Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ইসলামী আইন বিধিবদ্ধ করতে ইসলামী আইনশাস্ত্রে শরিয়াহর উৎস হিসেবে বিভিন্ন মানদণ্ড ব্যবহার করা হয়।[1] শরিয়াহর প্রাথমিক উৎস হিসেবে কুরআন ও সুন্নাহকে সারা বিশ্বের মুসলিম কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে গৃহীত ও ব্যবহৃত হয়। কুরআন হলো ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ। ইসলামি বিশ্বাস অনুযায়ী এই গ্রন্থ আল্লাহর কাছ থেকে এসেছে। ইসলামের নবী মুহাম্মদের কথা ও কাজ সুন্নাহর মধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। সুন্নাহর প্রতিটি বাক্য মুহাম্মদের সাথী ও ইমামদের (শিয়া ও সুন্নী) মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে।
ইসলামী ব্যবস্থাপনা অনুসারে কোন আইন গ্রহণে অনুমেয় ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে না, বরং আইনশাস্ত্রের প্রতিটি আইনের জন্য অবশ্যই বিশুদ্ধ উৎস থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনা প্রয়োজন। সুন্নী ফিকহ অনুসারে শরিয়াহর মাধ্যমিক উৎস হলো ইজমা বা ঐকমত্য, যা ইসলামের সঠিক প্রকৃতি বহন করে এবং যাতে কারোর কোন দ্বিমত নেই, সাদৃশ্যমূলক কারণ, বিশুদ্ধ কারণ, জনস্বার্থ রক্ষাকরণ, ন্যায়জাত কর্ম, ইসলামের প্রথম যুগের শাসকদের করা আইন এবং স্থানীয় রীতি বিরুদ্ধ নয়।[2] হানাফি ফিকহে সাধারণত কুরআন, সুন্নাহ,(শর্তসাপেক্ষে) ইজমা এবং কিয়াসের উপর নির্ভর করে আইন গ্রহণ করা হয়। মালিকি ও হাম্বলী ফিকহে সরাসরি হাদিসের ভাষ্য গ্রহণ করা হয়। তবে শাফেয়ী ফিকহে হানাফি ফিকহের চেয়ে বেশি সুন্নাহ থেকে ও বাকি দুইটির চেয়ে বেশি সাদৃশ্যমূলক সিদ্ধান্ত থেকে আইন গ্রহণ করা হয়।[3] শিয়াদের মধ্যে জাফরী মতবাদে চারটি উৎস ব্যবহার করা হয়,যথাঃ কুরআন, সুন্নাহ, ঐকমত্য এবং বুদ্ধি। তারা বিশেষ শর্তে ঐকমত্য বা ইজমা গ্রহণ করে এবং কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক সাধারণ মূলনীতি ব্যাখ্যা করতে বুদ্ধি প্রয়োগ করে। তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে কুরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা করতে আইনশাস্ত্রের মূলনীতি অনুসরণ করে। আখবরি জাফরী মতবলম্বীরা নিজস্ব ঐতিহ্য বেশি অনুসরণ করে এবং ব্যক্তিগত গবেষণা পরিহার করে।[4] সুন্নী ফিকহের চারটি আলাদা শাখা ও শিয়া ফিকহের মধ্যে ফিকহগত অনেক ভিন্নতা থাকলেও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক লেনদেনের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে তেমন কোন ভিন্নতা নেই।[5]
