Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান বা টিটিপি যা সাধারণত পাকিস্তানি তালেবান নামে পরিচিত, একটি সশস্ত্র ইসলামি জিহাদি গোষ্ঠী যারা আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে সক্রিয় রয়েছে। [1][2]এটি ২০০৭ সালে বাইতুল্লাহ মেহসুদ কর্তৃক সংগঠিত হয়। বর্তমান এর নেতা হলেন নূর ওয়ালী মেহসুদ। যিনি প্রকাশ্যে আফগান তালেবানের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। টিটিপির ভাষ্যমতে, তারা খায়বার পাখতুনখোয়া প্রদেশে শরিয়া আইন কায়েমের লক্ষ্যে লড়াই করছে। একমাত্র শরিয়া আইনই পাকিস্তানি বাহিনী এবং টিটিপির মাঝে চলমান সংঘর্ষের সমাধান হতে পারে। [3]পাকিস্তানি তালেবানরা আফগান তালেবানদের সাথে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আদর্শিক মিল রাখে এবং মার্কিন আফগান যুদ্ধে তাদের সহায়তা করে। তবে দুটি গ্রুপের আলাদা অপারেশন এবং ভিন্ন কমান্ড কাঠামো রয়েছে।[4] [5][6]
তেহরিক তালেবান পাকিস্তান | |
---|---|
تحریک طالبان پاکستان | |
অন্য যে নামে পরিচিত | টিটিপি, পাকিস্তানি তালেবান |
প্রতিষ্ঠাতা | বায়তুল্লাহ মেহসুদ |
প্রতিষ্ঠাতা নেতা | বায়তুল্লাহ মেহসুদ |
নেতা | নূর ওয়ালী মেহসুদ (২০১৮ - বর্তমান) |
১ম আমির | বায়তুল্লাহ মেহসুদ |
দ্বিতীয় আমির | হাকিমুল্লাহ মেহসুদ |
তৃতীয় আমির | ফজলুল্লাহ হায়াত |
মুখপাত্র | মুহাম্মদ খুরাসানি |
অপারেশনের তারিখ | ২০০৭ থেকে - বর্তমান |
দেশ | |
আনুগত্য |
|
সদরদপ্তর | ওয়াজিরিস্তান, পাকিস্তান |
সক্রিয়তার অঞ্চল | পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্ত |
মতাদর্শ | জিহাদবাদ, ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা |
মিত্র | আফগানিস্তান ভারত |
বিপক্ষ | পাকিস্তান |
যার দ্বারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসাবে মনোনীত | পাকিস্তান |
পাকিস্তানে এই সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে সেদেশের সরকার নিষিদ্ধ করেছিল।
টিটিপির লড়াইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য হল, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশ থেকে পাকিস্তানি সরকারব্যবস্থা উচ্ছেদ করে সেখানে শরিয়া শাসনব্যবস্থা কায়েম করা।[7]এ লক্ষ্যে তারা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চলে লড়াইরত অন্যান্য ছোট বড় একাধিক জিহাদি গোষ্ঠীকে সাথে নিয়ে যুদ্ধ করছে।[8] সদস্য সংগ্রহের জন্য টিটিপি মূলত আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তের উপজাতীয় অঞ্চলের উপর নির্ভর করে। সেখান থেকে জনবল সংগ্রহ করে তারা নিজেদের বাহিনীতে নিয়োগ দেয়। টিটিপি আল-কায়েদার কাছ থেকে আদর্শগত দিকনির্দেশনা পায় এবং তার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০২০ সালের জুলাই থেকে নভেম্বরের মধ্যে আমজাদ ফারুকী গ্রুপ, লস্কর-ই- ঝাংভির একটি দল, শহীদ মুসা কারওয়ান গ্রুপ, টিটিপির মেহসুদ দল, মেহমান্দ তালেবান, বাজাউর তালেবান, জামাত- উল-আহরার , এবং হিজবুল-আহরার টিটিপির সাথে একীভূত হয়ে কাজ করার ঘোষণা দেয়। এই পুনর্গঠন টিটিপিকে আরও মারাত্মক করে তুলে এবং আগেকার তুলনায় অধিক আক্রমণে সক্ষম করে তোলে।[9]
এভাবে ২০২০ সালে বহু বছর ধরে উপদলীয়তা এবং অন্তর্দ্বন্দ্বের পর নূর ওয়ালী মেহসুদের নেতৃত্বে এবং অন্যান্য গোষ্ঠীর যোগদানের মাধ্যমে টিটিপি পুনর্গঠিত হয়। মেহসুদ মূলত টিটিপিকে একটি নতুন দিকে চালিত করেছে যা আগেকার অবস্থান থেকে ভিন্ন। তিনি বেসামরিক নাগরিকদের উপর হামলা করতে নিষেধ করেন এবং শুধুমাত্র নিরাপত্তা ও আইন প্রয়োগকারী কর্মীদের উপর হামলার নির্দেশ দেন। কারণ তিনি জনগণের মাঝে গোষ্ঠীটির ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে এবং ইসলামিক স্টেট জঙ্গি গোষ্ঠীর চরমপন্থা থেকে তাদের সদস্যদের বাঁচিয়ে রাখার ব্যাপারে সদা তৎপর থাকেন।[10]
