Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভূ-কারিগরি প্রকৌশল (ইংরেজি: Geo-technical Engineering) হলো পুরকৌশলের একটি শাখা। মূলত ভূ-ত্বকের উপাদান তথা মাটির গুণাগুণ বিশ্লেষণ, মাটির শক্তিমাত্রা গবেষণা, মাটিতে ইমারতের ভিত বা বুনিয়াদ (Foundation of a Building) নির্মাণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয় পুরকৌশলের এই শাখায়।
মানুষ হাজার বছর ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ কার্য, কবরস্থকরণ, ইমারতের বুনিয়াদ নির্মাণ, কাঁচা ঘর বা সেমি পাকা ঘর নির্মাণসহ বহু কাজে মাটির ব্যবহার করে আসছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণে আল তৈরি করা, বাঁধ নির্মাণ, খাল খনন প্রভৃতি কাজে মাটির ব্যবহারের নিদর্শন ২ হাজার বছরেরও আগের মিশরীয় সভ্যতা, মেসোপোটেমিয়া সভ্যতা এবং ভারতবর্ষের সিন্ধু সভ্যতায় গড়ে ওঠা মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পোতেও দেখতে পাওয়া যায়।
ইতালির পিসা নগরীর হেলানো মন্দির কিংবা মিশরের উঁচু উঁচু পিরামিডের মত বুনিয়াদ (Foundation) সংক্রান্ত স্থাপনাগুলো বিজ্ঞানীদেরকে ভূ-পৃষ্ঠের নিচের মাটির বৈশিষ্টাবলি নিয়ে গবেষণায় উৎসুক করে তোলে। প্রথম দিকের গবেষণাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলো মৃত্তিকা-চাপ সংক্রান্ত তত্ত্ব, যা প্রতিরোধী দেয়াল বিনির্মাণে খুব কার্যকর। হেনরি গৌটিয়ের, একজন ফরাসী রাজকীয় প্রকৌশলী, ১৭১৭ সালে বিভিন্ন মাটির "প্রাকৃতিক ঢাল" চিনতে পেরেছিলেন, একটি ধারণা যা পরে মাটির বিশ্রামের কোণ হিসাবে পরিচিতি পায়। মাটির উপাদানের একক ওজনের উপর ভিত্তি করে মাটির প্রাথমিক শ্রেণিবিন্যাস ব্যবস্থাও তৈরি করা হয়েছিল, যা আর মাটির প্রকারের একটি ভাল ইঙ্গিত হিসাবে বিবেচিত হয় না। [1][2]
এছাড়াও, অষ্টাদশ শতকে ১৭৭৩ সালে বিজ্ঞানী চার্লস অগাস্টিন কুলম্ব (বিখ্যাত পদার্থবিদ) বলবিদ্যার মৌলিক ধারণাগুলোকে মাটির জন্য প্রয়োগ করেন এবং এর মাধ্যমে তিনি মৃত্তিকা-চাপ সংক্রান্ত একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি লক্ষ্য করেন, যখন কোন রিটেইনিং দেয়াল ভেঙে পড়ে, তখন এর পেছন দিকে একটি পিছলানো তল সৃষ্টি হয়, এবং এই পিছলানো তলের উপরের সর্বোচ্চ কৃন্তন পীড়ন ক্রিয়াশীল হয়। এ তত্ত্ব কুলম্ব তত্ত্ব নামে পরিচিত। পরবর্তীতে, বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান অটো মোর তাঁর দ্বিমাত্রিক পীড়ন অবস্থা বিষয়ক তত্ত্ব কুলম্বের তত্ত্বের সাথে সমন্বয় করেন, এ সমন্বিত তত্ত্ব মোর-কুলম্ব তত্ত্ব নামে পরিচিতি পায়।
ঊনবিংশ শতকে বিজ্ঞানী হেনরি ডার্সি মাটির ভেতরকার আন্তঃকণা ফাঁকা স্থান দিয়ে পানি প্রবাহের মূলনীতি বিষয়ক একটি সূত্র প্রদান করেন, যা ডার্সির সূত্র নামে বিশেষভাবে খ্যাত। ঐ শতকেই উইলিয়াম র্যাংকিন মৃত্তিকা-চাপ বিষয়ে কুলম্বের প্রচলিত তত্ত্বের বাইরে গিয়ে ভিন্ন তত্ত্ব প্রদান করেন। আলবার্ট এটারবার্গ কর্দমাক্ত মাটি (Clay)নিয়ে বিভিন্ন তত্ত্ব ও পরীক্ষণ উপস্থাপন করেন, যা মাটির শ্রেণিবিন্যাসে আজও ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
আধুনিক জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর সূচনা ১৯২৫ সালে কার্ল তারজাঘির হাত ধরে। তিনি মাটির কণাগুলোর আচরণ ও বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যায় বলবিদ্যার সফল প্রয়োগ করেন। ফলে, মৃত্তিকা বলবিদ্যা নামে বলবিদ্যার একটি স্বতন্ত্র শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাই কার্ল তারজাঘিকে মৃত্তিকা বলবিদ্যার জনক হিসেব অভিহিত করা হয়। কার্ল তারজাঘি কার্যকর পীড়নের মূলনীতিগুলো দাঁড় করান, এবং ব্যাখ্যা করেন যে, মাটির কৃন্তন শক্তিমাত্রা (Shear Strength) মূলত কার্যকর পীড়ন দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। তারজাঘির আবিষ্কৃত তত্ত্বের মধ্যে আরো আছে -- মাটির ভারবহন ক্ষমতা সংক্রান্ত তত্ত্ব, এবং কর্দমাক্ত মাটির দৃঢ়করণের দরুন মাটির দেবে যাওয়ার ঘটনা পূর্বাভাস ব্যাখ্যা করার তত্ত্বাদি। জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ এই বিশাল অবদানের জন্য তাঁকে এ শাস্ত্রের জনক বলা হয়।
জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হতে হলে চার বছর মেয়াদী পুরকৌশলে স্নাতক সম্পন্ন করতে হবে। পরবর্তী, স্নাতকোত্তরও করা যায় এ বিভাগে। বিশ্বের প্রায় সব প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত আছে। বাংলাদেশে বুয়েট সহ ডুয়েট , রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, আই.ইউ.টি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতি জায়গায় এ বিষয়ে পাঠদান করা হয়। জিও-প্রফেশনাল একাডেমি ২০০৮ সালে জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ডিপ্লোমা সনদপত্র প্রদান শুরু করেছে।
মৃত্তিকা বলবিদ্যা, মাটির আন্তস্তর বিন্যাস, প্রভৃতি বিষয়ে কোর্স করানো হয়।
জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বলবিদ্যার মূলনীতিগুলো মৃত্তিকা তথা মাটির জন্য প্রয়োগ করা হয়। বলবিদ্যা বিজ্ঞানের একটি প্রাচীন শাখা হলেও মৃত্তিকা বলবিদ্যা শাখাটি অধুনা প্রতিষ্ঠিত। মৃত্তিকা বলবিদ্যা অনুসারে, একটি মাটির ব্লককে তিনটি দশায় ভাগ করে বিবেচনা করা হয়ঃ কঠিন মাটি, পানি এবং বায়ু। মাটির কণাগুলোর মধ্যে যে ফাঁকা স্থান থাকে, ঐ ফাঁকা স্থানগুলোতে পানি ও বায়ু প্রবিষ্ট অবস্থায় থাকে।
মাটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকৌশলগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়াররা অহর্নিশি ব্যবহার করে থাকেন।
একক আয়তনের মাটির ব্লকের ওজনকে তার একক ওজন বলে। মাটির একটি ব্লকে যেহেতু কঠিন মাটি, তরল পানি ও বায়বীয় বাতাস থাকে, তাই একক আয়তনে এদের সম্মিলিত ওজনকেই মাটির একক ওজন বলা হয়। মাটির একক ওজন সাধারণত প্রতি ঘনমিটারে ১৬-২৫ কেজি বা প্রতি ঘনফুটে প্রায় ১১০-১৪০ পাউন্ড হয়ে থাকে।
মাটির ভেতর কণাগুলোর মাঝে মাঝে ফাঁকা স্থান বিরাজ করে। একটি মাটির ব্লক কল্পনা করলে, সেখানে কিছু অংশ স্রেফ মাটির কণা থাকে, আর কিছু অংশ ফাঁকা থাকে যা পানি অথবা বায়ু দ্বারা পূর্ণ হয়ে যায়। এরূপ একটি মাটির ব্লকে কেবল ফাঁকা অংশের আয়তন এবং পুরো মাটির ব্লকের আয়তনের অনুপাতকে স্বরন্ধ্রতা বলা হয়।
একটি মাটির ব্লকে বিদ্যমান ফাঁকা স্থান বা শূন্যস্থানের আয়তন ও নিরেট মাটির কণাগুলোর আয়তনের অনুপাতকে শূন্যস্থান অনুপাত বলে।
মাটির কণাগুলোর ভেতরে যে শূন্যস্থান বা আন্তকণা ফাঁকা স্থান থাকে তার মধ্য দিয়ে পানি বা অন্য কোন প্রবাহী তরল প্রবাহিত হতে পারে। মাটির ভেতর দিয়ে পানির প্রবাহের পরিমাপকেই প্রবেশ্যতা বলে। একে k দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এর একক, মিটার/সেকেন্ড।
মাটির কণাগুলোর মধ্যকার ফাঁকাস্থান গুলোর ভেতর পানি জমে থাকে বা প্রবাহিত হয়। এখন এই মাটির উপর চাপ প্রয়োগ করলে এই পানি ছিটকে বেরিয়ে আসে। এতে করে মাটির ব্লকের আয়তন কমে আসে, মাটির ব্লক সংকুচিত হয়। মাটির ব্লকের সংকোচিত হবার এ ধর্মকে সংনম্যতা বলা হয়। আর এভাবে পানি বের হয়ে আসার এ ঘটনাকে কনসলিডেশন বা দৃঢ়ীকরণ বলে।
সর্বোচ্চ যে পরিমাণ কৃন্তন পীড়ন প্রযুক্ত হলেও মাটি ধ্বসে পড়ে না, তাকে মাটির কৃন্তন শক্তি বলে।
তরল সীমা, নমনীয় সীমা ও কোচন সীমা গুলো এটার্বার্গের দ্বারা আবিষ্কৃত বলে এদেরকে এটারবার্গের সীমা বলা হয়। মাটির প্রকৌশলগত বৈশিষ্ট্যাবলি ও মাটির শ্রেণিবিন্যাসে এটারবার্গ সীমাগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.