কুরআন হলো ইসলামী আইনশাস্ত্রের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস। বিশ্বাস করা হয় যে এই গ্রন্থের প্রতিটি বাক্য সরাসরি আল্লাহর পক্ষ থেকে জিব্রাঈল ফেরেস্তার মাধ্যমে ইসলামের নবী মুহাম্মাদের ওপর মক্কা ও মদীনার বিভিন্ন স্থানে নাযিল করা হয়েছে। কুরআনে নৈতিক, দার্শনিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনীতি ভিত্তিক বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, যা একটি সমাজ নির্মাণে কাজে লাগে। মক্কায় নাযিল হওয়া অংশে দার্শনিক এবং আধ্যাত্মিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তবে মদীনায় নাযিল হওয়া অংশে আর্থ-সামাজিক আইন নিয়ে বেশি আলোকপাত করা হয়েছে। মুহাম্মদের জীবদ্দশাতেই কুরআন লেখা ও সংরক্ষণের কাজ শেষ হয় এবং তার মৃত্যুর কিছুদিন পরেই তা প্রণীত হয়।[6]
কুরআনের সমস্ত বাক্যকে তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। যথাঃ ' বিজ্ঞান ও দুরকল্পী মূলক', 'নৈতিক ও দার্শনিক মূলনীতি' এবং 'মানুষের আচার-ব্যবহারের নিয়ম'। এর তৃতীয় বিভাগটি সরাসরি ইসলামি আইনি বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে। সংখ্যা বিচারে এরকম আয়াতের সংখ্যা প্রায় পাঁচ শত, যা কুরআনের মোট আয়তনের এক-ত্রয়োদাংশ। কুরআনের আয়াত ব্যাখ্যা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আইন ও মতবাদ রয়েছে। সুন্নীদের কাছে সাহাবীদের মতামত ও শিয়াদের কাছে ইমামদের মতামত সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য। কারণ তারা জানেন যে কুরআনের কোন আয়াত কখন এবং কেন নাযিল করা হয়েছে।[1][6]
কুরআনের পরেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হলো সুন্নত। সাধারণভাবে সুন্নত বলতে 'মুহাম্মাদের কথা, কাজ ও মৌন সম্মতি' বা ' মুহাম্মাদের ঐতিহ্য ও রীতি' বোঝায়। তার দৈনন্দিন বাণী ও কথা, তার কাজ, তার মৌন সম্মতি এবং কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে বিবৃতি ইত্যাদি সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। তবে শিয়া ফিকাহবিদগণের মতে মুহাম্মাদের কন্যা ফাতিমা এবং বারো জন ইমামের কথা, কাজ ও মৌন সম্মতিও সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত।[1][7]
শরিয়াহর উৎস হিসেবে সুন্নতের গ্রহণযোগ্যতার প্রমাণ কুরআনেই বলা আছে।[8] কুরআন সমস্ত মুসলিমকে নির্দেশ দিয়েছে মুহাম্মাদকে অনুসরণ করতে। তিনি তার জীবদ্দশাতে ও মৃত্যুর পরেও তার সুন্নাহ অনুসরণ করতে বলে গেছেন।[9] সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের বিশ্বাস কুরআনের বাক্য ব্যাখ্যা ও অনুধাবনের জন্য সুন্নাহ অপরিহার্য। ইসলামী আইনশাস্ত্র অনুযায়ী এমন অনেক আইন আছে যা কুরআনে বলা নেই, অথচ তা মানবজাতির জন্য আবশ্যক, তা সুন্নাহতে বলা আছে। এমতাবস্থায় সুন্নাহ থেকেই আইন গ্রহণ করা হয়। মুসলমানরা আরো বিশ্বাস করে যে তাদের ধর্মীয় জীবনে কি করতে হবে অথবা কি বর্জন করতে হবে তা সুন্নাহ থেকেই গ্রহণ করতে হবে।
