বংশগতি, হেরিডিটি বা উত্তরাধিকার বা জৈবিক উত্তরাধিকার হলো অযৌন অথবা যৌন প্রজননের মাধ্যমে বাবা মা হতে সন্তান-সন্ততিতে জিনগত বৈশিষ্ট্য স্থানান্তরিত হওয়ার প্রক্রিয়া। বংশগতির মাধ্যমে, ব্যক্তির মাঝে বৈচিত্র্য সঞ্চারিত হতে পারে এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন দ্বারা প্রজাতির বিবর্তন ঘটতে পারে। জীববিজ্ঞানে বংশগতির অধ্যয়নকে বংশাণুবিজ্ঞান বলা হয়। গ্রেগর জোহান মেন্ডেল কে বংশগতির জনক বলা হয়ে থাকে।[1]

সংক্ষিপ্ত বিবরণ

Thumb
ডিএনএ গঠন। কেন্দ্রে বেস কে একটি ডাবল হেলিক্সে ফসফেট-সুগার চেইন দ্বারা বেষ্টিত।

মানুষের মধ্যে, চোখের রঙ উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যের একটি উদাহরণ, একজন ব্যক্তি পিতামাতার একজনের কাছ থেকে "বাদামী-চোখের বৈশিষ্ট্য" উত্তরাধিকার সূত্রে পেতে পারে।[2] উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যগুলি জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং জীবের জিনোমের মধ্যে জিনের সম্পূর্ণ সেটকে এর জিনোটাইপ বলা হয়।[3]

একটি জীবের গঠন এবং আচরণের পর্যবেক্ষণযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলির সম্পূর্ণ সেটকে তার ফেনোটাইপ বলা হয়। এই বৈশিষ্ট্যগুলি পরিবেশের সাথে তার জেনোটাইপের মিথস্ক্রিয়া থেকে উদ্ভূত হয়।[4] ফলস্বরূপ, একটি জীবের ফেনোটাইপের অনেক দিক উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত হয় না। উদাহরণস্বরূপ, সূর্যালোকযুক্ত ত্বক কোনও ব্যক্তির জেনোটাইপ এবং সূর্যালোকের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া থেকে আসে;[5] সুতরাং, সানট্যানগুলি মানুষের বাচ্চাদের কাছে প্রেরণ করা হয় না। যাইহোক, কিছু লোক তাদের জেনোটাইপের পার্থক্যের কারণে অন্যদের তুলনায় আরও সহজে ট্যান করে:[6] একটি আকর্ষণীয় উদাহরণ হল অ্যালবিনিজমের উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত বৈশিষ্ট্যযুক্ত লোকেরা, যারা একেবারেই ট্যান করে না এবং সানবার্নের প্রতি খুব সংবেদনশীল।[7]

উত্তরাধিকারী বৈশিষ্ট্যগুলি ডিএনএর মাধ্যমে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রেরণ করা হয় বলে জানা যায়।[3] ডিএনএ হল একটি দীর্ঘ পলিমার যা চার ধরনের বেসকে অন্তর্ভুক্ত করে, যা বিনিময়যোগ্য। নিউক্লিক অ্যাসিড ক্রম জেনেটিক তথ্য নির্দিষ্ট করে, এটি পাঠ্যের একটি অনুচ্ছেদ বানান করে অক্ষরের একটি ক্রমের সাথে তুলনীয়।[8] একটি কোষ মাইটোসিসের মাধ্যমে বিভক্ত হওয়ার আগে, ডিএনএ অনুলিপি করা হয়, যাতে ফলস্বরূপ দুটি কোষের প্রতিটি ডিএনএ সিকোয়েন্সের উত্তরাধিকারী হবে। একটি ডিএনএ অণুর একটি অংশ যা একটি একক কার্যকরী ইউনিট নির্দিষ্ট করে তাকে জিন বলা হয়; বিভিন্ন জিনের বিভিন্ন ভিত্তির বিভিন্ন ক্রম রয়েছে। কোষের মধ্যে, ডিএনএর দীর্ঘ স্ট্র্যান্ডগুলি ক্রোমোজোম নামে ঘনীভূত কাঠামো গঠন করে। জীবগুলি সমজাতীয় ক্রোমোজোমের আকারে তাদের পিতামাতার কাছ থেকে জেনেটিক উপাদান উত্তরাধিকারসূত্রে পায়, যার মধ্যে ডিএনএ সিকোয়েন্সগুলির একটি অনন্য সংমিশ্রণ রয়েছে যা জিনগুলির জন্য কোড করে। একটি ক্রোমোজোমের মধ্যে একটি ডিএনএ ক্রমের নির্দিষ্ট অবস্থানটি একটি লোকাস হিসাবে পরিচিত। যদি কোনও নির্দিষ্ট লোকাসের ডিএনএ সিকোয়েন্স ব্যক্তিদের মধ্যে পরিবর্তিত হয়, তবে এই ক্রমের বিভিন্ন রূপকে অ্যালিল বলা হয়। ডিএনএ সিকোয়েন্সগুলি মিউটেশনের মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে, নতুন অ্যালিল তৈরি করতে পারে। যদি কোনও জিনের মধ্যে একটি মিউটেশন ঘটে, তবে নতুন অ্যালিল জিনটি যে বৈশিষ্ট্যটি নিয়ন্ত্রণ করে তা প্রভাবিত করতে পারে, যা জীবের ফেনোটাইপকে পরিবর্তন করে।[9]

