Loading AI tools
ইতিহাসের বিভিন্ন দিক উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সমকামী সম্পর্ককে সময়ে সময়ে স্থানে স্থানে, সমাজ বিভিন্ন ভাবে মূল্যায়ন বা অবমূল্যায়ন করেছে। কেউ কেউ ভেবেছে, সমকামিতাকে সমাজে স্বীকৃতি দিলে সমস্ত পুরুষই এই সম্পর্কে জড়িয়ে যাবে; যদিও এর চর্চাকে লঘু পাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবুও সমাজের আইনি ব্যবস্থায় একে বাধা দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও আইনের মাধ্যমে এর চর্চাকারীদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রাখা হয়েছে। গুয়েন ব্রোউড ও সারাহ গ্রিন ১৯৭৬ সালের নৃকুলবিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণায় সমাজে সমকামিতার অবস্থা তুলে ধরেছেন। তারা দেখেছেন, ৪২ টি সম্প্রদায়ের মধ্যে ৯ টি সমাজে সমকামিতাকে স্বীকৃতি অথবা উপেক্ষা করা হয়েছে। ৫ টি সম্প্রদায়ে সমকামিতা সম্বন্ধে কোনো ধারণাই নেই। ১১ টি সম্প্রদায় একে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেছে কিন্তু কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করেনি এবং ১৭টি সম্প্রদায় সমকামিতার প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছে এবং শাস্তির ব্যবস্থা করেছে। ৭০টি সম্প্রদায়ের মধ্যে ৪১ টি সম্প্রদায়ে সমকামিতা অনুপস্থিত অথবা দুর্লভ এবং বাকি ২৯টি সম্প্রদায়ের মধ্যে এটি দেখা যায় ও দুর্লভ নয়।[1][2] এর চর্চা প্রাচীন গ্রিসে অনেক বেশি দেখা যেত যদিও পরবর্তীতে আব্রাহামিক ধর্ম, আইন এবং চার্চ এর কারণে সংস্কৃতি প্রভাবিত হয়। চার্চ সমকামিতাকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ অথবা ঐশ্বরিক আইনের লঙ্ঘন বলে অভিমত দিয়ে। একে রুখতে প্রতিষ্ঠা করে সডোমী আইন।
ইতিহাসের অনেক চরিত্র – যেমন সক্রেটিস, লর্ড বাইরন, দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, হেড্রিয়ান[3] – এদের বেলায় সমকামী বা উভকামী বর্ণনাটা ব্যবহার করা হয়েছে। মাইকেল ফোকাল্ট এর মত কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সমাজের গঠনে তখন এই বিষয়টা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা না থাকায়, তাদের যৌন অভিমুখিতার ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে জানা যায় না।[4] যদিও অনেকে তার এ বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেছে।[5] সমাজতত্ত্ব গঠন সংক্রান্ত বর্তমান যুগের চিন্তা-ভাবনা অনুযায়ী প্রাচীন বা মধ্য যুগে কেউ সমকামিতাকে একটি একচেটিয়া, চিরস্থায়ী অথবা যৌনতার অর্থনিরুপক হিসেবে অনুভব করেন নি। জন বসওয়েল এটার বিপরীতে আবার প্লেটোর গ্রীক লেখার উদাহরণ তুলে ধরেছেন[6] যেখানে ব্যক্তিদের মাঝে স্বতন্ত্র সমকামিতার দৃষ্টান্ত রয়েছে।
ইউরোপীয় কলোনীর পূর্বে আমেরিকার ইন্ডিজিনাস মানুষদের কিছু জাতির মধ্যে কাওকে দ্বৈত আত্মা বলা হত উনারা সমকামিতার চর্চা করতেন বলে বিশ্বাস করা হয়।[7] যদিও প্রত্যেক ইন্ডিজিনাস সংস্কৃতির নিজস্ব চর্চার নাম ছিল[8] আধুনিক প্যান-ইন্ডিয়ানরা ঐক্যবদ্ধভাবে "টু-স্পিরিট (দ্বৈত আত্মা)" বলে অভিহিত করে।[9] সমাজে তারা বিশেষ কাজগুলো করতেন। তাদের সম্মান করা হত।
সমকামিতা এবং রুপান্তরকামিতা লাতিন আমেরিকায় মার্কিনীদের কলোনী করার পূর্বে আজটেক, মায়া সভ্যতা, কুইচুয়াস, মোচে, যাপোটেক, এবং ব্রাজিলের ট্রুপিনাম্বাতে দেখা যেত।[10][11]
স্পেন বিজয়ীরা স্থানীয় জাতির মধ্যে সডোমীকে উন্মুক্তভাবে চর্চা করতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পরে। একে বারডেচ নামে (স্পেনীয়রা টু স্পিরিটকে এই নামে ডাকত) অভিহিত করে, তাদের শাস্তির আওতায় আনার ঘোষণা দেয়। উন্মুক্ত জনতার সামনে ফাসিঁ, পুড়িয়ে মারা ও কুকুর দ্বারা ছিড়ে ফেলার কাজ শুরু করে।[12]
পূর্ব এশিয়ার প্রাচীন ইতিহাসে সম প্রেমের অস্তিত্ব আছে; এমনটাই দেখা যায়।
