Loading AI tools
সরীসৃপের প্রজাতি উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ফরেস্ট কোবরা (বৈজ্ঞানিক নাম: Naja melanoleuca) আফ্রিকাজাত এলাপিডি পরিবারভুক্ত এক প্রজাতির বিষধর সাপ। এরা কালো কোবরা বা সাদা ঠোঁটের কালো কোবরা[4] নামেও পরিচিত। প্রধানত আফ্রিকার মধ্য ও পশ্চিমভাগে এদের দেখা যায়।[5] ফরেস্ট কোবরা ৩.২ মিটার (১০.৫ ফুট) রেকর্ড দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট নাজা প্রজাতির সবচেয়ে বৃহত্তম সাপ।[6] প্রধানত নিচু জমিযুক্ত বনাঞ্চল এবং আদ্র সাভানা প্রান্তরকে বাসস্থান হিসাবে পছন্দ করে। এদের ভৌগোলিক সীমার অন্তর্গত বিভিন্ন স্থানে নিজেদেরকে অভিযোজিত করে নেয়। শুষ্কতর আবহাওয়াযুক্ত অঞ্চলেও এদের দেখা যায়। এরা সন্তরণে অতি পারদর্শী এবং সেই কারণেই এদের প্রায়ই আধা-জলচর হিসাবে গণ্য করা হয়।[7] ফরেস্ট কোবরা সাধারণ খাদ্যাভ্যাসযুক্ত এবং সেই কারণেই এদের খাদ্য তালিকা বিশাল ও প্রচুর বৈচিত্রপূর্ণ। বৃহদাকার পতঙ্গ থেকে ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী প্রাণী সরীসৃপ[4] সবই তাদের আহারের অন্তর্ভুক্ত। এই সর্পপ্রজাতি অতি সজাগ, ভীরু এবং অতি ভয়ানক বলে বিবেচিত হয়।[7][8] এদের বিরক্ত বা উত্যক্ত করা হলে অথবা এরা কোণঠাসা হয়ে পড়লে কোবরা বর্গীয়রা ভয় দেখানো বা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিমা প্রদর্শন করে। দেহের অগ্রভাগ মাটির উপরে তুলে চ্যাপ্টা ফণা বিস্তার করে এবং উচ্চস্বরে হিসহিস আওয়াজ করতে থাকে। অন্যান্য আফ্রিকান কোবরার তুলনায় ফরেস্ট কোবরার দংশনের খবর বা নথিভুক্তকরনের ঘটনা অনেক কম, তবে এই প্রজাতির দংশন প্রাণঘাতী।[9]
ফরেস্ট কোবরা | |
---|---|
বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাস | |
জগৎ/রাজ্য: | অ্যানিম্যালিয়া (Animalia) |
পর্ব: | কর্ডাটা (Chordata) |
শ্রেণি: | রেপটিলিয়া (Reptilia) |
বর্গ: | স্কোয়ামাটা (Squamata) |
উপবর্গ: | সারপেন্টস (Serpentes) |
পরিবার: | এলাপিডি(Elapidae) |
গণ: | Naja |
Subgenus: | Boulengerina এডওয়ার্ড হ্যালোয়েল, ১৮৫৭[2][3] |
প্রজাতি: | N. melanoleuca |
দ্বিপদী নাম | |
Naja melanoleuca এডওয়ার্ড হ্যালোয়েল, ১৮৫৭[2][3] | |
সবুজ চিহ্নিত অংশ ফরেস্ট কোবরার আবাসস্থল | |
প্রতিশব্দ[2] | |
|
ফরেস্ট কোবরা এলাপিডি পরিবারের নাজা বর্গের অন্তর্ভুক্ত। ১৮৫৭ সালে মার্কিন সরীসৃপ ও উভয়চরবিদ এডওয়ার্ড হ্যালোয়েল সর্বপ্রথম নাজা মেলানোলিউকার বিবরণ দেন।[3][10] এদের বর্গীয় নাম নাজা, সংস্কৃত শব্দ nāgá (नाग) অর্থাৎ কোবরার ল্যাটিনরূপ।[11] melanoleuca বিশেষনটি প্রাচীন গ্রীকজাত যার অর্থ সাদা এবং কালো সংক্রান্ত। গ্রীক শব্দ মেলানো (melano) এর অর্থ কালো[12] এবং লিউকা (leuca) শব্দটি প্রাচীন গ্রিক বুৎপত্তি সম্পন্ন যার অর্থ সাদা।[13] এই প্রজাতির অন্যান্য নামগুলো হলো ব্ল্যাক কোবরা এবং ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট-লিপড কোবরা।[4]