সুন্নতের সমস্ত বিধান হাদীসে লিপিবদ্ধ অবস্থায় আছে। প্রথমদিকে মুহম্মাদ হাদীস লিখতে নিষেধ করতেন। কারণ এতে কুরআন থেকে হাদীসকে আলাদা করা সাধারণ মানুষের জন্য কঠিন হয়ে পড়ত। তিনি তার সাহাবাদের নির্দেশ দিতেন তার কথা মুখস্থ করে রাখতে। তার জীবদ্দশাতে কেউ কোন সন্দেহজনক হাদীস জানতে চাইলে তার কাছ থেকে জেনে নিশ্চিত হতে পারত। তবে তার মৃত্যুর পর সে সুযোগ রইলো না। মুসলমানদের মধ্যে হাদীস নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ সৃষ্টি হতে থাকলো। আর এভাবেই হাদীস লিখে রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলো। হাদীসের যাচাইযোগ্যতা অর্থাৎ কোন হাদীস সত্য এবং কোন হাদীস মানুষের বানানো তা পরীক্ষা করার জন্য উসুলে হাদীস শাস্ত্রের (হাদীসের বিজ্ঞান) জন্ম হলো।[7] এটি একটি পাঠগত সমালোচনার পদ্ধতি যা ইসলামের প্রথম যুগের পণ্ডিতদের দ্বারা বিকশিত হয়, যার মাধ্যমে হাদীসের সত্যতা নির্ধারণ করা হতো। এই পদ্ধতির ভেতরে হাদীসের বাক্যগুলো বিশ্লেষণ করা, বিশ্লেষণের মানদণ্ড নির্ধারণ, প্রতিবেদন তৈরীর পদ্ধতি এবং যে সমস্ত ব্যক্তি উক্ত হাদীস বর্ণনা করেছে তাদের সম্পর্কে সম্যক ধারণা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই সমস্ত নীতির ওপর ভিত্তি করে হাদীসের বিভিন্ন শ্রেণিবিভাগ সৃষ্টি হয়েছে।[10]
একটি হাদীসের সত্যতা প্রমাণের জন্য একে বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে যাচাই করা হয় (যেমনঃ সনদ)। বর্ণনাকারী যেন নিজের ইচ্ছামত হাদীস বর্ণনা করতে না পারে তাই তাকে হাদীসে তথ্যসূত্র বা হাদীসটি সে কোথা থেকে শুনেছে সেটির তথ্য দিতে হয়। হাদীস শোনার এই পরম্পরা শেষ হয় মুহাম্মাদের কাছে গিয়ে। এই পরম্পরার অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তির সততার খ্যাতি ও প্রখর স্মৃতিশক্তির প্রমাণ থাকতে হয়। এভাবে রিজাল শাস্ত্রের (হাদীস বর্ণনাকারীদের জীবনী ও মূল্যায়ন বিদ্যা) সৃষ্টি হয়।[7] বর্ণনাকারীর জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ও স্থান, বংশ, ছাত্র ও শিক্ষক, সাহিত্যজ্ঞান, নৈতিক আচার, তাদের ভ্রমণ ইত্যাদি রিজাল শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত বিষয়। এইসব শ্রেণীর ওপর নির্ভর করে হাদীসের গ্রহণযোগ্যাতা অথবা বর্ণনাকারী কি আসলেই হাদীস বর্ণনার যোগ্য কি না, তার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়। এই মানদণ্ড তাদের সমসাময়িক কালের ও ভৌগোলিক নৈকট্যের অন্যান্য হাদীস বর্ণনাকারীদের দ্বারা প্রতিপাদন করা হয়ে থাকে। রিজাল শাস্ত্রের অভিধানের উদাহরণ হলো ইবনে হাজার আল-আসকালানির লেখা 'তাহযীব আল তাহযীব' বা আল যাহাবীর লেখা তাদক্বিরত আল হুফফায ইত্যাদি।[11]
এই সমস্ত মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে হাদীসকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে।[7] যথাঃ
একটি শরিয়া আদালতে বিচারক মামলা শোনেন এবং এর পক্ষে-বিপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করেন। তারপর তিনি রায় প্রদান করেন। কখনো কখনো তিনি কোন মুফতীর সাথে পরামর্শ করে রায় প্রদান করেন।
