Loading AI tools
অভিভাবক চেতনা বাংলার সুন্দরবনের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের দ্বারা উপাসিত উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
বনবিবি হলেন বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত সুন্দরবন অঞ্চলে মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর দ্বারা পূজিত এক লৌকিক দেবী তথা পিরানি। উক্ত জনগোষ্ঠীর মানুষেরা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করে।[1] বনবিবি বনদেবী, বনদুর্গা, ব্যাঘ্রদেবী বা বণচণ্ডী নামেও পরিচিত।
কোনও কোনও মন্দিরে তিন ব্যাঘ্র-দেবদেবী বনবিবি, দক্ষিণরায় ও কালুরায় একসঙ্গে পূজিত হন। আবার কোথাও বনবিবি-শাজঙ্গুলির যুগ্ম বিগ্রহও পূজিত হতে দেখা যায়।[2] জলপাইগুড়ির বৈকুন্ঠপুর গভীর ফরেস্টের প্রতি বছর শীতে এই বন দুর্গা পুজো তথা মেলার আয়োজন হয়
ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের সুন্দরবন অঞ্চলেই মৎস্যজীবী, মধু-সংগ্রহকারী ও কাঠুরিয়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেতে বনবিবির পূজা করেন। ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর খুলনার ইতিহাস গ্রন্থের তথ্য অনুযায়ী, ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সুন্দরবন এলাকায় দক্ষিণরায়, বণিক ধোনাই ও মোনাই এবং গাজীর অস্তিত্বের কথা জানা যায়। বনবিবি ছিলেন ইব্রাহিম (মতান্তরে বেরাহিম) নামে এক আরবের কন্যা। ইব্রাহিমের স্ত্রী গুলাল বিবি সতীনের প্ররোচনায় সুন্দরবনে পরিত্যক্ত হলে সেখানেই বনবিবির জন্ম হয়। কথিত আছে, গুলাল বিবি মদিনা এবং ইব্রাহিম মক্কা হতে আগত ছিলেন। দক্ষিণরায় ছিলেন যশোহরের ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের অধীনস্থ ভাটির দেশের সামন্ত। দক্ষিণরায়ের সঙ্গে বনবিবির একাধিক যুদ্ধ হয়। শেষে দক্ষিণরায় পরাজিত হয়ে সন্ধি করেন। দক্ষিণরায়ের পরাজয়কে এই গ্রন্থে বাঘ বা অপশক্তির পরাজয় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে উভয় দেশের সুন্দরবন অঞ্চলের লোকসংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেন বনবিবি।[3]
বনবিবির মাহাত্ম্যবিষয়ক কাব্যের নাম "বনবিবির জহুরানামা"। এই কাব্য মঙ্গলকাব্যের শৈলীতে রচিত হলেও এতে আল্লাহ্-রসুল, মক্কা, পির-পিরানি ইত্যাদি প্রসঙ্গ যুক্ত হয়েছে। অরণ্যচারী মানুষের ধর্মবিশ্বাস ও জীবনযাত্রার একটি চিত্র এতে পাওয়া যায়।[4] গবেষকদের মতে, বনবিবি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু দেবী বনদুর্গা, বনচণ্ডী, ষষ্ঠী বা বিশালাক্ষী। বাংলায় ইসলামি প্রভাবে তিনি বনবিবিতে পরিণত হয়েছেন।[5]
