Loading AI tools
প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ, উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সত্যেন সেন (২৮শে মার্চ ১৯০৭ - ৫ই জানুয়ারি ১৯৮১) হলেন প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ উদীচী সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কিংবদন্তি বিপ্লবী, সাহিত্যিক এবং শ্রমিক-সংগঠক।
সত্যেন সেন | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ৫ জানুয়ারি ১৯৮১ ৭৩) | (বয়স
জাতীয়তা | বাংলাদেশী |
নাগরিকত্ব | বাংলাদেশী |
পেশা | বিপ্লবী, সাহিত্যিক, শ্রমিক সংগঠক |
পুরস্কার | বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক |
সত্যেন সেন ১৯০৭ সালের ২৮শে মার্চ বিক্রমপুর (বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার) টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং গ্রামের সেন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলায় ডাক নাম ছিল লস্কর। তার পিতার নাম ধরনীমোহন সেন এবং মাতার নাম মৃণালিনী সেন। চার সন্তানের মধ্যে সত্যেন ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। সোনারং গ্রামের সেন পরিবার ছিল শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার এক অনন্য উদাহরণ। সত্যেনের কাকা ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য। তার আরেক কাকা মনোমোহন সেন ছিলেন শিশুসাহিত্যিক। সত্যেন সেনের পরিবারেই তার পড়াশোনার হাতেখড়ি হয়। প্রাইমারি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা পরিবার ও গৃহশিক্ষকের কাছেই সম্পন্ন করেছিলেন। ১৯১৯ সালে সোনারং হাইস্কুলে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯২১ সালে তিনি যখন সোনারং হাইস্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র তখন থেকেই তার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ লাভ করে। ১৯২৪ সালে সোনারঙ হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করে কলকাতায় কলেজে ভর্তি হন এবং সেখানকার একটি কলেজ থেকে এফএ ও বিএ পাস করেন। এরপর তিনি কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিভাগে এমএ শ্রেণীতে ভর্তি হন। কিন্তু বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কারণে ১৯৩১ সালে কারাবরণ করলে জেলে থেকেই তিনি বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন।
কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি যুক্ত হন বিপ্লবী দল যুগান্তরের সাথে। ছাত্র অবস্থায় ১৯৩১ সালে তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রথম কারাবরণ করতে বাধ্য হন। বহরমপুর বন্দি ক্যাম্পে থেকেই শুরু হয় তার জেলজীবন। এ সময় তিনি ৩ মাস জেলে ছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী সশস্ত্র বিপ্লববাদী আন্দোলনের যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনি ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বার গ্রেফতার হন। এ সময় তার ৬ বছর জেল হয়। সত্যেন সেন ১৯৩৮ সালে জেল থেকে মুক্তি পান। ওই বছর শান্তিনিকেতন থেকে তাকে দেয়া হয় ‘গবেষণা বৃত্তি’। ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে এক সমাবেশে শহীদ হন ফ্যাসিবাদ বিরোধী বিপ্লবী কথা শিল্পী সোমেন চন্দ। এ সময় ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে সত্যেন সেন কার্যকারী দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৩ সালের মহাদুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় ‘কৃষক সমিতি’র মাধ্যমে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। কৃষক সমিতির নেতা-কর্মীকে নিয়ে দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় কাজ করেন। ১৯৪৬ সালে আইনসভার নির্বাচনে কমিউনিস্ট নেতা ব্রজেন দাস ঢাকা থেকে প্রার্থী হন। ব্রজেন দাসের পক্ষে সত্যেন সেন নির্বাচনী প্রচারণা চালান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালে স্বাধীন ভারত সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৪৮ সালে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়। ১৯৪৯ সালে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার জন্য তাকে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী গ্রেফতার করে। আবার দীর্ঘ কারাভোগ। ওই সময় কারাগারে কমিউনিস্টদের প্রতি নানা অত্যাচার ও নির্যাতনে মাত্রা ছিল অনেক বেশি।