মধ্যযুগীয় মুসলিম ফিকাহবিদগণ সকলের অবাধ মতবাদ প্রত্যাখ্যান করে শরীয়াহর কিছু মাধ্যমিক উৎস নির্ধারণ করেছেন। এইক্ষেত্রে প্রাথমিক উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) উহ্য রেখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।[12]
ইসলামী আইনশাস্ত্রের কোন বিষয়ে মুসলিম আইনবিদদের ঐক্যমত্য বা ইজমা শরিয়াহর তৃতীয় উৎস হিসেবে পরিগণিত হয়। ইসলামী পণ্ডিতগণ কুরআন থেকে অনেক আয়াত উদ্ধৃত করার মাধ্যমে ইজমার গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণ করতে চান।[13][14] মুহম্মাদ নিজে বলেছেন,
শরিয়াহর অন্যান্য উৎসের সংজ্ঞা প্রদান এবং তা মুসলিম সম্প্রদায়ে অনুশীলন করা ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।[16] এর কারণ হলো, ইজমা আইনশাস্ত্রের কোন বিষয়ে অসংখ্য মুসলিমের সর্বস্মমত মতামতের প্রতিনিধিত্ব করে। [17] ইজমা সম্পর্কে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক মতবাদ প্রচলিত আছে। সুন্নী ফিকাহবিদগণ কুরআন ও সুন্নাহর মত ইজমাকেও শরিয়াহর উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্যদিকে শীয়ারা ইজমাকে গ্রহণ করলেও শরিয়াহর উৎস হিসেবে উপরিউক্তদ্বয়ের মত মনে করেনা।[18] ইজমা বলতে অতীতে কোন বিষয়ের ওপর একমত হওয়ার চুক্তিকে নির্দেশ করে। তা হোক কাছে বা দূরের কোন দেশে।[16] সুন্নীদের মধ্যে ইজমায় অংশগ্রহণ করা নিয়েও বৈচিত্র্য আছে। যথাঃ
মাযহাব | ইজমার গঠন | ব্যাখ্যা | ||||
---|---|---|---|---|---|---|
হানাফি | ইসলামী ফকিহদের সর্বসম্মতিক্রমে | কারণ ফকিহগণ এই বিষয়ে বিস্তারিত জ্ঞান রাখেন | ||||
শাফি | ইসলামী সকল ফকিহদের অথবা সম্প্রদায়ের সম্মতিক্রমে | কারণ জনগণ সব বিষয় নাও জানতে পারে | ||||
মালিকি | ইসলামের প্রথম রাজধানী মদীনায় বসবাসরত মুসলিমের সম্মতিক্রমে | ইসলাম বলে, 'মদীনা খারাপ মানুষ থেকে দূরে থাকবে, যেভাবে ফার্নিশ মরিচাকে লোহা থেকে দূরে রাখে।' | ||||
হাম্বলী | মুহম্মাদ (সাঃ) এর সাহাবীদের সম্মতি ও অনুশীলন দ্বারা | কারণ তারাই ধর্ম সম্পর্কে বেশি জানে ও তারা বেশি ধার্মিক ছিলো। | ||||
উসুলি | কোন সময়ের সমস্ত আলেম কর্তৃক সর্বসম্মতি ক্রমে অথবা ইমামের সম্মতি ক্রমে | কারণ ইজমা কোন একক বিষয় নয়। এর সাথে অনেক মানুষ জড়িত যাতে করে সুন্নাহ হতে সত্য আহরণ করা যায়। | ||||
তথ্যসূত্র: |
সুন্নী ফকিহদের মতে ইসলামী শরিয়াহর চতুর্থ উৎস হলো কিয়াস। পূর্বের নেওয়া সিদ্ধান্ত বিশ্লেষণ করে নতুন আইন প্রণয়ন করাই এর লক্ষ্য। শিয়ারা কিয়াস অনুসরণ করে না। তারা এর সমজাতীয় পদ্ধতি ইজতিহাদ ব্যবহার করে। সুন্নীদের মধ্যে হাম্বলী মাজহাব এই পদ্ধতি অনুসরণ করতে চায় না এবং জাহিরি মাজহাব একে প্রত্যাখ্যান করে। কুরআন ও সুন্নাহ থেকে বর্তমান সময়ে উপস্থিত কোন সমস্যা, যা পূর্বে ছিলো না, তা সমাধান করার জন্যেই মূলত কিয়াস করা হয়। এই পদ্ধতিতে অবাধ সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ নেই, কেবল মাত্র প্রাথমিক উৎস হতে প্রমাণ সাপেক্ষে তা গ্রহণ করা যেতে পারে।[19]