একটি সংগঠন হিসাবে টিটিপির উত্থান হয়েছিল ২০০২ সালে, যখন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানের আদিবাসী এলাকায় ব্যাপক আগ্রাসন চালায়। মূলত ২০০১ সালে আমেরিকা আফগানিস্তানে আগ্রাসন চালালে অনেক আফগান তালেবান সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানের প্রতিবেশী উপজাতীয় এলাকায় আশ্রয় গ্রহণ করে। তাদের দমনে পাকিস্তানি বাহিনী উপজাতীয় এলাকায় অপারেশন শুরু করে। তাদের দাবি ছিল, আফগানিস্তানে অবস্থানরত অনেক বিদেশী যোদ্ধা এসব এলাকায় আশ্রয় নিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।। কিন্তু একবার দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু হলে বেশ কয়েকটি ওয়াজিরি উপ-উপজাতি এটিকে তাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার প্রচেষ্টা হিসাবে গ্রহণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর স্পষ্টত ভুল আচরণের কারণে সন্দেহভাজন জিহাদীদের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা অভিযান পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী এবং উপজাতিদের মধ্যে একটি অঘোষিত যুদ্ধে পরিণত হয়। সেখান থেকেই মূলত টিটিপি বা পাকিস্তানি তালেবান সৃষ্টি হয়।[11][12]
এরপর ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে বাইতুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে আনুষ্ঠানিকভাবে টিটিপির অস্তিত্বের ঘোষণা করা হয়। এটি তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক আল-কায়েদার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় গঠিত হয়েছিল। ২০০৮ সালে পাকিস্তান এই গোষ্ঠীটিকে নিষিদ্ধ করে। এর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট এবং সম্পদ জব্দ করে এবং এটিকে মিডিয়াতে উপস্থিত হতে বাধা দেয়। সরকার আরো ঘোষণা করে যে, টিটিপির বিশিষ্ট নেতাদের হত্যা করতে পারলে সরকারীভাবে পুরস্কার দেওয়া হবে।[13] সে বছরের ডিসেম্বরে মোল্লা ওমর সাবেক গুয়ান্তানামো বন্দী মোল্লা আবদুল্লাহ জাকিরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল পাঠান। যাতে তারা TTP-এর নেতৃস্থানীয় সদস্যদের মতভেদ দূর করতে এবং আফগানিস্তানে আমেরিকার উপস্থিতি মোকাবেলায় আফগান তালেবানদের সাহায্য করতে রাজি করতে পারে।[7] বাইতুল্লাহ মেহসুদ , হাফিজ গুল বাহাদুর এবং মৌলভি নাজির এতে সম্মত হন এবং শুরা ইত্তেহাদুল মুজাহিদিন গঠন করেন। এক পৃষ্ঠার উর্দু-ভাষায় প্রচারিত একটি লিখিত বিবৃতিতে তারা তিনজন নিশ্চিত করেন যে,তারা আমেরিকা নেতৃত্বাধীন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মতপার্থক্যকে দূরে সরিয়ে রাখবেন এবং মোল্লা ওমর এবং ওসামা বিন লাদেনের প্রতি তাদের আনুগত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন। যাহোক, এই ঐক্য খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি এবং ঘোষণার পরপরই এটি ভেঙে পড়ে। তবে টিটিপি পাকিস্তানে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকে।[14]
২০১০ সালের এপ্রিলে ক্বারী মেহসুদ একটি রেকর্ড করা ভিডিওতে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, টিটিপি নেতাদের উপর মার্কিন ড্রোন হামলার প্রতিক্রিয়ায় টিটিপি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলিকে এর প্রধান লক্ষ্য করে তুলবে। [15]সে বছরের ডিসেম্বরে টিটিপি আফগানিস্তানের একটি মার্কিন ক্যাম্পে সিআইএর স্থাপনায় আত্মঘাতী হামলার পাশাপাশি টাইমস স্কোয়ারে বোমা হামলার চেষ্টার দায় স্বীকার করে।[16]
