অরণ্য বা বন বা জঙ্গল হলো ঘন বিভিন্ন প্রকার উদ্ভিদের দ্বারা ঘেরা একটি এলাকা। [1] বিভিন্ন মাপকাঠির ভিত্তিতে, বনের নানান ধরনের সংজ্ঞা আছে।[2][3][4] ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত[5][6] জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, ২০০৬ সালে অরণ্য চার বিলিয়ন হেক্টর (১৫ মিলিয়ন বর্গ মাইল) বা বিশ্বের জমির প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা জুড়ে রয়েছে।[4] এই বনাঞ্চল অনেক প্রাণীর লালনক্ষেত্র হিসেবেও যেমন কাজ করে তেমনি বিভিন্ন নদী-নালার পথ পরিবর্তন, মাটি সংরক্ষণের মতো কাজ করে। পৃথিবীর জীবমণ্ডলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ অরণ্য।[7] যদিও প্রাথমিকভাবে একটি বনের বৈশিষ্ট্য নির্দিষ্ট করা হয় তার গাছের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। এ হলো অক্সিজেনের এক বিপুল সরবরাহকারী। অ্যান্টার্কটিকা ছাড়া অন্য সব মহাদেশেই অরণ্য বর্তমান। গরমকালে দশ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা ও বার্ষিক পঁচাত্তর সেন্টিমিটার বৃষ্টিপূর্ণ স্থান অরণ্য গড়ে ওঠার পক্ষে উপযোগী।

Thumb
A conifer forest in the Swiss Alps (National Park)
Thumb
The Adirondack Mountains of Upstate New York form the southernmost part of the Eastern forest-boreal transition ecoregion.

অরণ্য বা বন সংরক্ষণ

যে পদ্ধতিতে দেশের বনজ সম্পদের সুরক্ষা করা হয় এবং নিয়ন্ত্রিতভাবে ঐ সম্পদ ব্যবহার করা হয় তাকে অরণ্য বা বন সংরক্ষণ বলে।

বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা

বর্তমানে বন সংরক্ষণ অত্যন্ত জরুরী। বন সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে নিচে বর্ণনা করা হল;

(১) বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় ভারসাম্য স্থিতিশীল রাখা: উদ্ভিদ ও প্রাণীরা ক্রমাগত শ্বসনের জন্য বাতাস থেকে অক্সিজেন শোষণ করলেও তা ফুরিয়ে যায় না এই কারণে যে, গাছপালা সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে সেই কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করে আবার অক্সিজেন উৎপাদন করে। এখন বড়ো বড়ো গাছপালা সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাস অপসারিত করে এবং অক্সিজেন গ্যাস উৎপাদন করে। সুতরাং, বনের গাছপালা ধ্বংস করলে গ্যাসীয় ভারসাম্য বক্ষার কাজে বিঘ্ন ঘটে।

(২) ভূমিক্ষয় নিবারণ: বড়ো বড়ো গাছপালার শিকড় মাটির নীচে বহুদূর পর্যন্ত জালের আকারে ছড়িয়ে যায় যা মাটিকে শক্তভাবে ধরে রাখে। এছাড়া এরকম গাছপালার উপস্থিতিতে ঝোড়ো হাওয়া সজোরে মাটির উপর আছড়ে পড়তে পারে না। আর বৃষ্টির জল মাটি ধুয়ে নিয়ে যেতে পারে না। এসব কারণে বড় বড় গাছপালার সাহায্যে ভূমিক্ষয় নিবারণ সম্ভব হয়। কোনো অঞ্চলের গাছপালা কাটা হতে থাকলে ক্রমাগত ভূমিক্ষয়ের ফলে সেই অঞ্চল ক্রমে রুক্ষ মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।

