Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ইহুদি গণহত্যার সময় লক্ষ লক্ষ ইহুদিগণকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যা করার উদ্দেশ্যে জার্মান নাৎসি বাহিনী কতিপয় নির্মূল শিবির ("মৃত্যু শিবির", "হত্যা কেন্দ্র" ইত্যাদি নামেও পরিচিত) নির্মাণ করে। এসব নির্মূল শিবিরে ইহুদি ছাড়াও অন্যেরা পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়, যেমন- পোলীয়, সোভিয়েত যুদ্ধবন্দী এবং রোমানিগণ। এসকল শিবিরের বন্দীদের হত্যার জন্য ব্যবহৃত হত বিষাক্ত গ্যাস, গ্যাস প্রয়োগের জন্যে শিবিরের স্থায়ী ব্যবস্থা থাকত নতুবা গ্যাস প্রয়োগ করা যায় এরূপ গাড়ির ব্যবস্থা থাকত।[1] কোন কোন নাৎসি শিবির যেমন অশউইৎজ এবং মাজদানেক শিবিরসমূহ দ্বৈত উদ্দেশ্য ব্যবহৃত হত: প্রথমত এর বন্দীদের গ্যাস প্রয়োগে হত্যার উদ্দেশ্যে এবং দ্বিতীয়ত অভুক্ত অবস্থায় কঠিন কায়িক শ্রমে বাধ্য করেও বন্দীদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হত।[1][2]
বন্দীদেরকে রেলগাড়িতে করে নির্মূলের উদ্দেশ্যে এই স্থায়ী স্থাপনাসমূহে নিয়ে যাওয়া হত। এই প্রক্রিয়ার প্রথম সূচনা হয় যখন নাৎসিরা অত্যন্ত গোপনীয়তার সাথে রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগ করে হাসপাতালের শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের নির্মূল করার উদ্যোগ নেয়, তাদের এই গোপন মানবহত্যা কর্মসূচির নাম ছিল "অ্যাকশন টি-৪"।[3][lower-alpha 1] মানবহত্যার এই প্রযুক্তিকে পরবর্তীতে আরো সমুন্নত ও সম্প্রসারিত করে যুদ্ধকালীন অপ্রস্তুত বন্দীদের ওপর প্রয়োগ করা হয়, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল ইহুদি, যারা ছিল এসকল হত্যা শিবিরে নিহত বন্দীদের শতকরা ৯০ ভাগ।[9] "৩য় রাইখ"-এর মতে ইহুদিদের গণহত্যা ছিল ইহুদি প্রশ্নের "চূড়ান্ত সমাধান"।[10] এ ঘটনাসমূহ একত্রে ইহুদি গণহত্যা বা হলোকাস্ট (Holocaust) নামে পরিচিত, যার কারণে ইহুদি ব্যতীত অন্যান্য আরো ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ নিহত হয়।[1][11]
এছাড়াও ক্রোয়েশিয়ার ক্ষমতাসীন ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী উস্তাসে কর্তৃকও নির্মূল শিবির স্থাপিত হয়, এই সরকারটি ছিল নাৎসিদের পুতুল সরকার বিশেষ, এবং এই শিবিরেও ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সার্ব, ইহুদি ও রোমানিদের হত্যা করা হয় এবং সরকারবিরোধী ক্রোয়াট ও মুসলিম বসনীয়দেরকেও এস্থানে হত্যা করা হত।[12]
১৯৩৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পোল্যান্ড আক্রমণের পরে নাৎসি এস. এস. বাহিনী গোপন "অ্যাকশন টি-৪" হত্যা কর্মসূচি আরম্ভ করে, যার দ্বারা তারা পরিকল্পিত ভাবে জার্মান, অস্ট্রীয় এবং পোলিশ হাসপাতালসমূহের মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের "যন্ত্রণাহীন মৃত্যু" (euthanasia)-এর ব্যবস্থা গ্রহণ করে; তাদের এই কর্মসূচির পেছনে এই মনোভাব ছিল যে, এসকল রোগীরা "বেঁচে থাকার অনুপোযুক্ত জীবনসত্ত্বা" (জার্মান: Lebensunwertes Leben), নাৎসিদের মতে যার অর্থ "যার বেঁচে থাকার অধিকার নেই"।[13][14] এসকল হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের গোপনভাবে হত্যা করে নাৎসিদের যে অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হয়েছিল, তাকে তারা কাজে লাগিয়েছিল ১৯৪১ সালে নির্মূল শিবিরসমূহ নির্মাণ করতে, এসকল শিবিরে দ্বারা তারা তাদের "চূড়ান্ত সমাধান" বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিল। এসময়ের পূর্বেই অধিকৃত পোল্যান্ডের সকল ইহুদিদেরকে বিভিন্ন বেড়াজালে ঘেরা বস্তিসমূহে (ghettos) বন্দী করা হয়েছিল এবং নাৎসিদের নির্যাতন শিবিরসমূহে আটক করা হয়েছিল, তাদের সাথে অন্যান্য শ্রেণীর বন্দীরাও ছিল, যেমন রোমানি ও সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীগণ। বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে সকল ইহুদিদের নিধনের জন্যে নাৎসিদের Endlösung der Judenfrage (ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান) কর্মসূচি প্রথম আরম্ভ হয়েছিল অপারেশন রাইনহার্ডের সময়,[15] যার সূত্রপাত হয় ১৯৪১ সালের জুন মাসে, যখন নাৎসি-সোভিয়েত যুদ্ধ পুরোদমে আরম্ভ হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের জন্যে গ্যাস প্রয়োগ প্রযুক্তি প্রয়োগের পূর্বেও এস. এস. বাহিনী (Einsatzgruppen বাহিনী) বিভিন্ন পদ্ধতিতে তাদের হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে থাকত।[16] "অপারেশন বারবারোসা" সংঘটিত হবার পর এরা জার্মান মূল সেনাবাহিনী (Wehrmacht)-কে অনুসরণ করে পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকত।[17]