ফরেস্ট কোবরা এলাপিডি পরিবারের নাজা বর্গের অন্তর্ভুক্ত। ১৭৬৮ সালে জোশেফাস নিকোলাস লাউরেন্টি সর্বপ্রথম এই নাজা বর্গটি বর্ননা করেন।[14] ১৮৫৭ সালে Naja melanoleuca প্রজাতি প্রথম বর্ণনা করেন মার্কিন সরীসৃপ ও উভয়চরবিদ এডওয়ার্ড হ্যালোয়েল।[3] নাজা বর্গকে অঙ্গসংস্থান এবং খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের উপর নির্ভর করে কয়েকটি অন্তঃবর্গে বিভক্ত করা হয়। নাজা মেলানোলিউকা প্রজাতিটি বৌলেনগেরিনা অন্তঃবর্গের একটি অংশ। বৌলেনগেরিনা উপবর্গের অন্তর্ভুক্ত আরো তিনটি প্রজাতি হলো ব্যান্ডেড ওয়াটার কোবরা, কঙ্গো ওয়াটার কোবরা এবং বরোইং কোবরা। এই বৌলেনগেরিনা উপবর্গভুক্ত উল্লিখিত প্রজাতিগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে কারণ এদের সকলের মধ্যে মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকান বনাঞ্চলে সীমাবব্ধ থাকা এবং জঙ্গলের কিনারায় বসবাস করার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। এরা অধিকতর জলচর এবং খাদ্যের বিষয়ে আরো বেশীভাবে জলজ প্রাণী ও জলজ প্রজাতির উপর নির্ভরশীল। বৌলেনগেরিনা উপবর্গভুক্ত উক্ত সর্পপ্রজাতিগুলো আকারে বা দৈর্ঘ্যে বিভিন্নরকম হয়; যেমন- ফরেস্ট কোবরার দৈর্ঘ্য ২.৭ মিটার (৮.৯ ফুট) পর্যন্ত হয়, আবার বরোইং কোবরার দৈর্ঘ্য ০.৮মিটার (২.৬ ফুট) এর বেশি হয় না।
নিম্নে চিত্রিত ক্ল্যাডোগ্রাম বা শাখা বিন্যাসটি বিভিন্ন নাজা বর্গভুক্ত সর্পপ্রজাতির শ্রেনীবিন্যাস ও সম্পর্ককে বিশ্লেষণ এবং প্রকাশ করে।[15]
নাজা |
| ||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
নাজা বর্গভুক্ত আফ্রিকার কোবরা জাতীয় সাপগুলোর মধ্যে দীর্ঘতম হলো ফরেস্ট কোবরা।[7] সম্ভবত পৃথিবীর সমস্ত জাত কোবরা (নাজা) প্রজাতির সাপদের মধ্যে এটি দীর্ঘতম সাপ।[6][16] পূর্ণবয়স্ক ফরেস্ট কোবরার গড় দৈর্ঘ্য ১.৪ থেকে ২.২ মিটার (৪.৬ থেকে ৭.২ ফুট)[7][17] এবং সাধারণ দৈর্ঘ্য ২.৭ মিটার (৮.৯ ফুট) পর্যন্ত হয়। তবে বন্য অবস্থায় ৩.২ মিটার (১০.৫ ফুট) পর্যন্ত দৈর্ঘ্য রেকর্ড করা হয়েছে।[6] এই প্রজাতির স্ত্রী ও পুরুষেরা একইরকম দৈর্ঘ্যযুক্ত হয় এবং এদের মধ্যে কোন যৌন দ্বিরূপতা দেখা যায় না অর্থাৎ লিঙ্গের প্রকারভেদে এদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আলাদা হয় না।