কিয়াস ব্যবহারের সমর্থকরা কুরআন হতে উদ্ধৃতি প্রদান করেন, যেখানে পূর্বের সমাজে কিয়াসের প্রমাণ পাওয়া যায়। তাদের মতে মুহম্মাদ বলেছেন, ‘যেখানে কোন স্পষ্ট অহীর বিধান নেই, সেখানে আমি তোমাদের মধ্যে যুক্তি দিয়ে বিচার করব’।[20] তারা আরো দাবী করে যে মুহম্মাদ তাদের যুক্তির অধিকার অন্যের জন্য সম্প্রসারিত করে দিয়েছেন। তাদের সর্বশেষ দাবী হলো, এই পদ্ধতি ইজমা বা সর্বসম্মতিক্রমে সাহাবীদের মধ্যে প্রচলিত ছিলো।[19] ইসলামী শিক্ষা বিষয়ক পণ্ডিত বার্নার্ড জি. ওয়েস গবেষণা করে বের করেন যে ইসলামের প্রথম যুগে কিয়াস শরিয়াহর চতুর্থ উৎস হিসেবে পরিগণিত হত এবং সে সময়ের পণ্ডিতগণ একে আলাদা কিছু মনে করতেন না।[21] এভাবে বিভিন্ন সময় কিয়াসের বিষয় এবং এর বৈধতা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যদিও অধিকাংশ সুন্নী ফকিহগণ কিয়াসকে শরিয়াহর উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন।
ইসলামের সফলতা ও সম্প্রসারণ একে বিভিন্ন জাতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সংস্পর্শে এনেছে, যেমনঃ বাইজেন্টাইন, পারস্য ইত্যাদি। ফলে মুসলিমদের মধ্যে নিত্য নতুন সমস্যার তৈরী হতে থাকে,যা তৎকালীন বিদ্যমান আইন দ্বারা সমাধান করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। কারণ ইসলামের রাজধানী মদীনা অনেক দূরে এবং ইসলামী রাষ্ট্রে বসবাসকারীদের সাথে যোগাযোগ সহজলভ্য নয়। এমতাবস্থায় প্রাজ্ঞ ফকিহগণ এক অভিনব উপায় বের করলেন যেখানে ইসলামী আইন কঠোর ভাবে অনুসরণ করা কষ্টসাধ্য ছিলো। উমাইয়া খিলাফতের যুগে কিয়াসের মতবাদ শাসকদের মাধ্যমে নির্যাতিত হয়েছিলো। এরপর আব্বাসীয় খিলাফত যুগে ধারাবাহিক ভাবে কিয়াসের প্রায়োগিক ব্যবহারে আরো কঠোরতা আরোপ করা হয়।[19]
কিয়াস মতবাদের মূলনীতি ছিলো যে এর মাধ্যমে গৃহীত কোন বৈধ হুকুম জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করবে। তাই ইসলামের প্রাথমিক উৎস হতে কিয়াসের মাধ্যমে দেওয়া রায় ইজমার মাধ্যমে দেওয়া রায়ের অনুরূপ হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ইসলামে মদ হারাম, কারণ এতে ক্ষতিকর পদার্থ থাকে। কিয়াস এই নীতি থেকে বিধান তৈরী করে যে ঐ ক্ষতিকর পদার্থ বিশিষ্ট সকল পণ্য নিষিদ্ধ।
হানাফি মাজহাব দৃঢ় ভাবে কিয়াস অনুসরণ করে। ইমাম আবু হানিফা কিয়াসের সমর্থক একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, যিনি কিয়াসকে শরিয়াহর একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে সমাসীন করেন। তিনি কুরআন-সুন্নাহ থেকে কিয়াসের জন্য শক্তিশালী মূলনীতি প্রণয়ন করেন। ইসলামে উদীয়মান নতুন সমস্যা সমাধানে অন্যান্য ফকিহদের মত তিনি তার রায়কে প্রাধান্য দিতেন। এসব রায় নেওয়া হত শরিয়াহর প্রাথমিক উৎস (কুরআন ও সুন্নাহ) থেকে গবেষণার মাধ্যমে। তিনি ইসলামের আধ্যাত্মিক শিক্ষাও গ্রহণ করেছিলেন। তাই এই ধরনের বিধানের দ্বারা একই সাথে জনস্বার্থ ও মুসলিম জাতির কল্যাণ সাধিত হত।[19]
