Loading AI tools
পাঞ্জাব অঞ্চলে উৎপন্ন ভারতীয় ধর্ম উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
শিখধর্ম (/ˈsɪkzəm/; গুরুমুখী: ਸਿੱਖੀ, [8] (স্থানীয় নাম শিখী); সংস্কৃত ‘শিষ্য’ বা ‘শিক্ষা’ থেকে উৎপন্ন।[9][10]) হল একটি সর্বেশ্বরবাদী[11] ভারতীয় ধর্ম। এটি খ্রিস্টীয় ১৫শ শতাব্দীতে ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাব অঞ্চলে উৎপত্তি হয়।[12] পরবর্তীকালে শিখ গুরুগণ কর্তৃক এই ধর্ম প্রসার লাভ করে। শিখদের ১০ জন মানব গুরু ছিলেন, যাদের সর্বপ্রথম হলেন গুরু নানক। শিখদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিব যা শিখ গুরুদের রচনার সংকলন। প্রথম পাঁচ জন শিখ গুরু এটি সংকলন করেছিলেন। শিখধর্ম বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম ধর্মীয় গোষ্ঠী। এই ধর্মের অনুগামীর সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি।[13][14] ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যটি বিশ্বের একমাত্র শিখ সংখ্যাগুরু অঞ্চল।
শিখধর্ম | |
---|---|
ਸਿੱਖੀ | |
ধরন | সার্বজনীন ধর্ম |
প্রকারভেদ | ভারতীয় ধর্ম |
ধর্মগ্রন্থ | গুরু গ্রন্থ সাহিব দসম গ্রন্থ (বিতর্কিত) সর্বলোহ গ্রন্থ (বিতর্কিত) |
ধর্মতত্ত্ব | এশ্বরবাদ সর্বজনীনতাবাদ[1][2][3][4] |
Governance | পঞ্চ তখত |
অঞ্চল | প্রধান ধর্ম পাঞ্জাব, ভারত (৫৮%), এবং বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সংখ্যালঘু হিসেবে (শিখ প্রবাসী) |
ভাষা | সান্ত ভাষা[5] পাঞ্জাবি (Gurmukhi) খালসা বোলে[6] |
সদর দপ্তর | অকাল তখত |
প্রবর্তক | গুরু নানক |
উৎপত্তি | ১৫-১৬ শতক পাঞ্জাব অঞ্চল |
Separated from | হিন্দুধর্ম |
অনুসারীর সংখ্যা | ২.৫ - ৩ কোটি (যাকে "শিখ" বা "শিখ পন্থ" হিসাবে উল্লেখ করা হয়)[7] |
স্লোগান | "বোলে সো নিহাল… সত শ্রী আকাল" |
শিখধর্মের অনুগামীদের ‘শিখ’ (অর্থাৎ, ‘শিষ্য’) বলা হয়। দেবিন্দর সিং চাহালের মতে, “‘শিখী’ শব্দটি (সাধরনভাবে গুরুমত নামে পরিচিত) থেকে আধুনিক ‘শিখধর্ম’ শব্দটি এসেছে।”[15] ‘গুরুমত’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ ‘গুরুর প্রজ্ঞা’।[16]
সেওয়া সিং কলসি মতে, “শিখধর্মের কেন্দ্রীয় শিক্ষা হল ঈশ্বরের একত্বের তত্ত্বে বিশ্বাস।”[17] শিখধর্ম অনুসারে, আধ্যাত্মিক জীবন ও ধর্মনিরপেক্ষ জীবনকে এক করতে হয়।[18] প্রথম শিখ গুরু নানক সকল মানুষের একত্ব এবং ভাগ করে নেওয়ার গুরুত্ব বোঝাতে লঙ্গর প্রথার প্রবর্তন করেন।[19] শিখরা মনে করেন, “সকল ধর্মমত সমভাবে সঠিক এবং নিজ নিজ মতাবলম্বীদের আলোকিত করতে সক্ষম।”