[18] এই সর্পপ্রজাতির মাথা বৃহদাকার, ছড়ানো, চ্যাপ্টা এবং গলা থেকে সামান্য পৃথক হয়। এদের দেহ মোটামুটি পুরু, ঈষদ চাপা অথবা চ্যাপ্টা এবং লেজের অংশ সরু ও মাঝারি দৈর্ঘ্যের। দেহের পৃষ্ঠদেশ থেকে উদরের দিক চাপা এবং পৃষ্ঠদেশের উপরিবর্তী আঁশগুলো উদরদেশের নিম্নবর্তী আঁশগুলোর সাথে দেহের দুই পাশ দিয়ে এসে মিশেছে। দেহের পশ্চাৎদেশ বা পিছনের অংশ উপ-বেলনাকার। ফরেস্ট কোবরার গ্রীবাদেশীয় পর্শুকার পাঁজরগুলো লম্বা এবং প্রসারনে সক্ষম, তাই ভয় পেলে ও আক্রমণাত্বক ভঙ্গি দেখাতে এরা লম্বা ও কীলাকার ফণা ধারণ করে। এদের মাথার চাঁদি এবং দু-চোখের মধ্যস্থ মাথার পাশের দিকের কৌনিক অবস্থান, যাকে বলে ক্যান্থাস সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান। নাসিকা ছিদ্র গোল এবং চোখদুটি বৃহৎ ও গোল তারারন্ধ্রযুক্ত।[17]
অন্যান্য সর্পপ্রজাতির মতো ফরেস্ট কোবরার দেহত্বক আঁশে ঢাকা। সাপদের সম্পূর্ণ দেহত্বক বিভিন্ন আকার এবং আকৃতির আঁশে আবৃত থাকে- সব মিলিয়ে বলা হয় সর্পত্বক। এই আঁশগুলো তাদের দেহকে রক্ষা করে, গমনে সহায়তা করে, দেহের অভ্যন্তরীণ আর্দ্রতা বজায় রাখে এবং দেহত্বকের বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট যথা খসখসে ভাবের পরিবর্তন ঘটিয়ে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করে। ফরেস্ট কোবরার পৃষ্ঠদেশীয় আঁশগুলো মসৃণ, চকচকে এবং তীর্যক প্রকৃতির।[4] এই প্রজাতির প্রধান বর্নবিন্যাস তিন প্রকার বর্নে বৈচিত্রপূর্ন। সিয়েরা লিওনের পূর্ব অংশ থেকে পশ্চিম কেনিয়া এবং দক্ষিণ অ্যাঙ্গোলা পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে যে সমস্ত ফরেস্ট কোবরা জঙ্গল বা জঙ্গলের সীমান্তবর্তী অঞ্চল জুড়ে বসবাস করে তাদের বর্ন চকচকে কালো; চিবুক, গলা ও পেটের অভ্যন্তরীনভাগ দুধের সরের মতো রঙ বা সাদা এবং মোটা কালো আড়াআড়ি দাগ ও কালো ছিটছিট দাগযুক্ত। এদের মাথার পাশের দিক আকর্ষণীয় ভাবে সাদা-কালো দাগযুক্ত; দেখে মনে হয় ঠোঁটের উপর উল্লম্বভাবে সাদা-কালো ডোরা কাটা। দ্বিতীয় প্রকার বর্নবিন্যাস পশ্চিম আফ্রিকার সাভানা অঞ্চলে বসবাসকারী ফরেস্ট কোবরাদের মধ্যে দেখা যায়। এদের দেহ কালো এবং হলুদ বন্ধনীযুক্ত, লেজ কালো এবং মাথার উপরিভাগ বাদামী, হলুদঠোঁট, চিবুক ও গলা হলুদ বর্নের হয়। তৃতীয় প্রকার বর্নবিন্যাসটি পূর্ব আফ্রিকার উপকূলবর্তী সমতল, দক্ষিণ কোয়াজুলু-নাটাল, জাম্বিয়া ও গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের দক্ষিণভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে বসবাসকারী ফরেস্ট কোবরাদের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। এদের দেহের বর্ন বাদামী বা কালচে-বাদামী; তবে দেহের নিম্নভাগে কালচে-বাদামী রঙ খানিকটা হালকা হয়ে যায়। পেট হলুদ বা দুধের সরের মতো রঙের; ঘনভাবে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাদামী বা কালো ছিটছিট দাগ বা ফুটকি লক্ষ্য করা যায় এবং লেজের রঙ কালো। এই প্রজাতির সম্পূর্ণ কালো নমুনাগুলো পশ্চিম আফ্রিকায় দেখা যায়।[19]
ফরেস্ট কোবরার মাথা, দেহ এবং লেজের আঁশবিন্যাস নিম্নরূপ:[19]
|
|