২০১২ সালে বার্মার আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে টিটিপি মিয়ানমারে হামলার হুমকি দেয়। টিটিপি মুখপাত্র এহসানুল্লাহ পাকিস্তান সরকারের কাছে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং ইসলামাবাদে বার্মিজ দূতাবাস বন্ধ করার দাবি জানান এবং কোনো ব্যবস্থা না নিলে বার্মিজ স্বার্থের বিরুদ্ধে হামলার হুঁশিয়ারি দেন।[17]
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় আসাদ বিরোধী লড়াইয়ে আল কায়েদার সহায়তায় টিটিপি যোদ্ধা পাঠিয়েছিল বলে অভিযোগ করা হয়। [18]
২০০৯ সালের আগস্টে টিটিপির প্রধান নেতা বায়তুল্লাহ মেহসুদ সন্দেহভাজন মার্কিন ড্রোন থেকে নিক্ষেপিত ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নিহত হয়।[19] টিটিপি শীঘ্রই তার উত্তরসূরি নিয়োগের জন্য একটি শুরা আয়োজন করে। সরকারি সূত্রে জানা যায় যে, শুরা চলাকালীন টিটিপির দুই প্রধান নেতা হাকিমুল্লাহ মেহসুদ এবং ওয়ালি-উর-রহমানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। পাকিস্তানি নিউজ চ্যানেলগুলো হাকিমুল্লাহ মেহসুদ গুলিতে হয়েছে বলে খবর দিলেও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারেননি।
এর কিছুদিন পর পাকিস্তানি নিরাপত্তা কর্মকর্তারা টিটিপির মুখপাত্র মৌলভি ওমরকে গ্রেপ্তার করেছে বলে ঘোষণা দেয়। তিনি ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নেতার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন এবং তাঁকে হত্যার পর টিটিপি নেতৃত্বের মধ্যে অশান্তি বিরাজ করছে তাও স্বীকার করেন।[20] এর কিছুদিন পর জানা যায় যে, হাকিমুল্লাহ মেহসুদকে টিটিপির প্রধান নির্বাচিত করা হয়েছে। হাকিমুল্লাহর নেতৃত্বে টিটিপি পাকিস্তানি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এবং বেসামরিক (বিশেষ করে শিয়া,কাদিয়ানি এবং সুফি ) লক্ষ্যবস্তুর বিরুদ্ধে আত্মঘাতী অভিযান জোরদার করে।[21]
মূলত বায়তুল্লাহ মেহসুদ নিহত হওয়ার পর থেকে টিটিপির মাঝে ব্যাপক কোন্দল ছড়িয়ে পড়ে। হাকিমুল্লাহ মেহসুদ প্রধান নির্বাচিত হয়েও টিটিপিকে এক নেতৃত্বের আওতায় ধরে রাখতে পারেননি। ধর্মীয় বিষয়ে স্বল্প জ্ঞান, বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আক্রমণ ইত্যাদি বিষয়ে মতানৈক্যের ফলে টিটিপি কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে মাওলানা উমর কাসমির নেতৃত্বে টিটিপির একটি দল আহরার-উল-হিন্দ নামে একটি সংগঠন গড়ে টিটিপি থেকে বের হয়ে যায়। তাদের অভিযোগ ছিল, বর্তমান টিটিপি নেতৃবৃন্দ জালেম ও ধোঁকাবাজ পাকিস্তান সরকারের সাথে আলোচনায় বসে বিরাট অন্যায় করেছে। সে বছরের মে মাসে আরো একটি দল প্রধান গ্রুপ থেকে সরে গিয়ে খালিদ মেহসুদের নেতৃত্বে তেহরিক-ই-তালেবান দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তান নামে একটি বিচ্ছিন্ন ইউনিট গঠন করে। বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীটি টিটিপির বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে অসন্তুষ্ট ছিল। একটি বিবৃতিতে তারা বলেছিল "আমরা মুক্তিপণের জন্য অপহরণ, চাঁদাবাজি, পাবলিকের ক্ষতি এবং বোমা হামলাকে অনৈসলামিক বলে মনে করি।[22]
হাকিমুল্লাহ মেহসুদ নিহত হওয়ার পর ফজল হায়াত প্রধান নেতা নির্বাচিত হন। তবে তিনিও টিটিপিকে ধরে রাখতে পারেননি।[23] ২০১৭ সালে ফজল হায়াত নিহত হলে নুরওয়ালী মেহসুদ প্রধান নেতা নির্বাচিত হন।[24] তিনি টিটিপিকে একক নেতৃত্বের আওতায় নিতে ব্যাপক প্রয়াস চালান। মতানৈক্যপূর্ণ বিষয়গুলো এড়িয়ে চলেন এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানো বন্ধ করেন। [25]
