Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
মুহাম্মদ আলি পাশা আল-মাসউদ ইবনে আগা (উসমানীয় তুর্কি: محمد علی پاشا المسعود بن آغا; আরবি: محمد علي باشا / ALA-LC: Muḥammad ‘Alī Bāshā; আলবেনীয়: Mehmet Ali Pasha; তুর্কি: Kavalalı Mehmet Ali Paşa;[2] ৪ মার্চ ১৭৬৯ – ২ আগস্ট ১৮৪৯) ছিলেন উসমানীয় সেনাবাহিনীর একজন উসমানীয় আলবেনীয় কমান্ডার। তিনি পাশা পদে পদোন্নতি লাভ করেছিলেন এবং নিজেকে মিশর ও সুদানের খেদিভ ঘোষণা করেছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি জাতীয়তাবাদি না হলেও সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তার সংস্কারের ফলে তাকে আধুনিক মিশরের স্থপতি বিবেচনা করা হয়। মিশরের বাইরে তিনি লেভান্টও শাসন করেছেন। তার প্রতিষ্ঠিত মুহাম্মদ আলি রাজবংশ ১৯৫২ সালের বিপ্লবের আগ পর্যন্ত মিশর শাসন করেছে।
মুহাম্মদ আলি পাশা | |
---|---|
মিশর, সুদান, শাম, হেজাজ, মুরিয়া, থাসোস, ক্রিটের আমির | |
রাজত্ব | ১৭ মে ১৮০৫ – ২ মার্চ ১৮৪৮ |
পূর্বসূরি | আহমাদ খুরশিদ পাশা |
উত্তরসূরি | ইবরাহিম পাশা |
জন্ম | ৪ মার্চ ১৭৬৯ কাভালা, মেসিডোনিয়া, রুমেলি এয়ালেত, উসমানীয় সাম্রাজ্য (বর্তমান গ্রীস) |
মৃত্যু | ২ আগস্ট ১৮৪৯ ৮০) রাস এল-তিন প্রাসাদ, আলেক্সান্দ্রিয়া, মিশর এয়ালেত, উসমানীয় সাম্রাজ্য (বর্তমান মিশর) | (বয়স
সমাধি | মুহাম্মদ আলি মসজিদ, কায়রো দুর্গ, মিশর |
স্ত্রীগণ |
|
বংশধর | তেভহিদা ইবরাহিম পাশা তুসুন পাশা ইসমাইল হাতিস সাইদ পাশা হাসান আলি সাদিক বে মুহাম্মদ আবদেল হালিম মুহাম্মদ আলি ফাতমা আল-রুহিয়া জয়নব |
আলবেনীয় | Mehmet Ali Pasha |
আরবি | محمد علي باشا |
তুর্কি | Kavalalı Mehmet Ali Paşa |
রাজবংশ | মুহাম্মদ আলি রাজবংশ |
পিতা | ইবরাহিম আগা |
মাতা | জয়নব |
ধর্ম | ইসলাম[1] |
মুহাম্মদ আলি উসমানীয় রুমেলি এয়ালেতের (বর্তমান গ্রীস) কাভালা শহরে এক আলবেনীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।[3][4][5][6] তার সাক্ষাৎকার নেয়া অনেক ফরাসি, ইংরেজ ও অন্যান্য পশ্চিমা সাংবাদিক এবং তার চেনাপরিচিত লোকজনদের মতে তুর্কি ভাষায় কথা বলতে পারলেও তিনি শুধু আলবেনীয় ভাষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে কথা বলতে পারতেন।[7][8] একটি মতানুযায়ী তার পূর্বপুরুষরা তুর্কি ছিলেন এবং তারা দক্ষিণ-পূর্ব আনাতোলিয়া থেকে অভিবাসী হয়েছিলেন।[9] তবে তার বংশধররা এই মত মানেন না। অন্যান্য ইতিহাসবিদদের মতে তার পরিবার জাতিগতভাবে আলবেনীয় এবং আলবেনিয়া তাদের আদি বাসস্থান।[3][4][5][6][10][11][12][13] তার বাবা ইবরাহিম আগা ও মা জয়নব। মুহাম্মদ আলির অল্প বয়সে তার বাবা মারা যাওয়ার পর তার চাচার কাছে তিনি প্রতিপালিত হন। মুহাম্মদ আলির কঠোর পরিশ্রমের পুরস্কার হিসেবে তার চাচা তাকে কাভালা শহরে কর সংগ্রহের জন্য বুলাকবাশি পদ প্রদান করেছিলেন।
কর সংগ্রহে সাফল্যের পর মুহাম্মদ আলি তার চাচাত ভাই সেরেচেস্ম হালিল আগার অধীনে কাভালা ভলান্টিয়ার কন্টিনজেন্টের সেকেন্ড কমান্ডার পদ লাভ করেছিলেন। নেপলিয়ন বোনাপার্টের ফিরে যাওয়ার পর এই দলকে মিশর পুনরায় অধিকার করার জন্য পাঠানো হয়। তিনি পরে আলি আগার কন্যা এমিন নুসরাতলিকে বিয়ে করেন। ১৮০১ সালে তাদের ইউনিটকে পাঠানো হয়। ১৮০১ সালের বসন্তে আবুকিরে দলটি অবতরণ করে।[14]