যাইহোক, যখন একটি অ্যালিল এবং একটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে এই সহজ চিঠিপত্রটি কিছু ক্ষেত্রে কাজ করে, বেশিরভাগ বৈশিষ্ট্যগুলি আরও জটিল এবং জীবের মধ্যে এবং তাদের মধ্যে একাধিক ইন্টারঅ্যাক্টিং জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উন্নয়নমূলক জীববিজ্ঞানীরা পরামর্শ দেন যে জেনেটিক নেটওয়ার্ক এবং কোষগুলির মধ্যে যোগাযোগের জটিল মিথস্ক্রিয়াগুলি বংশগত বৈচিত্র্যের দিকে পরিচালিত করতে পারে যা উন্নয়নমূলক প্লাস্টিসিটি এবং ক্যানালাইজেশনের কিছু মেকানিক্সের অধীনে থাকতে পারে।

সাম্প্রতিক অনুসন্ধানগুলি বংশগত পরিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণগুলি নিশ্চিত করেছে যা ডিএনএ অণুর সরাসরি সংস্থা দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। এই ঘটনাগুলিকে এপিজেনেটিক উত্তরাধিকার সিস্টেম হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় যা জিনগুলির উপর কার্যকরী বা স্বাধীনভাবে বিকশিত হয়। এপিজেনেটিক উত্তরাধিকারের মোড এবং পদ্ধতির মধ্যে গবেষণা এখনও তার বৈজ্ঞানিক শৈশবে আছে, কিন্তু গবেষণার এই ক্ষেত্রটি অনেক সাম্প্রতিক কার্যকলাপকে আকৃষ্ট করেছে কারণ এটি সাধারণভাবে বংশগতি এবং বিবর্তনীয় জীববিজ্ঞানের সুযোগকে প্রশস্ত করে।

বংশগতির উপাদান


বংশগতির এই ধারা নিয়ন্ত্রিত হয় জীন দ্বারা। কোন প্রজাতির জিনোমে (জিনোম হল যেখানে বংশগতির উপাদান থাকে, যেমন ক্রোমোসোম/ ডি.এন.এ) বিভিন্ন বৈশিস্টের জীন থাকে।মাতাপিতার বৈশিস্ট্যাবলি তাদের সন্তানসন্ততিতে এসব উপাদানের মাধ্যমে সঞ্চারিত হয় বলে এসব কে বলে বংশগতিবস্তু।

ক্রোমোজোম

Thumb
বংশগতিবস্তু ( ক্রোমোসোম)

বংশগতির প্রধান উপাদান হল ক্রোমোজোম। বিজ্ঞানী স্ট্রাসবুরগার ১৮৭৫ সালে সর্বপ্রথম এটি আবিষ্কার করেন। এটি কোষের নিউক্লিয়াসের নিউক্লিওপ্লাজমে পাওয়া যায় এবং ক্রোমাটিন তন্তু দ্বারা গঠিত।প্রজাতির বৈশিস্ট্যভেদে ২-১৬০০ পর্যন্ত ক্রোমোজোম পাওয়া যায়। সাধারনত দৈর্ঘ্য ৩.৫ থেকে ৩০ মাইক্রন এবং প্রস্থ ০.২-২.০ মাইক্রন হয়ে থাকে (১ মাইক্রন=১/১০০০ মিমি)।ক্রোমোজোমের কাজ হল মাতা-পিতা থেকে জীন সন্তানসন্তুতিতে বহন করা।