২০১০ সালের ১ সেপ্টেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র টিটিপিকে একটি বিদেশী সন্ত্রাসী সংস্থা ঘোষণা করে এবং হাকিমুল্লাহ মেহসুদ এবং ওয়ালী উর-রহমানকে বিশেষভাবে বিশ্ব সন্ত্রাসী হিসাবে চিহ্নিত করে। তাদের অবস্থানের তথ্যের জন্যে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট $5 মিলিয়ন ডলারের পুরস্কারও ঘোষণা করে। [26]
২০১১ সালের জানুয়ারিতে ব্রিটিশ সরকার তাদের সন্ত্রাস আইন-২০০০ এর অধীনে টিটিপিকে নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে তালিকাভুক্ত করে । [27]
২০১১ সালের জুলাইয়ে কানাডিয়ান সরকার টিটিপিকে তার নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকায় যুক্ত করে। [28]
টিটিপি ও তালেবান নামে অভিন্ন হলেও আফগান তালেবান থেকে টিটিপি কাঠামোগতভাবে ভিন্ন। কারণ এটির একটি কেন্দ্রীয় কমান্ড আছে।[29] টিটিপি নিজেদের আফগান তালেবানের অনুগত আখ্যা দিলেও তালেবান প্রকাশ্যে তাদের স্বীকৃতি দেয়নি। ২০২১ সালে তালেবান আফগানিস্তান দখল করলে পাকিস্তান ব্যাপক তৎপরতা চালিয়েও তালেবানকে টিটিপির বিরুদ্ধে দমননীতি গ্রহণে রাজি করাতে পারেনি। তবে তালেবান উভয়ের মাঝে আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে রাজি হয়।
টিটিপি একটি জোট হলেও তাদের প্রভাব স্থানীয় কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ থাকে এবং প্রায়শই সেসব অঞ্চলের বাইরে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করতে পারে না। [30]টিটিপি তালেবানের মত সংঘবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ সংগঠন নয়। তাদের নেতাদের মাঝে যোগাযোগের ব্যাপক অভাব পরিলক্ষিত হয় এবং কেন্দ্রীয় কমান্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শৃঙ্খলা ও যোগাযোগের অভাবে তারা ব্যাপক হামলার শিকার হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক সপ্তাহের মধ্যেই টিটিপির চারজন সিনিয়র নেতা নিহত হয়।[31] তবে ২০২১ সালে আফগান তালেবান কাবুল দখল করলে টিটিপির বিভিন্ন গ্রুপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে আগ্রহী হয়। বায়তুল্লাহ মেহসুদের পর বর্তমান টিটিপি প্রধান নুরওয়ালী মেহসুদকে একজন সফল সাংগঠনিক নেতা মনে করা হয়। তিনি টিটিপির বিচ্ছিন্ন গ্রুপগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছেন। [32]
১. নুর ওয়ালী মেহসুদ (ওরফে আবু মনসুর আসেম) তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের আমির (প্রধান)। [24]
২. মুজাহিম (ওরফে মুফতি হযরত)- টিটিপির নায়েবে আমির (উপপ্রধান)।
৩. ওমর খালিদ খুরাসানিহাফিজ
৫.গুল বাহাদুর আলিম খান খুশালি।
৬. মুহাম্মাদ খুরাসানি। [33]
টিটিপির অফিশিয়াল মিডিয়ার নাম হল 'উমর মিডিয়া’। উমর মিডিয়া টিটিপির হামলা সম্পর্কে বিশদ বিবরণ প্রদান করে। ভিডিও ক্লিপগুলি উর্দু সাবটাইটেল সহ পশতু ভাষায় তৈরি করা হয়।[34] ২০১২ সালে উমর মিডিয়া একটি ফেসবুক পেজও পরিচালনা করত,যা ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তৈরি করা হয়েছিল। তবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ কিছুদিন পর পেইজটি ডিলেট করে দেয়।[35]