আনুমানিক ছয়শো খ্রিস্টপূর্বে চীনে সমকামিতা, শব্দটি আকর্ষণীয় স্থানে দংশনের আনন্দ, ছিন্ন কর্তন, দক্ষিণীয় প্রথা নামে পরিচিত ছিল। এই মোলায়েম শব্দগুলো কারো স্বভাব ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হতো তার পরিচয় নয়। (সাম্প্রতিক সময়ে কেতাদুরস্ত আধুনিক চাইনিজ তরুণরা মোলায়েম ভাবেই ব্রোকব্যাক, 斷背, দুনবেইয়ের মত শব্দগুচ্ছ সমকামী পুরুষদের পরিচয়ে ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। চাইনীজ পরিচালক অং লি তার চলচ্চিত্রের নাম ব্রোকব্যাক মাউন্টেন রাখেন)।[13] এই সম্পর্ক বয়স এবং সামাজিক অবস্থান হিসেবে ভিন্ন হয়। যাইহোক সমলিঙ্গে আকর্ষণ এবং যৌন মিথস্ক্রিয়া ধ্রুপদী উপন্যাস ড্রিম অব দ্য রেড চেম্বারে বর্ণিত হয়েছে। যা বর্তমানে সাথেও পরিচিত। বিষমকামী মানুষদের মধ্যে প্রেমের সময়ে ঘটা ঘটনাক্রম যেভাবে গল্পে উঠে আসে কালোত্তীর্ণ উপন্যাসটিতে সমপ্রেম একইভাবে উঠে এসেছে।
জাপানে সমকামিতা, বিভিন্ন রকম নাম যেমন সুডো অথবা ননসোকু নামে ইতিহাসে হাজার বছর ধরে পরিচিত এবং এর সাথে বুদ্ধের সন্নাসী জীবন ও সামুরাই ঐতিহ্যের একটা সংযোগ আছে। সম্পলিঙ্গে ভালোবাসার এই সংস্কৃতি চিত্রকলা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে ফুটিয়ে উঠতে ব্যাপকভাবে দায়ী।
একইরুপ থাইল্যাণ্ডেও এটিক্যাথোয়ে, অথবা "লেডিবয়েজ" নামে বহু শতক ধরে পরিচিত হয়ে আসছে। থাই রাজাদের পুরুষ ও নারী ভালোবাসার মানুষ একই সাথে থাকত। যদিও ক্যাথোয়ে দ্বারা স্ত্রীজোনিত ভাব অথবা বিপরীত লিঙ্গের পোশাকের প্রতি আগ্রহকে বুঝায়; তথাপি থাই সংস্কৃতিতে এই শব্দটি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অভিহিত করতে ব্যবহৃত হয়। তারা সমাজ কর্তৃক স্বীকৃত এবং থাইল্যান্ড কখনোই সমকামিতা বা সমকামী আচরণের উপর কোনো আইনি বাধা প্রয়োগ করে নি।
প্রাচীন পশ্চিমা নথি (মূলত সাহিত্যিক কাজ শৈল্পিক বিষয়বস্তু এবং গ্রিক পুরাণ) থেকে বুঝা যায় সমকামিতা সম্পর্কটি এসেছে প্রাচীন গ্রিস থেকে
এমস সিবান্ডা হোমোসেক্সুয়ালিটি-- ম্যান V গড এ বলেছেন, "সমকামিতা প্রসঙ্গে এই নথিগুলো থেকে যা বুঝা যায়; তা হলো একজন পুরুষের প্রেমের প্রয়োজনীয় ভিত্তিই ছিল নারীর সাথে ও কিশোর/যুবকের সাথে প্রেম করা। শহরগুলোতে সমকামিতার একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি ছিল।[14]
প্রাথমিক ভাবে স্বাধীন বয়স্ক পুরুষ ও স্বাধীন কিশোরের মধ্যে, সমকামিতা সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল। প্লেটো তার প্রথম দিকের লেখায় এর প্রশংসা করেন।[15] কিন্তু তার পরবর্তী কাজে তিনি এর নিষিদ্ধের প্রস্তাবনা দেন।সিম্পোজিয়ামে (১৮২বি-ডি) প্লেটো সমকামিতার গ্রহণযোগ্যতাকে গনতন্ত্রের সাথে ও এটার দমনকে স্বৈরতন্ত্রের সাথে তুলনা করেন। তিনি বলেনঃ “বর্বরদের স্বৈরতান্ত্রিক সরকার থাকার কারণেই তাদের কাছে সমকামিতা ছিল একটি লজ্জাজনক বিষয় – ঠিক যেমনটি ছিল দর্শন, শরীরচর্চার ক্ষেত্রে। এটা স্পষ্ট যে, ভালবাসার ফলশ্রুতিতে শক্তিশালী বন্ধুত্ব বা দৈহিক মিলনের মত মহান ধারণা - যা এই সব শাসকদের অধীনস্তদের মাঝে প্রতিপালন ছিল কিছুটা হুমকি স্বরূপ”।[6] “পলিটিক্স” লেখায় আরিস্টটল অবশ্য বর্বরদের মাঝে প্লেটোর বর্ণিত সমকামভীতির চিত্রটা নাকচ করেছেন (২.৪)। তিনি বলেন কেল্টদের মত বর্বররা এই যৌনতাটিকে বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতো (২.৬.৬) এবং ক্রেটানরা এটাকে জন্মনিয়ন্ত্রণ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করতো (২.৭.৫)।[6]
প্রাচীনকালে নারীর সমকামিতা সম্বন্ধে খুব অল্পই জানা গিয়েছে। সাপফো, লেসবো দ্বীপে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি পরবর্তীতে গ্রিকদের দ্বারা ধর্মীয় তালিকা নাইন লিরিক্স পয়েটে অন্তর্ভুক্ত হন। ১৯ শতকের শুরুতে নারী সমকামীদের যে বিশেষণে বিশেষায়িত করা হয়, তা তার নাম ও জন্মস্থান থেকে এসেছে (সাপ্পফিক ও লেসবিয়ান)[16][17] সাফোর কবিতায় দুই ধরনের লিঙ্গের প্রতিই ছিল গভীর প্রেম, ভালোবাসা। যারা এই কবিতা আবৃত্তি করত, তারাও প্রেমের সাথে তা বলত, কিন্তু দুইজন নারীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক কীভাবে হত, তার বর্ণনাকারী ছিল খুবই সীমিত এবং তা বিতর্কের বিষয়।।[18][19]