এই প্রজাতির বিষ হলো পোস্ট-সাইন্যাপ্টিক নিউরোটক্সিন এবং এদের দংশনে স্নায়ুতন্ত্রের ভয়ানক বিষক্রিয়া দেখা যায়।[9] ১৯৯৬ সালে আরন্সট এবং যুজ ও অন্যান্যরা মিলে এই বিষের মূল্যায়ন করে মান নির্ধারন করেন এলডি৫০ ০.২২৫মিগ্রা/কেজি সাবকিউটেনিয়াস টিস্যু।[20] অস্ট্রেলিয়া ভেনম অ্যান্ড টক্সিন ডেটাবেজের ব্রাউন ও ফ্রাই এর মতে, মুরিন ইন্ট্রাপেরিটোনিয়াল এলডি৫০ এর মান ০.৩২৪মিগ্রা/কেজি।[21][22] এর প্রতিটি দংশনে নির্গত বিষের পরিমাণ গড়ে ৫৭১মিগ্রা এবং সর্বোচ্চ ১১০২মিগ্রা।[23] একবার দংশনে এই প্রজাতির সাপেরা আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে তীব্রমাত্রায় বিষ ঢুকিয়ে দেয়, তাই এরা ভীষন বিপজ্জনক। আত্মরক্ষার্থে ফরেস্ট কোবরা ভীষন আক্রমণাত্বক ও মরিয়া হয়ে ওঠে। এদের কামড়ে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বিষক্রিয়ায় ৩০ থেকে ১২০মিনিটের মধ্যে আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেছে। বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো হল: ঝিমুনি ভাব, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অসাড়তা, শ্রবনশক্তি লোপ পাওয়া, বাকশক্তি লোপ পাওয়া, মাথা ঘোরা, শক, নিম্ন রক্তচাপ, পেট ব্যাথা, জ্বর, ফ্যাকাশে ভাব বা বিবর্নতা এবং অন্যান্য স্নায়ুগত ও শ্বসনতন্ত্রীয় লক্ষন দেখা যায়।[9]
আফ্রিকান কোবরাগুলোর মধ্যে ফরেস্ট কোবরা হলো অন্যতম সর্বাপেক্ষা কম দংশনকারী সাপ।[9] এর দংশনের হার ও ঘটনা খুবই কম হওয়ার প্রধান কারণ এরা জঙ্গলবাসী সাপ; লোকালয়ে এদের আগমনের সম্ভাবনা খুব কম। এই প্রজাতির লক্ষনসমূহ মিশরীয় কোবরার (Naja haje) অতি সদৃশ্য বা অনুরূপ বলে মনে করা হয়।[24] চিকিৎসাশাস্ত্রে এই প্রজাতির সাপ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা খুবই অপ্রতুল এবং নথিভুক্ত দংশনের ঘটনা বা নিদর্শন কদাচিৎ শোনা যায়। নিউরোটক্সিনের চরম বিষক্রিয়ার কারণে ফরেস্ট কোবরার কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসকার্য বন্ধ হয়ে মৃত্যু হওয়ার নজির রয়েছে। তবে বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো দেখা যাওয়ার সাথে সাথেই দ্রুত অ্যান্টিভেনাম (বিষনাশক) প্রয়োগ করা গেলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আক্রান্ত ব্যক্তি বেঁচে যায়। বিশেষ অ্যান্টিভেনামের প্রয়োগ ছাড়াই স্বতঃস্ফূর্তভাবে বা নিজে নিজেই বিষক্রিয়া থেকে সেরে ওঠার নিদর্শনও কদাচিৎ দেখা গেছে। যদিও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ও অ্যান্টিভেনামের প্রয়োগে অবহেলা করার অর্থ হলো চরম অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকি নেওয়া। এই প্রজাতির সাপ উত্ত্যক্ত হলে বা কোনঠাসা হয়ে পড়লে দ্রুত পাল্টা-আক্রমণ করতে পারে এবং যেহেতু দংশনকালে প্রচুর পরিমানে বিষ ঢালতে পারে, তাই দ্রুত মারাত্মক ফলাফলের সম্ভাবনা প্রবল। অধিকাংশ কোবরার ন্যায় এরাও চরম পাল্টা-আক্রমণাত্মক; পলায়নপর নয়। চিকিৎসা না করানো দংশনের ক্ষেত্রে মৃত্যুহার যদিও সঠিকভাবে বলা যায় না, তবুও খুব উচ্চমাত্রায় বলেই মনে করা হয়। ফরেস্ট কোবরারা কখনো বিষ ছোঁড়ে না বা স্প্রে করে না। সরিসৃপ ও উভয়চরবিদদের মতানুসারে, আফ্রিকার এলাপিডিদের মধ্যে এই প্রজাতির সাপকে অন্যতম সর্বাপেক্ষা বুদ্ধিমান প্রজাতি হিসাবে গন্য করা হয়।[24]
