সোমনাথ মন্দির
ভারতের একটি শিবমন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতের একটি শিবমন্দির উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সোমনাথ মন্দির ভারতের একটি প্রসিদ্ধ শিব মন্দির। গুজরাত রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সৌরাষ্ট্র অঞ্চলের বেরাবলের নিকটস্থ প্রভাস ক্ষেত্রে এই মন্দির অবস্থিত। এটি হিন্দু দেবতা শিবের দ্বাদশ লিঙ্গের মধ্যে পবিত্রতম। সোমনাথ শব্দটির অর্থ “চন্দ্র দেবতার রক্ষাকর্তা”। সোমনাথ মন্দিরটি ‘চিরন্তন পীঠ’ নামে পরিচিত। কারণ অতীতে ছয় বার ধ্বংসপ্রাপ্ত হলেও মন্দিরটি সত্বর পুনর্নিমিত হয়।[1][2] ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে জুনাগড়ের ভারতভুক্তির সময় এই অঞ্চল পরিদর্শন করে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বর্তমান মন্দিরটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর মন্দিরের কাজ এগিয়ে নিয়ে যান ভারত সরকারের অপর এক মন্ত্রী কে. এম. মুন্সি।[3]
সোমনাথ মন্দির | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
অবস্থান | |
অবস্থান | বেরাবল, গুজরাত, ভারত ২০.৮° উত্তর ৭০.৪° পূর্ব |
স্থাপত্য | |
ধরন | চালুক্য |
সৃষ্টিকারী | সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল (বর্তমান মন্দির) |
ওয়েবসাইট | |
সোমনাথ মন্দির |
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, দক্ষ প্রজাপতি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে চন্দ্র প্রভাস তীর্থে শিবের আরাধনা করলে, শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এই কারণে চন্দ্র সোমনাথে শিবের একটি স্বর্ণমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্য ও কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠ দ্বারা মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন বলে বিশ্বাস। একাধিক মুসলিম আক্রমণকারী এবং শাসকদের দ্বারা বারবার ধ্বংসের পরে মন্দিরটি অতীতে বেশ কয়েকবার পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল। উল্লেখযোগ্যভাবে এগারো শতকে মাহমুদ গজনভি প্রথম মন্দিরটি আক্রমণ করেন।
সোমনাথ মন্দিরের আরাধ্য দেবতা শিব সোমেশ্বর মহাদেব নামে পরিচিত। পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগে সোমেশ্বর মহাদেব ভৈরবেশ্বর, ত্রেতাযুগে শ্রাবণিকেশ্বর ও দ্বাপর যুগে শ্রীগলেশ্বর নামে পরিচিত ছিলেন। চন্দ্র তাঁর স্ত্রী রোহিণীর প্রতি অত্যধিক আসক্তি বশত তাঁর অন্য ছাব্বিশ স্ত্রীকে উপেক্ষা করতে থাকেন। এই ছাব্বিশ জন ছিলেন দক্ষ প্রজাপতির কন্যা। এই কারণে দক্ষ তাঁকে ক্ষয়িত হওয়ার অভিশাপ দেন। প্রভাস তীর্থে চন্দ্র শিবের আরাধনা করলে শিব তাঁর অভিশাপ অংশত নির্মূল করেন। এরপর ব্রহ্মার উপদেশে কৃতজ্ঞতাবশত চন্দ্র সোমনাথে একটি স্বর্ণ শিবমন্দির নির্মাণ করেন। পরে রাবণ রৌপ্যে, কৃষ্ণ চন্দনকাষ্ঠে এবং রাজা ভীমদেব প্রস্তরে মন্দিরটি পুনর্নিমাণ করেছিলেন।[4][5][6]
কথিত আছে, সোমনাথের প্রথম মন্দিরটি খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকে বিদ্যমান ছিল।[7]
গুজরাতের বল্লভীর যাদব রাজারা ৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করে দেন।[7] ৭২৫ খ্রিস্টাব্দে সিন্ধের আরব শাসনকর্তা জুনায়েদ তাঁর সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে এই মন্দিরটি ধ্বংস করে দেন।[7] তারপর ৮১৫ খ্রিস্টাব্দে গুজ্জর প্রতিহার রাজা দ্বিতীয় নাগভট্ট সোমনাথের তৃতীয় মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল লাল বেলেপাথরে নির্মিত সুবিশাল একটি মন্দির।