প্রাচীন রোমে, তরুণ পুরুষ শরীর যৌনতার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। কিন্তু সম্পর্ক হত স্বাধীন বয়স্ক পুরুষ ও ক্রীতদাস অথবা স্বাধীন তরুনের (যে গ্রহণ করত) মধ্যে।[20] ক্লডিয়াস ছাড়া সকল সম্রাটেরই পুরুষ প্রেমিক ছিল।[21] হেলিনোফাইল সম্রাট হার্দিয়ান তার পুরুষ প্রেমিক এন্টিনুসের সাথে সম্পর্কের জন্য প্রখ্যাত। যাইহোক ৩৯০ খ্রিষ্ঠাব্দে সম্রাট প্রথম থিওডোসিয়াস সমকামিতার জন্য শাস্তির বিধান চালু করেন। এই শাস্তির বিধান মুলত সেসব পুরুষদের জন্য ছিল, যারা সঙ্গমের সময় নারীর ন্যায় ভূমিকা পালন করত।[22] জাস্টিনিয়ান তার রাজত্বের শেষ সময়ে এসে এই শাস্তি সেসব এক্টিভ পার্টনার (যারা সঙ্গমের সময় পুরুষোচিত ভূমিকা পালন করে) এর জন্যও বলবৎ করে (৫৫৮ তে), সেখানে সতর্ক করে বলা হয়, এসমস্ত কার্যক্রমের জন্য ঈশ্বর প্রতিশোধ হিসেবে শহর ধ্বংস করে নিবে। এর পাশাপাশি যেসব পতিতালয়ে অর্থের বিনিময়ে সমকামী ক্রিয়া করা হত, সেখানেও ট্যাক্স আরোপ করা হয়, এ কর্মকাণ্ড বলবৎ থাকে ৬১৮ এর প্রথম এনাস্টাসিয়াসের সময় পর্যন্ত।[23]
রেনেসাঁর সময় উন্নত শহর যেমন, উত্তর ইতালী—ফ্লোরেন্স এবং ভেনিসে সুনির্দিষ্টভাবে সমপ্রেমের চর্চা হত, তারা গ্রিস ও রোমের ঐতিহ্য অনুসরণ করত।[24][25] কিন্তু অফিসারস অব দ্য নাইট আদালত সমপ্রেমী পুরুষরা বিবাহ করলে; তাদের শাস্তি দিত, অর্থদণ্ড দিত, জেলে কারাবাস দিত।[26] এই যে প্রেমমুলক একটা স্বাধীনতা ছিল, শিল্পকলায় সমকামিতার অস্তিত্ব ছিল; এটি সন্নাসী গিরোলামো সাভোনারোলার নৈতিকতার উত্থানের সময় ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে।[27]
সামাজিক ভাবে প্রখ্যাত ব্যক্তি রাজা প্রথম জেমস ও বাকিংহামের প্রথম নৃপতির মধ্যে সম্পর্ক ছিল বলে ধরা হয়। একজন বেনামী গ্রন্থাকারের তাদের উদ্দেশ্য করে বইয়ে লিখেন, "সমাজ পালটে গেছে, আমি জানি না কীভাবে। পুরুষ এখন পুরুষকে চুমু দেয়, নারীকে নয় এভাবে"[28]
১৭২৩ সালে ইংল্যান্ডে লাভ লেটারস বিটউইন অ্যা সার্টেইন লেট নোবেলম্যান এন্ড দ্য ফেমাস মি.উইলসন প্রকাশ হয়। আধুনিক বিশেষজ্ঞরা একে উপন্যাস হিসেবেই অনুমান করেছেন।[29]
১৭৪৯ সালের জন ক্লেল্যান্ডের জনপ্রিয় উপন্যাস ফ্যান্সি হিলের অতিরিক্ত সংযোজনে সমকামিতার পট ছিল। কিন্তু তা ১৯৫০ সালের সংস্করণে অপসারণ করা হয়।[30][31] থমাস ক্যানোন ১৭৪৯ সালে সম্প্রসারিত এবং গুরুতরভাবে সমকামিতার পক্ষে সমর্থনকারী বই এন্সিন্ট এন্ড মডার্ন পেডেরাস্টি ইনভেস্টিগেটেড এন্ড এক্সেমপ্লিফায়েড প্রকাশ করেন। যা সাথে সাথেই নিষিদ্ধ করা হয়। সেখানে এই অনুচ্ছেদটি অন্তর্ভুক্ত ছিল, "অপ্রাকৃতিক ইচ্ছা কালের সাথে সাংঘর্ষিক, এটা নিতান্তই অর্থহীন কথা। এই ধরনের ইচ্ছা একপ্রকার ভালোবাসাই, যা মানবমনের গভীরতম স্নেহশীল উদ্দীপনা।"[32] ১৭৮৫ সালের দিকে জেরমি বেনথাম সমকামিতার পক্ষে আরো একটি বই লিখেন, কিন্তু তা ১৯৭৮ সালের পূর্বে প্রকাশ হয় নি।[33] নেদারল্যান্ডে ১৮০৩ পর্যন্ত এবং ইংল্যান্ডে ১৮৩৫ পর্যন্ত সডোমীর চর্চাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।
