করছেন। আমার কাছে তিনি শুধুই আমার স্বামী”।[34]
শি চিনফিংয়ের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিচয় আছে, এমন ব্যক্তিদের উদ্ধ্বৃত করে ২০১১ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে, যাতে চিনফিংকে একজন উদ্যোগী, আন্তরিক, সতর্ক, পরিশ্রমী, সাধাসিধে ও মুখচোরা মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। আরও বলা হয়, তিনি একজন বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ যিনি সহজে কোন সমস্যা সমাধান করতে পারেন এবং কখনও উচ্চপদের ভাবগাম্ভীর্যে আবদ্ধ থাকেন না।[35] জানা যায়, শি চিনফিং স্টিভেন স্পিলবার্গের সেভিং প্রাইভেট রায়ান[36] ও মার্টিন স্করসিসের দ্য ডিপার্টেডের ভক্ত। আবার একই সাথে তিনি চীনের স্বাধীন নির্মাতা জিয়া ঝাংকেরও এখনও অনুরাগী।[37]
টীকা
- এই ম্যান্ডারিন চীনা ব্যক্তিনাম বা স্থাননামটির বাংলা প্রতিবর্ণীকরণে উইকিপিডিয়া:বাংলা ভাষায় ম্যান্ডারিন চীনা শব্দের প্রতিবর্ণীকরণ শীর্ষক রচনাশৈলী নিদের্শিকাতে ব্যাখ্যাকৃত নীতিমালা অনুসরণ করা হয়েছে।
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand in your browser!
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.