ফরাসিরা চলে যাওয়ার পর মিশরে ক্ষমতার শূণ্যতা তৈরী হয়। এসময় মামলুক শক্তি টিকে থাকলেও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। সেসাথে ক্ষমতার প্রশ্নে উসমানীয়দের সাথে মামলুকদের সংঘাত সৃষ্টি হয়।[15] এই দুর্যোগপূর্ণ সময়ে মুহাম্মদ আলি তার প্রতি অনুগত আলবেনীয় সেনাদের ব্যবহার করেন।[16] ১৮০১ সালে তিনি মিশরীয় আরব নেতা উমর মাকরাম ও আল-আজহারের প্রধান ইমামের সাথে মিত্রতা তৈরী করেন। ১৮০১ থেকে ১৮০৫ সালের মধ্যে উসমানীয় ও মামলুক পক্ষের মধ্যে চলা সংঘাতের সময় জনগণের সমর্থনের জন্য মুহাম্মদ আলি সতর্কতার সাথে কাজ করে যান।[17]
১৮০৫ সালে উলামাদের নেতৃত্বে মিশরের একদল গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ওয়ালি হিসেবে আহমাদ খুরশিদ পাশার পরিবর্তে মুহাম্মদ আলিকে নিয়োগের দাবি জানালে উসমানীয়রা তা মেনে নেয়। তবে ১৮০৯ সালে আলি কর্তৃক মাকরাম দামিয়েত্তায় নির্বাসিত হন। আবদুর রহমান আল-জাবারতির মতে মুহাম্মদ আলি ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করছেন এমনটা মাকরাম টের পেয়ে গিয়েছিলেন।[16]
সুলতান তৃতীয় সেলিম মুহাম্মদ আলির ক্ষমতা দখল ঠেকাতে পারেননি। জনগণের সমর্থনপুষ্ট হওয়ায় তিনি ক্ষমতা সংহত করার আগ পর্যন্ত তার বিরোধীদের ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন।
মামলুকরা ছিল মুহাম্মদ আলির সবচেয়ে বড় বাধা। তারা প্রায় ৬০০ বছরের বেশি বছর ধরে মিশর নিয়ন্ত্রণ করছিল এবং সময়ের সাথে সাথে তাদের শাসন মিশরজুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল। মুহাম্মদ আলি মামলুক নেতৃত্ব উৎখাতের পদক্ষেপ নেন। তিনি কায়রো দুর্গে একটি উৎসবে মামলুক নেতাদের দাওয়াত দেন। তার পুত্র তুসুনের আরব উপদ্বীপে অভিযানে যাওয়া উপলক্ষে এই উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। ১৮১১ সালের ১ মার্চ এর আয়োজন করা হয়। মামলুকরা দুর্গে জমায়েত হওয়ার পর মুহাম্মদ আলির সেনারা তাদের ঘিরে ফেলে হত্যা করে।[lower-alpha 1] নেতাদের হত্যার পর মুহাম্মদ আলি তার বাহিনীকে মিশরের বাকি মামলুক শক্তিকে উৎখাতের জন্য নিযুক্ত করেন।
মুহাম্মদ আলি মিশরকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একে তিনি ক্ষয়িষ্ণু উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রাকৃতিক উত্তরসুরি হিসেবে দেখতেন। মিশর নিয়ে তার পরিকল্পনা তিনি নিম্নোক্তভাবে বিবৃত করেছেন:
"আমি এই বিষয়ে ভালোভাবে অবগত যে (উসমানীয়) সাম্রাজ্য দিনের পর দিন ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে ... এর ধ্বংসাবশেষের উপর আমি একটি বিশাল রাজ্য গড়ে তুলব... ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস পর্যন্ত।"[20]
সুলতান তৃতীয় সেলিম ইউরোপীয় রীতিতে উসমানীয় সাম্রাজ্যকে সংস্কার ও আধুনিকায়নের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন যাতে উসমানীয় সাম্রাজ্য প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে। মুহাম্মদ আলিও আধুনিকায়নের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলেন।