১৮৬৪ থেকে ১৮৮০ এর মধ্যে কার্ল হেনরিচ উলরিচ ১২ টি পুস্তিকার গবেষণামুলক সিরিজ প্রকাশ করেন। এর শিরোনাম দেন "রিসার্চ অন দ্য রিডল অব ম্যান-ম্যনলি লাভ"। ১৮৬৭ সালে তিনিই নিজেকে সমকামী বলে সর্বসম্মুখে ঘোষণা দেন। মিউনিখের কনগ্রেস অব জার্মান জুরিস্টিসে সমকামী বিরোধী আইনের বিরুদ্ধে তিনি আপীল করেন। হ্যাভেলক এলিস ১৮৯৬ সালে প্রকাশ করেন সেক্সুয়াল ইনভার্সন; সেখানে তিনি সমকামিতা অস্বাভাবিক; এই ধারণাটিকে চ্যলেঞ্জ করেন। একই সাথে তিনি সমকামিতার উপস্থিতি যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শিল্প সমাজে সর্বব্যাপী; তা তুলে ধরেন।[34] যদিও সেসময়ের চিকিৎসা শাস্ত্রে যৌনতা বিষয়টা ক্ষীন ভাবে তুলে ধরা হয়েছিল এবং সাধারণ জনগণও এ বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিল না, তদাপি ম্যগনাস হিরসচেফেল্ডের সায়েন্টিফিক হিউম্যানিটারিয়ান কমিটি ১৮৯৭ থেকে ১৯৩৩ পর্যন্ত এ বিষয়টি সর্বসম্মুখে নিয়ে আসার প্রয়াস করে, এ কমিটি জার্মানীর সডোমী আইনের বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন করে। তবে এধরনের ক্যাম্পেইন গুলো অনাড়াম্বর ভাবে করা হত; ফলে ব্রিটিশ বুদ্ধিজীবী ও লেখকরা এবিষয়ে খুব একটা লিখালিখি করতেন না। কিন্তু এডওয়ার্ড কার্পেন্টার ও জন এডিংটন সিমন্ডস এবিষয়ে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ১৮৯৪ সালের শুরুতে তিনি হোমোজেনিক লাভ সহ বিভিন্ন বই, পুস্তিকা লিখেন। এরপর নিজেকে সমকামী হিসাবে স্বীকার করেন, ১৯১৬ সালে তার বই মাই ডেইস এন্ড ড্রিমস এর মাধ্যমে। ১৯০০ সালে এলিসার ভন কুপার প্রাচীন সাহিত্য থেকে তার সময়কালে সমকামিতা কীভাবে বিস্তৃত তা নিয়ে লেইব্লিংমিন উন্ড ফ্রিউন্ডেস্লিবে ইন ডের ওয়েল্টলিটারেটুর শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তার লক্ষ্য ছিল, সমকামিতাকে জীববিজ্ঞান এবং চিকিৎসা শাস্ত্র কী রুপে দেখে তার পাশাপাশি এটি সংস্কৃতিতে কীরুপে বিদ্যমান ছিল তা জনগণকে জানানো। কিন্তু পক্ষান্তরে তৃতীয় রাইখের হলোকাস্টের সময় এলজিবিটি মানুষদের উপর বিশেষ করে আক্রমণ হত।[35]
মুষ্টিমেয় কিছু আরব পর্যটক ১৮০০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে রিফাত আল তাহতোয়াই এবং মুহম্মদ আল-সাফার নামক দুইজন পর্যটক তাদের বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেন, ফরাসিরা তাদের নিয়ম ও নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভালোবাসার কবিতা শুধুমাত্র বিপরীত লিঙ্গের উদ্দেশ্যে লিখে; সমলিঙ্গের প্রতি নয়।[36]
পূর্ব মধ্যপ্রাচ্যীয় মুসলিম সংস্কৃতিতে সমকামিতার চর্চা বহুদুর বিস্তৃত থাকলেও ক্রমে ক্রমে তা নিষিদ্ধ করা হয়। সাম্প্রতিক সময় গুলোতে সমলিঙ্গে প্রেম ইউরোপীয় মডেল অনুসরণ করে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা চলছে; যদিও তা বিরল। ৭ টি মুসলিম দেশে সমকামিতা চর্চা করলে তার ফলে মৃত্যুদণ্ডের ন্যায় বিধান রাখা হয়েছে। দেশগুলো হলো: সৌদি আরব, ইরান, মাউরিটানিয়া, উত্তর নাইজেদিয়া, সুদান এবং ইয়েমেন।[37]
বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের সরকার সমকামিতার অস্তিত্বকেই তাদের দেশে অস্বীকার করছে এবং একে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করছে। ইরানের রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ, ২০০৭ সালে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভাষণে বলেছেন, ইরানে কোনো সমকামী নেই। ইরানে সমকামী থাকলেও সেখানকার পরিস্থিতি সমকামীদের জন্য এতটাই বৈরী যে; তাদের লুকিয়ে থাকতে হয়।[38]
প্রাচীন আসীরীয় সমাজে এটি বিশ্বাস করা হত যে; কোনো পুরুষ যদি তার সমমর্যাদার পুরুষের সাথে যৌনাচারণ অথবা সাংস্কৃতিক পতিতাবৃত্তি করে; তাহলে সমস্যা থেকে তার মুক্তি ঘটবে এবং সে হয়ে উঠবে সৌভাগ্যবান।[39] সুপ্রাচীন কিছু আসীরীয় গ্রন্থে প্রার্থনাসংবলিত মন্ত্র ছিল; যা সমকামী সম্পর্ককে ঐশ্বরিক আশীর্বাদ পুষ্ট হওয়ার জন্য উচ্চারণ করা হত।[40][41] ৩ সহস্র খ্রিষ্ঠপূর্ব থেকে সে সমাজে পায়ুসঙ্গম ধর্মীয় অনুষ্ঠান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[42] মেসোপটেমীয়দের ধর্মীয় জীবন ব্যবস্থায় মন্দিরের অভ্যন্তরে সমকামিতার চর্চা করা ধর্মীয় অংশ ছিল এবং কেও যদি পূজা-অর্চনার বাইরে এই সমকামিতার চর্চা করত; তবে তাকে কোনো ভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হত না।[41][43] কিছু রাজার পুরুষ প্রেমিক ছিল এবং— জিমরি-লিন (মারীর রাজা) ও হামুরাবি (ব্যবিলনের রাজা) উভয়ই পুরুষের সাথে শয়ন করতেন।[41] রাজাদের পরিচায়কের সাথে অথবা যোদ্ধাদের নিজেদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক থাকলেও সামাজিক ভাবে উৎকৃষ্ট কারো সাথে তার সম্মতি ব্যতিরেকে যদি পায়ুসঙ্গম হয়; তবে একে ধর্ষণ অথবা খারাপ লক্ষণ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যার ফলে শাস্তির ব্যবস্থা করা হত।[44][45]