আমাদের জ্ঞান হলো আমাদের একটি মতামত মাত্র। এর সবচেয়ে উত্তমটি আমরা গ্রহণ করতে সক্ষম। যিনি কোন বিষয়ে একাধিক উপসংহারে যেতে সক্ষম, তিনি তার মতামতের অধিকারী এবং আমরা আমাদের মতামতের অধিকারী।
শাফেয়ী মাজহাব কিয়াসকে শরিয়াহর বৈধ উৎস হিসেবে গ্রহণ করে। ইমাম শাফি যদিও একে দুর্বল উৎস মনে করতেন। তিনি এমন সমস্যা সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করতেন যেন বিচারকদের কিয়াসের আশ্রয় নিতে না হয়। যে কিয়াসের মূল প্রাথমিক উৎসে ছিলো না তা তিনি প্রত্যাখান করেন এবং ভর্ৎসনা করেন। তিনি বলেন, প্রাথমিক উৎসের সাথে সম্পর্কহীন কিয়াসের প্রভাব ক্ষতিকর হতে পারে। এই ধরনের ফলাফল সমাজে একই বিষয়ে একাধিক বিধানের সৃষ্টি হতে পারে, যা সুষম ও বৈধ বিধান ধ্বংস করে দেবে।[22]
ইমাম মালিকও কিয়াসকে বৈধ উৎস হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি মনে করেন যদি নতুন সমস্যা ও পূর্বের সমস্যার মধ্যে বৈপরীত্ব্য সৃষ্টি হয় তবে সেক্ষেত্রে কিয়াস একটি টেকসই সমাধান হতে পারে। তিনি তার ‘কঠোর পর্যালোচনা’ অতিক্রম করে গেছেন এবং বলেছেন পূর্বের ফকিহগণ যাকে ‘জনকল্যাণ মূলক’ বলেছেন তার ওপর ভিত্তি করে বিধান প্রণয়ন করা উচিত।[19]
আবু হানিফা শরিয়াহর আইন প্রণয়নের জন্য এক নতুন পদ্ধতি ইজতিহসান উদ্ভাবন করেছেন।[23] ইজতিহসান বলতে বুঝায়ঃ
ইজতিহসান পদ্ধতিটি ইজমার মূলনীতি থেকে উৎসারিত। যখন কোন সমস্যার সমাধান কোন উৎসে পাওয়া যায় না, তখন এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে কোন আইন জনসাধারণের কাছে সহজসাধ্য করার চেষ্টা করা হয় যেন সকলে তা অনুসরণ করতে পারে।[22] এই মতবাদের প্রামাণিক সূত্র কুরআন থেকে গ্রহণ করা হয়। উক্ত গ্রন্থে বলা আছে, ‘আল্লাহ ভালো ও সহজ জিনিস গ্রহণ করেন, তিনি কাঠিন্য পছন্দ করেন না’। [24] যদিও এই পদ্ধতি আবু হানিফা ও তার ছাত্রগণ (যেমনঃ আবু ইউসুফ) শুরু করেছিলেন, তবু ইমাম মালিক ও তার ছাত্রগণ একে অনেক উচ্চ স্তরের ব্যবহারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই উৎসের বিষয় ছিলো ব্যাপক আলোচনা ও যুক্তি-তর্ক। [25] তবে এর বিরোধীরা দাবি করে যে, পদ্ধতিটা প্রায়শই মূল উৎস থেকে দূরে সরে যায়।[22]
ইজতিহসান মতবাদটি আরব বিশ্বের বাইরে খুব উপকারী হয়ে উঠলো। কারণ সেখানকার মুসলিমরা আরবী ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রাখত।[23] তাদের জন্য ইসলাম পালনের সহজ পদ্ধতি হয়ে উঠলো ইজতিহসান। এর একটি স্বার্থক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে এভাবেঃ যদি একটি কূপের পানি দূষিত হয়ে যায় তবে এর পানি দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করা যাবে না। ইজতিহসান মতবাদ অনুসারে কূপ থেকে কয়েক বালতি পানি তুলে ফেললে কূপের দূষণ দূর হবে এবং তার পানি আবার ব্যবহার উপযোগী হবে। কিন্তু কিয়াস এর বিরোধীতা করবে। কিয়াস অনুসারে কয়েক বালতি পানি ফেলে দিলেও কূপে কিছু মাত্রার হলেও দূষণ থাকবে, যা কূপের পানি ব্যবহার উপযোগীতা হারাবে। কিন্তু এই আইন জনসাধারণের পালনের জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে। এইরকম কঠিন বিধান সহজসাধ্য করার জন্যই ইজতিহসান। [24]