আফগান তালেবান এবং পাকিস্তানি তালেবান একই মতাদর্শ এবং প্রভাবশালী পশতুন জাতি থেকে হলেও তারা আন্দোলনে স্বতন্ত্র, ইতিহাস, কাঠামো এবং লক্ষ্যে ভিন্ন।[29] একজন আফগান তালেবান মুখপাত্র দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেন, "আমরা তাদের সাথে জড়িত থাকতে পছন্দ করি না। আমরা পাকিস্তানি তালেবান যোদ্ধাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক প্রত্যাখ্যান করেছি ...মুসলমান হিসাবে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি আছে, কিন্তু এর পাশাপাশি, আমাদের মধ্যে আর কিছুই নেই।[36] [7]
অনেক বিশ্লেষক টিটিপিকে আল কায়েদার ছায়া সংগঠন মনে করেন। তাদের মতে, আফগান তালেবান ঐতিহ্যগতভাবে হানাফি হওয়ায় আদর্শিকভাবে আল কায়েদার সাথে মেলে না। কারণ আল কায়েদা সালাফি চিন্তাধারায় বিশ্বাসী। তাই আল কায়েদা ওয়াজিরিস্তানে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখতে নিজেদের আওতাধীন একটি সংগঠন গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ২০০৭ সালে গঠিত টিটিপি সেই প্রয়োজনীয়তা পূরণে সক্ষম হয়। আদর্শিকভাবে আফগান তালেবান ও টিটিপির মধ্যে পার্থক্য হল, টিটিপি সালাফি জিহাদি চিন্তাধারায় চালিত এবং তাদের হামলার ধরণ অনেকটা আল কায়েদার মতই। আল কায়েদার মত তারাও বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করা বৈধ মনে করে। অপরপক্ষে আফগান তালেবান ঐতিহ্যগতভাবে হানাফি এবং সালাফি চিন্তাধারার সাথে তাদের প্রচুর পার্থক্য বিদ্যমান। টিটিপি পাকিস্তানি আর্মিকে ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের হত্যা বৈধ বলে বিশ্বাস করে। কিন্তু তালেবান এমন ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধীতা করে।
টিটিপি প্রায় একচেটিয়াভাবে পাকিস্তানি রাষ্ট্রের উপাদানগুলোকে টার্গেট করে। আফগান তালেবানরা কূটনৈতিক কারণে আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সমর্থনের উপর নির্ভর করে। যদিও এতে পাকিস্তানের স্বার্থ অধিক রক্ষা হয়।
২০০৭ সালে বাইতুল্লাহ মেহসুদের নেতৃত্বে সংগঠিত হওয়ার পর টিটিপি প্রায় ২০০ পাকিস্তানি নেতা হত্যা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অনেক গোয়েন্দা বিশ্লেষক বিশ্বাস করেন যে, পাকিস্তান সরকার, পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর উপর টিটিপির এসব আক্রমণ পাকিস্তানি তালেবান এবং আফগান তালেবানের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন তৈরি করেছিল। আফগান তালেবান নেতা মোল্লা ওমর ২০০৭ সালের শেষের দিকে এবং ২০০৯ সালের প্রথম দিকে টিটিপিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নির্বিচারে হামলা বন্ধ করতে বলেছিলেন। ধারণা করা হয়, তালেবানের অনেক কর্মকর্তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টিটিপির সহিংস অভিযানে বিরক্ত। আফগান তালেবান এবং টিটিপির মাঝে দুই একবার সংঘর্ষও হয়েছে। ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবরে ভারী সশস্ত্র আফগান তালেবানরা আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে একটি টিটিপি ঘাঁটিতে হামলা চালায় । হামলায় তিন টিটিপি কমান্ডার নিহত হয়। ২০১৬ সালের ২৫ জুন আফগান তালেবান এবং টিটিপি আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে পুনরায় একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
২০০৭ সালে দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে পাকিস্তান আর্মির নির্বিচারে ওয়াজিরি জনগণ এবং শিশু হত্যার প্রতিক্রিয়ায় টিটিপি পাকিস্তানে নিকৃষ্ট কিছু হামলা পরিচালনা করে। যার মধ্যে ২০১৪ সালে পেশোয়ার স্কুল হত্যাকাণ্ড উল্লেখযোগ্য। টিটিপির পেশোয়ার স্কুল হত্যাকাণ্ডের পর আফগান তালেবানের নেতারা টিটিপি-র এমন কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বলেছিলেন যে, এটি অনৈসলামিক কাজ।[37][38][39][40][41][42]
