Loading AI tools
ধূমকেতু উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
হ্যালির ধূমকেতু (ইংরেজি: Halley's Comet) বা ধূমকেতু হ্যালি (ইংরেজি: Comet Halley), প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১পি/হ্যালি (ইংরেজি: 1P/Halley) নামাঙ্কিত, [1] হল পৃথিবী থেকে প্রতি ৭৫-৭৬ বছরে দৃশ্যমান একটি স্বল্প-পর্যায়ের ধূমকেতু।[1][10][11][12] হ্যালির ধূমকেতুই হল একমাত্র জ্ঞাত স্বল্প-পর্যায়ের ধূমকেতু যা পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় এবং সেই কারণে এটিই খালি চোখে দৃশ্যমান একমাত্র ধূমকেতু যা একজন মানুষের জীবদ্দশায় দুই বার দৃষ্টিগোচর হতে পারে।[13] সৌরজগতের অভ্যন্তরীণ অংশে হ্যালির ধূমকেতু শেষ বার উপস্থিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে এবং এরপরে আবার আসবে ২০৬১ সালের মধ্যভাগে।[14]
আবিষ্কার | |
---|---|
আবিষ্কারক | প্রাগৈতিহাসিক (পর্যবেক্ষণ) এডমন্ড হ্যালি (পর্যায়ক্রমের শনাক্তকরণ) |
আবিষ্কারের তারিখ | ১৭৫৮ (প্রথম পূর্বকথিত অনুসূর অবস্থান) |
কক্ষপথের বৈশিষ্ট্য[1] | |
যুগ ১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ (২৪৪৯৪০০.৫) | |
অপসূর | ৩৫.০৮২ জ্যো.এ. |
অনুসূর | ০.৫৮৬ জ্যো.এ. (শেষ অনুসূর অবস্থান: ৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৬) (পরবর্তী অনুসূর অবস্থান: ২৮ জুলাই, ২০৬১)[2] |
অর্ধ-মুখ্য অক্ষ | ১৭.৮৩৪ জ্যো.এ. |
উৎকেন্দ্রিকতা | ০.৯৬৭১৪ |
কক্ষীয় পর্যায়কাল | ৭৫.৩২ বছর |
গড় ব্যত্যয় | ৩৮.৩৮° |
নতি | ১৬২.২৬° |
উদ্বিন্দুর দ্রাঘিমা | ৫৮.৪২° |
নিকটবিন্দুর সময় | ২৮ জুলাই, ২০৬১[2] |
অনুসূরের উপপত্তি | ১১১.৩৩° |
ভৌত বৈশিষ্ট্যসমূহ | |
মাত্রাসমূহ | ১৫ কিমি × ৮ কিমি[3] |
ভর | ২.২×১০১৪ কিগ্রা[4] |
গড় ঘনত্ব | ০.৬ [[গ্রাম/সেমি৩]] (গড়)[5] ০.২–১.৫ গ্রাম/সেমি৩ (আনুমানিক)[6] |
মুক্তি বেগ | ~টেমপ্লেট:V2 কিমি/সে |
ঘূর্ণনকাল | ২.২ দিন (৫২.৮ ঘণ্টা) (?)[7] |
প্রতিফলন অনুপাত | ০.০৪[8] |
আপাত মান | ২৮.২ (২০০৩ সালে)[9] |
অভ্যন্তরীণ সৌরজগতে হ্যালির ধূমকেতুর পর্যায়ক্রমিক প্রত্যাবর্তন অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ২৪০ অব্দ থেকে সারা বিশ্বের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের দ্বারা পর্যবেক্ষিত ও নথিবদ্ধ হয়ে এসেছে। কিন্তু ১৭০৫ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডমন্ড হ্যালির আগে কেউই বুঝতে পারেননি যে এই আবির্ভাবগুলি আসলে একই ধূমকেতুর পুনরাবির্ভাব মাত্র। এই আবিষ্কারের ফলেই ধূমকেতুটি এখন হ্যালির নামাঙ্কিত হয়েছে।[15]
১৯৮৬ সালের আবির্ভাবকালে হ্যালির ধূমকেতুই ছিল প্রথম ধূমকেতু যেটিকে মহাকাশযানের মাধ্যমে বিস্তারিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল এবং যার ফলে একটি নিউক্লিয়াসের গঠনভঙ্গিমা এবং কোমা ও পুচ্ছ গঠনের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে প্রথম পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য সংগ্রহ সম্ভব হয়।[16][17] এই সব পর্যবেক্ষণ দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত ধূমকেতু গঠন-সংক্রান্ত একাধিক অনুকল্পকে সমর্থন করে। বিশেষভাবে সমর্থিত হয় ফ্রেড হুইপলের "ধূলিময় তুষারগোলক" মডেলটি, যার মাধ্যমে নিখুঁতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলা হয়েছিল যে হ্যালির ধূমকেতু জল, কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অ্যামোনিয়ার মতো উদ্বায়ী বরফের একটি মিশ্রণ ও ধুলো দ্বারা গঠিত। এই অভিযানগুলি থেকে যে তথ্য পাওয়া যায় তা এই জাতীয় ধারণাগুলিকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সংশোধন ও পুনর্মূল্যায়ণ করতে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, এখন জানা গিয়েছে যে হ্যালির ধূমকেতুর পৃষ্ঠভাগ প্রধানত ধুলো, অনুদ্বায়ী পদার্থ ও অল্প পরিমাণে বরফ দ্বারা গঠিত যা প্রতিফলন ঘটেছে