লাইবেরিয়াতে ফরেস্ট কোবরার দংশনের দুটি ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়। যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শরীরে মারাত্মক স্নায়ুবিক লক্ষন তথা বমির ভাব, হৃদ-স্পন্দন বেড়ে যাওয়া এবং শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি দেখা যায়। ঘানাতে একটি শিশু সর্পদংশনের ২০মিনিটের মধ্যে মারা যায় এবং সন্দেহ করা হয় যে, ঘাতক সাপটি ফরেস্ট কোবরা প্রজাতিভুক্ত।[25]
মূলত পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকাতে ফরেস্ট কোবরা দেখা যায়।[4] এছাড়াও বেনিন, নাইজেরিয়া, বিষুবীয় গিনি, ক্যামেরুন, গাবন, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্র, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র, উত্তর অ্যাঙ্গোলা, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, লাইবেরিয়া, কোত দিভোয়ার, বুরকিনা ফাসো, ঘানা এবং টোগোসহ দক্ষিণ আফ্রিকার খন্ডিত ভূখন্ডে এদের দেখা মেলে।[19]
জঙ্গলের সাপ হিসাবে ফরেস্ট কোবরা আফ্রিকান কোবরাগুলোর মধ্যে একমাত্র সাপ, যা উঁচু বনভূমিতে বাস করে।[26] এই সর্পপ্রজাতি বিভিন্ন পরিবেশে সহজেই ভালোভাবে অভিযোজিত হতে পারে। এই কারণে ফরেস্ট কোবরার বাসস্থান বা বাসভূমি ভীষনভাবে নির্ভর করে আফ্রিকান ভৌগোলিক পরিধি বা সীমানার ঠিক কোন অংশে সাপটি জন্মগ্রহণ করেছে তার উপর। দক্ষিণ আফ্রিকাজাত ফরেস্ট কোবরাদের সাধারনত সাভানা অঞ্চলে এবং তৃণভূমিতে বাস করতে দেখা যায়; যদিও এদেরকে ভাঙ্গাচোরা পাথুরে অঞ্চলেও বাস করতে দেখা যায়। পশ্চিম ও মধ্য আফ্রিকার ক্রান্তীয় এবং নাতি-ক্রান্তীয় রেইন ফরেস্ট এই প্রজাতির সাপের মূল বাসভূমি।[5] আবার পশ্চিম আফ্রিকার ম্যানগ্রোভের জঙ্গলেও এদের বসবাস রয়েছে। ফরেস্ট কোবরা প্রজাতির ডোরাকাটা সাপগুলো পশ্চিম আফ্রিকার সাভানা ও তৃণভূমি অঞ্চলে (সাধারনত নদীর ধারে) এবং ঘন গাছপালাযুক্ত অঞ্চলে বিশেষ করে নদী তীরবর্তী জঙ্গলে দেখা যায় (১৪° উত্তর অক্ষাংশ পর্যন্ত)। এই প্রজাতির অতি পছন্দের বাসভূমি হলো নিম্নভূমিভর্তী জঙ্গল এবং আদ্র সাভানা ভূমি যেখানে উপকূলীয় ঝোপঝাড় রয়েছে।[19] ফরেস্ট কোবরাকে উচ্চ অভিযোজন ক্ষমতাসম্পন্ন সাপ বলে মনে করা হয় এবং তাই প্রয়োজন হলে অনায়াসেই এরা অধিকতর শুষ্ক অঞ্চলে নিজেদের অভিযোজিত করতে পারে। পশ্চিম কেনিয়ার প্রশস্ত তৃণভূমিযুক্ত অঞ্চলে এই সর্পপ্রজাতি দেখা যায়।