একটি শক্তিশালী ইউরোপীয় ধাচের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা মুহাম্মদ আলির লক্ষ্য ছিল।[21] এই উদ্দেশ্যে তিনি মিশরীয় সমাজকে পুনর্গঠন করেন, অর্থনীতি মজবুত করেন, পেশাদার আমলাতন্ত্র গড়ে তোলেন এবং আধুনিক সামরিক বাহিনী গঠন করেন।
মিশরের জন্য রাজস্বের উৎস নিশ্চিত করা ছিল তার প্রথম পদক্ষেপ। এই উদ্দেশ্যে তিনি মিশরের ভূমি জাতীয়করণ করেছিলেন। ফলে রাষ্ট্র সকল উৎপাদনশীল জমির মালিক হয়। রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ তিনি কর বৃদ্ধির মাধ্যমে করেছিলেন। ইতিপূর্বে জমির মালিক কর-কৃষকদের উপর করের মাত্রা ইচ্ছাকৃতভাবে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তারা চাষীদের কাছ থেকে কাঙ্ক্ষিত কর আদায়ে ব্যর্থ হলে তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়।[22]
বাস্তবে মুহাম্মদ আলির ভূমি সংস্কার মিশরে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার কায়েম করেছিল। তিনি সকল উৎপাদককে তাদের পণ্য সরাসরি রাষ্ট্রের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করেছিলেন। এর বিনিময়ে রাষ্ট্র বিভিন্ন মিশরীয় পণ্য মিশর ও বিদেশের বাজারে বাজারে বিক্রি করত এবং মুনাফা অর্জন করত।
কৃষিক্ষেত্রে উন্নয়নের পাশাপাশি মুহাম্মদ আলি মিশরে শিল্পের ভিত্তি গড়ে তুলেছিলেন। মূলত আধুনিক সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। এরপর তিনি অস্ত্র উৎপাদনে মনোযোগী হন। কায়রোর কারখানায় মাস্কেট ও কামান প্রস্তুত হত। আলেক্সান্দ্রিয়ায় নির্মিত শিপইয়ার্ডে তিনি নৌবাহিনী গড়ে তুলতে শুরু করেন।
অস্ত্র উৎপাদন ছাড়াও রাজস্ব আয়ের জন্য তিনি বস্ত্রশিল্প গড়ে তুলেছিলেন। শুরুর দিকে তিনি ইউরোপীয় ম্যানেজার নিয়োগ দিয়ে মিশরীয়দের শিল্পের উপর প্রশিক্ষণ দেন।
মুহাম্মদ আলি পেশাদার সশস্ত্র বাহিনী এবং আমলাতন্ত্র গড়ে তোলার কাজ করেছেন। নাগরিকদের ইউরোপে পড়াশোনার জন্য পাঠানো হয়েছিল। ইউরোপীয় শৈলীর সেনাবাহিনী গঠন করা তার উদ্দেশ্য ছিল। ইউরোপীয় ভাষা, বিশেষত ফরাসি ভাষা শেখার জন্য শিক্ষার্থীদের পাঠানো হয় যাতে তারা সামরিক ম্যানুয়েল আরবিতে অনুবাদ করতে পারে। তিনি শিক্ষিত মিশরীয় ও নিযুক্ত ইউরোপীয় দক্ষ ব্যক্তিদেরকে মিশরে বিদ্যালয় ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যবহার করেছিলেন।
মুহাম্মদ আলির এসকল প্রশিক্ষণ কর্মের ফলে মিশরে পেশাদার আমলাতন্ত্র গড়ে উঠে। একটি কার্যকর কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র গঠনের ফলে তার অন্যান্য সংস্কারগুলো সফল হয়। মামলুকদের ধ্বংসের পর সরকারে খালি স্থান পূরণের জন্য নতুন লোক নিয়োগ দিতে হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে মুহাম্মদ আলি তার নিজের হাতে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছিলেন। তিনি কর সংগ্রহ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য মিশরকে দশটি প্রদেশে বিভক্ত করেন।[23] অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি তার পুত্রদের বসিয়েছিলেন।