ক্রমোজোম হল ডিএনএ এর প্যাকেজ আকার যেখানে ডি.এন.এ সুস্থিত অবস্থায় থাকে। মানুষের দেহে ৪৬ টি ক্রমোজোম পাওয়া যায় যার মধ্যে ৪৪ টি অটোসোম এবং বাকি ২ টি সেক্স ক্রোমোজোম।দুটি ক্রোমাটিন জালিকা মিলিত হয়ে দিসুত্রক ক্রমোজোম গঠন করে। ক্রোমোজোমের যে স্থানে দুটি ক্রোমাটিন জালিকা মিলিত হয় তাকে সেন্ট্রমিয়ার বলে। প্রায় প্রতি কোষে ক্রোমাটিন থাকে কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম যেমন, লোহিত রক্তকণিকায় ক্রোমাটিন থাকে না।

ডি.এন.এ (DNA)

Thumb
বংশগতিবস্তু ( ডি.এন.এ)

ডিএনএ (DNA) হল ডিওক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড (Deoxyribo Nucleic Acid).প্রায় সকল প্রাণী,উদ্ভিদ,প্রোক্যারিওটে ডি.এন.এ পাওয়া যায়। ইউক্যারিওটডিএনএ সাধারণত নিওক্লিয়াসে পাওয়া যায় ( কিছু ডি.এন.এ মাইটকন্ডিয়া এবং ক্লোরোপ্লাস্টে পাওয়া যায়)। এটি সাধারণত দ্বিসুত্রক পলিনিউক্লিওটাইড এর সর্পিলাকার গঠন।এর একটি সুত্র অন্যটির বিপরীত ও পরিপূরক।এর একটি সুত্রক ৩'-৫' এবং অন্যটি ৫'-৩' পর্যন্ত বিস্তৃত। এতে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট শর্করা,নাইট্রোজেন গ্যাস, ও অজৈব ফসফেট দ্বারা গঠিত। নাইট্রোজেন বেস ২ প্রকার, পিউরিন ও পাইরিমিডিন। এডিনিন(A) ও গুয়ানিন(G) বেস হল পিউরিন থায়মিন(T) ও সাইটোসিন(C) হল পাইরিমিডিন। একটি সুত্রের এডিনিন অন্য সুত্রের থাইমিন এর সাথে ২ টি হাইড্রোজেন বন্ড দ্বারা যুক্ত এবং একটি সুত্রের গুয়ানিন অন্য সুত্রের সাইটোসিনের সাথে ৩ টি হাইড্রোজেন বন্ড দ্বারা যুক্ত।১৯৫৩ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক সর্বপ্রথম ডি.এন.এ (DNA) এর দ্বি সুত্রক কাঠামো এর বর্ণনা দেন।হেলিক্সের প্রতিটি পূর্ণ ঘূর্ণন ৩.৪ nm (৩৪Å)

Thumb
ডি.এন.এ অনুলিপন
ডি.এন.এ অনুলিপন (DNA Replication)

এই প্রক্রিয়ায় একটি DNA অণু থেকে আর একটি নতুন DNA অণু তৈরি হয়। DNA অর্ধ-রক্ষণশীল পদ্ধতিতে অনুলিপিত হয়। মাতৃ DNA এর একটি সুত্রে সাথে নতুন একটি সুত্র যুক্ত হয়ে নতুন দ্বি-সুত্রক DNA তৈরি হয় বলে একে অর্ধ-রক্ষণশীল বলে। এই পদ্ধতিতে DNA সূত্র দুটির হাইড্রোজেন বন্ধন ভেঙ্গে গিয়ে আলাদা হয় এবং তাদের পরিপূরক সূত্র তৈরি হয়। ১৯৫৬ সালে ওয়াটসন ও ক্রিক এ ধরনের ডি.এন.এ অনুলিপন পদ্ধতি বর্ণনা করেন।

আর.এন.এ (RNA)