১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মান পুলিশ অধিকর্তা রাইনহার্ড হাইনরিখের পরিচালনায় ওয়ানসি সম্মেলনে (Wannsee Conference) নাৎসিরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে ইউরোপের সকল ইহুদিদের নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে। এই কর্মসূচির প্রশাসনের দায়দায়িত্ব দেয়া হয় এস. এস. অফিসার অ্যাডল্ফ আইখম্যানকে।[18]
১৯৪১ সালের ১৩ই অক্টোবরে এস.এস. বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হাইনরিখ হিমলার কর্তৃক লুবলিন কারাগারে নিযুক্ত পুলিশ প্রধান ওডিলো গ্লোবচ্নিককে হত্যাকাণ্ডের জন্য জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডের বেলজেকে প্রয়োজনীয় স্থাপনা নির্মাণের মৌখিক আদেশ দেয়া হয়, মস্কোর যুদ্ধ সন্নিকটে এই আশংকায় হিমলার এ আদেশ দেন। একথা উল্লেখযোগ্য যে, এই আদেশ দেয়া হয় ওয়ানসি সম্মেলনের ৩ মাস পূর্বে।[19] তবে, ডিসেম্বর মাসেই পোল্যান্ডের লোড্জ নগরীর পূর্বে কুল্মহফ গ্রামে গ্যাস-ভ্যানসমূহ দ্বারা হত্যাকাণ্ড আরম্ভ হয়ে যায়, যার কর্তৃত্বে ছিলেন এস.এস. অফিসার হারবার্ট ল্যাঙ্গ।[20] ১৯৪২ সালের মার্চ মাসেই বেলজেক শিবিরে হত্যাকাণ্ড শুরু হয়ে যায়, এর নেতৃত্বে থাকে জার্মান কর্মকর্তারা যারা প্রকৌশলী সংগঠন (Organisation Todt)-এর বেশে পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছিল।[19] ১৯৪২ সালের মাঝামাঝি অপারেশন রাইনহার্ডকে সামনে রেখে পোল্যান্ডে আরো ২টি মৃত্যু শিবির স্থাপিত হয়: সোবিবোর শিবির (১৯৪২ সালের মে মাসে স্থাপিত, কর্তৃত্ব: অফিসার ফ্রান্জ স্টাঙ্গল্) এবং ট্রেব্লিংকা শিবির (১৯৪২ সালের জুলাই মাসে স্থাপিত, কর্তা: "অ্যাকশন টি-৪" এর অফিসার ইর্মফ্রেড এবার্ল, যিনি ছিলেন এরকম হত্যা শিবিরে দায়িত্বরত একমাত্র চিকিৎসক)।[21] ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে অশউইৎজ্ শিবিরে সংযোজিত হয় অত্যাধুনিক গ্যাস প্রয়োগের ব্যবস্থা সংবলিত বাংকার।[22] মাজদানেকে এসব বাংকার স্থাপিত হয় সেপ্টেম্বরে।[23]
নাৎসিরা নির্মূল শিবির ও যুদ্ধবন্দী শিবিরসমূহকে পৃথক রাখত, যদিও "নির্মূল শিবির" (Vernichtungslager) এবং "মৃত্যু শিবির" (Todeslager) শব্দদুটি সমার্থক ছিল। দু'টি শব্দ দ্বারাই বোঝান হত গণহত্যায় ব্যবহৃত বন্দীশালাসমূহকে। "মৃত্যু শিবির"সমূহ ব্যবহৃত হত রেলগাড়ি করে নিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক মানুষকে একত্রে হত্যা করার জন্যে। বেলজেক, সোবিবোর এবং ট্রেব্লিংকা শিবিরের বন্দীদের কয়েক ঘণ্টার বেশি বাঁচিয়ে রাখা হত না।[25] রাইনহার্ড কর্মসূচির নির্মূল শিবিরসমূহ গ্লোবচ্নিকের প্রত্যক্ষ কর্তৃত্বে ছিল। প্রতিটি নির্মূল শিবিরে কর্মরত থাকত এস. এস. বাহিনীর শাখা ('SS-Totenkopfverbände)-এর ২০ থেকে ৩৫ জন সদস্য এবং তাদের দোসর প্রায় একশত ট্রনিকি সহকারী সদস্য, প্রধানত সোভিয়েত ইউক্রেনের অধিবাসী, এবং প্রায় এক হাজার "সন্ডারকোমান্ডো", বা বন্দীদের মধ্যে যাদেরকে দাসবৃত্তিতে বাধ্য করা হত।[26] জার্মান পুলিশ বাহিনী "অর্পো" এবং "শ্যুপো" ঘেটোসমূহ থেকে জোরপূর্বক ইহুদি নারী-পুরুষ এবং শিশুদের সংগ্রহ করে এসব শিবিরে "বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের" জন্যে নিয়ে আসত।[27]
জার্মানির নিজস্ব ভূখন্ডে মৃত্যু শিবির এবং বন্দী শিবিরসমূহ পৃথক ছিল, যেমন- বের্গেন শিবির, ওরানিয়েনবার্গ শিবির, রেভেন্সব্রুক শিবির এবং স্যাশেনহাউসেন বন্দীশালা; ২য় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেই, "অবাঞ্ছিত"দের হত্যা করার উদ্দেশ্যে এই শিবিরগুলো স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৩৬ সালের মার্চ মাস থেকে নাৎসি বন্দী শিবিরসমূহ পরিচালনা করত এস. এস. বাহিনীর শাখা এস. এস. টোটেনকফারব্যান্ড (SS-Totenkopfverbände) (খুলি চিহ্নিত এস.এস.টি.ভি. সদস্যরা), ১৯৪১ সালে স্থাপিত নির্মূল শিবিরগুলোও এরাই পরিচালনা করত।[28] ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরে এস.এস. বাহিনীর একজন শরীরবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ড. জোহান ক্রেমার এসব নির্মূল শিবিরের হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করে তাঁর ডায়েরীতে লিখেন: "এর তুলনায় দান্তের ইনফার্নোর কাহিনী প্রায় রম্যরচনার মত শোনায়। অশউইৎজ্ শিবিরকে তারা এমনি এমনি নির্মূল শিবির নাম দেয়নি!"[29] ন্যুরেমবার্গের বিচারে এসব তথ্য স্পষ্ট হয়ে আসে, অ্যাডল্ফ আইখম্যানের ডেপুটি ডিটার উইসলিকেনিকে "নির্মূল" শিবিরসমূহের নাম সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি অশউইৎজ্ এবং মাজদানেকের নাম উল্লেখ করেন। তারপর তাকে প্রশ্ন করা হয়, "আপনি মাউটহাউসেন, ডাচাউ এবং বুকেনওয়াল্ড শিবিরগুলোকে কী বলে আখ্যায়িত করেন?", এর উত্তরে তিনি বলেন, "এগুলো স্বাভাবিক বন্দী শিবির ছিল, আইখম্যানের দৃষ্টিকোণ থেকে।"[30]