হিন্দু আইনের মুল ভিত্তি মনুসুত্রীয় আইনে, তৃতীয় লিঙ্গের সদস্যরা; প্রচলিত লিঙ্গ যেভাবে তাদের যৌনতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়; তার বাইরে গিয়ে যৌন অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে পারা আর সমকামিতা মুলক কর্মকাণ্ড করাকে স্বীকৃতি দিয়েছে।[46]
মেলানেসিয়ার বিভিন্ন সমাজে; বিশেষ করে পাপুয়া নিউ গিনিতে গত শতাব্দির মধ্যভাগের পূর্ব পর্যন্ত সমলিঙ্গে সম্পর্ক তাদের সংস্কৃতিরই অখণ্ড অংশ ছিল। উদাহরণস্বরূপ; ইটোরো এবং মারিন্ড আনিম মানুষ বিষমকামিতাকে পাপ হিসেবে দেখত ও সমকামিতাকে উৎযাপন করত। মেলানেসিয়ার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে; কোনো বালকের বয়ঃসন্ধির পূর্বে বয়স্ক কিশোরের সাথে সে জুটি বাধত। তরুনটি তার পরামর্শদাতা হত এবং তার সাথে যৌনাচার করত (মৌখিক, পায়ু বা উপজাতীয় নীতিতে)। অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেটি যতদিন না বয়ঃসন্ধিকাল অতিক্রম করছে ততদিন এভাবে চলত। যাইহোক, ইউরোপীয় মিশনারীদের তৎপরতায় খ্রিষ্ঠান ধর্মে দীক্ষিতকরণের জন্য অনেক মেলানেসিয়ান সমাজে বর্তমানে সমকামিতা ঘৃণ্য হয়ে উঠছে।[47]
মিশরে সমকামিতা মিশরীয় ত্বাত্তিক ও ইতিহাসবেত্তাদের জন্য বিতর্কিত বিষয়। এটা এখনো সুষ্পষ্টভাবে জানা যায় নি যে, কীভাবে প্রাচীন মিশরীয় সমাজে সমকামিতাকে দেখা হত। এই বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ জল্পনা কল্পনা আছে, আছে নানা গুজব প্রচলিতও। তবে ব্যতিক্রমও আছে
এরকম ব্যতিক্রম এবং প্রাচীন মিশরে সমকামিতা থাকার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে রাজবংশের ২ জন সরকারী কর্মকর্তা নায়ানখ-খুনুম এবং খুনুম হটেপ এর ক্ষেত্রে। উভয় পুরুষই ফারাও নিউসেরের অধীনে ৫ম রাজত্বে (আনুমানিক ২৪৯৪–২৩৪৫ খ্রিষ্ঠপূর্ব) কাজ করতেন।[48] নিয়ানখ খুনুম ও খুনুম হতেপের নিজেদের পরিবার ছিল, সে পরিবারে সন্তান ও স্ত্রীও ছিল। কিন্তু যখন তারা মারা যান, অনুমান করা যায়; তাদেরকে একত্রে এবং একই মাসাটাবা সমাধিতে সমাধিস্থ করা হয়। এই সমাধিতে বেশ কিছু চিত্র ছিল, যেখানে দেখা যায়, এই দুইজন পুরুষ একে অপরকে আলিঙ্গন করছে, মুখে মুখ ও নাকে নাক ঘষছে। এই চিত্রাঙ্কন অনেক ধরনের কল্পনার জন্ম দিয়েছে, কারণ প্রাচীন মিশরে নাকের সাথে নাক স্পর্শ চুম্বনকে বুঝানো হত।[48]
অনেক মিশরীয় তাত্ত্বিক ও ইতিহাসবেত্তারা; নিয়ানখ-খুনুম ও খুনুম হতেপের চিত্রকলার যে ব্যাখ্যা দাড় করানো হয়েছে, তার সাথে দ্বিমত পোষন করেছেন। কিছু বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই চিত্রকলা সমকামী দুইজন পুরুষের বিবাহের উদাহরণ এবং প্রাচীন মিশর এই সমকামিতাকে স্বীকার করেছে, এটাই এখান থেকে প্রতিভাত হয়।[49] অন্যান্য কিছু গবেষক এর সাথে দ্বিমত পোষণ করেছে, এবং এই চিত্রকলা থেকে ব্যাখ্যা করেছেন যে নিয়ানখ-খুনম ও খুনম-হতেপ হয়ত জমজ এমনকি এও হতে পারে তারা যুগ্ন জমজ। এটা কোনো বিষয় নয়, কোন ব্যাখ্যাটা সঠিক, তবে এটা পরিষ্কার যে, নিয়ানখ-খুনম ও খুনম-হতেপ একে অপরের খুব কাছে ছিল, বেচেঁ থাকার সময়েও, এবং মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারে নি।[48]