(৩) আবহাওয়া শীতল রাখা ও বৃষ্টিপাত ঘটানো: পৃথিবীর বুকে যে সব গাছপালা রয়েছে সেগুলি প্রতিদিন বাষ্পমোচন বা প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় (Transpiration) বিপুল পরিমাণ জল বাষ্পাকারে বাতাসে বের করে দেয়। পাতার পত্ররন্ধ্রের (stoma) পথ দিয়ে এই জলীয় বাষ্প বেরিয়ে আসে। একটিমাত্র ভুট্টা গাছ থেকে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লিটার জল বাষ্পাকারে বাতাসে মেশে। এর থেকেই বোঝা যায় আকাশে মেঘ সৃষ্টির কাজে গাছের ভূমিকা কিরকম গুরুত্বপূর্ণ।

এইভাবে বাষ্পমোচন করতে গিয়ে গাছপালা আশপাশের পরিবেশকে ঠাণ্ডা রাখে। আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘ এই শীতল আবহাওয়ার সংস্পর্শে এলেও ঠান্ডা হয়ে বৃষ্টিপাত ঘটায়। এই কারণে বনাঞ্চলে বেশী বৃষ্টিপাত হয়। আমাদের মতো কৃষিপ্রধান দেশে বৃষ্টির জল কৃষিকার্যের জন্যে যে কত দরকার তা আমরা সবাই জানি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাষবাসের জন্যে এখনও এই প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাতের উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। কৃষিক্ষেত্রে যত বৃষ্টিপাত হয় তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ জলই গাছপালার বাষ্পমোচনের ফলে বাতাসে জমা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। কাজেই এলোপাথাড়ি গাছপালা কেটে ফেলতে থাকলে এই বাষ্পমোচন প্রক্রিয়াও যায় বন্ধ হয়ে, আর পরিণামে বৃষ্টিপাতের মাত্রা কমে যায় বা অনাবৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা দেয়। আমাদের দেশে বিগত কয়েক বছর যাবৎ যে খরা পরিস্থিতি দেখা দিচ্ছে বনাঞ্চল অপসারণকে অনেকে সেজন্য দায়ী করেছেন। এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন না করলে শস্যশ্যামল কৃষিভূমি যদি কোনদিন রুক্ষ নীরস মরুতে পরিণত হয় তাহলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।

এইসব বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা করে বন সংরক্ষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এজন্য আইন প্রণয়ন করতে হয়েছে ও সরকার বন অধিগ্রহণ করে তার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। শুধু বন সংরক্ষণই নয়, ঐ সঙ্গে বৃক্ষরোপণেও উৎসাহ দেখানো হচ্ছে। গাছপালা যে কতভাবে মানুষের কল্যাণ সাধন করে চলেছে সে বিষয়ে সর্বসাধারণকে সচেতন করা আশু প্রয়োজন।

(৪) অর্থনৈতিক গুরুত্ব: দেশের অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেকটা নির্ভর করে বনজ সম্পদের উপর। জ্বালানী কাঠ, ভেষজ ঔষধ, খাদ্য, বস্ত্র, যানবাহনের কাঠামো ও আসবাবপত্রের উৎস। বনজ উদ্ভিদ গৃহনির্মাণে ও কাগজ তৈরিতেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

(৫) বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল: বনের মধ্যে বিভিন্ন বন্যপ্রাণী বসবাস করে। বনজ সম্পদ ঠিক মত সুরক্ষিত থাকলে বন্যপ্রাণীরা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা চালাতে পারে। বন ধ্বংস হলে বন্য প্রাণীরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয়।[8]

বন-সংরক্ষণের উপায়

বন-সংরক্ষণের জন্য বনাঞ্চলের গাছকাটা যথাসম্ভব কমাতে হবে। সেই সঙ্গে নতুনভাবে চারাগাছ লাগাতে হবে। দ্রুত বৃদ্ধি পায় এমন প্রজাতির নতুন গাছ লাগানো দরকার। বনে যাতে আগুন না লাগে সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কারণ, বনে আগুন লাগলে, দাবানলে বনজ সম্পদের দারুণ ক্ষতি হয়। বনাঞ্চলের উদ্ভিদের বিভিন্ন রোগ এবং পচনশীলতা দমন করা দরকার। উপযুক্ত সার প্রয়োগ করলে বনভূমির উর্বরা শক্তি বজায় থাকে। বনাঞ্চলের বৃষ্টির জল যাতে সহজে ঐ এলাকার মাটিতে প্রবেশ করে সেজন্য মাঝে মধ্যে খাল কাটা এবং আল দেওয়া প্রয়োজন। বনাঞ্চলে মানুষ এবং গবাদি পশুর অত্যাচার যথাসম্ভব কমাতে হবে। লুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য ব্যবস্থা যেমন নিতে হবে তেমনি আবার ক্ষতিকর কীটপতঙ্গের হাত থেকে বনাঞ্চলের উদ্ভিদকে রক্ষা করতে হবে।[9]