[17] ‘বন্দ চক্কো’ বা ভাগ করে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গুরু নানক সকল মানুষকে সৎ পথে জীবন ধারণ করতে, কুপথ পরিহার করতে এবং ‘নাম জপন’ বা ঈশ্বরের পবিত্র নাম স্মরণের গুরুত্বের শিক্ষা দেন। গুরু নানক কেবলমাত্র ধ্যানীর জীবন অপেক্ষা “সত্য, বিশ্বাস, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বিশুদ্ধতায় পরিপূর্ণ সক্রিয়, সৃজনশীল ও ব্যবহারিক জীবনে”র উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন।[20] ৬ষ্ঠ শিখ গুরু হরগোবিন্দ পরস্পর-সহায়ক রাজনৈতিক/সমসাময়িক (‘মিরি’) ও আধ্যাত্মিক (‘পিরি’) জগৎ প্রতিষ্ঠা করেন।[21]
নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুরের মতে, আদর্শ শিখের শক্তি (সমসাময়িক যুগে বসবাস করার ক্ষমতা) ও ভক্তি (আধ্যাত্মিক ধ্যানপূর্ণ গুণাবলি) দুইই থাকবে। শেষে দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিং ১৬৯৯ সালে আনন্দপুর সাহিবে খালসার সন্ত সৈনিকদের দীক্ষিত করার ধারণাটি প্রচলন করেন।[22] শিখদের সন্ত-সৈনিকদের সকল গুণ ধারণ করতে হয়।[23][24]
ধর্মটি ধর্মীয় নিপীড়নের সময়ে বিকশিত এবং বিকশিত হয়েছিল, হিন্দু ও ইসলাম উভয় ধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।[25] ভারতের মুঘল শাসকরা দুই শিখ গুরু গুরু আরজান (১৫৬৩-১৬০৫) এবং গুরু তেগ বাহাদুর (১৬২১-১৬৭৫) ইসলাম গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় নির্যাতন ও মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন । শিখদের নিপীড়ন ১৬৯৯ সালে গুরু গোবিন্দ সিং কর্তৃক বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা রক্ষার আদেশ হিসাবে খালসা প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত করে।[26][27]
"শিখ" শব্দের অর্থ যিনি শিখ ধর্ম ও বিশ্বাসকে গ্রহণ করেন এবং শ্রীগুরু গ্রন্থ সাহিবের শিক্ষা অনুসরণ করেন এবং ঘন চুল রাখেন... “আমি একান্তভাবে জানাচ্ছি এবং ঘোষণা করছি যে আমি একজন ‘কেশধারী’ শিখ এবং আমি শ্রীগুরু গ্রন্থ সাহিব ও দশ জন শিখ গুরুর শিক্ষায় বিশ্বাস ও সেই অনুসরণ করছি এবং আমার অন্য কোনো বিশ্বাস নেই।
Definition of a Sikh and Sikh affirmation in the Delhi Gurdwara Act of 1971.[28]
শিখধর্মের উৎস হল গুরু নানক ও তার উত্তরসূরিদের শিক্ষা। শিখ ধর্মবিশ্বাসের মূল কথাটি গুরু নানক এইভাবে জ্ঞাপন করেছেন: “সত্য অনুভবের চেয়ে বৃহত্তর কিছুই নেই। সত্যময় জীবন বৃহত্তর মাত্র।”[29] শিখ শিক্ষায় সকল মানুষের সমত্ব এবং জাতি, কর্ম বা লিঙ্গের ভিত্তিতে কোনো রকম বৈষম্যের বিরোধিতায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। শিখধর্মে গৃহস্থ জীবন যাপনে উৎসাহ দেওয়া হয়।