নির্মূল শিবিরসমূহে হত্যাকাণ্ডের শিকার ছাড়াও জার্মানরা লক্ষ লক্ষ বিদেশীদের আটক করে নির্মূল শিবির সহ বিভিন্ন শিবিরে জোরপূর্বক শ্রমদান করতে বাধ্য করে, [31] যাতে করে নির্মূল শিবিরগুলো লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়।[32] রাইখ (নাৎসি শাসন)-এর মোট শ্রমশক্তির এক-চতুর্থাংশই ছির এর বন্দীরা। অনাহার, রোগবালাই, ক্লান্তি, খুন এবং শারীরিক নির্যাতনে এসব বন্দীদের শতকরা ৭৫ ভাগই মৃত্যুবরণ করেন।[31]
২য় বিশ্বযুদ্ধের প্রথম দিকে ইহুদিদেরকে কয়েদ শিবির এবং ঘেটোসমূহে পাঠানো হত এবং বন্দী করা হত, কিন্তু ১৯৪২ সাল থেকে তাদেরকে "পুনর্বাসনের" নাম করে নির্মূল কেন্দ্রসমূহে পাঠানো হতে থাকে। রাজনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত কারণে নাৎসিদের সবচেয়ে কুখ্যাত মৃত্যু শিবিরসমূহ স্থাপিত হয় জার্মান অধিকৃত পোল্যান্ডে, যেখানে তাদের নিধনের শিকার অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। নাৎসি জার্মানির দখলকৃত ইউরোপের মধ্যে পোল্যান্ডেই সর্বাধিক ইহুদির বসবাস ছিল।[33] তাছাড়া ৩য় রাইখের যুদ্ধপূর্ব সীমান্তের বাইরে যেসমস্ত শিবির ছিল সেগুলো বেসামরিক জার্মান নাগরিকদের নজরের বাইরে রাখা সুবিধাজনক হয়।[34]
"চূড়ান্ত সমাধান"-এর প্রাথমিক পর্যায়ে দখলকৃত সোভিয়েত ইউনিয়নে এবং চেলেম্নো শিবিরে গ্যাস ভ্যান নির্মাণ করা হয়, যার ভেতরে বিষাক্ত গ্যাস নিঃসৃত করার ব্যবস্থা থাকত, পরে এসমস্ত ভ্যান অন্যত্র ব্যবহারের জন্যেও নিয়ে যাওয়া হয়। এস.এস. বাহিনী তাদের গোপনীয় "অ্যাকশন টি-৪" কর্মসূচি পরিচালনা কালে তারা দ্রুত মানবহত্যার যে পদ্ধতিসমূহ রপ্ত করেছিল তা তারা পরবর্তিতে কাজে লাগায়। ইহুদি গণহত্যার জন্যে দুই প্রকার পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়।[15]
অশউইৎজ্ শিবিরে রেলগাড়ি ভর্তি বন্দীদের হত্যার জন্যে সায়ানাইড ভিত্তিক বিষাক্ত গ্যাস জাইক্লন-বি ব্যবহৃত হত, বন্দীদেরকে "পুনর্বাসনের" ছলে রেলগাড়িতে উঠানো হত। অপারেশন রাইনহার্ডের সময় নির্মিত (১৯৪১ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৪৩ সালের নভেম্বর এর মধ্যে) ট্রেবলিংকা, বেলজেক ও সোবিবোর শিবিরে বিপুল পরিমাণে ধোঁয়া উৎপন্ন করার জন্যে ব্যবহৃত হত অন্তর্দাহ ইঞ্জিন (Internal combustion engine)। অপারেশন রাইনহার্ডের তিনটি শিবির নির্মাণের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল পোল্যান্ডের ইহুদি জনগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ নির্মূল করা, যারা নাৎসি ঘেটোসমূহে আটক হয়েছিল।[35] প্রথম প্রথম মৃতদেরকে বিশালাকার খননযন্ত্র (excavator)-এর সাহায্যে গণকবর দেয়া হত, পরবর্তীতে মৃতদেহসমূহ গণহারে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে ফেলা হয় যাতে গণহত্যার কোন চিহ্ন না থাকে, এই প্রক্রিয়ার নাম দেয়া হয় সোন্ডারঅ্যাকশন ১০০৫।[36][37]
অশউইৎজ্-বিরকেনাউ এবং মাজদানেক শিবিরদুটি ছিল নির্মূল শিবির ও কয়েদ ঘাঁটির সংমিশ্রণ। কিন্তু চেলেম্নো শিবির অপারেশন রাইনহার্ডের শিবিরসমূহ নির্মিত হয়েছিল শুধুমাত্র বিপুল সংখ্যক মানুষকে (মূলতঃ ইহুদিদের) অতি দ্রুত হত্যা করার উদ্দেশ্যে, এসব শিবিরে আগমনের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বন্দীদের হত্যা করা হত। এসমস্ত শিবিরসমূহ নির্মিত হয়েছিল পোলিশ রেললাইনসমূহের কাছাকাছি, যাতে শিবিরের কর্মচারীরা দ্রুত এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যাতায়াত করতে পারে। এই শিবিরগুলোর নকশা প্রায় অবিকল ছিল: দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে তারা কয়েক শত মিটার হত, কর্মচারীদের থাকা এবং যন্ত্রপাতিসমূহ রাখার জন্যে অল্পকিছু দালান ছিল, হাজার হাজার বন্দী রাখার মত কোন স্থান সংকুলান ছিল না, হতভাগ্য বন্দীদের রেলগাড়ির কামরাগুলোতে ঠাসাঠাসি করে ঢোকানো হত।[38][39]