বেশ কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বে মূল লক্ষ্যে আফগান তালেবান ও টিটিপি এক ও অভিন্ন। উভয় দলই শরিয়া শাসনব্যবস্থার পুনর্বহাল চায় এবং উভয়ই জাতিগতভাবে পশতুন।[43] ধারণা করা হয়, ২০১৭ সালে নুর ওয়ালী মেহসুদ টিটিপির প্রধান নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে আফগান তালেবান ও টিটিপির মাঝে দূরত্ব অনেক কমে এসেছে। নুর ওয়ালী মেহসুদ বিতর্কিত বিষয়গুলো পরিহার করে চলেন এবং বেসামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালাতে আগ্রহী নন। যাহোক, ২০২১ সালের আগস্টে তালেবান যখন কাবুলে ক্ষমতা দখল করে, তখন পাকিস্তান আফগান তালেবানদের টিটিপির বিরুদ্ধে দমননীতি করতে গ্রহণ করতে রাজি করাতে পারেনি। এর পরিবর্তে আফগান তালেবান পাকিস্তান এবং টিটিপির মধ্যে আলোচনার মধ্যস্থতা করেছিল। পাকিস্তান কয়েক ডজন টিটিপি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছিল। ২০২১ সালের নভেম্বরে আফগান তালেবানরা প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকার এবং টিটিপির মধ্যে এক মাসের যুদ্ধবিরতিতে সহায়তা করেছিল। তবে যুদ্ধবিরতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে টিটিপি আমির নূর ওয়ালি মেহসুদ যোদ্ধাদের ১০ ডিসেম্বর থেকে পাকিস্তানে তাদের আক্রমণ পুনরায় শুরু করতে বলেছিলেন। [44]
পাকিস্তানি তালেবানের আল কায়েদার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তারা পরস্পরে আর্থিক সহায়তা আদানপ্রদান করে এবং বোমা বিশেষজ্ঞ ও অস্ত্র নির্মাতা সদস্যেদর অদলবদল করে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ওবামার প্রধান সন্ত্রাস-দমন উপদেষ্টা জন ব্রেনান বলেন, 'এটি এমন একটি গোষ্ঠী যারা আল-কায়েদার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তারা একসাথে প্রশিক্ষণ দেয়, একসাথে পরিকল্পনা করে। তাদের প্রায় আলাদা করা যায় না।[45] ধারণা করা হয় যে, টিটিপি গঠনে আল কায়েদার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। টিটিপি আল কায়েদার কাছ থেকে আদর্শিক দিকনির্দেশনা নেয়। আল কায়েদা আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে পশতুন এলাকায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য টিটিপির উপর নির্ভর করে এবং টিটিপি আল কায়েদার জন্য একটি শক্তি গুণক।[26] মূলত সোভিয়েত আমলের সময় থেকে আল-কায়েদার কিছু কর্মী পশতুন এলাকায় নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং স্থানীয় সংস্কৃতিতে নিজেদেরকে সম্পূর্ণ জড়িয়ে ফেলেছিল এবং টিটিপি গঠনে তারা বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল।[46]
২০০৮ সালে বাইতুল্লাহ মেহসুদ দক্ষিণ ওয়াজিরিস্তানে আয়মান আল জাওয়াহিরির সাথে দেখা করেছিলেন। তখন পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেছিল, যে মেহসুদ আসলে একজন আল-কায়েদার অপারেটর। [47] ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাইতুল্লাহ মেহসুদ, হাফিজ গুল বাহাদুর এবং মৌলভি নাজির একটি বিবৃতি প্রকাশ করেন, যাতে তারা ওসামা বিন লাদেনের প্রতি তাদের আনুগত্যের বিষয়টি পুনরায় নিশ্চিত করেন।[48]
তবে বর্তমান টিটিপি নেতাদের সাথে আল কায়েদার সাংগঠনিক সম্পর্ক তেমন উন্নত নয় বলে ধারণা করা হয়। বিশেষত প্রধান আমির নূর ওয়ালী মেহসুদ আফগান তালেবানে প্রতি ঝুঁকে পড়ায় আল কায়েদার সাথে টিটিপি সম্পর্ক অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হয়।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.