কমিউনিস্ট পেলেই বেশি অত্যাচার শুরু করে দিত। সত্যেন সেনকেও কারা প্রশাসন নানা অত্যাচার ও নির্যাতন করে। যার ফলে তার শারীরিক অসুস্থতা ও চোখের পীড়া দেখা দেয়। কারাবাসে অবস্থানকালে সত্যেন সেন মার্কসবাদী-লেনিনবাদী রাজনৈতিক মতাদর্শ ও দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। এ মতাদর্শ ও দর্শনকে জীবনাদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে আজীবন শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার লড়াই-সংগ্রাম করেছেন। দীর্ঘদিন কারাভোগ শেষে ১৯৫৩ সালে মুক্তি পেয়ে নিজ গ্রাম সোনারাংয়ে ফিরে আসেন। ওই সময় নানা প্রতিকূল পরিবেশ ও পরিস্থিতির কারণে তাদের পরিবারের সবাই নিরাপত্তার কারণে কলকাতায় পাড়ি জমান। তিনি এ সময় যুক্ত হন কৃষক আন্দোলনের সাথে। ১৯৭১ সালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেন। তবে তিনি প্রত্যক্ষভাবে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। মুক্তিযোদ্ধাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন। এছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এক পর্যায়ে তার চোখের পীড়া আরো গুরুতর রূপ নেয়। তিনি প্রায় অন্ধ হতে চলেন। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি তাকে চোখের উন্নত চিকিৎসার জন্য মস্কো পাঠায়। এখানে অবস্থানকালে তিনি বিভিন্ন দেশের বিপ্লবীদের পরিচিত হন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন। তারাও স্ব-স্ব দেশে গিয়ে বাংলাদেশের প্রতি সহনাভূতি জানান। মস্কো হাসপাতালে অবস্থানকালে তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ পান। সেখানকার বাঙালিদের মুক্তির উল্লাস প্রত্যক্ষ করেন। তিনি নিজেও অশ্রুসিক্ত নয়নে ওই আনন্দ উপভোগ করেন। মুক্ত, স্বাধীন স্বপ্নের স্বদেশ, বাংলাদেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালে।
১৯৬৯ সালে বিপ্লবী কথাশিল্পী সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, শহীদুল্লা কায়সারসহ একঝাঁক তরুণ উদীচী গঠন করেন। জন্মলগ্ন থেকে উদীচী অধিকার, স্বাধীনতা ও সাম্যের সমাজ নির্মাণের সংগ্রাম করে আসছে। উদীচী ’৬৮, ’৬৯, ’৭০, ’৭১, সালে বাঙালির সার্বিক মুক্তির চেতনাকে ধারণ করে গড়ে তোলে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। [1] এ সংগ্রাম গ্রামবাংলার পথেঘাটে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় উদীচীর কর্মীরা প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়।
উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী এদেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারার সংস্কৃতি নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সত্যেন সেনের সৃষ্টিকর্ম ও সাহিত্য হলো সমাজ বাস্তবতার স্পষ্ট প্রকৃতি-স্বরূপের প্রতিচ্ছবি। তার জীবনের সকল কিছুতেই মৌলিক বিষয় হিসেবে কাজ করেছে মানুষের জীবন-সংগ্রাম ও শ্রম-সভ্যতার ইতিহাস। স্বাধীনতার পর তিনি উদীচী পুনর্গঠনের কাজ করেন। সাহিত্য চর্চাও অব্যহত রাখেন।
গান মাধ্যমে মানুষকে জাগরিত করা সহজ। এই উপলব্দি নিয়ে গণমানুষের জন্য মানুষের জীবন বাস্তবতার গান রচনা করেছেন। তার গানের মূল বিষয়বস্তু হলো অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, শোষণমুক্তির জন্য আন্দোলন ও সাম্য-সুন্দর মানুষের পৃথিবী নির্মাণ। গান রচনার মাধ্যমেই মূলত তার লেখালেখি জগতে আশা। পাশাপাশি গানের সুর করা ও গান শেখানোর কাজও তিনি করেছেন। শ্রমিকদের নিয়ে তিনি তাঁদের নিয়ে গান এবং পালা রচনা করতেন। গানের দল গঠন করে শ্রমিকদের এ কবিগান তিনি রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ পরিবেশন করতেন। তার লেখা ১১টি গানের মধ্যে ‘চাষি দে তোর লাল সেলাম/তোর লাল নিশানারে’ গানটি তখন চাষিদের জাতীয় সঙ্গীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৫৬ সালে বিক্রমপুরের ষোলঘরে কৃষক সমিতির সম্মেলনে প্রথম তারই নেতৃত্বে গানটি গাওয়া হয়। এছাড়া সত্যেন সেন গানের মাধ্যমে বরিশালে মনোরমা বসু মাসিমার ‘মাতৃমন্দিরের’ জন্য তহবিল সংগ্রহ করেছিলেন। সত্যেন সেন একজন নির্ভীক সাংবাদিক ছিলেন। জীবনের নানা চড়াই-উৎরাইয়ের বাঁকে তিনি কোথাও আপোস করেননি। যারা করেছে, তাদেরকে তিনি ঘৃণা করতেন। তিনি মূলত কোনো লেখাই লেখার জন্য লিখতেন না। তিনি লিখতে মানূষের অধিকারের কথাগুলো। প্রথমে দৈনিক ‘মিল্লাত’ পরবর্তী সময়ে দৈনিক ‘সংবাদ’র মাধ্যমে সত্যেন সেন সাংবাদিকতা করেছেন।
কিন্তু ১৯৭৩ সালে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। ফলে আবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। চিকিৎসার জন্য চলে যান ভারতে। আশ্রয় নেন শান্তি নিকেতনের মেজদিদি প্রতিভা সেনের কাছে। সাহিত্য চর্চা ও অসুস্থতার মাঝে চলে যায় ৮টি বছর। শান্তি নিকেতনের গুরুপল্লীতে ১৯৮১ সালে ৫ জানুয়ারি তিনি মারা যান।
সত্যেন সেনের সাহিত্যকর্ম সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার একটি নিদর্শন এবং বাংলা সাহিত্যের অনন্য পথিকৃৎ। মানুষের জীবন ও ইতিহাসকে যে রচনাকার সামগ্রীকভাবে অবলোকন করতে সক্ষম না হন, যিনি মানব সমাজটাকে তার বর্তমানের সকল বৈষম্য দূর করে সঙ্গতিপূর্ণ এক মানব সমাজ সৃষ্টিতে নিজেকে উৎসর্গ না করেন এবং যিনি দূরগামী সেই লক্ষ্যকে নিত্য মুহূর্তের কর্ম ও আচরণের সঙ্গে যুক্ত করতে না পারেন, তার পক্ষে সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার অনুপ্রেরণাদায়ক সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়।
পাতাবাহার (১৯৬৮) অন্যতম।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.