হ্যালির ধূমকেতুর নামটি সাধারণভাবে উচ্চারিত হয় হ্যালি (/ˈhæli/) বা হেইলি (/ˈheɪli/)।[18][19] এডমন্ড হ্যালির অন্যতম জীবনীকার কলিন রোনান হলি (/ˈhɔːli/) উচ্চারণটি অধিকতর শ্রেয় মনে করতেন।[20] হ্যালির জীবদ্দশায় তাঁর নামের ইংরেজি বানানগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল Hailey, Haley, Hayley, Halley, Hawley ও Hawly, এবং এই কারণেই সমসাময়িক উচ্চারণটি কী ছিল তা সঠিক জানা যায় না। কিন্তু বর্তমান কালের এই পদবিধারীরা হ্যালি (/ˈhæli/) উচ্চারণটিই শ্রেয় জ্ঞান করেন।[21]
হ্যালির ধূমকেতুই প্রথম ধূমকেতু যেটিকে পর্যায়ক্রমিক ধূমকেতু হিসেবে শনাক্ত করা হয়। রেনেসাঁর যুগের পূর্বাবধি ধূমকেতুর প্রকৃতি সম্পর্কে দার্শনিক ঐকমত্য ছিল এগুলি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। অ্যারিস্টটল কর্তৃক প্রবর্তিত এই ধারণাটিকে ১৫৭৭ সালে টাইকো ব্রাহে খারিজ করে দেন। প্যারালেক্স পরিমাপের সাহায্যে তিনি দেখান যে ধূমকেতুগুলি নিশ্চিতভাবেই চাঁদের ওপারে অবস্থিত। ধূমকেতু যে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে সে ব্যাপারে তখনও অনেকে নিশ্চিত ছিলেন না এবং পরিবর্তে মনে করতেন যে এগুলি সৌরজগতের মধ্য দিয়ে সরলরৈখিক পথে গমন করে।[22]
১৬৮৭ সালে প্রকাশিত ফিলোসফিয়া ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা গ্রন্থে স্যার আইজ্যাক নিউটন আবিষ্কৃত মাধ্যাকর্ষণ ও গতির সূত্রগুলির রূপরেখা প্রদান করেন। ধূমকেতু সম্পর্কে নিউটনের রচনাটি সুস্পষ্টভাবেই অসম্পূর্ণ। যদিও তিনি সন্দেহ করেছিলেন যে, ১৬৮০ ও ১৬৮১ সালে পর্যায়ক্রমে আবির্ভূত দু’টি ধূমকেতু আসলে সূর্যের পশ্চাদভাগ অতিক্রমের আগে ও পরে দৃষ্ট একই ধূমকেতু (পরবর্তীকালে নিউটনের ধারণাটি সঠিক প্রমাণিত হয়; নিউটনের ধূমকেতু দেখুন),[23] তা সত্ত্বেও তিনি নিজ মডেলে ধূমকেতুগুলির সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যবিধানে সমর্থ হননি।
শেষ পর্যন্ত নিউটনের বন্ধু তথা সম্পাদক ও প্রকাশক এডমন্ড হ্যালি ১৭০৫ সালে প্রকাশিত সাইনপসিস অফ দি অ্যাস্ট্রোনমি অফ কমেটস গ্রন্থে ধূমকেতুর কক্ষপথগুলিতে বৃহস্পতি ও শনির অভিকর্ষীয় প্রভাব পরিমাপের জন্য নিউটনের নতুন সূত্রগুলি ব্যবহার করেন।[24] ২৪টি ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের একটি তালিকা সংকলন করে তিনি ১৬৮২ সালে আবির্ভূত একটি দ্বিতীয় ধূমকেতুর কক্ষীয় উপাদান পরিমাপ করে দেখেন যে সেগুলি ১৫৩১ সালে পেট্রাস অ্যাপিয়ানাস কর্তৃক এবং ১৬০৭ সালে জোহান কেপলার কর্তৃক পর্যবেক্ষিত দু’টি ধূমকেতুর অনুরূপ।[24][25] এইভাবে হ্যালি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, তিনটি ধূমকেতু আসলে প্রতি ৭৬ বছর অন্তর প্রত্যাবর্তনকারী একই বস্তু (এরপর এই সময়কালটি ৭৪ থেকে ৭৯ বছরের মধ্যে হেরফের হতে দেখা গিয়েছে)। ধূমকেতুটি গ্রহগুলির অভিকর্ষীয় আকর্ষণের ফলে কতটা বিঘ্নের সম্মুখীন হতে পারে তার একটি খসড়া পরিমাপ করার পর তিনি ১৭৫৮ সালে ধূমকেতুটির প্রত্যাবর্তনের ভবিষ্যদ্বাণী করেন।[26] ১৬৮২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ধূমকেতুটিকে অনুসূর অবস্থানে ব্যক্তিগতভাবে পর্যবেক্ষণ করলেও[27] সেটির প্রাক্কথিত প্রত্যাবর্তন প্রত্যক্ষ করার আগেই ১৭৪২ সালে হ্যালির মৃত্যু ঘটে।[28]
ধূমকেতুটির প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে হ্যালির ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়েছিল। যদিও ১৭৫৮ সালের ২৫ ডিসেম্বর জার্মান কৃষক ও অপেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান জর্জ প্যালিৎশ কর্তৃক পর্যবেক্ষিত হওয়ার আগে এটিকে দেখা যায়নি। ১৭৫৯ সালের ১৩ মার্চের আগে ধূমকেতুটি সেটির অনুসুর অবস্থানে পৌঁছায়নি। বৃহস্পতি ও শনির আকর্ষণের ফলে ৬১৮ দিনের এই দেরি ঘটেছিল।[29] এই প্রভাবের কথা পরিমাপ করা হয়েছিল ধূমকেতুটির প্রত্যাবর্তনেরও আগে (গণনায় এক মাসের ভুলের ফলে প্রত্যাবর্তনের তারিখ ১৩ এপ্রিল বলে মনে করা হয়েছিল)।[30] এই পরিমাপ করেছিলেন তিন ফরাসি গণিতজ্ঞ অ্যালেক্সিস ক্ল্যারিওট, জোসেফ লেল্যান্ড ও নিকোল-রেইন লেপোত।[31] ধূমকেতুর প্রত্যাবর্তন নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হলে প্রথম গ্রহ ভিন্ন অন্য কোনও বস্তুকে দেখা যায় সূর্যকে প্রদক্ষিণরত অবস্থায়। এছাড়া এই প্রমাণটি ছিল নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম সফল পরীক্ষাগুলির অন্যতম এবং উক্ত পদার্থবিজ্ঞানের ব্যাখ্যাদানকারী ক্ষমতার একটি সুস্পষ্ট নমুনা।[32] ১৭৫৯ সালে ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী নিকোলাস-লুইস ডে লাকেইল প্রথম হ্যালির সম্মানে ধূমকেতুটির নামকরণ করেন।[32]