[26] উগান্ডার জলাভূমিতেও এদের সর্বদাই দেখা যায়। ফরেস্ট কোবরার বাদামী বর্নবিন্যাস দেখা যায় উপকূলবর্তী ও উচ্চভূমির জঙ্গলে, ঘন ঝোপঝাড়ে এবং তৃণভূমিযুক্ত অঞ্চলে (যেমন: ন্যাঙ্গা, জিম্বাবুয়ে)। এদের গুপ্ত অভ্যাস এবং গর্তে বাস করার পছন্দের দরুন এদের প্রায়শই ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলে দেখা যায়। মধ্য আফ্রিকার অনেক শহরে ও আশেপাশের অঞ্চলে এদের দর্শন পাওয়া যায়। এমনকি এই শহরগুলো থেকে গাছপালা, ঝোপঝাড় অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার পরও এখানে এরা দৃশ্যমান। ফলের বাগানে বা যেখানে ফলের চাষ হয় সেখানেও এরা বসবাস করে, তবে এক্ষেত্রে এরা বৃক্ষবাসী। এদের উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন অভিযোজনের কারণে এরা বিভিন্ন উচ্চতায় বাস করতে সক্ষম। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮০০মিটার (৯২০০ ফুট) উঁচু পার্বত্য জঙ্গলেও এদের বসবাস করতে দেখা যায়।[26]
ফরেস্ট কোবরাদের সাধারনত দিনের বেলায় সক্রিয় দেখা যায়। এরা চটপটে ও ক্ষিপ্র এবং ভাল আরোহণকারীও। নাজা বর্গের আদর্শ কোবরাদের মধ্যে এরা অন্যতম শ্রেষ্ঠ জলচর সাপ।[7] এই সর্পপ্রজাতি স্থলজ, দ্রুতগামী ও চমৎকার আরোহণকারী। ১০মিটার বা ৩৩ ফুটেরও বেশি উঁচু গাছে এরা চড়তে পারে। এরা অতি সজাগ ও তৎপর। এরা পানিতে সাঁতার কাটতে পারে এবং দরকার হলেই পানিতে নেমে পড়ে। কোনো কোনো অঞ্চলে এদের প্রধান খাদ্য হলো মাছ। মাছ শিকারে এরা প্রায়শই জলে নামে এবং তাই এদের অর্ধ-জলচর হিসাবেও গণ্য করা হয়। যদিও জনমানবহীন অঞ্চলে দিনের বেলায় মূলত এদের দেখা পাওয়া যায়, তথাপি জনবসতি অঞ্চলে নৈশ অভিযানে এদের সক্রিয় হতেও দেখা যায়। যখন এরা সক্রিয় থাকে না, তখন এরা জঙ্গলের অথবা জঙ্গলের সীমানার গর্তে, গাছের ফাঁপা গুঁড়িতে বা কোটরে, উদ্ভিদের গুচ্ছমূলে, পাথরের ফাটলে, পরিত্যক্ত উইপোকার ঢিপিতেও বসবাস করে। কোনো কোনো অঞ্চলে এই সর্পপ্রজাতিদের নদীর পাড়ের গর্তে বা ফাটলে, গাছের ঝুলে থাকে মূলগুচ্ছে, পাখির বাসার কোটরে এবং শহরাঞ্চলে আবর্জনার গাদা অথবা পুরনো অব্যবহৃত বাড়ীতে বাস করতে দেখা যায়। উত্তেজিত এবং কোণঠাসা হলে এরা চ্যাপ্টা লম্বা ফনা মেলে দেহের অগ্রভাগ অনেকটা উচ্চতা পর্যন্ত তুলে ধরে। ফরেস্ট কোবরা ক্ষিপ্ত বা বিরক্ত হলে অথবা কোনঠাসা হলে অনেকটা দূর থেকে দ্রুত ছোবল মারতে পারে। এরা আক্রমণাত্মক হয়ে সামনের দিকে তেড়ে আসে এবং দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ছোবল দেয়।[24] কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন, আফ্রিকার সাপদের মধ্যে অন্যতম সর্বাপেক্ষা ভয়ঙ্কর এই ফরেস্ট কোবরা। খাঁচাবন্দী অনেক ফরেস্ট কোবরার ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এরা বিশেষরকম ক্ষিপ্ত এবং আক্রমণাত্বক।[7][8] তবে এই সর্পপ্রজাতি বিষ ছেটাতে পারে না।[19]