বন্দীরা শিবিরে পৌঁছানোর পর নাৎসিরা তাদের সাথে ছলনা করত, তাদের বলা হত এটি একটি অস্থায়ী যাত্রাবিরতি, এবং শীঘ্রই তারা জার্মান কয়েদ ঘাঁটিতে রওনা দেয়ার জন্যে পূর্বদিকে যাত্রা শুরু করবে।[40] শক্তিশালী দেখে কয়েকজন বন্দীকে বাছাই করা হত, তাদেরকে সাথে সাথে হত্যা করা হত না, বরং তাদেরকে জোরপূর্বক "সোন্ডারকমান্ডো" নামক শ্রমিক দলে ভেড়ানো হত। অতঃপর তাদেরকে দিয়ে নিহত বন্দীদের মৃতদেহসমূহ গ্যাস প্রকোষ্ঠ থেকে সরিয়ে সেগুলো পোড়ানো হত।
অপারেশন রাইনহার্ডে ব্যবহৃত শিবিরসমূহ যেমন: বেলজেক, সোবিবোর এবং ট্রবলিংকা শিবিরে রেলগাড়ি ভর্তি বন্দীদের আগমনের সাথে সাথে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্যাস প্রকোষ্ঠে নিয়ে যাওয়া হত, এভাবেই শিবিরগুলোর নকশা করা হয়েছিল।[15] অশউইৎজ-২ বিরকেনাউ শিবিরের হত্যা কেন্দ্রসমূহ একই সময়ে নির্মিত হয়, এগুলো তৈরি করা হয় কয়েদখানার একটি অংশ হিসেবে,[41] এবং মাজদানেক বন্দী শিবিরেও অনুরূপ হত্যাকেন্দ্র নির্মিত হয়।[15] অন্যান্য অধিকাংশ শিবিরে বন্দীদের প্রথমে জোরপূর্বক কয়েদ খাটানো হয়; তাদেরকে অনাহারে-অর্ধাহারে রেখে প্রয়োজনমত কয়েদ খাটানো হয়। অশউইৎজ্, মাজদানেক এবং জাসেনোভাক শিবিরে পৃথকভাবে জাইক্লন-বি গ্যাস প্রকোষ্ঠ এবং দাহন ভবন যুক্ত করা হয়, এসকল স্থানে ১৯৪৫ সালে যুদ্ধের শেষ পর্যায় অবধি হত্যাকাণ্ড চলতে থাকে।[42] সোভিয়েত ইউনিয়নে নির্মিত ম্যালি ট্রস্টনেট্স শিবিরটি প্রথমে বন্দীশালা ছিল। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে যখন বন্দীদেরকে গণহারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল, তখন এটিকেও হত্যা শিবির বানানো হয়। ১৯৪৩ সালের অক্টোবর থেকে এই শিবিরে গ্যাস নিঃসৃত করার ব্যবস্থাযুক্ত ভ্যানগাড়ি ব্যবহৃত হত।
যুগোস্লাভিয়ায় নাৎসি বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত সাজমিস্তে বন্দীশালায় ১৯৪২ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত এরূপ একটি গ্যাস-গাড়ি ব্যবহারের জন্যে প্রস্তুত থাকে। গণহারে হত্যাকাণ্ড সম্পন্ন হলে গাড়িটি বার্লিনে ফেরত পাঠানো হয়। ভ্যানগাড়িটি মেরামত করে এরপর ম্যালি ট্রস্টনেট্স শিবিরে পাঠানো হয় সেখানে ব্যবহারের জন্যে। তৎকালীণ অধিকৃত পোল্যান্ডের লেভিভ নগরীর নিকটস্থ জানোস্কা বন্দী শিবিরে বন্দীদেরকে একটি প্রক্রিয়ায় বাছাই করা হত। কিছু বন্দীদের মৃত্যুর আগে কয়েদ খাটানোর জন্যে বাঁচিয়ে রাখা হত। অন্যদেরকে হয় হত্যার উদ্দেশ্যে বেলজেক শিবিরে পাঠানো হত অথবা শিবিরের পেছনে পাহাড়ি ঢালে (পিয়স্কি পাহাড়ে) নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হত। ওয়ারস' বন্দী শিবিরটি ছিল কয়েকটি জার্মান বন্দীশালার সমষ্টি, সম্ভবত এদের মধ্যে একটি ছিল নির্মূল শিবির, যার অবস্থান ছিল জার্মান অধিকৃত ওয়ারস' নগরীতে। এই শিবিরটির সংক্রান্ত খুঁটিনাটি তথ্য নিয়ে বিতর্ক রয়েছে এবং এটি ঐতিহাসিক গবেষণার বিষয়।
নাৎসি জার্মানি এবং ফ্যাসিবাদী ইতালির সহায়তায় ১৯৪১ সালের ১০ই এপ্রিল সংগঠিত হয় "স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্র" (Independent State of Croatia), এবং তারাও নাৎসিদের অনুরূপ বর্ণবাদী ও রাজনৈতিক নীতি গ্রহণ করে। ফ্যাসিবাদী উস্তাসে সরকার কর্তৃক কয়েকটি হত্যা শিবির স্থাপিত হয়, যা নাৎসিদের "ইহুদি সমস্যার" "চূড়ান্ত সমাধান" বাস্তবায়নে সহায়তা করে, এসব শিবির রোমানি ও সরকারবিরোধীদের নির্মূল করতে ব্যবহার করা হয়। তবে এসকল শিবিরের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্রোয়েশিয়ায় অবস্থানরত সার্ব জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা।[43][44] সার্বদের প্রতি এই ফ্যাসিবাদী সরকার যে নির্মম আচরণ করেছিল তা জার্মানদের পর্যন্ত অভিভূত করে।[45][46]
ক্রোয়েশিয়ার গসপিচ নগরী থেকে ২০ কি.মি. দূরে একটি জনমানবহীন স্থানে নির্মিত হয় জাদোভ্নো বন্দী শিবির। এই শিবিরে ১৯৪১ সালের মে থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত টানা ১২২ দিন হাজার হাজার ইহুদি ও সার্বদের আটক রাখা হয়। বহু বন্দীকে নিকটস্থ গভীর খাদে ধাক্কা দিয়ে ফেলে হত্যা করা হয়।[47]