১০২৪ খ্রিস্টাব্দে মামুদ গজনি আরেকবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন।[5][8] ১০২৬ থেকে ১০৪২ খ্রিস্টাব্দের মাঝে কোনো এক সময়ে গুজ্জর পরমার রাজা মালোয়ার ভোজ ও সোলাঙ্কি রাজা আনহিলওয়ারার প্রথম ভীমদেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। এই মন্দিরটি ছিল কাঠের তৈরি। কুমারপাল (রাজত্বকাল ১১৪৩-৭২) কাঠের বদলে একটি পাথরের মন্দির তৈরি করে দেন।[9][10]
১২৯৬ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলাউদ্দিন খিলজির সৈন্যবাহিনী পুনরায় মন্দিরটি ধ্বংস করে।[5][7][10] হাসান নিজামির তাজ-উল-মাসির লিখেছেন, গুজরাতের রাজা করণ পরাজিত হন, তাঁর সেনাবাহিনী পলায়ন করে, "পঞ্চাশ হাজার নীরিহ মানুষকে তরবারির আঘাতে নিহত করা হয়" এবং "বিজয়ীদের হাতে আসে কুড়ি হাজারেরও বেশি ক্রীতদাস ও অগণিত গবাদি পশু"।[7] ১৩০৮ খ্রিস্টাব্দে সৌরাষ্ট্রের চূড়াসম রাজা মহীপাল দেব আবার মন্দিরটি নির্মাণ করান। তাঁর পুত্র খেঙ্গর ১৩২৬ থেকে ১৩৫১ সালের মাঝে কোনো এক সময়ে মন্দিরে শিবলিঙ্গটি প্রতিষ্ঠা করেন।[10]
১৩৭৫ খ্রিস্টাব্দে গুজরাতের সুলতান প্রথম মুজফফর শাহ আবার মন্দিরটি ধ্বংস করেন।[7][10] মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হলে ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে গুজরাতের সুলতান মাহমুদ বেগদা আবার এটি ধ্বংস করে দেন।[5][7][10]
কিন্তু এবারও মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়। ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব মন্দিরটি ধ্বংস করেন।[7] আওরঙ্গজেব সোমনাথ মন্দিরের জায়গায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এই মসজিদে হিন্দু শাস্ত্র-ভিত্তিক মোটিফগুলি সম্পূর্ণ ঢাকা পড়েনি।[11]
পরে ১৭৮৩ সালে পুণের পেশোয়া, নাগপুরের রাজা ভোঁসলে, কোলহাপুরের ছত্রপতি ভোঁসলে, ইন্দোরের রানি অহল্যাবাই হোলকর ও গোয়ালিয়রের শ্রীমন্ত পাতিলবুয়া সিন্ধের যৌথ প্রচেষ্টায় মন্দিরটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তবে মূল মন্দিরটি মসজিদে পরিণত হওয়ায় সেই জায়গায় মন্দির প্রতিষ্ঠা করা যায় নি। মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ধ্বংসাবশেষের পাশে।[11]
নিচের উদ্ধৃতিটি তেরো শতকের আরব ভূগোলবিদ আসারু-ল-বিলাদের লেখা ওয়ান্ডারস অফ থিংস ক্রিয়েটেড, অ্যান্ড মার্ভেলস অফ থিংস এক্সিস্টিং বই থেকে নেওয়া। এতে সোমনাথ মন্দির ও তার ধ্বংসের বিবরণ পাওয়া যায়:[8]
“সোমনাথ: ভারতের বিখ্যাত শহর, সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত এবং সমুদ্রের তরঙ্গবিধৌত। এই স্থানের বিস্ময়কর স্থানগুলির মধ্যে একটি হল এক মন্দির যেখানে সোমনাথ নামে একটি বিগ্রহ রয়েছে। বিগ্রহটি মন্দিরের মাঝখানে নিচের কোনোরকম ঠেকনা ছাড়াই উপর থেকে ঝুলে রয়েছে। হিন্দুরা এটিকে খুব শ্রদ্ধা করে। বিগ্রহটিকে ওভাবে ঝুলতে দেখে মুসলমানই হোক, আর কাফেরই হোক, সবাই আশ্চর্য হয়ে যায়। চন্দ্রগ্রহণের দিন হিন্দুরা এই মন্দিরে তীর্থ করতে আসে। সেই সময় লক্ষ লক্ষ লোক এই মন্দিরে ভিড় জমান।"