১৮২০ এর দশকে প্রথম মিশরীয় শিক্ষার্থীদের ইউরোপে পাঠানো হয়। সাহিত্যের উপর এর প্রভাব পড়ে। একে আরবি সাহিত্যের রেনেসার সূচনাকাল ধরা হয় এবং এটি নাহদা বলে পরিচিত।
শিল্প ও সামরিক ক্ষেত্রে আধুনিকায়নকে সংহত করার জন্য মুহাম্মদ বেশ কিছু বিদ্যালয় গড়ে তোলেন। এখানে ফরাসি রচনা শিক্ষা দেয়া হত। রিফা আল-তাহতাউয়ি ফরাসি থেকে আরবি অনুবাদের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। ইসলামের প্রথম যুগের গ্রিক থেকে আরবি অনুবাদ আন্দোলনের পর এই অনুবাদ কর্মকে দ্বিতীয় প্রধান অনুবাদ আন্দোলন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
১৮১৯/২১ সালে তার সরকার আরব বিশ্বের প্রথম নিজস্ব ছাপাখানা বুলাক প্রতিষ্ঠা করে।[24] এখান থেকে তার সরকারের দাপ্তরিক গেজেট প্রকাশিত হত।
আরবীয় ঘোড়া উৎপাদনে তার ব্যক্তিগত আগ্রহ ছিল। তিনি আরবীয় ঘোড়ার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যকে গুরুত্ব দিতেন।
মিশরে একটি ইউরোপীয় ধাচের সামরিক বাহিনী ও ব্যক্তিগত সাম্রাজ্য গড়ে তুলতে চাইলেও মুহাম্মদ আলি প্রথমদিকে উসমানীয় সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদের পক্ষে আরব উপদ্বীপ ও গ্রীসে যুদ্ধে সহায়তা করেছেন। তবে পরবর্তীতে তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।
আরব উপদ্বীপে অভিযান ছিল তার প্রথম সামরিক অভিযান। মক্কা ও মদিনা এসময় আল সৌদের হাতে চলে যায়। সৌদিরা এসময় আরব উপদ্বীপের অনেক অংশ দখল করে নিয়েছিল। ১৮০৫ সালে তারা হেজাজ দখল করে।
উসমানীয়দের মূল সামরিক বাহিনী ইউরোপে ব্যস্ত থাকায় দ্বিতীয় মাহমুদ এসময় মুহাম্মদ আলিকে আরব অঞ্চল পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব দেন। ১৮১১ সালে মুহাম্মদ আলি এই কাজে তার পুত্র তুসুন পাশাকে নিযুক্ত করেছিলেন। প্রথমদিকে এই অভিযান সফল না হলেও ১৮১২ সালে দ্বিতীয় দফা অভিযানে হেজাজ পুনরুদ্ধার করা হয়।[25]
অভিযান সফল হলেও সৌদি শক্তি শেষ হয়ে যায়নি। মধ্য নজদ অঞ্চল থেকে তারা উসমানীয় ও মিশরীয়দের ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। এর ফলে মুহাম্মদ আলি তার আরেক পুত্র ইবরাহিম পাশাকে সৌদিদের উৎখাতের জন্য নিয়োগ দেন। দুই বছরের অভিযানের পর সৌদিরা উৎখাত হয় এবং সৌদি পরিবারের অধিকাংশ বন্দী হয়। পরিবারের প্রধান আবদুল্লাহ ইবনে সৌদও বন্দী হন। তাকে ইস্তানবুল পাঠানো হয় এবং পরে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।[26]
মুহাম্মদ আলি এরপর স্বাধীনভাবে অভিযান শুরু করেন। তিনি সুদানে অভিযান চালান। এসময় সুদানে কোনো কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ছিল না। অভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহে এখানে পুরনো ধাচের অস্ত্র ব্যবহৃত হত। ১৮২০ সালে মুহাম্মদ আলি তার তৃতীয় পুত্র ইসমাইল ও আবিদিন বের নেতৃত্বে দক্ষিণে সুদানের ভেতর ৫,০০০ সৈনিকের একটি বাহিনী প্রেরণ করেন।[27] সুদানে প্রবেশের পর শাইগিয়া কর্তৃক মিশরীয়রা মারাত্মক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। তবে মিশরীয়দের সামরিক শ্রেষ্ঠত্বের ফলে শাইগিয়ারা পরাজিত হয় এবং মিশরীয়রা সুদান জয় করতে সক্ষম হয়।