বনবিবির কিংবদন্তিগুলি "বনবিবির কেরামতি" (বনবিবির অলৌকিক কার্যাবলি) ও "বনবিবির জহুরানামা" (বনবিবির গৌরবগাথা) নামে কয়েকটি লোককাব্যে পাওয়া যায়। এই কাব্যের কবিদের মধ্যে বায়ানউদ্দীন ও মোহাম্মদ খাত্তর বিশেষ পরিচিত এবং উভয়ের গ্রন্থের বিষয়বস্তুর মধ্যে অনেক সাদৃশ্য দেখা যায়।[6] এই কাহিনির দু’টি প্রধান পর্ব: দক্ষিণরায়ের সঙ্গে যুদ্ধ ও দুখের বিবরণ।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, বনবিবি হলেন মক্কা থেকে আসা ইব্রাহিম ফকিরের (স্থানীয় নামে বেরাহিম) কন্যা। ইব্রাহিমের প্রথমা পত্নী ফুলবিবি নিঃসন্তান ছিলেন। তিনি এক শর্তে স্বামীকে পুনরায় বিবাহের অনুমতি দেন। ইব্রাহিম বিবাহ করেন গুলালবিবিকে। এই সময় আল্লাহ্ বিশেষ উদ্দেশ্যে স্বর্গ থেকে বনবিবি ও শাহ জঙ্গলীকে গুলালবিবির সন্তান রূপে জন্মগ্রহণের নির্দেশ দিয়ে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন। গুলালবিবি গর্ভবতী হলে ইব্রাহিম ফুলবিবির শর্তানুসারে তাঁকে বনভূমিতে ফেলে আসেন। এই বনেই বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী জন্মগ্রহণ করেন। তাদের যত্ন নেওয়ার জন্য আল্লাহ্ স্বর্গ থেকে চারজন দাস প্রেরণ করেন। গুলালবিবি শাহ জঙ্গলীর হাতে বনবিবিকে রেখে চলে গেলেন। বনবিবি বনেই বড়ো হতে থাকেন। সাত বছর পর ইব্রাহিম নিজের ভুল বুঝতে পেরে দুই সন্তানসহ গুলালবিবিকে মক্কায় ফিরিয়ে নিয়ে যান।
একবার প্রার্থনার সময় বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দু’টি জাদু-টুপি পেয়েছিলেন। ওই টুপির সাহায্যেই তাঁরা হিন্দুস্তানে আঠারো ভাটির দেশে (সুন্দরবন) চলে যান (অপর বর্ণনা অনুসারে, তাঁদের জিব্রাইলের আঠারো জনের দেশে আনা হয়েছিল)। সেখানে পৌঁছে শাহ জঙ্গলী প্রার্থনায় বসেন। আঠারো ভাটির দেশে সেই সময় দানবরাজ দক্ষিণরায়ের নিয়ন্ত্রণে ছিল। শাহ জঙ্গলীর প্রার্থনার শব্দ পেয়ে তিনি বন্ধু সনাতন রায়কে খোঁজ নিয়ে পাঠান। পরে সনাতনের বনবিবি ও শাহ জঙ্গলীর কথা শুনে দক্ষিণরায় তাঁদের এলাকা থেকে বিতাড়ণের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি যখন যুদ্ধে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর মা নারায়ণী তাঁকে বাধা দেন এবং নিজেই ভূত-প্রেতের সেনাবাহিনী নিয়ে বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাত্রা করেন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর বনবিবি নারায়ণীকে পরাজিত করেন। কিন্তু করুণাবশত তিনি নারায়ণীকে রাজ্যের অর্ধেক ও পুত্রকে ফিরিয়ে দেন। এরপর নারায়ণীর সঙ্গে বনবিবির সখ্যতা স্থাপিত হয়।[6] সুন্দরবনের অধিবাসীরা এখানকার জনবসতি অঞ্চলকে বনবিবির রাজ্য হিসেবে স্বীকার করলেও দক্ষিণরায়কে তাঁরা গভীর জঙ্গলের শাসক মনে করেন।