আরএনএ (RNA) হল রাইবোনিউক্লিক এসিড। সাধারণত RNA হল একসুত্রক, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ভাইরাস যেমনঃ TMV, Yellow Mosaic Virus, Influenza Virus হল দ্বিসুত্রক।এতে পাঁচ কার্বন বিশিষ্ট রাইবোজ শর্করা, অজৈব ফসফেট, ও নাইট্রোজেন বেস (এডিনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন ও ইউরাসিল) থাকে। RNA তে থায়ামিন থাকে না এর পরিবর্তে ইউরাসিল থাকে।

জিন

জীবের সকল বৈশিস্ট্য নিয়ন্ত্রণকারী এককের নাম জিন। জিনগুলো ক্রোমোজোম এর উপর অবস্থিত এবং সাধারণত ডি এন এ দিয়ে তৈরি। মানুষের জিনমে প্রোটিন তৈরি করে এমন জিনের সংখ্যা ১৯০০০। এছাড়া রয়েছে নন কোডিং জিন যা প্রোটিন তৈরি করে না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে যুক্ত। সাধারণত একটি বৈশিষ্টের সাথে এক বা ততোধিক জিন যুক্ত থাকতে পারে। মাল্টি সাব ইউনিট প্রোটিন কমপ্লেক্স এর সাথে একাধিক জিন যুক্ত থাকে। ১৯০৯ সালে ডব্লিউ. জোহান্সন সর্বপ্রথম 'জিন' শব্দটি ব্যবহার করেন। বিভিন্ন জীবে জিনের সংখ্যা বিভিন্ন। তবে একই প্রকৃতির জীবে তা সাধারণত একই থাকে। মাতাপিতা থেকে প্রথম জেনারেশনে (F1) যে বৈশিষ্ট প্রকাশ পায় তাকে প্রকট (Dominant) বৈশিষ্ট এবং এই বৈশিষ্ট প্রকাশে দায়ী জিনকে প্রকট জিন বলে। তবে ২য় জেনারেশনে (F2) এক চতুর্থাংশ জীবে প্রচ্ছন্ন (Recessive) বৈশিষ্ট প্রকাশ পায়।

প্রায় ৫০০০ মটরশুঁটি গাছের উপর পরিক্ষা করেন। তিনি বিভিন্ন জেনারেশনের গাছের মধ্যে ক্রস করিয়ে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করেন মেন্ডেল বংশগতির দুটি সূত্র প্রবর্তন করেন। প্রথম সূত্রটিসংকর জনন থেকে প্রাপ্ত এবং দ্বিতীয় সূত্রটি দ্বিসংকর জনন থেকে প্রাপ্ত ।

মেন্ডেলের প্রথম সূত্র

মেন্ডেলের প্রথম সূত্রটি ‘পৃথকীকরণ সূত্র (Law of Segregation) নামে পরিচিত। মনোহাইব্রিড ক্রসে প্রথম বংশধরের উদ্ভিদে বৈসাদৃশ্যময় দুটি ফ্যাক্টর মিশ্রিত না হয়ে পাশাপাশি অ্যালিলে অবস্থান করে এবং পরবর্তী গ্যামেট সৃষ্টিকালে ফ্যাক্টর দুটি পৃথক হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গ্যামেটে গমন করে। অথবা,

সংকর(hybrid) জীবে বিপরীত লক্ষণের ফ্যাক্টর গুলো(জিনগুলো) মিশ্রিত বা পরিবর্তিত না হয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে এবং জননকোষ সৃষ্টির সময় পরস্পর থেকে পৃথক হয়ে যায়।

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্র

মেন্ডেলের দ্বিতীয় সূত্রটি ‘স্বাধীন বন্টনের সূত্র’ (Law of Independent Assortment) নামে পরিচিত। দুই বা ততোধিক জোড়া বৈসাদৃশ্যময় (বিপরীত) বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন দুটি জীবের মধ্যে ক্রস (সংকরায়ন) ঘটালে প্রথম বংশধরে (ঋ১-জনুতে) কেবল প্রকট বৈশিষ্ট্যগুলোই প্রকাশিত হবে কিন্তু পরবর্তীতে জননকোষ উৎপাদনকালে বৈশিষ্ট্যগুলো জোড়া ভেঙে পরস্পর থেকে স্বতন্ত্র বা স্বাধীনভাবে বিন্যস্ত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন জননকোষে প্রবেশ করবে।

তথ্যসূত্র

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.