কোনও কোনও গবেষকের মতে প্রথম শতাব্দীর মেসোপটেমিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ইতিপূর্বেই হ্যালির ধূমকেতুটিকে পর্যায়ক্রমিক ধূমকেতু হিসেবে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।[33] এই তত্ত্বের উৎস বাভিল তালমুদ, ট্র্যাকটেড হোরায়ত#আগ্গাদায় উল্লিখিত একটি বাক্যাংশ,[34] যেখানে বলা হয়েছে, "প্রতি সত্তর বছর অন্তর আবির্ভূত একটি নক্ষত্র নৌকার অধিনায়কদের ভ্রান্তি উৎপাদন করে।"[35]
১৯৮১ সালে গবেষকেরা সংখ্যাগত একাঙ্গীভবন পদ্ধতিতে হ্যালির ধূমকেতুর অতীত কক্ষপথগুলি গণনা চেষ্টা করেন। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর নিঁখুত পর্যবেক্ষণগুলি থেকে কাজ শুরু করলেও এই গবেষণায় ৮৩৭ সালে পৃথিবীর অতি নিকটে ধূমকেতুটির অবস্থানের পূর্বের কোনও ফলাফল উঠে আসেনি। গণনার জন্য প্রাচীন চৈনিক ধূমকেতু পর্যবেক্ষণের ফলাফলগুলি ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়েছিল।[36]
খ্রিস্টপূর্ব ২৪০ অব্দ থেকে হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথের পর্যায়কালের ভিন্নতা ঘটেছে ৭৪ থেকে ৭৯ বছর পর্যন্ত।[32][11] সূর্যকে কেন্দ্র করে এই ধূমকেতুর কক্ষপথ অতিমাত্রায় উপবৃত্তাকার এবং এটির কক্ষীয় উৎকেন্দ্রিকতা ০.৯৬৭ (যা বৃত্তের ক্ষেত্রে ০ এবং অধিবৃত্তাকার বঙ্কিম পথের ক্ষেত্রে ১)। অনুসুর বিন্দুটির (কক্ষপথে যে বিন্দুতে ধূমকেতুটি সূর্যের সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে) অবস্থান কেবলমাত্র ০.৬ জ্যো.এ.। [37] এই বিন্দুটি বুধ ও শুক্রের কক্ষপথের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। অপসুর বিন্দুটির (সূর্য থেকে সর্বাধিক দূরত্ব) অবস্থান ৩৫ জ্যো.এ. (সূর্য থেকে প্লুটোর দূরত্বের প্রায় সমান)। হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথ পশ্চাদমুখী, যা সৌরজগতে একটি ব্যতিক্রমী নিদর্শন; এই ধূমকেতুটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে গ্রহগুলির বিপরীত দিকে অর্থাৎ সূর্যের উত্তর মেরুর উপর থেকে ঘড়ির কাঁটার ক্রমে। ক্রান্তিবৃত্তের প্রতি কক্ষপথটির নতি ১৮°, এটির অধিকাংশই ক্রান্তিবৃত্তের দক্ষিণে অবস্থিত। (পশ্চাদমুখী হওয়ার কক্ষপথটির প্রকৃত নতি ১৬২°।)[38] পশ্চাদমুখী গতির কারণে এই ধূমকেতুটি পৃথিবীর আপেক্ষিকে সৌরজগতের যে কোনও বস্তুর তুলনায় সর্বাধিক গতিবেগ-সম্পন্ন বস্তুগুলির অন্যতম। ১৯১০ সালের অতিক্রমণের সময় ধূমকেতুটির আপেক্ষিক গতিবেগ ছিল ৭০.৫৬ কিলোমিটার/সেকেন্ড (১৫৭,৮৩৮ মাইল/ঘণ্টা বা ২৫৪,০১৬ কিলোমিটার/ঘণ্টা)।[39] হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথ দুই স্থানে পৃথিবীর কাছে আসে বলে এই ধূমকেতুটি দু’টি উল্কাবৃষ্টির ঘটনার সঙ্গে সংযুক্ত: মে মাসের গোড়ার দিকে এটা অ্যাকোয়ারিডস ও অক্টোবরের শেষভাগে ওরিয়নিডস।[40] হ্যালির ধূমকেতুটি হল ওরিয়নিডসের উৎসবস্তু। ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব পর্যবেক্ষণ করে এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে, ধূমকেতুটি এটা অ্যাকোয়ারিডস উল্কাবৃষ্টি অতিরিক্তভাবে উত্তেজিত করতে পারে, তবে এটি সম্ভবত সেই উল্কাবৃষ্টির উৎসবস্তু নয়।[41]
হ্যালির ধূমকেতুকে "পর্যায়ক্রমিক" অথবা "স্বল্প-পর্যায়ের ধূমকেতু"-র শ্রেণিতে (যে সব ধূমকেতুর কক্ষপথে আবর্তনকাল ২০০ বছর বা তার কম) ফেলা হয়।[42] এই শ্রেণির বিপরীতে রয়েছে "দীর্ঘ-পর্যায়ের ধূমকেতু"গুলি, যেগুলির কক্ষপথে আবর্তনকাল সহস্রাধিক বছর। পর্যায়ক্রমিক ধূমকেতুগুলির ক্রান্তিবৃত্তের প্রতি গড় নতি মাত্র দশ ডিগ্রি এবং কক্ষীয় পর্যায় মাত্র ৬.৫ বছর; তাই হ্যালির ধূমকেতুর কক্ষপথটিকে সেগুলির অনুরূপ বলা চলে না।[32] অধিকাংশ স্বল্প-পর্যায়ের ধূমকেতুকে (যেগুলির কক্ষীয় পর্যায় ২০ বছরের কম এবং নতি ২০-৩০ ডিগ্রি বা তার কম) বলা হয় বৃহস্পতি-পরিবারভুক্ত ধূমকেতু। এগুলির মধ্যে যেগুলির সঙ্গে হ্যালির ধূমকেতুর সাদৃশ্য আছে, অর্থাৎ যেগুলির কক্ষীয় পর্যায় ২০ থেকে ২০০ বছরের মধ্যে এবং নতি শূন্য থেকে ৯০ ডিগ্রির বেশি, সেগুলিকে বলায় হ্যালি-বর্গভুক্ত ধূমকেতু।[42][43] ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫১১টি বৃহস্পতি-পরিবারভুক্ত ধূমকেতু শনাক্ত করা গেলেও, হ্যালি-বর্গভুক্ত ধূমকেতু পর্যবেক্ষিত হয়েছে মাত্র ৭৫টি।[44]