ধ্বংস হওয়ার কারণ

লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর প্রায় ষাট শতাংশই অরণ্যাবৃত ছিল। আমূল জলবায়ুর পরিবর্তন, হিমশৈলের চলন এবং মানুষের কার্যকলাপের জন্য বিপুল অরণ্যভূমি নষ্ট হয়েছে। বর্তমানে মানুষের নির্দয়ভাবে গাছ কাটার জন্য বনাঞ্চল ধ্বংসের পথে৷ এছাড়াও ঘর-বাড়ি এবং অবকাঠামো নির্মানে কাঠের দরকারে গাছ কাটে।

অরণ্য বাস্তুসংস্থান

Thumb
Temperate rainforest in Tasmania's Hellyer Gorge
Thumb
Biogradska forest in Montenegro
Thumb
Spiny forest at Ifaty, Madagascar, featuring various Adansonia (baobab) species, Alluaudia procera (Madagascar ocotillo) and other vegetation
Thumb
Even, dense old-growth stand of beech trees (Fagus sylvatica) prepared to be regenerated by their saplings in the understory, in the Brussels part of the Sonian Forest.

গাছ বেড়ে উঠতে পারে এমন সব এলাকায় বন পাওয়া যায়। গাছের বেড়ে ওঠা সম্ভব এমন উচ্চতা পর্যন্ত (ট্রি লাইন) গাছ জন্মায়। তবে এর ব্যতিক্রমও আছে কয়েকটি ক্ষেত্রে। যেমন যেখানে প্রাকৃতিক কোনো কারণে বার বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে বা অন্যান্য ঝঞ্ঝা খুব বেশি অথবা মানুষেরই কোনো কাজের ফলে পরিবেশে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, এমন এলাকায় বনাঞ্চল দেখা যায় না।

নিরক্ষীয় অঞ্চলের ১০° উত্তর এবং দক্ষিণ অক্ষাংশ এলাকার অধিকাংশ হচ্ছে ক্রান্তীয় বৃষ্টিঅরণ্য প্রভাবিত এলাকা। আবার ৫৩°উত্তর এবং ৬৭°উত্তর দ্রাঘিমাংশের মধ্যে রয়েছে উত্তরের বন।

বহু প্রাণী এবং বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বাসস্থান হলো বন। অন্যান্য উদ্ভিদজগতের তুলনায় এই এলাকার ইউনিট প্রতি জৈববস্তু বা বায়োমাস অনেক বেশি থাকে। মাটির নিচে শিকড় পদ্ধতিতে এবং গাছের আংশিকভাবে পচে যাওয়া বর্জ্য বস্তু থেকেই বেশিরভাগ সময়ে এই জৈববস্তু তৈরি হয়। বনের মধ্যে কাঠের যে যৌগ আছে তার মধ্যে লিগণিন থাকে। সেলুলোজ বা কার্বোহাইড্রেটের মতো জৈবপদার্থের তুলনায় এতে পচন ধরে অপেক্ষাকৃত ধীরে। বনের সঙ্গে বনভূমির পার্থক্য করা হয় তার গাছগাছালির চাঁদোয়া কতোটা দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে। বনে অনেক সময় বিভিন্ন গাছের শাখা এবং তার পত্রসমষ্টি মিশে যায় একে অপরের সঙ্গে। যদিও বন হিসেবে যেটা উল্লেখ করা হচ্ছে তার এলাকার মাপে ফারাক থাকতে পারে। বনভূমিতে আবার বড় বড় গাছ থাকা এলাকায় একটানা অনেকটা খোলা চাঁদোয়া পাওয়া যায়, একেকটি গাছের মধ্যে জায়গাও অনেক ছড়িয়ে থাকে। যার ফলে তার মধ্যে দিয়ে মাটিতে অনেক বেশি সূর্যের আলো এসে পৌঁছতে পারে।