এটা এখনো অস্পষ্ট যে, প্রাচীন মিশরীয়রা সমকামিদের নিয়ে কী ভাবত। কোনো দলিল এবং সাহিত্যে, যৌন অভিমুখিতা সংক্রান্ত বিষয়, সরাসরি উল্লেখ ছিল না। বিষয়টা নানা অলঙ্কারিকভাবে উল্লেখকরা হত। সিথ এবং তার যৌন স্বভাবের গল্প, নেতিবাচক ভাবধারা দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রাচীন মিশরীয় দলিলে এটাও সুষ্পষ্টভাবে বলা হয় নি যে, সমকামিতা সম্পর্ক নিন্দনীয় বা ঘৃণ্য এবং কোনো প্রাচীন মিশরীয় দলিলে সমকামিতার বিরুদ্ধে আইনগত বিধানও প্রয়োগ করা হয় নি। এইজন্য এই বিষয়ের উপর সরাসরি মুল্যায়ন করা খুবই দুষ্কর।[48][50]
১৯ শতকে বুগান্ডার রাজা দ্বিতীয় মুয়াংগা (১৮৬৮-১৯০৩) তার বালক ভৃত্যের সাথে নিয়মিত সঙ্গমে লিপ্ত হত।[51]
ইথিওপিয়া বাইবারে (১৯০৯) ইউরেনিসমের (সমকামিতার অন্য নাম) বিরোধিতা করা হয়। সেমিটিক হারারী মানুষদের কাছে সডোমী অপরিচিত ছিল না। যদিও খুব বেশি চর্চা করা হত না; কিন্তু সমকামিতার চর্চা গাল্লা [অরোমো] এবং সোমালীতে করা হত। এই তিন সম্প্রদায়ের মানুষই পারস্পরিকভাবে হস্তমৈথুন করত। গ্যামস্ট (১৯৬৯) উল্লেখ করেন মধ্য ইথিওপিয়ার কুশিটিক ভাষী মেষপালক কেমেন্টদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ক করার প্রবণতা ছিল। এমহারা রাজ্যে মেসিং (১৯৫৭) খুজে পান; পুরুষদের মধ্যে বেশান্তর করার প্রবণতা ছিল। তারা একে "ঈশ্বরের ভুল" হিসাবে দেখত। ডোনাল্ড ডনহামের (১৯৯০) মতে উত্তর ইথিওপিয়ার মালেদের মধ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু পুরুষদের নারী ভূমিকা পালন করতে দেখা যেত। তারা জৈবিকভাবে পুরুষ হলেও, নারীদের ন্যায় পোশাক পরিধান করত, নারীদের কাজ করত, নিজের ঘরের খেয়াল রাখত, এমনকি পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্কেও জড়াত।
সমকামিতা পূর্ব আফ্রিকান সমাজেও দেখা গিয়েছে। নিডহাম (১৯৭৩) বর্ণনা করেছে, কেনিয়ার মেরু সমাজের ধর্মীয় নেতা যারা হতেন, তাদেরকে মুগাওয়ে বলা হত। এই মুগাওয়ে বেশিরভাগ সময়ে সমকামী হতেন এবং কখনো কখনো পুরুষকে বিবাহ করতেন। ব্রাইয়াক (১৯৬৪) উল্লেখ করেছেন, এক্টিভ কিকুয়ু সমকামী দের অনেক বলা হত এবং মেষপালক নান্দি ও মারাগোলি দের বলা হয়, সমপ্রেমী অবিবাহিত পুরুষ।
সমকামিতা শব্দটি উদ্ভাবিত হয়েছিল উনিশ শতকে। এরপর একই শতকে এর বিপরীত শব্দ বিষমকামিতা শব্দটির উদ্ভব হয়। বিশ শতকে যৌন পরিচয় নির্ধারণে উভকামিতা শব্দটি উদ্ভব হয়। একই সাথে যারা সঙ্গমে আকৃষ্ট নয়, তাদের পরিচয় দানের জন্যও কোনো শব্দ উদ্ভবের প্রয়োজন ছিল। ইতিহাসের পাতায় যৌনতা শুধুমাত্র দুইটি ভিন্ন লিঙ্গে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সমলিঙ্গেও সম্প্রসারিত ছিল। কিন্তু ঐতিহাসিক ঘটনাকে বুঝতে অথবা দেখতে গেলে আধুনিক ধারণা অথবা আধুনিক যৌনতার ধারণায় দেখতে গেলে, তা সম্প্রসারিত দৃষ্টির আলোয় ও সাহিত্যভিত্তিক সংজ্ঞার আলোকে দেখতে হবে।
ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বদের আধুনিক যৌন পরিচয় দ্বারা অনেকসময় বর্ণনা করা হয় হয়। উদাহরণস্বরূপ, স্ট্রেইট, বাই (উভকামী) গে অথবা কুইর (নিজের যৌন পরিচয় নিয়ে যারা সন্দিহান) নামক শব্দগুচ্ছ দ্বারা। তবে এতে অনেক সমস্যা আছে, কারণ যেসব জীবনীকাররা প্রাচীনকালের বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের জীবনী লিখেছেন, এটা সম্ভাবনা আছে যে, তারা তাদের যৌন অভিমুখিতা নিয়ে লেখার সময় তাদের সমকামিতার অংশটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন। একই অবস্থা ঘটে কিন্তু বিপরীতভাবে বর্তমান সময়েও, যারা এলজিবিটি সমর্থক গবেষক; তারা সেসব বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গ নিয়ে গবেষণা করার সময় সমস্ত তত্ত্ব বাদ দিয়ে শুধুমাত্র সমকামিতাতেই আটকে থাকেন।