পরে জাদোভ্নো শিবিরের পরিবর্তে জাসেনোভাক বন্দী শিবিরটি ব্যবহৃত হয়, যা আবার ৫টি উপশিবিরে বিভক্ত ছিল। জাসেনোভাক শিবিরে আগত বহু বন্দীদেরকে হত্যার উদ্দেশ্যে নিয়ে আসা হত। বন্দীদের শাস্তির মেয়াদের ওপর ভিত্তি করে তাদেরকে হত্যা করা হত। শক্তসামর্থ্য বন্দী, যাদের শাস্তির মেয়াদ তিন বছরের কম, তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখা হত। যেসকল বন্দীদের শাস্তির মেয়াদ তিন বছরের ঊর্ধ্বে, তারা শক্তসামর্থ্য হলেও তাদের হত্যা করা হত।[48] কখনো কখনো নাৎসিদের ন্যায় নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গণহত্যা পরিচালিত হত। কখনো কখনো বন্দীদেরকে মুগুর দ্বারা প্রহার করে কিংবা কৃষিকাজে ব্যবহৃত ছুরি দ্বারা কুপিয়ে হত্যা করা হত, কোন কোন বন্দীদেরকে ঠেলে সাভা নদীর খাদের প্রান্ত থেকে নিক্ষেপ করা হত।
হাইনরিখ হিমলার ১৯৪১ সালে মিনস্ক নগরীর উপকণ্ঠে গুলি করে গণহত্যা পরিদর্শন করতে আসেন। এসময় দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার তাকে বলেন এ প্রকারের গুলি করে হত্যাকাণ্ডে যারা বন্দুকের ঘোড়া চাপছে তারা মানসিকভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। তাই হিমলারের গণহত্যা পরিচালনার অপর কোন প্রক্রিয়া উদ্ভাবনের কথা উপলব্ধি হয়।[49] যুদ্ধের পরে অশউইৎজ্ এর একজন অধিনায়ক রুডল্ফ হোস-এর ডায়েরিতে তিনি লেখেন যে, মানসিকভাবে "রক্তের মাঝে সাঁতার কাটা আর সহ্য হচ্ছে না।" নির্মূল শিবিরসমূহে নিযুক্ত জার্মান কর্মকর্তাগণ(Einsatzkommando)-এর অনেকেই পরবর্তী সময়ে উন্মাদ হয়ে পড়েন এবং অনেকে আত্মহত্যা করেন।[50]
নাৎসিরা কার্বন মনো অক্সাইড সিলিন্ডার ব্যবহার করে ৭০,০০০ প্রতিবন্ধীকে হত্যা করে এবং এ কর্মসূচির নাম দেয় "যন্ত্রণাহীণ মৃত্যু প্রোগ্রাম" (euthanasia programme), যাতে গণহত্যার সংবাদকে ধামাচাপা দেয়া যায়। কার্বন মনো-অক্সাইডের প্রাণঘাতী প্রভাব সত্ত্বেও এই গ্যাস পূর্বাঞ্চলসমূহে ব্যবহৃত হয়নি, কারণ এই গ্যাস সিলিন্ডারে করে পরিবহন করা ব্যয়সাপেক্ষ ছিল।[49]
প্রতিটি নির্মূল শিবির ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় পরিচালিত হলেও প্রত্যেকটিতে দ্রুত এবং কার্যকরভাবে গণহত্যা সংঘটিত করার ব্যবস্থা ছিল। ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসে হোস একটি আনুষ্ঠানিক ভ্রমণে গমন করলে তার স্থলাভিষিক্ত কর্মকর্তা কার্ল ফ্রিত্জ একটি নতুন পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখেন। অশউইত্জ কারাগারে ছারপোকায় আক্রান্ত পোশাকসমূহ দানাদার প্রুসিক এসিড দ্বারা ধৌত করে ছারপোকা নিধন করা হত। এই দানাদার স্ফটিকসমূহ ক্রয় করা হত আই.জি. ফ্যার্বেন কেমিক্যাল কোম্পানী থেকে। এই পণ্যের বাণিজ্যিক নাম ছিল জাইক্লন-বি। এই জাইক্লন-বি স্ফটিক তার পাত্র থেকে বের করা হলে তা বাতাসে বিষাক্ত সায়ানাইড গ্যাস ছড়াত। কার্ল ফ্রিত্জ এই জাইক্লন-বি এর প্রতিক্রিয়া সোভিয়েত যুদ্ধবন্দীদের ওপর প্রয়োগ করে, এ পরীক্ষার জন্য বন্দীদের মাটির নিচের একটি বদ্ধ কক্ষে আটক করা হয়। হোস তার ভ্রমণ থেকে এই গ্যাসটির কার্যকারিতার কথা শুনে অভিভূত হন এবং এর পর থেকে মৃত্যু শিবিরটিতে এই পদ্ধতিতেই হত্যাকাণ্ড চালানো হয়, মাজদানেক শিবিরেও এই পদ্ধতি গৃহীত হয়। গ্যাস প্রয়োগ ছাড়াও শিবির রক্ষীরা বন্দীদের গুলি করে, উপবাস করিয়ে, নির্যাতন করে ইত্যাদি উপায়ে হত্যা করে থাকত।[51]
ওয়াফেস এস.এস. বাহিনীর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সংস্থার কর্মকর্তা (Obersturmführer) কার্ট গারস্টেইন একজন সুইডিশ কুটনীতিবিদকে মৃত্যু শিবিরে যুদ্ধকালীন তার জীবন সম্পর্কে বলেন, ১৯৪২ সালের ১৯ আগস্ট তারিখে তিনি প্রথম বেলজেক নির্মূল শিবিরে আগমন করেন (যেখানে কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস প্রকোষ্ঠ ছিল)। এর পর তাকে একটি রেলগাড়ির ৪৫টি বগি থেকে ৬,৭০০ জন ইহুদিদের নামাতে দেখেন, যাদের অনেকেই ছিল মৃত। জীবিতদের উলঙ্গ অবস্থায় গ্যাস প্রকোষ্ঠে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে:
এস.এস. কর্মকর্তা (Unterscharführer) হ্যাকেনবোল্ট ইঞ্জিনটি চালু করার সচেষ্ট প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু তা চালু হচ্ছে না। ক্যাপ্টেন উইর্থ এগিয়ে এলেন। আমি দেখতে পেলেন তিনি বেশ ভীত, কারণ আমি একটি বিপর্যয়কে সাক্ষ্য করছি। হ্যাঁ, আমি এসবই দেখছি এবং অপেক্ষা করছি। আমার থামা-ঘড়ি দেখাচ্ছে, ৫০ মিনিট, ৭০ মিনিট, কিন্তু ডিসেল ইঞ্জিন চালু হচ্ছে না। গ্যাস প্রকোষ্ঠের ভেতরে লোকজন দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। অনেকে কাঁদছে, "সিনাগগে যেমনটা হয়", বললেন প্রফেসর ফ্যানেস্টীল, তাঁর চোখজোড়া কাঠের দরজার জানলায় সেঁটে আছে। রাগন্বিত হয়ে ক্যাপ্টেন উইর্থ হ্যাকেনবোল্টের সহকারী ইউক্রেনীয় ট্রনিকি সদস্যটির মুখের ওপর ধমক দিয়ে যাচ্ছেন, বারো, তেরো বার। দুই ঘণ্টা ৪৯ মিনিট পর -থামাঘড়ি অনুসারে- ডিজেল ইঞ্জিন চালু হয়ে উঠল। এই পুরো সময়টিতে প্রকোষ্ঠে ঠাসাঠাসি করে থাকা মানুষগুলো জীবিত রইল, ৪ গুণন ৭৫০ জন মানুষ, ৪ গুণন ৪৫ ঘনমিটার আয়তনে। আরো ২৫ মিনিট কেটে গেল। অনেকেই এতক্ষণে মারা পড়েছে, জানলা দিয়ে তা দেখা যাচ্ছে, একটি বৈদ্যুতিক বাতি কয়েক মুহূর্তের জন্য কক্ষটিকে আলোকিত করছিল। ২৮ মিনিট অতিক্রম করার পর শুধু অল্প কিছু সংখ্যক জীবিত ছিল। অবশেষে ৩২ মিনিট পেরোবার পর সকলেই মৃত্যুবরণ করল। দন্তবিশেষজ্ঞরা এরপর মৃতদের বাধাই করা সোনার দাঁত, দাঁত বন্ধনী, দাঁতের টুপি ইত্যাদি খুলে নিতে লাগল। তাদের মধ্যে দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যাপ্টেন উইর্থ। তাকে বেশ পুলকিত দেখাচ্ছিল, তিনি আমাকে কৌটাভর্তি নকল দাঁত দেখিয়ে বললেন, "দেখুন, এই সোনার ওজন কত নিজেই তুলে দেখুন! এটা শুধু গতকাল আর পরশুর সংগ্রহ। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না প্রতিদিন আমরা কি খুঁজে পাই- ডলার, হীরা, সোনা। আপনি নিজেই দেখবেন!" — কার্ট গারস্টেইন [52]
অশউইত্জ শিবির অধিনায়ক রুডল্ফ হোস বলেন, যখন জাইক্লন-বি বড়িসমূহ[53] ইহুদিদের ওপর প্রথমবার ব্যবহৃত হচ্ছিল, তাদের অনেকে সন্দেহ করেছিল যে তাদের হত্যা করা হতে যাচ্ছে, যদিও তাদের এই বলে ধোঁকা দেয়া হয় যে তাদেরকে উকুনমুক্ত করার জন্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে[53] এবং এর পরে তারা আবার শিবিরে ফিরে আসবে। এ কারণে নাৎসিরা অন্যদের সতর্ক করে দিতে পারে- এমন "আশংকাজনক ব্যক্তিদের" ভিড়ের মধ্য থেকে সরিয়ে ফেলে। তারা এই আশংকা করে যে এসকল ব্যক্তি অন্য যারা ধোঁকার শিকার হয়েছে তাদেরকে সতর্ক করে বন্দীদের মাঝে বিদ্রোহের সূচনা করবে। এই "আশংকাজনক ব্যক্তি"দেরকে অন্যদের দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে নিশ্চুপে হত্যা করা হয়।
নির্মূলীকরণ প্রক্রিয়ায় বন্দীদের একটি বিশেষ অংশ "সোন্ডারকোমান্ডো"(Sonderkommando)-কে কাজে লাগানো হত; তারা ইহুদিদের নগ্ন হয়ে নির্ভয়ে কক্ষসমূহে প্রবেশ করতে উৎসাহিত করত। বন্দীদের সাথে তারা গ্যাস কক্ষে প্রবেশ করত যেগুলো গোসলখানার মত সাজানো থাকত (অকেজো পানির নল, ঝর্ণা, টাইলযুক্ত দেয়াল ইত্যাদি লাগানো থাকত); এবং কক্ষসমূহের দরজা বন্ধ করার ঠিক আগ পর্যন্ত তারা বন্দীদের সাথে থাকত। এই গোসলখানার ছলটি যাতে শান্তশিষ্টভাবে সম্পন্ন করা যায় তা নিশ্চিত করতে কক্ষের দরজায় একজন এস.এস. সদস্য দাঁড়িয়ে থাকত। সোন্ডারকোমান্ডোরা অন্য বন্দীদেরকে শিবিরের ভেতর তাদের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের মিথ্যা কাহিনী শুনাত যাতে তারা আশ্বস্ত হয় এবং এভাবে ছলে-বলে-কৌশলে বন্দীদেরকে গ্যাস প্রকোষ্ঠে ঢোকানো হত, এমনকি তারা বৃদ্ধ ও শিশুদেরকেও একইভাবে বিবস্ত্র হতে নির্দেশ দিত।[54]
তদুপরি বন্দীদেরকে মিথ্যা আশ্বাস দেয়ার জন্যে "সোন্ডারকোমান্ডো"রা তাদের সাথে তাদের বন্ধু ও পরিবার সম্পর্কে গল্পগুজব চালিয়ে যেত, যারা তাদের পূর্বে এসব শিবিরে আগমন করেছিল। বন্দীদের মধ্যে অনেক মায়েরা তাদের সন্তানদেরকে কাপড়ের নিচে লুকিয়ে রাখত এই ভয়ে যে, গোসলখানায় ব্যবহৃত এই "উকুননাশক" পদার্থ তাদের ক্ষতি করতে পারে। শিবির অধিনায়ক হোস এই বর্ণনা দেন যে, "বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের সদস্যরা এদিকে বিশেষ খেয়াল রাখত", যেন মায়েরা তাদের সন্তানদের সহ "গোসলখানা" কক্ষে প্রবেশ করে। এমনকি "সোন্ডারকোমান্ডো"রা কিছুটা বয়স্ক এমন শিশুদের সান্ত্বনা দিত যাতে তারা বিবস্ত্র হবার সময় ভীত না হয়ে পড়ে।[55]
এতদসত্ত্বেও সব বন্দী এসব মনস্তাত্ত্বিক প্রতারণায় প্রতারিত হত না; অধিনায়ক হোস ইহুদিদের মধ্যে এমন ব্যক্তিদের কথা বলেন যারা "ধারণা করতে পেরেছিল অথবা জানত তাদের কী পরিণতি হতে যাচ্ছে, তবুও তারা তাদের সন্তানদের সাথে ঠাট্টাচ্ছলে কথা বলে এবং সান্ত্বনা দেয়, যদিও তাদের নিজেদের চোখে আতঙ্ক ও মৃত্যুভয় প্রস্ফুটিত হয়।" কিছু নারীগণ "বিবস্ত্র হবার সময় বিকটস্বরে বিলাপ করতে থাকে, কেউ কেউ মাথার চুল ছিঁড়তে থাকে অথবা উদ্ভ্রান্তের মত চিত্কার করতে থাকে; "সোন্ডারকমান্ডো" সদস্যরা সাথে সাথে তাদেরকে বাইরে নিয়ে যায় এবং গুলি করে হত্যা করে।[56] এমতাবস্থায় কেউ কেউ গ্যাস প্রকোষ্ঠের দ্বারপ্রান্তে এসে "তাদের নিজেদের জীবন বাঁচাতে তাদের সমাজের লুকিয়ে থাকা সদস্যদের পরিচয় ফাঁস করে দিতে থাকে।"[57]