হ্যালি-বর্গভুক্ত ধূমকেতুগুলির কক্ষপথ ইঙ্গিত করে যে, এগুলি অতীতে দীর্ঘ-পর্যায়ের ধূমকেতু ছিল; পরবর্তীকালে দানব গ্রহগুলির মাধ্যাকর্ষণ বলে এগুলির কক্ষপথ বিঘ্নিত হয় এবং অভ্যন্তরীণ সৌরজগতের দিকে প্রেরিত হয়।[42] অতীতে হ্যালির ধূমকেতু যদি দীর্ঘ-পর্যায়ের ধূমকেতু হয়ে থাকে, তবে সম্ভবত এটির উৎস উর্ট মেঘ (ধূমকেতুতুল্য বস্তুগুলির একটি গোলক, যার অভ্যন্তরীণ সীমারেখা ২০,০০০-৫০,০০০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের মধ্যে অবস্থিত)।[43] অপরপক্ষে বৃহস্পতি-পরিবারভুক্ত ধূমকেতুগুলির উৎস মনে করা হয় কাইপার বেষ্টনীকে,[43] যা আসলে সূর্য থেকে ৩০ জ্যো.এ. (নেপচুনের কক্ষপথ) ও ৫০ জ্যো.এ.-এর (বিক্ষিপ্ত চাকতিতে) মধ্যে অবস্থিত তুষারময় আবর্জনার একটি চ্যাপ্টা চাকতি। ২০০৮ সালে একটি নেপচুনোত্তর বস্তুর হ্যালির ধূমকেতুর অনুরূপ পশ্চাদমুখী কক্ষপথ আবিষ্কৃত হলে হ্যালি-শ্রেণিভুক্ত ধূমকেতুগুলির অন্য একটি উৎসস্থলের কথা প্রস্তাব করা হয়। এই বস্তুটি হল ২০০৮ কেভি৪২, যেটির কক্ষপথ বস্তুটিকে নিয়ে ইউরেনাসের কক্ষপথের ঠিক বহির্ভাগ থেকে প্লুটোর দূরত্বের দ্বিগুণ অংশ পর্যন্ত। এটি সম্ভবত নতুন ক্ষুদ্র সৌরজাগতিক বস্তুগুলির অন্যতম, যা হ্যালি-বর্গভুক্ত ধূমকেতুগুলির উৎস হিসেবে কাজ করেছে।[45]
হ্যালির ধূমকেতু সম্ভবত ১৬,০০০-২০০,০০০ বছর এটির বর্তমান কক্ষপথে অবস্থান করছে, কয়েক শতকের আবির্ভাবের বাইরে এটিকে সংখ্যাগতভাবে একাঙ্গীভূত করা সম্ভব হয়নি এবং ৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে এটির পৃথিবীর নিকটে আসার আগের ঘটনাগুলি শুধুমাত্র নথিবদ্ধ পর্যবেক্ষণ থেকেই নিশ্চিত করা গিয়েছে।[46] অভিকর্ষীয় প্রভাব ছাড়া অন্যান্য প্রভাবগুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ;[46] হ্যালির ধূমকেতু সূর্যের দিকে যত এগিয়ে আসে ততই এটি পৃষ্ঠভাগ থেকে উদ্গতিপ্রাপ্ত গ্যাসের জেট নির্গমন ঘটায়, যার ফলে ধূমকেতুটি এর কক্ষপথ থেকে স্বল্প বিচ্যুত হয়ে যায়। কক্ষপথের এই পরিবর্তনের ফলে ধূমকেতুটির অনুসুর অবস্থানে পৌঁছাতে গরে চার দিন দেরি হয়।[47]
১৯৮৯ সালে বরিস চিরিকোভ ও ভাইটোল্ড ভেচেস্লাভোভ হ্যালির ধূমকেতুর ঐতিহাসিক নথিপত্র ও কম্পিউটার সিম্যুলেশন থেকে গৃহীত ৪৬টি নিকট আবির্ভাবের একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপিত করেন। এই গবেষণা থেকে জানা যায় দীর্ঘ সময়কালের প্রেক্ষিতে এই ধূমকেতুর গতি বিশৃঙ্খলাময় ও পূর্বাভাষের প্রতিকূল।[48] বিজ্ঞানীরা মনে করেন, হ্যালির ধূমকেতুর জীবনকাল ১ কোটি বছর দীর্ঘ হতে পারে। এই সব গবেষণা থেকে এও দেখা গিয়েছে যে, হ্যালির ধূমকেতুর গতিবিদ্যার অনেক ভৌত বৈশিষ্ট্য কেপলার মানচিত্র নামে পরিচিত একটি সরল সিমপ্লেকটিক মানচিত্র দ্বারা প্রায় যথাযথভাবেই বর্ণনা করা যায়।[49] সাম্প্রতিকতর গবেষণা থেকে এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে আগামী লক্ষ বছরের মধ্যে হ্যালির ধূমকেতু হয় সম্পূর্ণ বাষ্পীভূত হবে অথবা দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়বে কিংবা আগামী কয়েক লক্ষ বছরের মধ্যে সৌরজগৎ থেকেই উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে।[50][43] ডি. ডব্লিউ. হিজেসের পর্যবেক্ষণ ইঙ্গিত করে যে, বিগত ২,০০০ থেকে ৩,০০০ ঘূর্ণনের মধ্যে হ্যালির ধূমকেতুর নিউক্লিয়াসের ভর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে।[17]