বারিজহতি গ্রামে ধনাই ও মানাই নামে দুই ‘মৌলি’ (মধু-সংগ্রহকারী) বাস করত। তারা ছিল দুই ভাই। আঠারো ভাটির দেশের একটি ‘মহলে’ (ঘন জঙ্গল) মধ্য সংগ্রহের জন্য ধনাই সাতটি নৌকা নিয়ে এক অভিযানের ইচ্ছা প্রকাশ করে। কিন্তু মানাই তাকে বাধা দেয়। অবশেষে গরিব মেষপালকের ছেলে দুখেকে সঙ্গে নিয়ে ধনাই অভিযান করে। নৌকা ছাড়ার আগে দুখের মা দুখেকে বিপদে পড়লে বনবিবিকে স্মরণ করতে বলেছিলেন। ডাকাত রায়ের রাজত্বের অংশ কেন্দুখালির চরে পৌঁছে তারা দক্ষিণরায়কে উপঢৌকন দিতে ভুলে গিয়েছিল। তাই তিন দিন তারা মধু সংগ্রহে অসমর্থ হয়। তৃতীয় রাতে দক্ষিণরায় স্বপ্নে দেখা দিয়ে তাদের নরবলির নির্দেশ দেয়। দক্ষিণরায়ের সঙ্গে কিছু কথা-কাটাকাটির পর লোভী ধনাই মধু ও মোমের বিনিময়ে দুখেকে উৎসর্গ করতে রাজি হয়। তারপর প্রচুর পরিমাণে মোম ও মধু সংগ্রহ করে সে দুখেকে ফেলে রেখে গ্রামে ফিরে আসে। এদিকে বাঘের ছদ্মবেশে দক্ষিণরায় দুখেকে হত্যা করতে গেলে সে দেবীকে স্মরণ করে। দুখের প্রার্থনা শুনে বনবিবি ও তাঁর ভাই জঙ্গলী এসে উপস্থিত হন। দক্ষিণরায়কে পরাজিত করেন জঙ্গলী। পরাজিত দক্ষিণরায় খান গাজীর (গাজী পীর) আশ্রয় নেন। বনবিবি ও শাহ জঙ্গলী দক্ষিণরায়কে ধাওয়া করে খান গাজীর কাছে উপস্থিত হন। অবশেষে গাজী দক্ষিণরায়ের ক্ষতি না করার জন্য বনবিবিকে রাজি করান। পরিবর্তে গাজী দুখেকে সাতটি মূল্যবান কার্টুলি দিয়েছিলেন এবং দক্ষিণরায় তাকে দিয়েছিলেন প্রচুর মো ও মধু। বনবিবির আদেশে তাঁর পোশাক মুরগিরা দুখেকে তার গ্রামে রেখে আসে। গ্রামে ফিরে দুখে বনবিবির পূজাকে জনপ্রিয় করে তোলে। পরবর্তীকালে সে ধনাইয়ের মেয়ে চম্পাকে বিয়ে করে এবং গ্রামের ‘চৌধুরী’ (প্রধান) হয়।[6]
বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলার সুন্দরবন অঞ্চলে বনবিবিকে নিয়ে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে:[7]
এক সওদাগরের দুই সুন্দরী স্ত্রী ছিলেন। ছোটো বউয়ের চক্রান্তে সন্তানসম্ভবা বড়ো বউ গুলালবিবি সুন্দরবনে নির্বাসিতা হন। কয়েকদিন পর সেখানেই যমজ পুত্র-কন্যার জন্ম দিয়ে তার মৃত্যু হয়। সদ্যোজাত শিশু দু'টির কান্না শুনে বনের বাঘ, কুমির, হরিণ, অজগর, বানস সবাই ছুটে আসে। তারাই দুই ভাইবোনকে লালনপালন করে বড়ো করে তোলে। ছেলেটি বড়ো হয়ে বাঘের রাজা এবং মেয়েটি বনবিবি নামে পরিচিত হয়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই বনবিবি হলেন মানুষের রক্ষাকর্ত্রী। তারা মনে করেন, বনের বাওয়ালি-মৌলেরা বাঘের মুখে পড়লে বনবিবির নাম স্মরণ করে মন্ত্র পড়ে আর সঙ্গে সঙ্গে বাঘও দৌড়ে পালিয়ে যায়। অদ্যাবধি স্থানীয় মানুষ বনে কাজে যাওয়ার আগে বনবিবির পূজা করে।