বন্দীদের গ্যাস কক্ষে প্রবেশ করিয়ে এর দরজা সেঁটে আটকিয়ে দেয়া হয়, অতঃপর জাইক্লন-বি এর বড়ি ছাদে অবস্থিত কিছু বিশেষ ছিদ্রপথে কক্ষের ভেতর ফেলে দেয়া হয়। নিয়ম ছিল যে, ছিদ্রপথে গ্যাস নিঃসরণ এবং পরবর্তীতে মরদেহ লুন্ঠনসহ সব কর্মকাণ্ড তত্বাবধান করবেন শিবিরের অধিনায়ক। হোস আরো উল্লেখ করেন যে, গ্যাস প্রয়োগে নিহতদের মরদেহে "কোন খিঁচুনিজাতীয় প্রভাব দেখা যেত না"; অশউইত্জ এর চিকিত্সকগণ এর এই ব্যাখ্যা দেন যে জাইক্লন-বি গ্যাস "ফুসফুসকে অবশ করে দেয়", যা ভুক্তভোগীর দেহে খিঁচুনি শুরু হবার পূর্বেই তার মৃত্যু ঘটিয়ে থাকে।[58]
রাজনৈতিক প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে উচ্চপদস্থ নাৎসি নেতা এবং এস.এস. কর্মকর্তাদেরকে অশউইত্জ্-বিরকেনাউ শিবিরের গ্যাস প্রয়োগে হত্যাকাণ্ড পর্যবেক্ষণের জন্যে পাঠানো হত; হোস বলেন, "এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে সবাই অভিভূত হয়ে পড়ে। যারা এসমস্ত নির্মূল শিবিরের গুরুত্বের পক্ষে জোর গলায় কথা বলত, তারাও এই 'ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান' চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করার পর চুপ হয়ে যায়।" যদিও অশউইত্জ্ শিবিরের অধিনায়ক রুডল্ফ হোস এই গণহত্যার পক্ষে এই বলে অবস্থান নেন যে- হিটলারের নির্দেশ তিনি দৃঢ় সংকল্পের সাথে পালন করছেন, তিনি বুঝতে পারেন যে, "অ্যাডল্ফ আইখম্যানের মত জাঁদরেল মানুষও আমার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতে চেতেন না।"[60]
গ্যাস প্রয়োগে হত্যাকাণ্ড শেষে "সোন্ডারকোমান্ডো" সদস্যরা গ্যাস প্রকোষ্ঠগুলি থেকে মরদেহসমূহ সরিয়ে ফেলে, কোন স্বর্ণের দাঁত থাকলে সেগুলো খুলে নেয়া হয়। প্রথমদিকে মরদেহ গুলোকে গণকবর দেয়া হত, কিন্তু পরবর্তীতে "সোন্ডারঅ্যাকশন ১০০৫" কর্মসূচি চলাকালে রাইনহার্ডের অন্তর্ভুক্ত শিবিরসমূহে মরদেহ দাহন করা হয়।
"সোন্ডারকোমান্ডো" সদস্যদের দায়িত্ব ছিল অগ্নিকুন্ডে মরদেহসমূহ পোড়ানো,[61] আগুন তাতিয়ে দেয়া, মরদেহের অতিরিক্ত চর্বি অপসারণ এবং "জলন্ত মরদেহের পাহাড়কে উল্টে দেয়া যাতে বায়ুপ্রবাহে আগুনের শিখা আরো জ্বলে ওঠে", অধিনায়ক হোস পোল্যান্ডের জেলখানায় বসে তার স্মৃতিকথায় এমনটাই বর্ণনা দেন।[61] বন্দীদের এই তথাকথিত "বিশেষ বিভাগের" কর্মতত্পরতা দেখে তিনি বিস্মিত হন, কারণ এই কর্মীরা জানত যে তাদের শেষ পরিণতিও এরূপই হবে।[61] ল্যাজারেট হত্যাকেন্দ্র এ কর্মীরা অসুস্থ বন্দীদের এমনভাবে ধরে রাখত যেন তাদের গুলি করার সময় তারা বন্দুকের নল না দেখতে পারে। এসব কর্মীদের কাজের ধরন দেখে মনে হত "তারা যেন বন্দী নয় বরং তারাই হত্যাকারী", হোসের লেখনী মতে।[61] তিনি আরো লেখেন যে, "এমনকি যখন তারা গণকবরে থাকা অর্ধগলিত লাশসমূহ পোড়ানোর মত ভয়ানক নোংরা কাজের সময়ও" এই কর্মীরা আহার ও ধূমপান করত।[61] কখনো কখনো তারা তাদেরই কোন আত্মীয়ের মরদেহের সম্মুখীন হত, অথবা তাদেরকে গ্যাস কক্ষে প্রবেশ করতে দেখত। হোস আখ্যা দেন, নিশ্চয়ই এসমস্ত ঘটনা তাদেরকে নাড়া দিত, কিন্তু "কোন কিছু করেই কোন লাভ হবে না" এরূপ চিন্তা তাদের মাথায় প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল। এরূপ একজন "সোন্ডারকোমান্ডো" তার স্ত্রীর মরদেহ খুঁজে পায়, তারপরেও সে মরদেহ টেনে নেয়ার কাজে ফিরে যায় যেন "কিছুই ঘটে নি।"[61]
অশউইত্জ্ শিবিরে মরদেহসমূহ বৃহদাকার দাহনকক্ষে পোড়ানো হত এবং এর ছাইসমূহ মাটিতে পুঁতে দেয়া হত, ছড়িয়ে দেয়া হত কিংবা নদীতে নিক্ষিপ্ত হত। সোবিবোর, ট্রেবলিংকা, বেলজেক ও চেলেম্নো শিবিরে মরদেহ পোড়ানো হত বিশাল অগ্নিকুন্ডে। অশউইত্জ্-বিরকেনাউ শিবিরের হত্যাকাণ্ডকে একপ্রকার শিল্পায়িত রূপ দেয়া হয়, এস্থানে তিনটি দালান নির্মিত হয়, প্রতিটিতে একটি দাহনকক্ষ থাকত এবং এগুলো নকশা করা হয় "জে.এ. টফ এন্ড সোনি" প্রকৌশলী সংস্থার বিশেষজ্ঞদের দ্বারা। ২৪ ঘণ্টা এই দাহনকক্ষগুলোতে মরদেহ পোড়ানো অব্যাহত থাকত, তবে মরদেহের সংখ্যা এতই বেশি ছিল যে এত ব্যবস্থাপনার পরেও সেগুলো দাহনকক্ষে সংকুলান হত না, অতিরিক্ত মরদেহ বাইরে অগ্নিকুন্ডে পোড়ানো হত।[62]