মুহাম্মদ আলি আফ্রিকায় তার কর্তৃত্ব সম্প্রসারণের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্য তার ইউরোপীয় অঞ্চলে জাতিগত বিদ্রোহের মুখোমুখি হয়। ১৮২১ সালে গ্রীক প্রদেশগুলোতে বিদ্রোহ দেখা দেয়। উসমানীয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে অক্ষম হয়ে পড়ছিল। এর ফলে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ মুহাম্মদ আলিকে বিদ্রোহ দমনে সহায়তার বিনিময়ে ক্রিট দ্বীপ প্রদানের প্রস্তাব দেন।
মুহাম্মদ আলি তার পুত্র ইবরাহিম পাশার অধীনে সেনাদল ও নৌ বহর পাঠান।[28] ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া এসময় গ্রীসকে রক্ষার জন্য হস্তক্ষেপ করে। ১৮২৭ সালের ২০ অক্টোবর নাভারিনোর যুদ্ধে উসমানীয় প্রতিনিধি মুহাররাম বের অধীনে থাকা মিশরীয় নৌবাহিনী ইউরোপীয় নৌবাহিনীর কাছে ধ্বংস হয়। এডমিরাল এডওয়ার্ড কডরিংটন ছিলেন ইউরোপীয় বাহিনীর প্রধান। নৌবহর ধ্বংস হওয়ায় মিশর নিজ বাহিনীকে রসদ পাঠাতে সক্ষম ছিল না। ফলে তাদের পিছু হটতে হয়।
ক্ষতিপূরণ হিসেবে মুহাম্মদ আলি সিরিয়া অঞ্চল দাবি করেন। তবে উসমানীয়রা এতে সায় দেয়নি। সুলতান জানতে চান যে যদি তিনি সিরিয়া হস্তগত করেন আর মুহাম্মদ আলি পরে ক্ষমতাচ্যুত হন তবে কী হবে। [29] মুহাম্মদ আলি উসমানীয়দের নীরবতা মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। মিশরের পূর্বের শাসকদের মত মুহাম্মদ আলি নিজেও বিলাদ আল-শাম নিয়ন্ত্রণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন। এই অঞ্চল কৌশলগত ও প্রাকৃতিক সম্পদগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
এই উদ্দেশ্যে একটি নতুন নৌবহর ও নতুন বাহিনী গড়ে তোলা হয়। ১৮৩১ সালের ৩১ অক্টোবর ইবরাহিম পাশার অধীনে সিরিয়ায় মিশরীয় অভিযানের মাধ্যমে প্রথম তুর্কি-মিশরীয় যুদ্ধ শুরু হয়। মিশরীয়রা অধিকাংশ সিরিয়া সহজে করায়ত্ত করে। এক্রের বন্দরে সবচেয়ে শক্ত প্রতিরোধ তৈরী হয়েছিল। ছয় মাস অবরোধের পর মিশরীয়রা শহর দখল করে। এক্রের পতনের পর মিশরীয়রা আনাতোলিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কোনিয়ার যুদ্ধে ইবরাহিম পাশা উজিরে আজম রশিদ পাশার নেতৃত্বাধীন উসমানীয় বাহিনীকে পরাজিত করেন।
অভিযান চলাকালে মুহাম্মদ আলি ইউরোপীয় শক্তিগুলোর উপর দৃষ্টি রেখেছিলেন। কোনো আক্রমণের ফলে যাতে তার অর্জন হারাতে না হয় সেজন্য তিনি সতর্কতার সাথে পদক্ষেপ নেন। নতুন বিজিত অঞ্চলগুলোতে পূর্বের মত খুতবায় সুলতানের নাম নেয়া হত এবং এসব অঞ্চলে পূর্বের উসমানীয় মুদ্রা চালু ছিল।[30]
এসব সত্ত্বেও মুহাম্মদ আলি চাইছিলেন যাতে সুলতান দ্বিতীয় মাহমদুকে অপসারণ করে তার শিশুপুত্র প্রথম আবদুল হামিদকে ক্ষমতায় বসানো হয়। এর ফলে দ্বিতীয় মাহমুদ রাশিয়ার দেয়া সামরিক সহায়তার প্রস্তাব গ্রহণ করেন।[31] রাশিয়ার এই অর্জনের ফলে ব্রিটেন ও ফ্রান্স সরাসরি হস্তক্ষেপ করে। এই অবস্থানের কারণে ইউরোপীয় শক্তিগুলো ১৮৩৩ সালের মে মাসে একটি আলোচনার ব্যবস্থা করে।[32] শান্তিচুক্তির শর্ত হিসেবে মুহাম্মদ আলি আনাতোলিয়া থেকে ফিরে আসেন এবং তাকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে ক্রিট ও হেজাজ প্রদান করা হয় এবং ইবরাহিম পাশাকে সিরিয়ার ওয়ালি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।[33]