শ্রেণীভুক্তিকরণ

বিভিন্নভাবে এবং বিশেষত্বের বিভিন্ন মাপকাঠিতে বনগুলিকে শ্রেণীভুক্ত করা হয়। তারই একটার পরিভাষা হলো ‘বায়মে, প্রজাতির অধিকাংশের পাতার দীর্ঘজীবনের সঙ্গে কীভাবে গাছপালা টিকে থাকে তাকেই প্রকাশ করা হয় এই পরিভাষা দিয়ে (এই প্রজাতিগুলি চিরহরিৎ পর্ণমোচী তা বোঝা যায়)। আরেকটা স্বাতন্ত্রও আছে, যেখানে বনগুলি বড় পাতার গাছ, সরলবর্গীয় (সূঁচালো পাতা) গাছ অথবা মিশ্র ধরনের গাছ দিয়ে সাজানো।

  • উপমেরু অঞ্চলে উত্তরের অরণ্য রয়েছে। এগুলি সাধারণত চিরহরিৎ ও সরলবর্গীয় ধরনের হয়।
  • শীতপ্রধান এলাকায় বড় পাতার পর্ণমোচী গাছের বন (যথা, শীতপ্রধান পর্ণমোচী বন) এবং চিরহরিৎ সরলবর্গীয় বন (যথা, শীতপ্রধান সরলবর্গীয় বন ও শীতপ্রধান বৃষ্টি অরণ্য) উভয় ধরনের বনই হতে পারে। গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় আবার জলপাই জাতীয় বৃক্ষের চিরসবুজ পাতাওয়ালা গাছের বনসহ বড় পাতার চিরহরিৎ অরণ্য টিকে থাকতে পারে।
  • ক্রান্তীয় এবং প্রায় ক্রান্তীয় বনের অন্তর্ভুক্ত হলো ক্রান্তীয় এবং প্রায় ক্রান্তীয় আর্দ্র বন, ক্রান্তীয় এবং প্রায় ক্রান্তীয় শুষ্ক বন এবং ক্রান্তীয় এবং প্রায় ক্রান্তীয় সরলবর্গীয় বন।
  • কোনো জঙ্গলের সাধারণ বৈশিষ্ট্য তাদের সামগ্রিক প্রাকৃতিক কাঠামো অথবা উন্নয়নের বিভিন্ন পর্যায়ের অবস্থার ভিত্তিতে শ্রেণী বিন্যস্ত হয়। (যথা ওল্ড গ্রোথ বনাম সেকেন্ড গ্রোথ)
  • জলবায়ু ও কোন প্রজাতির গাছ বেশি রয়েছে, তার ভিত্তিতেও বনগুলিকে আরো নির্দিষ্টভাবে শ্রেণী বিন্যস্ত করা যায়, ফলস্বরূপ বহু ধরনের বনের ধরন পাওয়া যায় (যথা, পোন্দেরোসা পাইন/ডগলাস ফার বন)

গোটা বিশ্বে বহু সংখ্যক বন প্রকারভেদ ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে, কিন্তু কোনোটাই সর্বজনীন স্বীকৃত নয়।[10] অন্যান্য জটিল ব্যবস্থার থেকে UNEP-WCMC-এর বন প্রকারভেদ ব্যবস্থা একটা সরলীকৃত ব্যবস্থা (যথা,UNESCO -র জঙ্গল ও বনভূমি উপবিভাগ)। বিশ্বজুড়ে এই ব্যবস্থাটি বনগুলিকে ২৬টি মূল শ্রেণীতে ভাগ করেছে, যাতে জলবায়ু এলাকার পাশাপাশি প্রধান গাছপালার চরিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

আরোও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.