মেসোপটেমীয় দেবদেবী
উইকিমিডিয়ার তালিকা নিবন্ধ / From Wikipedia, the free encyclopedia
মেসোপটেমীয় দেবদেবীগণ ছিলেন প্রায় স্বতন্ত্রভাবেই নরত্বারোপিত দেবদেবী।[2] মানুষ বিশ্বাস করত, তারা ছিলেন অসাধারণ শক্তিমত্তার অধিকারী[2] এবং মানুষের কল্পনায় তারা ছিলেন অতিকায় সব সত্ত্বা।[2] এই দেবদেবীদের বৈশিষ্ট্য মেলাম নামে এক দ্ব্যর্থক পরিধেয় পদার্থ, যা "তাঁদের ঢেকে রাখত ভীতিপ্রদ মাহাত্ম্যে"।[3] মেলাম যোদ্ধা, রাজা, অতিকায় দৈত্য, এমনকি অপদেবতাদেরও পরিধেয় হতে পারত।[4] এক দেবতার মেলাম এক মানুষের উপর দেখার পরিণতিটিকে বলা হয় নি। এই শব্দটি "মাংসের উপর শারীরিক উদ্দীপন" বোঝাতে ব্যবহার করা হত।[5] সুমেরীয় ও আক্কাদীয় উভয় ভাষাতেই এমন অনেক শব্দ আছে, যেগুলি নি শব্দটির সংবেদন সৃষ্টি করে।[4] এই শব্দগুলির অন্যতম ছিল পুলুহ্তু শব্দটি, যার অর্থ ভয়।[5] এই দেবতাদের প্রতিকৃতিতে প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তাদের দেখা গিয়েছে মাথায় শিং-যুক্ত টুপি পরিহিত অবস্থায়।[6][7] এই টুপিতে ষাঁড়ের সাত জোড়া সিং একটি পর একটি স্থাপিত হত।[8] কোনও কোনও ক্ষেত্রে এঁদের সোনা ও রুপোর অলংকার সেলাই করা পোশাক পরিহিত অবস্থাতেও দেখা যায়।[7]
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অধিবাসীরা বিশ্বাস করত যে, তাদের দেবদেবীরা বাস করেন স্বর্গে।[9] কিন্তু একজন দেবতার মূর্তিকে তারা স্বয়ং সেই দেবতারই শারীরিক প্রতিমূর্তি মনে করত।[9][10] প্রকৃত অর্থে, কাল্ট মূর্তিগুলির নিয়মিত যত্ন নেওয়া হত ও এগুলির প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হত।[11][9] পুরোহিতদের একটি দলকে নিযুক্ত করা হয়েছিল সেই সব মূর্তির তদারকির জন্য।[12] তারা মূর্তিগুলিকে পোশাক পরাতেন[10] এবং সেগুলির সামনে ভোজের আয়োজন করতেন, যাতে দেবতারা "খেতে" পারেন।[11][9] একজন দেবতার মন্দিরকে তারা আক্ষরিক অর্থেই সেই দেবতার বাসভবন বলে বিশ্বাস করতেন।[13] এই দেবদেবীদের নৌকা বা পূর্ণ-দৈর্ঘ্যের বজরা ছিল। এগুলি সাধারণত মন্দিরের ভিতরেই রক্ষিত হত[14] এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবে জলপথে সেই দেবদেবীদের কাল্ট মূর্তিগুলি পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হত।[14] দেবদেবীদের নিজস্ব রথও ছিল। এগুলি স্থলপথে কাল্ট মূর্তিগুলি পরিবহনের কাজে লাগত।[15] কখনও কখনও দেবতার কাল্ট মূর্তিকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ে আসা হত, যাতে সেই দেবতা যুদ্ধের সূচনাটি দেখতে পান।[15] মানুষ বিশ্বাস করত, মেসোপটেমীয় দেবমণ্ডলীর প্রধান দেবতারা "দেবতাদের সভা"য় অংশগ্রহণ করতেন[6] এবং সেই সভায় তাঁরা যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন।[6] এই সভাটিকে উরের তৃতীয় রাজবংশের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২১১২ অব্দ – আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০৪ অব্দ) সমসাময়িক আধা-গণতান্ত্রিক সংসদীয় ব্যবস্থার এক দিব্য প্রতিরূপ মনে করা হত।[6]
ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মেসোপটেমীয় দেবমণ্ডলীর বিবর্তন ঘটেছিল।[16] সাধারণভাবে মেসোপটেমীয় ধর্মের ইতিহাসকে চার ভাগে ভাগ করা হয়।[16] প্রথম পর্যায়ের সূত্রপাত ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে। সেই যুগে দেবতা-সংক্রান্ত ধারণাটির ভিত্তি ছিল মানুষের বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলি।[17] খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ে দেবতাদের ক্রমাধিকারতন্ত্রটি আরও বেশি সুগঠিত হয়ে ওঠে[17] এবং দেবত্বারোপিত রাজারা দেবমণ্ডলীতে প্রবেশ করতে শুরু করলেন।[17] তৃতীয় পর্যায়টির সময়কাল ছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দ। সেই যুগে দেবতারা পূজিত হতেন ব্যক্তিমানুষের ইষ্টদেবতা রূপে এবং দেবতাদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটি সর্বত্র প্রসার লাভ করে।[17] খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে চতুর্থ তথা সর্বশেষ পর্যায়ে দেবতারা নির্দিষ্ট মানবীয় সাম্রাজ্য ও শাসকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন।[18] কিউনিফর্ম লিপিগুলি থেকে তিন হাজারেরও বেশি মেসোপটেমীয় দেবদেবীর নাম উদ্ধার করা হয়েছে।[19][16] এগুলির অনেকগুলিই পাওয়া যায় প্রাচীন মেসোপটেমীয় লিপিকারদের দ্বারা সংকলিত দেবতাদের নামের দীর্ঘ তালিকাগুলি পাওয়া যায়।[19][20] এই তালিকাগুলির মধ্যে দীর্ঘতম তালিকাটির শিরোনাম আন = আনতুম। এটি ব্যাবিলনীয় পণ্ডিতদের রচনা। এই তালিকায় দুই হাজারেরও বেশি সুমেরীয় দেবদেবী ও তাঁদের অনুরূপ সেমিটীয় দেবদেবীদের নাম উল্লিখিত হয়েছে।[19][17]
গুডিয়ার রাজত্বকাল (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২১৪৪-২১২৪ অব্দ) ও উরের তৃতীয় রাজবংশের সমসাময়িক প্রথম প্রত্যায়িত দেবমণ্ডলীর নাম আনুননাকি।[21][22] প্রথম দিকে আনুননাকিরা ছিলেন প্রভূত ক্ষমতার অধিকারী স্বর্গীয় দেবদেবী।[23][21] মানুষ বিশ্বাস করত, তাঁরা "মানবজাতির ভাগ্য নির্ধারণ করতেন"।[22] পরবর্তীকালে তারা কাথোনিক পাতাল দেবতা হিসেবে বিবেচিত হতে থাকেন।[23] প্রধানত সাহিত্যিক উপাদানগুলিতেই তাদের উল্লেখ পাওয়া যায়।[22] প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে তাদের কোনও কাল্টের অস্তিত্বের প্রমাণ খুব কম ক্ষেত্রেও পাওয়া গিয়েছে।[24][22] এর কারণ সম্ভবত আনুননাকি মণ্ডলীর প্রত্যেক সদস্য বা সদস্যার নিজস্ব স্বতন্ত্র একটি করে কাল্ট ছিল এবং সেই কাল্টগুলি ছিল পরস্পরের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ধরনের।[21] অনুরূপভাবে এমন কোনও উপস্থাপনাও আবিষ্কৃত হয়নি, যেখানে আনুননাকিকে একটি পৃথক গোষ্ঠী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[21] অবশ্য কয়েকটি প্রতিকৃতিতে এই মণ্ডলীর কোনও সদস্য বা সদস্যাকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিতও করা গিয়েছে।[21] আরেকটি দেবমণ্ডলীর নাম ছিল ইজিজি। এই দেবমণ্ডলী প্রথম প্রত্যায়িত হয়েছিল আদি ব্যাবিলনীয় যুগে (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৮৩০ অব্দ – আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১৫৩১ অব্দ)।[25] ইজিজি নামটি দেখে মনে হয় যে, প্রথমে সেই নামটি দশ মহৎ দেবতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল।[25] কিন্তু পরবর্তীকালে এই নামটি দ্বারা সম্মিলিতভাবে সকল দেবতাকেই বোঝানো হত।[25] কোনও কোনও ক্ষেত্রে আনুননাকি ও ইজিজি নাম দু’টি প্রায় সমার্থক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।[21][22]