যাইহোক, বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে একাডেমিক দুনিয়ায় আধুনিক শব্দগুচ্ছ গুলো নিয়ে কাজ করতে বেশ সমস্যা পোহাতে হয়। আধুনিক শব্দ কুইর এর সংজ্ঞাও পুর্ণাঙ্গভাবে একাডেমিক মহলে সংজ্ঞায়িত হয় নি এবং বিভিন্ন সমাজে যৌন অভিমুখিতার যে গাঠনিক পরিচয় তা ভিন্ন। যেমনঃ কোনো সমাজে সমকামিতার বিষয়টি সাধারণ মানুষ জানে, আবার কোনো সমাজে এ বিষয়টিকে সম্পুর্ণভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করা হয়। একাডেমিক কাজ করার সময় কোথায় কোন শব্দ ব্যবহার করা হবে তা ঠিক করা হয়। পাঠককে সতর্ক থেকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গদের যৌন অভিমুখিতা সম্বন্ধে পাঠ করতে হবে।
গ্রিক পুরুষরা নিজেদের যৌনতার প্রকাশ বেশ বিস্তৃতভাবে করতে পারতেন, কিন্তু নারীদের উপর ছিল বাধ্যবাধকতা। নারীরা যদি কিছুটা বয়স্ক হত এবং কদাচিৎ রাস্তায় বের হত, মানুষ তাদের জিজ্ঞেস করত, তিনি কার মাতা, কার স্ত্রী এমন জিজ্ঞেস করা হত না।
প্রাচীন গ্রিসে পুরুষরা কিশোরদের তার পেডেরাস্টি সম্পর্কের অংশীদার হিসেবে নির্বাচন করতে পারত। কিশোরদের নারীদের উপরও প্রেমসুলভ ভাবনা করত। সেখানের প্রাচীন বচন ছিল, "নারীরা ব্যবসার জন্য; আর কিশোররা আনন্দের জন্য"। দাস হিসেবে বালক ক্রয় করা হত। রাজমহলে সাধারণ বালকদেরও পাঠানো হত, প্রাচীন নথি থেকে জানা যায়, তাদের পিতাদেরও এ সম্পর্কে সম্মতি ছিল। এ ধরনের সম্পর্ক নারী পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্কের বিকল্প ছিল না। বরং কিছু সময়ের জন্য এ সম্পর্ক করা হত। সাধারণত একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ তার সঙ্গীর জন্য প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ বাছাই করত না। তবে ব্যতিক্রমও ছিল; (যেমনঃ আলেক্সান্ডার দ্য গ্রেট)। তিনি একজন তরুণকে ভালোবেসেছিলেন। কিছু গবেষক দেখিয়েছেন, প্রাচীন গ্রিসে বিশ্বাস করা হত; বীর্য হচ্ছে জ্ঞানের উৎস। তাই এরকম যৌনতার সম্পর্কে প্রেমিক যখন তার ভালোবাসার মানুষটির মাঝে এই বীর্যরস পরিবাহিত করে, তখন তার জ্ঞানও সেই মানুষটির মাঝে ছড়িয়ে পরে।
প্রাচীন রোমানীয়দের, সাম্রাজ্য বিজয় করার যে মানসিকতা, তা সমকামিতার চর্চাকেও প্রভাবিত করে।[52] রোমান প্রজাতন্ত্রের নাগরিকের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল, তার দেহকে অন্যের দ্বারা মর্দন বা ব্যবহার হওয়া থেকে রক্ষা করার[53] যদি কোনো পুরুষ নাগরিকের দেহ অন্য কারো দ্বারা ব্যবহার হত; এবং বশ্যতা স্বীকার করত, তবে রোমান সাম্রাজ্যে সেই ব্যক্তিকে ক্রীতদাস হিসেবে বিবেচনা করা হত [54] যতদিন পর্যন্ত না; একজন পুরুষ যৌনতার সময় পুরুষোচিত ভুমিকা পালন না করছে, ততদিন পর্যন্ত সে চাইলেই সমকামী সম্পর্ক রাখতে পারত; এটা সেসময় সাধারণ বিষয় ছিল।[55] যোদ্ধাদের মধ্যে সমকামী সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল এবং অনেক সময় রুঢ়ভাবে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।[56] তরুণ নাগরিকদের কঠোরভাবে সমকামিতার সময় তার সামাজিক অবস্থানের কারো সাথে সমকামিতা মুলক যৌনতার সময় নারীচিত ভুমিকা পালন করার উপর বাধাদান করা হয়েছিল এবং আইনি বাধা হিসেবে লেক্স স্ক্যান্টিনিয়া প্রয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যারাই রোমানের বৈধ নাগরিক বা দাসত্বের জাল থেকে মুক্ত পুরুষের সাথে জোরপূর্বক যৌনাচারে (স্টাপ্রাম) লিপ্ত হবে, তাদের বিরুদ্ধেই এই আইন প্রয়োগ করা হত।[57] পুরুষ দাস, পতিতা, এবং বিনোদনদাতারা সামাজিক ভাবে নিচু ও ঘৃণীত ছিল এবং সঙ্গীদের সাথে যৌন চাহিদা মিটানোর সময় তার সাথে পুরুষোচিত ভুমিকা পালন করতে পারত।
রোমানীয় যৌনতায় "সমকামী" এবং "বিষমকামী" এই শব্দ গুচ্ছ আলাদাভাবে উল্লেখ নেই এবং ল্যাটিন ভাষায় এমন কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই, যাতে করে অনুবাদের মাধ্যমে এইরকম ২ ধরনের যৌনতাকে আলাদাভাবে শ্রেণিবিন্যাসিত করা যায়।[58] রোমানের পুরুষ নাগরিক যদি ইচ্ছাকৃতভাবে মুখ যৌনতা ও পায়ূ যৌনতাকে স্বীকার করতেন; তবে সে সেই সাম্রাজ্যে অবজ্ঞার স্বীকার হতেন। মেয়েলীপনা আচরণের জন্য তাদের বিরুদ্ধে আদালতে কেস হত, রাজনীতির মাঠেও তারা হতেন সমালোচনার স্বীকার। যৌনতার সময় এরকম স্ত্রীজনিত আচরণের অভিযোগ করা হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ (পপুলারিস) জুলিয়াস সিজার ও মার্ক এন্টনীর বিরুদ্ধে।[59] রোমান সাম্রাজ্যে খ্রিষ্ঠান আইন বলবৎ হবার আগ পর্যন্ত; ,[60] খুব কমই প্রমাণ আছে যে, সেসময় কেও সমকামী হলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল।[61]