গিওট্টো ও ভেগা অভিযানের মাধ্যমে গ্রহবিজ্ঞানীরা হ্যালির ধূমকেতুর পৃষ্ঠভাগ ও গঠনের প্রাথমিক তথ্য আহরণ করেছিলেন। সকল ধূমকেতুর মতো হ্যালির ধূমকেতুও যখন সূর্যের নিকটে উপস্থিত হয় তখন এটির উদ্বায়ী যৌগগুলি (জল, কার্বন মনোঅক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য বরফের মতো নিম্ন স্ফুটনাংক-যুক্ত যৌগগুলি) নিউক্লিয়াসের পৃষ্ঠভাগ থেকে ঊর্ধ্বপাতিত হতে শুরু করে।[51] এই কারণে ধূমকেতুটিতে যে কোমার বা বায়ুমণ্ডলের উৎপত্তি ঘটে সেটির দৈর্ঘ্য ১০০,০০০ কিলোমিটার পর্যন্ত প্রসারিত হয়।[3] ধূলিময় বরফ বাষ্পীভূত হওয়ায় ধূলির কণা নির্গত হয়, যা নিউক্লিয়াস থেকে গ্যাসের সঙ্গেই ছড়িয়ে পড়ে। কোমায় গ্যাসের অণুগুলি সৌরালোক শোষণ করে এবং পরে তা বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যে পুনরায় বিকিরিত করে। এই ঘটনাটিকে বলা হয় প্রতিপ্রভা। অন্যদিকে ধূলিকণাগুলি সৌরালোককে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত করে দেয়। এই উভয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই কোমাটি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।[13] কোমায় গ্যাসের অণুগুলির একাংশ সৌর অতিবেগুনি বিকিরণ কর্তৃক আয়নায়িত হয়ে গেলে[13] সৌর বায়ুর (সূর্য থেকে নির্গত বিদ্যুৎগ্রস্থ কণার একটি স্রোত) চাপ কোমার আয়নগুলিকে একটি দীর্ঘ পুচ্ছে বের করে আনে। এই পুচ্ছটির দৈর্ঘ্য মহাশূন্যে ১০ কোটি কিলোমিটারেরও বেশি হতে পারে।[51][52] সৌর বায়ুর প্রবাহে পরিবর্তন ঘটলে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী ঘটনা ঘটতে পারে, যাতে পুচ্ছটি সম্পূর্ণত নিউক্লিয়াস থেকে পৃথক হয়ে যায়।[16]
কোমার বিশাল আকার সত্ত্বেও হ্যালির ধূমকেতুর নিউক্লিয়াস তুলনামূলকভাবে ছোটো: দৈর্ঘ্যে মোটামুটি ১৫ কিলোমিটার, প্রস্থে ৮ কিলোমিটার এবং সম্ভবত ৮ কিলোমিটার পুরু।[b] এটির আকার অনেকটা চীনাবাদামের খোলার মতো।[3] ভর আপেক্ষিকভাবে কম (মোটামুটি ২.২ × ১০১৪ কিলোগ্রাম)[4] এবং এর গড় ঘনত্ব প্রায় ০.৬ গ্রাম/সেমি৩, যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে এটি খুব শিথিলভাবে একত্রিত প্রচুর ছোটো ছোটো টুকরো দ্বারা গঠিত। এই ধরনের গঠন রাবল পাইল নামে পরিচিত।[5] পৃথিবীর মাটি থেকে কোমার ঔজ্জ্বল্য যা পর্যবেক্ষিত হয়েছে তা ইঙ্গিত করে যে হ্যালির ধূমকেতুর আবর্তনকাল প্রায় ৭.৪ দিন। অবশ্য বিভিন্ন মহাকাশযান থেকে গৃহীত আলোকচিত্রে এবং জেট ও খোলাটির পর্যবেক্ষণের ফলে এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে আবর্তনকালটি ৫২ ঘণ্টার।[17] নিউক্লিয়াসটি নিয়তাকার হওয়ার জন্য হ্যালির ধূমকেতুর আবর্তন সম্ভবত জটিল।[51] ফ্লাইবাই অভিযানগুলির সময় হ্যালির ধূমকেতুর পৃষ্ঠভাগের মাত্র ২৫ শতাংশেরই আলোকচিত্র গ্রহণ সম্ভব হয়েছে। তা সত্ত্বেও এই ছবিগুলি থেকে ধূমকেতুটির এক অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। এই পৃষ্ঠভাগে পাহাড়-পর্বত, শৈলশিরা, অবনমিত ভূমি এবং অন্তত একটি অভিঘাত খাদও দেখা যায়।[17]
সকল পর্যায়ক্রমিক ধূমকেতুর মধ্যে হ্যালির ধূমকেতুই সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। অন্যান্যগুলি, যেমন এনকে ধূমকেতু ও হোমস ধূমকেতু এক বা দুই অর্ডার অফ ম্যাগনিচিউড কম সক্রিয়।[17] এটির দিবাভাগ (যে অংশটি সূর্যের অভিমুখী) রাত্রিভাগের অংশটির চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়। পর্যবেক্ষণের ফলে জানা গিয়েছে যে নিউক্লিয়াস থেকে যে গ্যাসগুলি উৎক্ষিপ্ত হয় তার মধ্যে ৮০ শতাংশ জলীয় বাষ্প, ১৭ শতাংশ কার্বন মনোক্সাইড এবং ৩-৪ শতাংশ কার্বন ডাইঅক্সাইড।[53] সেই সঙ্গে হাইড্রোকার্বনেরও চিহ্ন পাওয়া যায়।[54] যদিও সাম্প্রতিকতর সূত্রগুলি থেকে জানা গিয়েছে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ ১০ শতাংশ এবং সেই সঙ্গে মিথেন ও অ্যামোনিয়ারও চিহ্ন বিদ্যমান।[55] যে ধূলিকণাগুলি পাওয়া গিয়েছে তা প্রধানত কার্বন-হাইড্রোজেন-অক্সিজেন-নাইট্রোজেন বা CHON (যে যৌগগুলি বাহ্য সৌরজগতে অত্যন্ত সুলভ) ও সিলিকেটের (যে রকম পার্থিব শিলাগুলিতে পাওয়া যায়) মিশ্রণ।[51] ধূলিকণাগুলি শনাক্তকরণের সীমা (~০.০০১ µm) পর্যন্ত আকারে ছোটো হয়ে যায়।[16] হ্যালির ধূমকেতু থেকে বিমুক্ত জলে ডিউটেরিয়াম থেকে হাইড্রোজেনের অনুপাতকে প্রথম দিকে পৃথিবীর মহাসাগরের জলে প্রাপ্ত অনুপাতের সমান করা হয়েছিল, যা থেকে বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছিলেন যে সুদূর অতীতে হ্যালি-সদৃশ ধূমকেতুগুলির মাধ্যমেই পৃথিবীতে জলের আবির্ভাব ঘটেছিল। পরবর্তীকালের পর্যবেক্ষণগুলি থেকে জানা যায়, হ্যালির ধূমকেতুতে ডিউটেরিয়াম অনুপাত পৃথিবীর মহাসাগরগুলিতে প্রাপ্ত অনুপাতের থেকে অনেক বেশি। যার ফলে এখন মনে করা হয় যে পৃথিবীর জলের উৎস সম্ভবত এই ধূমকেতুগুলি নয়।[51]