বনবিবি হিন্দুসমাজে বনদুর্গা, বনচণ্ডী বা বনদেবী নামেও পূজিতা হন। তিনি মাতৃদেবতা, ভক্তবৎসলা ও দয়ালু। তাঁর মূর্তিও সুশ্রী ও লাবণ্যময়ী। হিন্দুদের পূজিতা মূর্তিতে তাঁর গায়ের রং হলুদ, মুকুট, কণ্ঠহার ও বনফুলের মালা পরিহিতা এবং লাঠি অথবা ত্রিশূলধারিণী। মুসলমান সমাজে বনবিবি পিরানি হিসেবে পরিচিত। ইসলামি-প্রভাবান্বিত মূর্তিগুলিতে তিনি টিকলির সঙ্গে টুপি পরিধান করেন, চুল বিনুনি করা, ঘাগরা-পাজামা বা শাড়ি এবং জুতো পরিহিতা। তবে উভয় মূর্তিকল্পেই তাঁর কোলে পুত্র রূপে দুখেকে দেখা যায়। বনবিবির বাহন বাঘ বা মুরগি।[5]
শিলিগুড়ি শহর লাগোয়া ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি বিধানসভার অন্তর্গত বৈকন্ঠপুর জঙ্গলে প্রায় দুই থেকে আড়াই কিলোমিটার ভেতরে গেলে দেখা মিলবে বনদুর্গা মন্দিরের। অথবা জলপাইগুড়ির বেলাকোবা থেকে 21 কিমি দূরে গাজোলডোবা সংলগ্ন জঙ্গলের এলাকা পথ দিয়ে যাওয়া যায় এখানে।এই পুজোয় লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়। এই বনদূর্গা পূজো দেখতে জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, কোচবিহার এমনকি পার্শ্ববর্তী রাজ্য আসাম এবং বাংলাদেশ থেকেও প্রচুর মানুষ এসে থাকেন এই পুজো দেখতে।
দিল্লি ভিটা, চাঁদের খাল জায়গাটি সকলের কাছে অপরিচিত হলেও বন দুর্গার মন্দির হিসেবে সকলের কাছে পরিচিত। পৌষ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে, এই মন্দিরে বনদুর্গা পূজা হয়ে থাকে। কথিত রয়েছে দেবী চৌধুরানী নৌকা করে করতোয়া নদী হয়ে এখানে আসতেন। ভবানী পাঠক এবং দেবী চৌধুরানীর গোপন আস্তানা ছিল এই জায়গা। তখন অবশ্য ঠুনঠুনি মা বলে এখানে দেবী পুজিত হতো। এখন এটি বনদুর্গা বলেই সকলের কাছে পরিচিত। বৈকুন্ঠপুর এর জঙ্গলের মাঝে এর অবস্থান।
জানা গিয়েছে, ব্রিটিশ আমলে এই পুজোর সূচনা করেছিলেন দেবী চৌধুরানী ও ভবানী পাঠক। সেই থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর বৈকুন্ঠপুরের গভীর জঙ্গলে এই পুজো হয়েছে আসছে।প্রথমে এই পুজোকে ঠুনঠুনির পুজো বলা হতো।পরবর্তীতে ৪১ বছর ধরে একটি নতুন কমিটি গঠন করে মা বনদূর্গা পূজোর নাম করে পুজোর আয়োজন করে আসছেন উদ্যোগতারা। তবে বর্তমানে একে বনদুর্গা মায়ের পুজো বলে এখানে প্রতি বছর পৌষমাসে এর পুজো করা হয়। রাজগঞ্জে বৈকন্ঠপুর জঙ্গলে দিল্লী ভিটা চাঁদের খালে অনুষ্ঠিত হয় বনদুর্গা পুজো।