শিখধর্ম একটি সর্বেশ্বরবাদী (কোনো কোনো দিক থেকে)[30][31] এবং প্রকাশিত ধর্ম।[32] শিখধর্মে ‘ঈশ্বর’ ধারণা হল “ওয়াহিগুরু” – যা নিরাকার, অনন্ত ও দৃষ্টির অগম্য (অর্থাৎ, যা চর্মচক্ষে দেখা যায় না): ‘নিরঙ্কর’, ‘অকাল’ ও ‘অলখ’। শিখ ধর্মশাস্ত্রের শুরুর অক্ষরটি হল ‘১’ – যা ‘ঈশ্বরে’র বিশ্বজনীনতার প্রতীক। শিখ শাস্ত্রমতে, ‘ঈশ্বর’ হলেন সর্বব্যাপী ও সর্বশক্তিমান। তাকে ‘ইক ওঙ্কার’ শব্দের দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।[33] শিখরা বিশ্বাস করেন, সৃষ্টির পূর্বের শুধুমাত্র ‘ঈশ্বর’ই ছিলেন এবং তাঁর ‘হুকুমে’ (ইচ্ছা বা আদেশ) ছিল।[34] ঈশ্বরের যখন ইচ্ছা হল তখন সমস্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টি হল। শুরু থেকেই ঈশ্বর মায়া বা মানুষের সত্যতার ধারণা প্রতি ‘আকর্ষণ বা আসক্তি’ নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন।[35]
অন্যান্য ধর্মের তুলনায় শিখধর্মে ‘ঈশ্বর’ ধারণা একটু আলাদা রকমের। এটি ‘ইক ওঙ্কার’ বা ‘এক চিরন্তন’[36] বা ‘সর্বব্যাপী সত্ত্বা’ নামে পরিচিত। এটির অর্থ ‘ঈশ্বর’।[37] এটি গুরুমুখী হরফে পাওয়া যায়।[38] এই ‘সত্ত্বা’র কোনো লিঙ্গের উল্লেখ শিখধর্মে নেই (যদিও অনুবাদে এটিকে পুরুষ হিসেবেই দেখানো হয়)। এটি ‘অকাল পুর্খ’ (সময় ও বিশ্বের অতীত) এবং ‘নিরঙ্কর’ (নিরাকার)। এছাড়া, নানক লিখেছেন যে, একাধিক বিশ্বে তিনি প্রাণ সৃষ্টি করেছেন।[39]
নানক আরও লিখেছেন যে, ‘অকাল’কে বোঝা মানুষের অসাধ্য।[33] তবে একই সময়ে এটি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতও নয়। ‘অকাল’ সকল সৃষ্টিতে সর্বব্যাপী (‘সর্ব ব্যাপক’) এবং আধ্যাত্মিকভাবে যাঁরা জাগরিত হন তারা তাকে সর্বত্র দেখতে পান। ঈশ্বরকে ‘অন্তর্দৃষ্টি’ বা ‘হৃদয়ে’র দ্বারা দেখার উপর নানক জোর দিয়েছেন। স্বর্গীয় জীবনে জাগরিত হওয়ার জন্য ভক্তেরা ধ্যান করবে – এমন বিধান ছিল তাঁর। গুরু নানক ধ্যানের মাধ্যমে সত্যের প্রকাশের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বারংবার ধ্যানের মাধ্যমে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে যোগাযোগের সেতুটি গড়ে ওঠে বলেই তিনি মনে করতেন।[33]
গুরু গ্রন্থ সাহিবের প্রথম চরণে উল্লিখিত মূল মন্তর এবং তার নির্দিষ্ট রাগ:
গুরু নানকের শিক্ষা স্বর্গকে সর্বশেষ গন্তব্য বলে না। তাঁর মতে অকালের সঙ্গে মিলনের ফলে মানুষ মুক্তি পায় বা ‘জীবন্মুক্ত’ হয়।[40] গুরু গোবিন্দ সিংহ স্পষ্ট করে বলেছেন, মানব জন্ম সৌভাগ্যের। তাই সবাইকে জীবনকে কাজে লাগাতে হবে।[41] শিখদের প্রামাণ্য ধর্মগ্রন্থ ব্যাখ্যায় পুনর্জন্ম ও কর্মবাদের শিখ ধারণা হিন্দু বা বৌদ্ধ ধারণার অনুরূপ বলে উল্লিখিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে বিতর্ক থাকলেও প্রকৃতক্ষেত্রে তা নয়।[41][42][43] শিখধর্মে কর্ম হল ‘ঈশ্বরের করুণা ধারণার দ্বারা গৃহীত’ (“নদর, মেহর, কৃপা, করম’ ইত্যাদি)। গুরু নানক লিখেছেন, “কর্মের প্রভাবে দেহের জন্ম হয়, কিন্তু মুক্তিলাভ হয় করুণায়।”[44] ঈশ্বরের কাছাকাছি যেতে শিখরা মায়ার কুপ্রভাবকে এড়িয়ে যাবে। মনকে চিরন্তন সত্যে স্থির রাখার জন্য ‘শবদ কীর্তন’, ধ্যান, ‘নাম’ ও মানবজাতির সেবা করবে। শিখরা বিশ্বাস করেন ‘সৎসঙ্গ’ বা ‘সধ সঙ্গত’ হল পুনর্জন্মের চক্র থেকে মুক্তি লাভের একটি অন্যতম প্রধান পন্থা।[45]
মায়া হল একটি সাময়িক কল্পনা বা ‘অসত্য’। এটি হল ঈশ্বর ও মোক্ষলাভের প্রচেষ্টার পথে অন্যতম প্রধান বিচ্যুতি। জাগতিক আকর্ষণ শুধুমাত্র কাল্পনিক সাময়িক দুঃখ ও তুষ্টিবিধান করতে পারে এবং তা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির পথ থেকে মানুষকে বিচ্যুত করে। নানক অবশ্য মায়াকে শুধুমাত্র জগতেরই অসত্যতা বলেননি, জগতের মূল্যেরও অসত্যতা বলেছেন। শিখধর্মে অহংকার, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও কাম – এই পাঁচটি ‘পাঞ্জ চোর’ (পাঁচ চোর) হিসেবে পরিচিত। শিখরা মনে করেন, এগুলি মানুষকে বিচ্যুত করে এবং এগুলি ক্ষতিকারক। শিখদের মতে, জগতে একখন কলিযুগ অর্থাৎ অন্ধকারের যুগ চলছে। কারণ, জগত মায়াকে ভালবেসে মায়ার প্রতি আসক্ত হয়ে সত্যভ্রষ্ট হয়েছে।[46] মানুষের ভাগ্য ‘পাঞ্জ চোরে’র কাছে পরাহত হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঈশ্বরের থেকে মানুষের বিচ্যুতি ঘটে এবং একমাত্র গভীর ও নিরন্তর ভক্তির মাধ্যমেই সেই অবস্থার উন্নতি সম্ভব।[47]
নানকের মতে, মানব জীবনের লক্ষ্য হল অকালের (সময়াতীত ঈশ্বর) সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন। অহংকার এই যোগসূত্র স্থাপনের পথে বড়ো বাধা। গুরুর শিক্ষা গ্রহণ করে নাম গ্রহণের (ঈশ্বরের পবিত্র নাম গ্রহণ)[48][49] অহংকারের বিনাশ ঘটে। গুরু নানক ‘গুরু’ (অর্থাৎ ‘শিক্ষক’)[50] শব্দটির অর্থ করেছেন ‘আত্মা’। গুরুই জ্ঞানের উৎস ও মুক্তি পথের সহায়ক।[51] ‘ইক ওঙ্কার’ হল সর্ব পরিব্যপ্ত। গুরু ও অকাল অভিন্ন এবং এক।[52] সত্যের নিঃস্বার্থ সন্ধানে ব্যক্তিকে গুরুর সঙ্গে যুক্ত হতে হয়।[53] শেষ পর্যন্ত অনুসন্ধানকারী বুঝতে পারেন, দেহের মধ্যে অনুসন্ধানকারী/অনুগামী এবং শব্দ রূপী চৈতন্যই হলেন সত্যকারের গুরু। মানব শরীর শুধুমাত্র সত্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের সেতু।[52] সত্য একবার ব্যক্তির হৃদয়ে প্রজ্বলিত হলে, অতীতের সকল ধর্মের সারকথা ব্যক্তি বুঝতে পারেন।[54]