গিওট্টো মহাকাশযানটিই ধূমকেতু গঠনকৌশলের ফ্রেড হুইপল প্রস্তাবিত "ধূলিময় তুষারগোলক" অনুকল্পের প্রথম প্রমাণ উপস্থাপনা করে। হুইপলের অনুমান অনুযায়ী, ধূমকেতুগুলি তুষারময় বস্তু, যা অভ্যন্তরীণ সৌরজগতে আসতে আসতে সূর্য কর্তৃক তপ্ত হয়ে ওঠে। এর ফলে সেগুলির পৃষ্ঠভাগস্থ বরফ ঊর্ধ্বপাতিত হয় (অর্থাৎ কঠিন অবস্থা থেকে সরাসরি গ্যাসে পরিবর্তিত হয়) এবং উদ্বায়ী পদার্থের জেটগুলি বিস্ফোরিত হয়ে বাইরের দিকে বেরিয়ে এসে কোমার সৃষ্টি করে। গিওট্টো দেখিয়ে দেয় যে এই অনুকল্পটি সাধারণভাবে সঠিক,[51] তবে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তনসাপেক্ষ। উদাহরণস্বরূপ, হ্যালির ধূমকেতুর অ্যালবেডো প্রায় ৪ শতাংশ, অর্থাৎ এই ধূমকেতুটি এর উপর আঘাতপ্রাপ্ত মাত্র ৪ শতাংশ সৌরালোক প্রতিফলিত করে; যা কয়লার ক্ষেত্রেও আশা করা যায়।[56] তাই পৃথিবীর পর্যবেক্ষকদের চোখে উজ্জ্বল সাদা দেখালেও হ্যালির ধূমকেতু আসলে কুচকুচে কালো। বাষ্পীভূত হতে থাকা "মলিন বরফ"-এর পৃষ্ঠভাগের তাপমাত্রার হেরফের উচ্চতর অ্যালবেডোয় ১৭০ K (−১০৩ °সে) থেকে নিম্ন অ্যালবেডোয় ২২০ K (−৫৩ °সে) পর্যন্ত হয়; ভেগা ১-এর পর্যবেক্ষণের ফলে জানা গিয়েছে হ্যালির ধূমকেতুর পৃষ্ঠভাগের তাপমাত্রার পার্থক্য ৩০০–৪০০ K (২৭–১২৭ °সে)। এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, হ্যালির ধূমকেতুর পৃষ্ঠভাগের মাত্র ১০ শতাংশই সক্রিয় এবং এটির বৃহত্তর অংশ কালো ধুলোর একটি আস্তরণের নিচে রয়েছে, যা তাপকে অব্যাহত রাখে।[16] এই সব পর্যবেক্ষণ একত্রিত করে এই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে যে হ্যালির ধূমকেতু প্রকৃতপক্ষে অনুদ্বায়ী পদার্থ দ্বারা গঠিত এবং সেই কারণে তার সঙ্গে এক "ধূলিময় তুষারগোলক"-এর পরিবর্তে এক "তুষারময় ধূলিগোলক"-এর সাদৃশ্যই বেশি।[17][57]
হ্যালির ধূমকেতুর উপস্থিতি সম্ভবত প্রথম নথিবদ্ধ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৭ অব্দে, যদিও এই তথ্য অনিশ্চিত। খ্রিস্টপূর্ব ৪৬৮ থেকে ৪৬৬ অব্দের মধ্যে প্রাচীন গ্রিসে একটি ধূমকেতুর কথা নথিবদ্ধ করা হয়; সেটির সময়, অবস্থান, স্থিতিকাল ও সেটির সঙ্গে সম্পৃক্ত উল্কাবৃষ্টির ঘটনাগুলি থেকে সেটি যে হ্যালির ধূমকেতু তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।[58] প্লিনি দি এল্ডারের বিবরণ অনুসারে, সেই বছর থ্রেসের এগোসপোতামি শহরে একটি উল্কাপাতের ঘটনা ঘটেছিল। তিনি লিখেছিলেন যে উল্কাপিণ্ডটি বাদামি রঙের এবং আকারে একটি মালবাহী গাড়ির মতো।[59] চীনা কালপঞ্জিকারেরাও সেই বছর একটি ধূমকেতুর কথা উল্লেখ করেছিলেন।[60]
ঐতিহাসিক নথিতে হ্যালির ধূমকেতুর প্রথম নিশ্চিত উপস্থিতিটি হল খ্রিস্টপূর্ব ২৪০ অব্দে রচিত চীনা কালপঞ্জি রেকর্ডস অফ দ্য গ্র্যান্ড হিস্টোরিয়ান বা শিজি-তে উল্লিখিত একটি বিবরণ। এই বিবরণীতে পূর্ব দিকে আবির্ভূত হয়ে উত্তর দিকে সঞ্চরণশীল একটি ধূমকেতুর উল্লেখ পাওয়া যায়।[61] খ্রিস্টপূর্ব ১৬৪ অব্দে হ্যালির ধূমকেতুর নিকট উপস্থিতির একমাত্র যে নথি পাওয়া গিয়েছে তা হল দু’টি খণ্ডিত ব্যাবিলনীয় ফলক, বর্তমানে এগুলি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।[61]
খ্রিস্টপূর্ব ৮৭ অব্দে হ্যালির ধূমকেতুর নিকট আগমন ব্যাবিলনীয় ফলকগুলিতে নথিবদ্ধ হয়েছিল। এই ফলকগুলিতে বলা হয়েছে যে, এক মাস ধরে "দিনের পর দিন" ধূমকেতুটিকে দেখা গিয়েছিল।[62] হ্যালির ধূমকেতুর এই আবির্ভাব সম্ভবত মহান টাইগ্রেনেস নামে এক আর্মেনীয় রাজার মুদ্রায় স্মরণ করা হয়েছিল। উক্ত মুদ্রায় টাইগ্রেনেসকে একটি মুকুট-পরিহিত অবস্থায় দেখা যায়। ভাহে গুরজাদিয়ান ও আর. ভারদানিয়ানের মতে, মুকুটটিতে চিত্রিত "বাঁকানো পুচ্ছবিশিষ্ট একটি তারা সম্ভবত খ্রিস্টপূর্ব ৮৭ অব্দে হ্যালির ধূমকেতুর অতিক্রমণের প্রতীক।" গুরজাদিয়ান ও ভারদানিয়ানের মতে, "খ্রিস্টপূর্ব ৮৭ অব্দের ৬ অগস্ট যখন হ্যালির ধূমকেতুর সূর্যের সবচেয়ে কাছে উপস্থিত হয়েছিল তখনই সম্ভবত টাইগ্রেনেস সেটিকে দেখেছিলেন", কারণ ধূমকেতুর আবির্ভাব ছিল একটি "সর্বাধিক নথিবদ্ধকরণযোগ্য ঘটনা"; প্রাচীন আর্মেনীয়দের কাছে তা সম্ভবত ছিল সুদক্ষ রাজাধিরাজের নতুন যুগের বার্তাবহ।[63]