বনবিবি অরণ্যের দেবী রূপে কল্পিত এবং অরণ্যচারী মানুষের দ্বারা পূজিত। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, তিনি কখনও মুরগি বা কখনও বাঘের রূপ ধারণ করেন। ভক্তবৎসলা এই দেবীর কারও প্রতি আক্রোশ নেই বলেই কথিত। সুন্দরবনের মৎস্যজীবী, ‘বাউয়ালি’ (কাঠুরিয়া) ও ‘মৌলে’রা (মধু-সংগ্রহকারী) তাঁকে রক্ষয়িত্রী জ্ঞানে পূজা করেন। তাঁদের ধারণা, বনের বাঘ ও ভূত-প্রেত প্রভৃতি অপশক্তির উপর কর্তৃত্ব করেন বনবিবি। তাই গভীর বনে কাঠ, গোলপাতা, মধু ও মোম সংগ্রহ করতে বা মাছ ধরতে যাওয়ার আগে তাঁরা বনবিবির উদ্দেশ্যে সিন্নি, ক্ষীর ও অন্নভোগ নিবেদন করেন। প্রতি বছর মাঘ-ফাল্গুন মাস নাগাদ বনবিবির বাৎসরিক পূজা হয়। এই পূজায় ব্রাহ্মণেরা পৌরোহিত্য করেন না, করেন নিম্নবর্ণীয় হিন্দুরা। বনবিবির পূজায় নিরামিষ নৈবেদ্য নিবেদনের রীতি আছে, বলি হয় না; কখনও বা তাঁর নামে জীবন্ত মুরগি ছেড়ে দেওয়া হয়।[5]
ড. দেবব্রত নস্করের মতে, বৃহত্তর চব্বিশ পরগনার পার্শ্ববর্তী মেদিনীপুর অঞ্চল এবং সেই সঙ্গে বাঁকুড়া ও হুগলি প্রভৃতি জেলার আদিবাসী ও উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা পৌষ সংক্রান্তি বা ১ মাঘ যে বড়াম বা বড়ামচণ্ডীর পূজা করেন, তার সঙ্গে চব্বিশ পরগনার বনবিবি-পূজার সাদৃশ্য পাওয়া যায়। হাতি ও বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষালাভের উদ্দেশ্যে বড়ামচণ্ডীর পূজা প্রচলিত এবং এই পূজাতেও ঘুড়ি ওড়ানোর চল রয়েছে। বনবিবির পূজা করা হয় বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে এবং এই পূজাতেও ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা রয়েছে। বড়ামচণ্ডীর সঙ্গে চব্বিশ পরগনার অপর দেবী নারায়ণীর সাদৃশ্যও লক্ষিত হয়। বড়ামচণ্ডী ও নারায়ণী উভয়েরই লতাপাতা আঁকা মুণ্ডমূর্তির পূজা প্রচলিত। উভয় পূজাতেই পশুপাখি বলি ও নাচগানের আয়োজন করা হয় এবং উভয় পূজায় আয়োজিত হয় পৌষ সংক্রান্তি বা ১ মাঘ। এছাড়া পশ্চিম রাঢ় অঞ্চলে রঙ্কিনী দেবীর পূজার সঙ্গেও বনবিবি, নারায়ণী ও বড়ামচণ্ডীর পূজার সাদৃশ্য রয়েছে।[8]
পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার বারুইপুর থানার অন্তর্গত বেগমপুর মৌজার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মেলা হল চাঁপাতলার বনবিবি মেলা। পিয়ালি নদীর তীরে প্রফুল্ল সরোবরের কাছে একটি অশ্বত্থ গাছের গোড়ায় বনবিবির থানটি অবস্থিত। স্থানীয় অধিবাসীদের বিশ্বাস, চাঁপাতলার বনবিবির থানটি ২০০-২৫০ বছরের প্রাচীন। বারুইপুরের চৌধুরী পরিবারকে এই