ফরেস্ট কোবরার খাদ্য তালিকায় বিচিত্র রকমের শিকার রয়েছে।[4] এরা উভচর প্রাণী, মাছ, গোধিকা বা গুই সাপ, অন্যান্য সাপ, টিকটিকি, পাখির ডিম, ইঁদুর জাতীয় তীক্ষ্ণদন্তী প্রাণী, চিড়িং মাছ এবং অন্যান্য ক্ষুদ্রাকার স্তন্যপায়ী প্রাণী শিকার করে। পশ্চিম আফ্রিকাতে এই প্রজাতির একটি সাপ গিফোরডস জায়েন্ট শ্রু নামক অতি দুর্গন্ধময় একটি পতঙ্গভুক প্রাণীকে খেয়েছিল বলে জানা যায়। বলাবাহুল্য, এই পতঙ্গভুক প্রাণীটি এমনই দুর্গন্ধযুক্ত যে অধিকাংশ সাপই এদেরকে স্পর্শ করে না।[24]
এই প্রজাতির সাপেরা অন্ডজ বা ডিম্বনালীজাত।[7] গ্রীষ্মকালে স্ত্রী সাপেরা ১১ থেকে ২৬টির মতো ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সাদা বর্নের এবং মসৃন প্রকৃতির। প্রতিটি ডিম আনুমানিক ৩০ থেকে ৬০মিলিমিটার (১.২ থেকে ২.৪ ইঞ্চি) হয়। ডিমগুলো থোকা হয়ে একসাথে লেগে থাকে।[19] এরা ডিম পাড়ে গাছের ফাঁপা কুঠুরিতে, উইপোকার ঢিপিতে, মাটির গর্তে অথবা স্ত্রী সাপের করা বাসায়। মিলনের পূর্বে স্ত্রী এবং পুরুষ জোড়া নাচের ছন্দে ও ভঙ্গিমায় তাদের মাথা মাটি থেকে ১ফুট বা তারও বেশি উঁচুতে তুলে এদিক ওদিক দুলে দুলে নড়াচড়া করতে থাকে। এই ব্যাপারটি সর্প এবং সর্পিনীর মিলন হওয়ার পূর্বে একঘণ্টা ধরে চলতে পারে। সেইসময় পুরুষ সাপটি তার ক্লোকা অর্থাৎ যে স্থানে জনননালী, মূত্রনালী ও অন্ত্র উন্মুক্ত হয়, সেই স্থানটি স্ত্রী সাপটির ক্লোকার উপর চেপে ধরে। প্রজননকালে স্ত্রী ফরেস্ট কোবরাটি অত্যন্ত বিরক্ত, অসহিষ্ণু এবং আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। এইসময় স্ত্রী সাপ কোনোরকম উত্ত্যক্ত করা বা বিপন্ন হওয়ার কারণ ছাড়াই আক্রমণ করে এবং অনেক সময় পথচারীর চলার পথে ফরেস্ট কোবরার বাসা পড়ে গেলে তার ফলাফল মারাত্মক হতে পারে।[6] ডিম থেকে বাচ্চা সাপগুলো স্বতন্ত্রভাবেই বড় হয়ে ওঠে এবং দৈর্ঘ্য ২২-২৫সেন্টিমিটার (৮.৭ থেকে ৯.৮ ইঞ্চি) হয়।[17] যদিও কোনো কোনো সূত্র দাবি করে যে, ডিম ফুটে বেরোনো বাচ্চাগুলো ৪৭সেন্টিমিটার (১৯ ইঞ্চি) পর্যন্ত লম্বা হতে পারে।[19] ডিম ফোটার সময়কাল মোটামুটি ৫৫ থেকে ৭০ দিন এবং প্রয়োজনীয় উষ্ণতা ২৭-৩০ °সেলসিয়াস (৮১-৮৬ °ফারেনহাইট)। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, একটি বন্দী ফরেস্ট কোবরার ডিম ফুটতে ৮০দিনের বেশি সময় লেগেছিল।[27] এই ফরেস্ট কোবরা প্রজাতির সাপগুলো দীর্ঘায়ু প্রাণী হিসাবে পরিচিত। একটি অনুরূপ সাপ বন্দীদশায় ২৮ বছর বেঁচেছিল এবং এটি বিষধর সাপদের মধ্যে বন্দীদশায় সবচেয়ে বেশিদিন বাঁচার এটাই রেকর্ড।[26] অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের চিড়িয়াখানার একটি ফরেস্ট কোবরার বয়স ০১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সাল অনুযায়ী ৩৫ বছর।[28]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.