মুহাম্মদ আলির ভবিষ্যতে আক্রমণ আটকানোর জন্য সুলতান প্রস্তাব দেন যে সিরিয়া ও ক্রিট ফিরিয়ে দিলে এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খা ত্যাগ করলে মিশর ও আরবে তাকে উত্তরাধিকার সূত্রে শাসনের অধিকার প্রদান করা হবে।[34] সিরিয়া ও ক্রিট থেকে মিশরীয়দের ফিরিয়ে দেয়ার ক্ষমতা তুর্কিদের নেই বুঝতে পেরে মুহাম্মদ আলি এই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
১৮৩৮ সালের ২৫ মে, মুহাম্মদ আলি ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে জানান যে তিনি উসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে চান।[35] তার এই পদক্ষেপ ইউরোপীয় শক্তিগুলোর অবস্থানের বিপরীত ছিল।[34] কিন্তু তার অবস্থানের কারণে ইউরোপীয় শক্তিগুলো, বিশেষত রাশিয়া অবস্থা পরিবর্তনের জন্য হস্তক্ষেপ করে। তবে সাম্রাজ্যের ভেতর যুদ্ধের অবস্থা বিরাজ করছিল।
দ্বিতীয় মাহমুদ তার বাহিনীকে সিরিয়ার দিকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেন। ইবরাহিম পাশা তাদের নেজিবের যুদ্ধে পরাজিত করেন। যুদ্ধের প্রায় পরেই দ্বিতীয় মাহমুদ মারা যান। এরপর তার পুর প্রথম আবদুল মজিদ ক্ষমতালাভ করেন। এসময় মুহাম্মদ আলি ও ইবরাহিম পাশা ভবিষ্যত পন্থা নিয়ে দ্বিমত করেন। ইবরাহিম পাশা অগ্রসর হয়ে কনস্টান্টিনোপল দখল করতে চাইছিলেন। অন্যদিকে মুহাম্মদ আলি কিছু অঞ্চল আদায় এবং তার ও তার পরিবারের জন্য রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন চাইছিলেন।
এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয়রা পুনরায় হস্তক্ষেপ করে। ১৮৪০ সালের ১৫ জুলাই ব্রিটিশ সরকার মুহাম্মদ আলিকে সিরিয়া ও লেবানন পর্বতের উপকূলীয় অঞ্চল ত্যাগের বিনিময়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে মিশরের শাসনাধিকারের সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দেয়। মুহাম্মদ আলি এসময় ফরাসিদের সহায়তা পাওয়ার আশা করেছিলেন, তবে ফরাসিরা তাকে সহায়তা করতে পারেনি। এরপর ব্রিটিশ নৌবাহিনী সিরিয়া ও আলেক্সান্দ্রিয়ার বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়।[36]
ব্রিটিশ ও অস্ট্রীয় নৌবাহিনী নীল বদ্বীপ অঞ্চল অবরোধ করে এবং বৈরুতের উপর গোলাবর্ষণ করে। ১৮৪০ সালের নভেম্বরে এক্রের আত্মসমর্পণের পর মুহাম্মদ আলি শর্ত মানতে রাজি হন। শর্তের মধ্যে ছিল হেজাজ ও ক্রিটের উপর তার দাবি পরিত্যাগ, নৌবাহিনীর আকার হ্রাস এবং তার সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ১৮,০০০ এ কমিয়ে আনা। এর বিনিময়ে তাকে ও তার বংশধরদেরকে উত্তরাধিকার সূত্রে মিশর ও সুদানের শাসনভার অর্পণ করা হয়।[37]
মুহাম্মদ আলি ১৮৪৯ সালের ২ আগস্ট মারা যান। তাকে কায়রোর মুহাম্মদ আলি মসজিদে দাফন করা হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.