ইমাম মালিক আল-মাসলাহা আল-মুরসালাহ নামে একটি টারশিয়ারি উৎস বিকশিত করেন। সাধারণ মানুষের সর্বোচ্চ স্বার্থ রক্ষা করে, এমন বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত। ইসলামী আইনের এই উৎসের ওপর ভিত্তি করে গৃহীত আইনকে বলা যেতে পারে ‘জনস্বার্থের আলোকে অহির বিধানের অন্তর্নিহিত অর্থ’। এইক্ষেত্রে ফকিহগণ জনস্বার্থে তাদের প্রজ্ঞা ব্যবহার করেন। কিন্তু এই উৎসটি শাফেয়ী, হাম্বলী ও জাহিরি মাজহাব অস্বীকার করে।[23]
ইমাম শাফেয়ী এমন বিষয় গ্রহণ করেছেন যা তার মতে কিসাসের সবচেয়ে সহজ প্রয়োগযুক্ত। ইমাম আবু হানিফা ও মালিক একই মত গ্রহণ করেছেন। তিনি আইন প্রণয়নের একটি টারশিয়ারি উৎসের বিকাশ ঘটিয়েছেন। শাফেয়ী মাজহাবে ইসতিদলাল বা অনুমান ক্রিয়ার মাধ্যমে শরিয়াহর উৎস থেকে আইন গ্রহণ করার প্রক্রিয়া আছে। যখন কোন স্পষ্ট বিধান পাওয়া যায় না, কেবল তখনই ইসতিদলাল করা যায় যা, আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনস্বার্থ পক্রিয়া থেকে পৃথক হয়ে যায়।[22]
মুসলিম প্রাজ্ঞরা ইসতিদলালকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছেন। প্রথমটি হলো কোন প্রস্তাবনা ও কার্যকর কারণহীন কোন বিষয়ের মধ্যে বিদ্যমান সংযোগের অভিব্যক্তি। দ্বিতীয়টি হলো এমন বিষয়ে অনুমান যার সত্যতার ব্যাপারে কোন প্রমাণ নেই, যার দ্বারা সংশ্লিষ্ট আলোচনার ইতি টানা যায়। সর্বশেষটি হলো ইসলামের প্রথম যুগের অহীর বিধান বিষয়ক কর্তৃপক্ষ। [26]
শিয়ারা মনে করেন যে যদি কোন সমস্যার সমাধান শরিয়াহর প্রাথমিক উৎসে খুঁজে পাওয়া না যায়, তবে নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সেই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে কোন আইন তৈরী করাকে ইজতিহাদ বা গবেষণা বলা হয়। তারা মনে করেন, কিয়াস হলো একধরনের ইজতিহাদ। সুন্নী শাফেয়ী মাজহাবের মতে মনে করা হয় যে, ইজতিহাদ ও কিয়াস একই।[27]
সুন্নীরা আইন তৈরীর কার্যক্রম হিসেবে ইজতিহাদকে গ্রহণ করে থাকেন। যাইহোক, তারা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে উক্ত প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘোষণা করে। এর কারণ হলো, ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রসমূহ (যেমনঃ বাগদাদ, নিশাপুর, বুখারা ইত্যাদি) মঙ্গলদের করতলগত হয়েছিলো। আর এভাবেই ইজতিহাদের সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়।[27]