গুরুর স্তবগানকে শিখরা ‘গুরবাণী’ (গুরুর বাণী) বলেন। গুরুবাণী গাওয়াকে বলা হয় শবদ কীর্তন। গুরু গ্রন্থ সাহিবের সমগ্র অংশই কাব্যের আকারে ছন্দে রচিত। শাস্ত্রীয় সংগীতের নির্দিষ্ট ৩১টি গুরু গ্রন্থ সাহিব গাওয়ার নিয়ম। তবে উক্ত গ্রন্থে উল্লিখিত সব কটি রাগের সঙ্গে পরিচিত এমন সংগীতজ্ঞ শিখদের মধ্যে কমই দেখা যায়। শবদ কীর্তন প্রথা চালু করেছিলেন গুরু নানক। ধ্যানের সময় কীর্তন শোনা এবং ভক্তিপূর্ণ চিত্তে সর্বোচ্চ সময়াতীত ঈশ্বরের মাহাত্ম্য কীর্তন করাকে তিনি ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সবচেয়ে কার্যকর উপায় মনে করতেন।[55] শিখদের তিনটি প্রভাতী প্রার্থনা হল জপজি সাহিব, জাপ সাহিব ও তব-প্রসাদ সাভাইয়ে।[56] দীক্ষিত শিখেরা খুব ভোরে উঠে ধ্যান করেন এবং তারপর প্রাতঃরাশের পূর্বে নিতনেমের পঞ্চ বাণীর সবগুলি আবৃত্তি করেন।
শিখদের ধর্মানুশীলনের একটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি হল ঈশ্বরের পবিত্র নাম[48] স্মরণ।[49] নাম জপো (পবিত্র নাম জপ) বা নাম সিমরণ (নাম জপের মাধ্যমে পবিত্র নাম স্মরণ) পদ্ধতিতে ঈশ্বরের নাম স্মরণ করা হয়।[49][57] ভারতের বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ে ঈশ্বরের নাম বা বীজ অক্ষর সোচ্চারে জপ করার প্রথা থাকলেও, গুরু নানক ব্যক্তিগতভাবে নাম জপের পক্ষপাতী ছিলেন। গুরু নানকের আদর্শ ছিল নামের প্রতি ব্যক্তিসত্ত্বার পূর্ণ অভিপ্রকাশ ও ধর্মের পূর্ণ প্রকাশ। গুরু নানকের মতে, নাম সিমরন সুশৃঙ্খল পদ্ধতিতে করলে পাঁচটি স্তর পার হয়ে “ঈশ্বরের দিকে ও ঈশ্বরের মধ্যে অগ্রসর হওয়া যায়।” স্মরণের সর্বশেষ পর্যায়টি হল সচ খণ্ড (সত্যের রাজত্ব)। এখানেই ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মার মিলন ঘটে।[51]
সেবা ও কার্য ছাড়া ধ্যান নিষ্ফল।[58] শিখরা নিঃস্বার্থ সেবার উপদেশ দিয়ে থাকেন। সেবা ও দাতব্য কার্যের ফলে হউমাই বা অহংকারের বিনাশ ঘটে।[59] শিখধর্মে সেবা তিন প্রকার। যথা: "তন" বা দৈহিক সেবা, "মন" বা মানসিক সেবা (যেমন অন্যের সাহায্যার্থে অধ্যয়ন) ও "ধন" বা আর্থিক সেবা।[60] গুরু নানক কিরত করো ধারণার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। এই ধারণাটি হল কর্ম, পূজা ও দাতব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য সাধন এবং সব মানুষের অধিকার রক্ষা করা। চড়দি কলা বা জীবন সম্পর্কে আশাবাদী ও সরল ধারণা গ্রহণের জন্য শিখদের উৎসাহ দেওয়া হয়। শিখধর্মে ভাণ্ড চক্কো ভাগ করে নেওয়ার ধারণার উপরও গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এর মাধ্যমে শিখ গুরদ্বারাগুলিতে খাবার বণ্টন করা হয় (লঙ্গর), দান করা হয়, সমাজ সেবামূলক কাজ ও অন্যান্য সেবামূলক কাজ করা হয়।