থানের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করা হলেও উক্ত পরিবারের দেবোত্তর সম্পত্তি দানের নথিপত্রে এই থানের উল্লেখ পাওয়া যায় না। পূর্বে এখানে থান বলতে দু’টি অনাচ্ছাদিত মাটির ঢিপি ছিল। বর্তমানে এটি ১০/৬ ফুট, ইটের দেওয়াল ও টালির ছাউনি-যুক্ত একটি পূর্বদ্বারী ঘর। ১৯৯০-এর দশকে জনৈক মুসলমান ভক্ত এই ঘরটি নির্মাণের জন্য সমস্ত ইট দান করেন এবং গ্রামবাসীরা চাঁদা তুলে টালির চালটি তৈরি করেন। ১ মাঘ বাৎসরিক পূজার দিন একটি অস্থায়ী খড়ের চাল তৈরি করে বেদীর কাছে বনবিবি-শাজঙ্গুলীর মূর্তি স্থাপন করে পূজা করা হয়। বর্তমানে নতুন মূর্তি গড়ে পূজা প্রচলিত হয়েছে। তবে পূজার দিন শতাধিক ‘দেবী ছলন’ (মানতকারীদের দান করা মূর্তি) আসে। সেগুলিকে মন্দিরের মধ্যে প্রায় ঠাসাঠাসি করে রাখা হয়। পূজার পর উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে সেগুলি ঘরের মধ্যেই নষ্ট হয়ে যায়। পার্শ্ববর্তী মাছ চাষের লভ্যাংশের একাংশ দেবীর বাৎসরিক পূজায় ব্যয় করা হয়।[9]
বনবিবির ‘ছলন’গুলিতে দেবীর রূপের ভিন্নতা লক্ষ্যতা করা যায়। মূর্তিগুলি মাটির এবং মূর্তির অলংকারগুলিও কৃত্রিম। কোনও মূর্তিতে দেবী দ্বিভূজা ও ব্যাঘ্রবাহিনী, কোনও মূর্তিতে সিংহবাহিনী। ব্যাঘ্রবাহিনী বনবিবির কোলে শিশু এবং একই কাঠামোয় মুগুর বা গদা হাতে মুসলমানী পোষাকে দাড়িওয়ালা এক পুরুষের মূর্তিও দেখা যায়। বনবিবির পালায় এই শিশুটিকে দুখে ও পুরুষটিকে দেবীর ভাই শাহ জঙ্গুলী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। সিংহবাহিনী দেবীমূর্তিটিকে সাধারণত বনবিবির সখী নারায়ণী মনে করা হয়। কোনও মূর্তিতে বনবিবিকে বাহনহীন মুসলমান কিশোরীর বেশে কল্পনা করা হয়; তাঁর পরনে ঘাগরা, পায়ে জুতো, কানে কুণ্ডল, গলায় হার, মাথায় মুকুট ইত্যাদি অলংকার থাকে। আবার কোনও কোনও মূর্তিতে তাঁকে পদ্মের উপর দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। ড. দেবব্রত নস্করের মতে, স্থানীয় শিল্পীরা নিজস্ব খেয়ালখুশি মতো এই মূর্তিগুলি গড়েন বলেই এগুলির মধ্যে এহেন ভিন্নতা দেখা যায়। তবে ১ মাঘের বাৎসরিক পূজার দিন এই সকল মূর্তিই বনবিবির মূর্তি হিসেবে পূজিত হয়।[9]
চাঁপাতলার বনবিবির পূজা-হাজত করেন পুঁড়ির শুবেদালী মোল্লা। স্থানীয় হিন্দুরা এই পূজার আয়োজন ও ব্যবস্থাপনা করেন। দেবীর পূজায় মন্ত্রতন্ত্রের কোনও বিধি নেই, নামাজের কলমা পড়ে ভক্তদের জন্য ‘দোয়াদরিত মাঙা’ হয়। ভক্তেরা ধূপ জ্বেলে এবং ফলমূল, বাতাসা, সন্দেশ ও দক্ষিণা দিয়ে পূজা করেন। গণ্ডি দেওয়া ও চন্দন মৃত্তিকা গ্রহণ পূজার একটি বিশেষ অঙ্গ। স্থানীয়দের বিশ্বাস, দেবী