খ্রিস্টপূর্ব ১২ অব্দে হ্যালির ধূমকেতুর নিকট আগমন হান রাজবংশের রাজত্বকালের চীনা জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সেই বছর অগস্ট থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে হানের বই-তে নথিবদ্ধ করে রাখেন।[10] সেই বছর ধূমকেতুটির পৃথিবীর ০.১৬ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছিল।[64] রোমান ইতিহাসলেখক ক্যাসিয়াস ডিওর মতে, সেই বছরই বেশ কয়েক দিন ধরে রোমের আকাশে একটি ধূমকেতু দেখা গিয়েছিল, যা মার্কাস ভিপসানিয়াস আগ্রিপ্পার আসন্ন মৃত্যুর ইঙ্গিত বয়ে এনেছিল।[65] খ্রিস্টপূর্ব ১২ অব্দে হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব যিশু খ্রিস্টের প্রথাগতভাবে স্থিরীকৃত জন্মতারিখের অল্প কয়েক বছর আগেই ঘটেছিল। এই কারণে কোনও কোনও ধর্মতত্ত্ববিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী মনে করেন, এই ধূমকেতুর আবির্ভাবই বেথলেহেমের তারা-সংক্রান্ত বাইবেলীয় কাহিনিটির ব্যাখ্যা প্রদান করতে পারে। অবশ্য এই ঘটনাটির ক্ষেত্রে গ্রহসংযোগ সহ অন্যান্য ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়ে থাকে এবং যিশুর জন্মতারিখের কাছাকাছি সময়ের মধ্যে অন্যান্য ধূমকেতুর আবির্ভাবের কথাও নথিবদ্ধ হয়েছে।[66]
যদি তালমুদ হোরায়োতে উল্লিখিত "প্রতি সত্তর বছরে একবার আবির্ভূত নক্ষত্র যেটি জাহাজের ক্যাপ্টেনদের ভ্রান্তি উৎপাদন করে"[67] (উপরে দেখুন) হ্যালির ধূমকেতুর দ্যোতক হয়, তাহলে এটি সম্ভবত ৬৬ খ্রিস্টাব্দে ধূমকেতুটির আবির্ভাবের বিবরণ। কারণ কথিত আছে যে উল্লিখিত পংক্তিটি রাব্বি জোশুয়া বেন হানানিয়াহ-র রচনা এবং জোশুয়া বেন হানানিয়াহ-র জীবদ্দশায় কেবলবাত্র ৬৬ খ্রিস্টাব্দেই হ্যালির ধূমকেতুর আবির্ভাব ঘটেছিল।[68]
১৪১ খ্রিস্টাব্দে হ্যালির ধূমকেতুর নিকট আবির্ভাবও চীনা কালপঞ্জিতে নথিভুক্ত হয়েছিল।[69]
৩৭৪ ও ৬০৭ খ্রিস্টাব্দের নিকট আবির্ভাবের সময় হ্যালির ধূমকেতু প্রতিবারেই পৃথিবীর ০.০৯ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের মধ্যে চলে এসেছিল।[64] কথিত আছে যে ৪৫১ খ্রিস্টাব্দের নিকট আবির্ভাবটি ছিল চ্যালোনসের যুদ্ধে হুনযোদ্ধা আতিলার পরাজয়ের পূর্বাভাস।[70] ৬৮৪ সালের নিকট আবির্ভাব ইউরোপে নথিবদ্ধ হয়েছিল ১৪৯৩ সালের নিউরেমবার্গ কালপঞ্জির সংকলকের ব্যবহৃত অন্যতম উৎসসূত্রে। উক্ত কালপঞ্জিটিতে ঘটনাটির আট শতাব্দী পূর্বের ধূমকেতুটির একটি বিবরণ ধৃত হয়েছিল।[71] চীনা নথিপথে এই বছরের ধূমকেতুটিকে বলা হয়েছিল "ঝাঁটা নক্ষত্র"।[72][25] ৮৩৭ সালে হ্যালির ধূমকেতু সম্ভবত পৃথিবীর ০.০৩ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের (৩২ লক্ষ মাইল; ৫১ লক্ষ কিলোমিটার) মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করেছিল যা এখনও পর্যন্ত জ্ঞাত পরিসংখ্যানগুলির মধ্যে নিকটতম আবির্ভাব।[64] এই সময় সম্ভবত ধূমকেতুটির পূচ্ছ আকাশে ৬০ ডিগ্রি জুড়ে প্রসারিত হয়েছিল। এই আবির্ভাবের ঘটনাটি চীন, জাপান, জার্মানি, বাইজানটাইন সাম্রাজ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নথিবদ্ধ করে রেখেছিলেন।[10] সম্রাট লুইস দ্য পায়াস এই আবির্ভাবটি পর্যবেক্ষণ করে নিজেকে প্রার্থনা ও স্বেচ্ছানুশোচনায় নিয়োজিত করেছিলেন এই ঘটনার জন্য "রাজ্যে পরিবর্তন ও রাজকুমারের মৃত্যুর কথা জানাজানি" হয়েছে মনে করে।[73] ৯১২ সালের হ্যালির ধূমকেতুর আগমন নথিবদ্ধ হয়েছিল অ্যানালস অফ আলস্টার-এ, যেখানে বলা হয় "এক অন্ধকার ও বর্ষণময় বছর। একটি ধূমকেতু আবির্ভূত হয়েছিল।"[74]
১০৬৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু ইংল্যান্ড থেকে দেখা গিয়েছিল এবং সেটিকে একটি অশুভ সংকেত মনে করা হয়েছিল: কারণ, সেই বছরই হেস্টিংসের যুদ্ধে ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় হ্যারোল্ড নিহত হন এবং দিগ্বিজয়ী উইলিয়াম সিংহাসন অধিকার করেন। বেউক্স টেপেস্ট্রিতে ধূমকেতুটি উল্লিখিত হয় এবং টাইট্যুলিতে এটি বর্ণিত হয় একটি নক্ষত্র হিসেবে। সেই যুগের যে সব বিবরণী পাওয়া গিয়েছে তাতে দেখা যায় যে ধূমকেতুটির বর্ণনায় বলা হয়েছে, এটি আকারে ছিল শুক্র গ্রহের চার গুণ এবং এর ঔজ্জ্বল্য ছিল চাঁদের ঔজ্জ্বল্যের এক-চতুর্থাংশ। সেইবার হ্যালির ধূমকেতু পৃথিবীর ০.১০ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক এককের মধ্যে চলে এসেছিল।[64]