শিখধর্ম ন্যায়,[61] নিরামক ন্যায় ও দিব্য ন্যায়কে[61] নৈতিকতার যে কোনো বিষয়ের মানদণ্ড মনে করে।[23][24] পাঞ্জাবি ভাষায় "নিয়াউ" শব্দটি এক্ষেত্রে প্রযোজ্য।[61] এই শব্দটির অর্থ ন্যায়বিচার। "ধরম" শব্দটির মাধ্যমেও[61] "নৈতিকতার বিচারে" ন্যায়কে বোঝানো হয়ে থাকে।[61][62] "ধরমের প্রতি আক্রমণ হল ন্যায়বিচার, সত্যতা ও সাধারণভাবে নৈতিকতার উপর আক্রমণ।"[16] দশম শিখ গুরু গোবিন্দ সিংয়ের মতে, "শান্তি স্থাপনের সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে যখন শব্দের গুরুত্ব থাকে না, তখন অসির ঝলকানিই আইনসম্মত। তখন তরবারি বের করা ন্যায়সম্মত।"[63]
শিখধর্মে নারী ও পুরুষের অধিকার সমান। অন্যান্য ধর্মে যখন আধুনিককালে নারী পুরোহিতের জন্য দাবি উঠছে, শিখধর্মে প্রথম থেকেই ধর্মস্থানে মহিলারা প্রার্থনায় অগ্রণী ভূমিকা নিতেন।[64]
সংস্কৃত ভাষায় ‘গুরু’ শব্দের অর্থ শিক্ষক, সহায়ক বা উপদেশদাতা। ১৪৬৯ থেকে ১৭০৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দশ জন নির্দিষ্ট শিখ গুরু শিখধর্মের প্রথা ও দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রত্যেক গুরু পূর্বতন শুরুর শিক্ষার সঙ্গে নতুন কথা যোগ করেন এবং সেগুলি কার্যে পরিণত করেন। এর ফলে শিখধর্মের জন্ম হয়। গুরু নানক ছিলেন শিখধর্মের প্রথম গুরু এবং তিনি তার এক শিষ্যকে উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছিলেন। গুরু গোবিন্দ সিং সর্বশেষ মানব গুরু। মৃত্যুর পূর্বে তিনি গুরু গ্রন্থ সাহিবকে শিখদের সর্বশেষ এবং চিরকালীন গুরু ঘোষণা করে যান।[65]
গুরু নানকের উত্তরসূরি ছিলেন গুরু অঙ্গদ। তৃতীয় শিখ গুরু গুরু অমর দাসের সময়কাল শিখধর্মের বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। গুরু নানকের শিক্ষা ছিল মোক্ষের অনুসন্ধান করা। গুরু অমর দাস জন্ম, বিবাহ ও মৃত্যু-সংক্রান্ত স্বতন্ত্র প্রথা অনুমোদন করে অনুগামীদের নিয়ে একটি পৃথম সম্প্রদায় গড়ে তোলেন। এছাড়া তিনি মানজি (ডায়োসিসের সমতুল্য) নামে একটি যাজক ব্যবস্থাও স্থাপন করেন।[51]
গুরু অমর দাসের উত্তরসূরি ও জামাতা গুরু রাম দাস অমৃতসর শহরটি স্থাপন করেন। এই শহরেই হরমন্দির সাহিব অবস্থিত এবং এটি শিখদের কাছে পবিত্রতম শহর হিসেবে পরিচিত। গুরু অর্জন শিখদের সংগঠিত করতে শুরু করলে মুঘল কর্তৃপক্ষ তাকে বন্দী করে।[66] মুঘল বাহিনী অত্যাচার করে গুরু অর্জনকে হত্যা করলে, তার উত্তরসূরিরা শিখ সম্প্রদায়ে একটি সামরিক ও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে মুঘল বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন।