জাগ্রত এবং ভক্তের সকল প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই এখানে পূজা-হাজত দেন ও ‘দোয়াদরিত’ প্রার্থনা করেন। এছাড়া ভক্তেরা রোগমুক্তির জন্য দেবীর থানে ঢিল বেঁধে মানত করেন। পরে রোগমুক্তি ঘটলে থানে গণ্ডি দেওয়া, বাতাসা লুট, বুক চিরে রক্ত দেওয়া ইত্যাদি আচার পালন করা হয়। অধিক ফলনের জন্য মানত করলে খেতের প্রথম ফসল ধানের আঁটি বা বিচালি, মুলো, বেগুন ইত্যাদি থানে দেওয়া হয়। আবার হাঁস-মুরগির ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর জন্য মানত করে কৃতকার্য হলে পূজাস্থানে হাঁস-মুরগির বাচ্চা ছেড়ে দেওয়ারও রীতি আছে। এছাড়া জমি বা কৃষি যন্ত্রপাতি কিনে তা থেকে ভালো পরিষেবা পাওয়ার আশায় মানত করলে মানতপূর্তিতে ছলন ও বাজনা-সহ বনবিবির পূজা দেওয়া হয়।[9]
চাঁপাতলার বনবিবির মেলার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ঘুড়ি ওড়ানো ও ঘুড়ি লোটার প্রথা। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলায় সরস্বতী পূজার দিন এবং পার্শ্ববর্তী কলকাতা ও শহরতলি অঞ্চলে বিশ্বকর্মা পূজায় ঘুড়ি ওড়ানোর প্রথা থাকলেও, চাঁপাতলায় স্থানীয় কিশোর ও যুবকেরা বনবিবির মেলা উপলক্ষ্যে ১ মাঘ দিনের বেলা এই আচার পালন করেন। ঘুড়ি ওড়ানো দেখতে এখানে প্রচুর দর্শনার্থীরও সমাগম হয়। রাতে গান, নাটক, যাত্রা ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। মেলায় মনিহারি, লোহার কৃষি যন্ত্রপাতি, গৃহস্থালির জিনিসপত্র থেকে শুরু করে রেডিমেড পোষাক, মিষ্টি, ফুচকা, তেলেভাজা খাবার ইত্যাদির দোকান বসে। সারা রাত ‘ফড়’-এর (জুয়া) আসর চলে।[9]
বারুইপুর শহরের নিকটবর্তী ধোপাগাছিতেও ১ মাঘ বনবিবির বাৎসরিক পূজা ও মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলাটি ‘বিবি মার মেলা’ নামে পরিচিত। এখানে বিবি মার পূজা উপলক্ষ্যে পরিবার, পাড়া বা গ্রামভিত্তিক বনভোজন আয়োজিত হয়। বনভোজনে সাদা বেগুন ও আলুসিদ্ধ ভাত খাওয়া হয়। হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ এই উৎসবে যোগ দেন। পূজা উপলক্ষ্যে দুশোরও বেশি বনবিবির ‘ছলন’ আসে। আশেপাশের গ্রামের মানুষজন এখানে দেবীর থানে পূজা-হাজত দেন এবং পূজা উপলক্ষ্যে মেলার আয়োজন করা হয়।[10]
দুই বাংলার সুন্দরবনের ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় অধিবাসীরা বনবিবির মন্দির স্থাপনা করেছেন। সজনেখালি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, দো বাঁকি অভয়ারণ্য ও দয়াপুর গ্রামে বনবিবির মন্দির চোখে পড়ে।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.