“সুলতান ইয়ামিনু-দ দৌলা মাহমুদ বিন সুবুক্তিগিন ভারতের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ ঘোষণা করলেন। তিনি ভেবেছিলেন সোমনাথ ধ্বংস করে দিলেই হিন্দুদের মুসলমান করা যাবে। তাই তিনি সোমনাথ ধ্বংস করার ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান হন। এর ফলে হাজার হাজার হিন্দুকে জোর করে মুসলমান করা হয়। তিনি ৪১৬ হিজরির জিল্কাদা মাসের মাঝামাঝি সময় (১০২৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে) এসেছিলেন।
"বিহগ্রের দিকে সুলতান আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর লুটের মাল নিয়ে যাওয়ার হুকুম দিলেন। ধনসম্পদ তাঁর খুব পছন্দ হয়েছিল। সেখানে সোনা ও রুপো দিয়ে তৈরি অনেক মূর্তি ছিল। রত্নখচিত অনেক পাত্র ছিল। ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সেসব জিনিস সেই মন্দিরে পাঠিয়েছিলেন। মন্দির থেকে লুণ্ঠিত দ্রব্যের মোট অর্থমূল্য ছিল কুড়ি হাজার দিনারেরও বেশি।"
স্বাধীনতার আগে, প্রভাস পত্তন ছিল দেশীয় রাজ্য জুনাগড়ের অংশ। জুনাগড়ের ভারতভুক্তির পর ১৯৪৭ সালের ১২ নভেম্বর ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের তৎকালীন উপ-প্রধানমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল জুনাগড়-পুনর্গঠনের জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনীকে উপযুক্ত নির্দেশ দিতে আসেন। সেই সময়ই তিনি সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের আদেশ দেন।[13]
সর্দার প্যাটেল, কে এম মুন্সি ও কংগ্রেসের অন্যান্য নেতারা সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের প্রস্তাব নিয়ে মহাত্মা গান্ধীর কাছে গেলে, গান্ধীজি তাঁদের আশীর্বাদ করেন। তবে তিনি বলেন, মন্দির নির্মাণের খরচ যেন সরকার বহন না করে। তিনি জনগণের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহের পরামর্শ দেন। পুনর্নির্মাণের কাজে যুক্ত হতে পেরে তিনি নিজে গর্বিত, এমন কথাও বলেন।[14] কিন্তু তারপরই গান্ধীজি ও সর্দার প্যাটেলের মৃত্যু হলে, নেহেরু সরকারের খাদ্য ও সরবরাহ মন্ত্রী কে এম মুন্সি একাই মন্দির পুনর্নির্মাণের কাজটি এগিয়ে নিয়ে চলে।[14]
১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে ধ্বংসাবশেষ সাফ করে ফেলা হয়। আওরঙ্গজেব নির্মিত মসজিদটি কয়েক মাইল দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।[15] ১৯৫১ সালের মে মাসে কে এম মুন্সির আমন্ত্রণে ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ মন্দিরের শিলান্যাস করেন।[16] রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁর ভাষণে বলেন, "যেদিন শুধুমাত্র এই ভিত্তির উপর এক অসামান্য মন্দিরই নির্মিত হবে না, বরং প্রাচীন সোমনাথ মন্দির ভারতের যে ঐশ্বর্যের প্রতীক ছিল, সেই ঐশ্বর্য ভারত ফিরে পাবে, সেইদিনই আমার দৃষ্টিতে সোমনাথ মন্দির পুননির্মিত হবে।"[17] তিনি আরও বলেন, "ধ্বংসের শক্তির চেয়ে যে সৃষ্টির শক্তি মহৎ তার প্রতীক সোমনাথ মন্দির।"[17]
এই সময় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সির মধ্যে এক মতান্তর দেখা দেয়। নেহেরু এই মন্দির পুনর্নির্মাণকে হিন্দু পুনর্জাগরণ আন্দোলন হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু রাজেন্দ্র প্রসাদ ও কে এম মুন্সি মনে করেছিলেন, এই মন্দির পুনর্নির্মাণ স্বাধীনতার ফলস্রুতি এবং অতীতে হিন্দুদের বিরুদ্ধে হওয়া অবিচারের প্রতিকার।[17]
সোমনাথ মন্দির বর্তমানে শ্রীসোমনাথ ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত হয়।[18]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.