মধ্যযুগে সমকামিতা সাধারনত নিন্দিত ছিল এবং এজন্য সডোমী ও গোমরাহর গল্প অনেকাংশে দায়ী ছিল। ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে যে; ঐসময় কোনো প্রখ্যাত ব্যক্তি আছেন কিনা যাদের মধ্যে সমকামিতা বা উভকামিতা দেখা যায়। এরকম কিছু ব্যক্তি যেমনঃ দ্বিতীয় এডওয়ার্ড, রিচার্ড দ্য লায়নহার্ট, ফিলিপ দ্বিতীয় অগাস্টাস এবং উইলিয়াম রুফাস সমকামী সম্পর্কে জড়িত ছিল; এমনটা জানা যায়।
ঐতিহাসিক এলান এ টুলকিন সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, মধ্যযুগে পুরুষ সমকামিতা ফ্রান্স সহ অন্যান্য ইউরোপীয় অঞ্চলে ব্যাপ্ত ছিল। এর একটা বৈধ নাম ছিল যাকে বলা হত "enbrotherment" (affrèrement); যার ফলে দুইজন পুরুষ একসাথে বিবাহিত দম্পতির ন্যায় থাকতে পারত। এই ধরনের দম্পতি একটি পাউরুটি, এক গ্লাস ওয়াইন ও একই ব্যাগ পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ব্যবহার করত[62] তার এই অনুচ্ছেদ ইংলিশ মিডিয়ায় বেশ সাড়া পেয়েছিল কারণ, তুলকিন সমকামী বিবাহের পূর্বের অবস্থা হয়তো আবিষ্কার করছেন।[63] তুলকিনের দৃষ্টিকোন; মধ্যযুগে সমকামিতা বিদ্বেষ সবচেয়ে বেশি তীব্র ছিল; এমন বিতর্কের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
জার্মানীর ঘটনাক্রম দেখার জন্য দেখুন ম্যাগনাস হিসচেফেল্ড এবং হলোকাস্টের সময় সমকামিতার ইতিহাস.
১৯৪৮ সালে আলফ্রেড কিনসে সেক্সুয়াল বিহেভিয়ার ইন দ্য হিউম্যান মেল প্রকাশ করেন; যা কিনসে প্রতিবেদন হিসেবে পরিচিত।
বহুবছর ধরে সমকামিতাকে মানসিক ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করা হত। যদিও এই ধারণা যে তত্বের উপর ভিত্তি করে দাড়িঁয়েছিল; তা পরবর্তীতে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৭৩ সালে যুক্তরাজ্য মানসিক ব্যাধির তালিকা থেকে সমকামিতাকে বাদ দিয়েছে। ১৯৮৬ সালে সমকামিতা যে মানসিক ব্যাধি; এরকম সমস্ত তথ্যসূত্র মার্কিন মনস্তাত্ত্বিক সংগঠনের ডায়াগন্সটিক এন্ড স্ট্যাটিস্টিকাল ম্যানুয়াল অব মেন্টাল ডিসঅর্ডারের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।
যৌনতার বিপ্লবের সময় যৌনতা সংক্রান্ত অনেক আদর্শ যেমনঃ যৌনাচারণ করা হয় প্রজননের জন্য এরকম ধারণাকে প্রাচীন ও সেকেলে হিসেবে চিন্তা করা হয়েছিল। অনেকে মনে করেন, যৌনতা বিষয়ে এভাবে ভাবনাই সমকামিতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার পাথেয় হিসাবে কাজ করেছে।
স্টোনওয়াল দাঙা হচ্ছে নিউ ইয়র্ক শহরের পুলিশের সাথে স্টোনওয়াল ইন (একটি সরাইখানা) মালিকের দফায় দফায় হওয়া একপ্রকার প্রচণ্ড সংঘর্ষ। এ সরাইখানা বা বার গ্রিনউইচ গ্রামে অবস্থিত; যা সেসময় সমকামীদের আড্ডাস্থল হিসেবে নির্ধারিত ছিল। ১৯৬৯ সালের ২৭ জুন শুক্রবার মধ্যরাতে এখানে পুলিশের নিয়মিত রেইড (অপ্রত্যাশিত হানা) এর সময় দাঙার সুত্রপাত হয় যার সমাপ্তি ঘটে পরদিন ২৮ জুন সকালে। এই দাঙ্গায় সমকামী, রাস্তার সাধারণ মানুষ ও রাজ্যের রাণী পুলিশে বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সাধারণ মানুষের আন্দোলনের এই উদ্দীপনা জন্মেছিল তৎকালীন সময়ে বেসামরিক মানুষের অধিকারের আন্দোলন গুলো থেকে।[65][66] এই দাঙ্গার পর গে লিবারেশন ফ্রন্টের (জিএলএফ) মত অনেক সমকামী অধিকার সংগঠন গড়ে উঠে। এক বছর পর; এইদিনে এই বিদ্রোহের স্মরণে প্রথম গে প্রাইড মার্চ অনুষ্ঠিত হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.