ফলে সুন্নী সমাজে ইজতিহাদের স্থান গ্রহণ করে তাক্বলীদ, অর্থাৎ বিগত যুগের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।[28] পরবর্তীতে সুন্নীদের মধ্যে অনেক উল্লেখযোগ্য পণ্ডিত আসেন যারা ইসলামের প্রাথমিক উৎস থেকে আবারো আইন প্রতিপাদন করা শুরু করেন। তাদের অন্যতম হলো ইবনে তাইমিয়া, ইবনে রুশদ ইত্যাদি ব্যক্তিবর্গ। কুরআন ও সুন্নাহতে ইজতিহাদ করার ব্যাপারে অনেক দিকনির্দেশনা দেওয়া আছে। যেমনঃ মুয়াজ ইবনে জাবালের সাথে কথোপকথনের সময় মুহম্মাদ তাকে জিজ্ঞাসা করেন যে সে কীভাবে বিচার করবে। মুয়াজ উত্তর দিয়েছিলেন যে তিনি প্রথমে কুরআন, পরে সুন্নাহ এবং এই দুইটিতে না পেলে ইজতিহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মুহাম্মাদ তার বক্তব্য অনুমোদন দিলেন। [29]
একজন প্রাজ্ঞ আইনবিদ যিনি এই এই উৎস ব্যবহার করার যোগ্যতা রাখেন তাকে বলা হয় মুজতাহিদ। সুন্নীদের মাজহাবগুলোর প্রতিষ্ঠাতাগণ এমনই যোগ্যতা সম্পন্ন আইনবিদ বা ফকিহ ছিলেন। একজন মুজতাহিদ একই সময় একজন মুফতির ক্ষমতা লাভ করেন এবং যেকোন ফতোয়া দিতে পারেন। কিছু মুজতাহিদকে মুজাদ্দিদ বা ধর্ম সংস্কারক বলা হয়। মনে করাহয় যে প্রতি শতাব্দীতেই মুজাদ্দিদের জন্ম হয়। কিন্তু শিয়ারা মনে করে প্রতি শতাব্দীতে তাদের গুপ্ত ইমামের একজন মুখপাত্র জন্মগ্রহণ করেন।[28]
‘আর্ফ’ শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো ‘জানা’, তবে এর দ্বারা কোন একটি সমাজের রীতি ও পালনীয় ঐতিহ্য বুঝায়। যদিও আগে এটি ইসলামী শরিয়াহর উৎস হিসেবে গ্রহণ করা হতো না।[30] ইসলাম শুধুমাত্র ঐ সমস্ত রীতি অনুমোদন করে যা মুহাম্মাদের যুগে ছিলো এবং যার দ্বারা কোন ইসলামী আইন লঙ্ঘিত হত না। মুহাম্মাদের পরবর্তী যুগের রীতি যাচাই এর পর অনসরনীয়, যদিও ইসলাম বলে মুসলিম জাতি যে বিষয় ভালো মনে করবে, আল্লাহ তা ভালো মনে করবেন। আর্ফে ইজমার মত অসংখ্য এবং কিয়াসের চেয়ে বেশি দায়িত্বশীল রয়েছ। তাই আর্ফকে ইসলামের সাধারণ আইন বলা হয়।[31]
স্থানীয় রীতির প্রথম অনুমোদন করেন আবু ইউসুফ। তিনি হানাফি ফিকহের প্রথম যুগের পণ্ডিত ছিলেন। যদিও একে সুন্নাহর অংশ মনে করা হয়, তবে তা দাপ্তরিক উৎসের মত বিশুদ্ধ নয়। পরবর্তীতে আল শারখশি এই মতের বিরোধীতা করেন। তিনি মনে করেন রীতি কখনো লিখিত তথ্যের ওপর প্রাধান্য লাভ করতে পারেনা।[30] সুন্নী ফকিহদের মতে স্থানীয় রীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে, যা আইনসিদ্ধ বিবেচনা করা হবে, সে রীতিকে অবশ্যই ঐ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকারী হতে হবে। তা নিছক কোন সম্প্রদায়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে হবে না। এই রীতি যদি ইসলামী আইনের বিরুদ্ধে যায়, তবে তা প্রত্যাখাত হবে এবং যদি তা কিয়াসের সাথে সাংঘর্ষিক না হয়, তবে তা অগ্রাধিকার পাবে। প্রমাণসাপেক্ষে স্থানীয় রীতি পালনে অনেক ফকিহদের একটা ঝোক থাকে, কোন পণ্ডিতের মতবাদের চেয়ে তারা রীতিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়।[31] তবে শিয়ারা রীতিকে শরিয়াহর উৎস মনে করে না, এমনকি সুন্নীদের হাম্বলী ও জাহিরি মাজহাব এই ব্যাপারে একই মত অনুসরণ করে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.