অ্যাংলো-স্যাক্সন কালপঞ্জি-তেও এই ধূমকেতুর আবির্ভাবের কথা উল্লিখিত হয়েছিল। ম্যালমেসবেরির উইলিয়ামের মতে, ম্যালমেসবেরির এইলমার ৯৮৯ ও ১০৬৬ উভয় সালের হ্যালির ধূমকেতুই প্রত্যক্ষ করেছিলেন:
"অল্পকাল পরেই একটি ধূমকেতু আবির্ভূত হয়েছিল। ধূমকেতুটি (ওরা বলে) শূন্য আকাশপথে তার দীর্ঘ জ্বলন্ত কেশরাশির পিছু পিছু সরকারে একটি পরিবর্তনের পূর্বাভাস বয়ে এনেছিল: যে প্রসঙ্গে আমাদের মঠের এথেলমেয়ার নামে এক সন্ন্যাসী একটি সুন্দর কথা বলেন। ‘তুমি এসেছ, তাই না?’ দীপ্তিমান নক্ষত্রটি দেখে সন্ত্রস্ত হয়ে তিনি বলে ওঠেন। ‘তুমি এসেছ, বহু জননীর চোখের জলের হে উৎস। অনেক কাল আগে তোমাকে দেখেছিলাম; কিন্তু এবার দেখছি তুমি আরও অনেক বেশি ভয়ংকর, কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি তুমি আমার দেশের পতনকে আন্দোলিত করছ।’"[75]
আইরিশ অ্যানালস অফ দ্য ফোর মাস্টারস-এ এই ধূমকেতুটি বর্ণনায় বলা হয়: "একটি নক্ষত্র [যেটি] আবির্ভূত হয়েছিল মে মাসের সপ্তম ক্যালেন্ডে, লিটল ইস্টারের পরের মঙ্গলবারে, যার আলো থেকে চাঁদের ঔজ্জ্বল্য বা আলো অধিক ছিল না; এবং সেইভাবেই এটি পরবর্তী চারটি রাতের শেষ পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়েছিল।"[74][76] নিউ মেক্সিকোর চাকো নেটিভ আমেরিকানরা সম্ভবত তাদের পেট্রোগ্লিফে ১০৬৬ সালের নিকট আবির্ভাবের কথা নথিবদ্ধ করেছিল।[77]
ল্যুপাস দ্য প্রোটোসপ্যাথারিয়াসের ইতালো-বাইজানটাইন কালপঞ্জিতে উল্লিখিত হয়েছে যে, ১০৬৭ সালে আকাশে একটি "ধূমকেতু-নক্ষত্র" আবির্ভূত হয়েছিল (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কালপঞ্জিটিতে কিছু ভুল রয়েছে, কারণ ঘটনাটি ঘটেছিল ১০৬৬ সালে এবং "রবার্ট" বলতে তিনি উইলিয়াম বুঝিয়েছেন):
মে মাসে সম্রাট কনস্টানটাইন ড্যুকাসের মৃত্যু হয় এবং সম্রাটের পুত্র মাইকেল সাম্রাজ্য লাভ করেন। এই বছরই একটি ধূমকেতু নক্ষত্রের আবির্ভাব ঘটে এবং নর্মান কাউন্ট রবার্ট[sic] ইংরেজদের রাজা হ্যারোল্ডের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং রবার্ট জয়ী ও ইংরেজদের রাজা হন।[78]
সন্ন্যাসী এয়াডওয়াইন হ্যালির ধূমকেতুর ১১৪৫ সালের নিকট আবির্ভাব নথিবদ্ধ করেছিলেন। ১৯৮৬ সালের নিকট আবির্ভাবের সময় ধূমকেতুটিতে একটি পাখা পুচ্ছ দেখা গিয়েছিল, যা এয়াডওয়াইনের অঙ্কনের অনুরূপ ছিল।[72] কেউ কেউ দাবি করেন, ১২২২ সালের নিকট আবির্ভাব থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে চেঙ্গিস খাঁ ইউরোপ অভিমুখে নিজের সামরিক অভিযান প্রেরণ করেছিলেন।[79] শিল্পী গিওট্টো ডি বনডোনে ১৩০১ সালের নিকট আবির্ভাবটি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ১৩০৫ সালে সম্পূর্ণ গিওট্টোর অ্যারেনা চ্যাপেল চক্রের যিশুর জন্ম-বিষয়ক বিভাগে তিনি বেথলেহেমের তারাকে একটি আগুন-রঙা ধূমকেতু হিসেবে চিত্রিত করেন।[72] ১৩৭৮ সালের নিকট আবির্ভাবটি নথিবদ্ধ হয়েছিল অ্যানালেস মেডিওলেনেন্সেস-এ[80] এবং পূর্ব এশীয় নথিপত্রেও।[81]
ক্যাসিনি প্রথম ধারণা করেন যে ১৫৭৭, ১৬৬৫, ১৬৮০ সালের ধূমকেতু সম্ভবত একই। তার এই অসমাপ্ত ধারণা কাজে লাগিয়ে ১৩৩৭ সাল থেকে ১৬৯৮ সাল পর্যন্ত ২৪টি ধূমকেতুর তথ্য থেকে দেখান যে ১৫৩১, ১৬০৭, ১৬৮২ সালের ধূমকেতুর ভেতরে অনেক মিল। এর আগে নিউটন হ্যালীর একটি সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে কেপলারের সূত্র থেকে বিপরীত বর্গীয় নীতি প্রমাণ করেন যার নাম On the Motion of Bodies in Orbit . যার ফলে হ্যালী ধূমকেতুর কক্ষপথ উপবৃত্তাকার ধরে হিসাব করেন এবং ১৭০৫ সালে A Synopsis of the Astronomy of Comets এ দেখান যে ধূমকেতুটি ১৭৫৯ সালের শেষে দেখা যাবে। পরবর্তীতে Alexis Clairaut, Joseph Lalande এবং Nicole-Reine Lepaute এই তিনজন ফরাসি গণিতবিদের একটি দল তার হিসাবে শুদ্ধি আনেন এবং দেখান হ্যালীর হিসাব প্রায় সম্পূর্ণ সঠিক। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী করা অনুসূর দূরত্ব হয় ১৭৫৯ সালের মধ্য এপ্রিলে।
বিজ্ঞানী হ্যালী প্রথম দেখান যে ১৫৩১, ১৬০৭, ১৬৮২ সালের ধূমকেতু ১৭৫৯ সালের শেষে আবার দেখা যাবে। তার এই সফল হিসাবের জন্য এই ধূমকেতুর নাম হ্যালীর ধূমকেতু।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.