শিখ গুরুরা শিখধর্মে এমন এক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন যাতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিখ সম্প্রদায় প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম হয়। ষষ্ঠ শিখ গুরু গুরু হরগোবিন্দ অকাল তখত (সময়াতীত ঈশ্বরের সিংহাসন) ধারণার জন্ম দেন। হরমন্দির সাহিবের উল্টোদিকে অবস্থিত এই অকাল তখত হল শিখধর্মের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক সংস্থা। সরবত খালসা বা খালসা পন্থের একটি প্রতিনিধিসভা বৈশাখী বা হোলা মোহাল্লা উপলক্ষে অকাল তখতে ঐতিহাসিকভাবে সমবেত হন এবং সমগ্র শিখ জাতিকে প্রভাবিত করছে এমন কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হয়, তখন সেই সম্পর্কে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গুরমতা (অর্থাৎ, ‘গুরুর ইচ্ছা’) হল সরবত খালসার আদেশনামা। এটি গুরু গ্রন্থ সাহিবের উপস্থিতিতে দেওয়া হয়। শিখধর্মের মৌলিক নীতিগুলিকে স্পর্শ করছে, এমন বিষয়েই গুরমতা আদেশনামা দেওয়া যায় এবং এটি সকল শিখ জাতির উপর প্রযোজ্য হয়।[67] গুরমতাকে অনেক সময় হুকুমনামাও বলা হয়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে হুকুমনামা বলতে গুরু গ্রন্থ সাহিবের একটি স্তোত্রকে বোঝায়। উক্ত স্তোত্রটি শিখ জাতির প্রতি একটি আদেশ।
ধর্ম পালনের অন্যতম কর্তব্য হচ্ছে গুরুদ্বার গমন। ধর্ম, পটভূমি, বর্ণ নির্বিশেষে গুরুদ্বার সবার জন্য উন্মুক্ত। একটি গুরুদ্বার-এ উপাসনা মূলত ধর্মগ্রন্থের অনুচ্ছেদের আবৃতির মাধ্যমে সংগঠিত হয় । "ল্যঙ্গার" বা সম্প্রদায় ভোজনমূলক ঐতিহাসিক শিখ অনুশীলনের অবস্থান থাকে গুরুদ্বার-এ । নিরামিষ খাবারের জন্য সব গুরুদ্বার সবসময়ই যে কোনও বিশ্বাসের জন্য উন্মুক্ত থাকে ।
খালসা অর্থ খালিস, অকৃত্রিম বা নির্দোষ। যে সকল শিখ ধর্মের জন্য নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছে তাদের খালসা বলা হয়। ১৬৯৯ সালে শিখদের দশম গুরু গোবিন্দ সিং পাঁচ জন নির্বাচিত ব্যক্তিকে দীক্ষা দান করেন। তারা পাঞ্জ পিয়ারে নামে পরিচিত ছিল।
মুলত শিখরা ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশ এবং পাকিস্তানের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে বসবাস করেন। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য দুরপ্রাচ্যও কিছু শিখ বসবাস করেন। পৃথিবীতে মোট শিখ ধর্মের অনুসারী ২ কোটি ৩০ লক্ষাধিক।
১. মিথ্যা না বলা
২.মিথ্যা মামলায় সাক্ষী না দেওয়া
৩. দাড়ি কর্তন না করা
৪. মদ্যপান
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.