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডি.সি.তে অবস্থিত "যু্ক্তরাষ্ট্র ইহুদি গণহত্যা স্মৃতি জাদুঘর" (United States Holocaust Memorial Museum)-এর হিসাবমতে ফ্যাসিবাদী "উস্তাসা" গোষ্ঠীর শাসনামলে ক্রোয়েশিয়ার জ্যাসেনোভাক নির্মূল শিবিরে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে প্রায় ৭৭,০০০ থেকে ৯৯,০০০ বন্দীকে হত্যা করা হয়। জ্যাসেনোভাক স্মৃতিস্তম্ভেও অনুরূপ সংখ্যা দেয়া আছে, সেখানে নিহতের সংখ্যা বলা হয়েছে ৮০,০০০ থেকে ১ লক্ষ।[63] "নাৎসিদের দোসর" ("Nazi Collaborators") নামক একটি টেলিভিশন প্রামাণ্যচিত্রে তৎকালীন ক্রোয়েশিয়ার ফ্যাসিবাদী নেতা ডিংকো সাকিচ্-এর অপরাধসমূহের বর্ণনা দেয়া হয়েছে, এ প্রামাণ্যচিত্রের মতে জ্যাসেনোভাক শিবিরে ৩ লক্ষাধিক বন্দীকে হত্যা করা হয়েছিল।[46] হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয় জাইক্লন-বি গ্যাস যেগুলো প্রয়োগের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার বিশিষ্ট ভ্যানগাড়ি ও পরবর্তীতে গ্যাস-কক্ষ নির্মাণ করা হয়। জ্যাসেনোভাকের কারারক্ষীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে তারা অনেক বন্দীকে জীবিত অবস্থায় দাহন চুল্লীতে নিক্ষেপ করত। জার্মান শিবির সমূহ থেকে ক্রোয়েশিয়ার এসব উস্তাসে শিবিরের পার্থক্য ছিল যে এখানে গ্যাস কক্ষের পাশাপাশি হস্তচালিত উপায়ে গণহত্যা চালানো হত। এর মধ্যে রয়েছে মুগুর, কৃষিকাজে ব্যবহৃত ছুরি ইত্যাদি দ্বারা বন্দীদের হত্যা করা হত এ প্রকারে হত্যার সময় বন্দীদের অনেক সময় জীবিত অবস্থাতেই পার্শ্ববর্তী সাভা নদীর খাদে নিক্ষেপ করা হত।
জাদোভ্নো নির্মূল শিবিরে নিহতের সংখ্যা ধারণা করা হয় ১০,০০০ থেকে ৭২,০০০ পর্যন্ত যা সংঘটিত হয় ১২২ দিনের মধ্যে (১৯৪১ সালের মে থেকে আগস্ট মাসের মধ্যে)।[64] জাদোভ্নো শিবিরে সাধারণতঃ ভুক্তভোগীদেরকে এক সারিতে দাঁড় করানো হত, সারির প্রথম কয়েকজনকে রাইফেলের বাট বা অন্য কোন অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হত। অতঃপর সারিভর্তি বন্দীদের খাদে নিক্ষেপ করা হত। এরপরও যারা বেঁচে থাকত তাদের হত্যা করার জন্যে খাদে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হত। এরপর লাশের স্তুপে কুকুর লেলিয়ে দেয়া হত যাতে তারা মৃতদেহ ও যারা তখনো জীবিত ছিল তাদের ভক্ষণ করতে পারে। অনেক বন্দীকে মেশিনগান দ্বারা গুলি চালিয়ে হত্যা করা হত, অনেককে আবার ছুরিকাঘাতে অথবা ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে প্রহার করে হত্যা করা হত।[65][66]
নিম্নলিখিত তালিকাভুক্ত নাৎসি নির্মূল শিবিরসমূহে হত্যাকাণ্ডের শিকার ব্যক্তির মোট সংখ্যা ৩০ লক্ষাধিক বলে ধারণা করা হয়:
শিবিরের নাম | আনুমানিক নিহতের সংখ্যা |
কার্যকর থাকার কাল | অঞ্চল | বর্তমানে যে রাষ্ট্রে অবস্থিত | গণহত্যার প্রক্রিয়া |
---|---|---|---|---|---|
অশউইত্জ-বিরকেনাউ | ১,১০০,০০০ [67] | মে,১৯৪০ - জানুয়ারি, ১৯৪৫ | উর্ধ্বতর সাইলেসিয়া প্রদেশ | পোল্যান্ড | জাইক্লন-বি গ্যাস কক্ষ |
ট্রেবলিংকা | ৮০০,০০০ [68] | ২৩ জুলাই ১৯৪২ - ১৯ অক্টোবর, ১৯৪৩ | সাধারণ প্রশাসনিক অঞ্চল | পোল্যান্ড | কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস কক্ষসমূহ |
বেলজেক | ৬০০,০০০ [69] | ১৭ মার্চ, ১৯৪২ - জুন, ১৯৪৩ | সাধারণ প্রশাসনিক অঞ্চল | পোল্যান্ড | কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস কক্ষসমূহ |
চেলেম্নো | ৩২০,০০০ [70] | ৮ ডিসেম্বর ১৯৪১ - মার্চ, ১৯৪৩, জুন ১৯৪৪ - ১৮ জানুয়ারি, ১৯৪৫ |
রাইখ্সগাউ ওয়ার্থল্যান্ড জেলা | পোল্যান্ড | কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস ভ্যান |
সোবিবোর | ২৫০,০০০[71] | ১৬ মে, ১৯৪২- ১৭ অক্টোবর, ১৯৪৩ | সাধারণ প্রশাসনিক অঞ্চল | পোল্যান্ড | কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস কক্ষসমূহ |
মাজদানেক | অন্তত ৮০,০০০ [72] | ১ অক্টোবর, ১৯৪১ - ২২ জুলাই, ১৯৪৪ | সাধারণ প্রশাসনিক অঞ্চল | পোল্যান্ড | জাইক্লন-বি গ্যাস কক্ষ |
ম্যালি স্ট্রট্সনেট্স | ৬৫,০০০ [73] | ১৯৪১ সালের মধ্যভাগ - ২৮ জুন ১৯৪৪ | রাইখ্সকমিসারিয়াত ওস্টল্যান্ড | বেলারুশ | গুলি করে হত্যা, গ্যাস ভ্যান[74] |
সাজ্মিস্তে | ২৩,০০০ [75] | ২৮ অক্টোবর, ১৯৪১ - জুলাই ১৯৪৪ | স্বাধীন ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্র | সার্বিয়া | কার্বন মনো-অক্সাইড গ্যাস ভ্যান |
সর্বমোট | ৩,১১৫,০০০ - ৩,২১৫,০০০ [76][77] |
এসমস্ত নির্মূল শিবিরে হত্যাকাণ্ডের চিহ্ন সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে লুকায়িত করার জন্যে নাৎসি বাহিনী ব্যপক প্রচেষ্টা চালায়। গণহত্যায় ব্যবহৃত প্রক্রিয়া এবং নিহতদের দেহাবশেষ সমেত সমস্ত প্রমাণ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। গোপনীয় "সোন্ডারঅ্যাকশন ১০০৫" কর্মসূচির ফলে বন্দী শ্রমিকদের দ্বারা শিবিরগুলো ভেঙে ফেলার প্রয়াস চালানো হয়, সমস্ত নথিপত্র ধ্বংস করা হয়, গণকবরগুলো খনন করে দেহাবশেষ সরিয়ে ফেলা হয়। কিছু কিছু নির্মূল শিবিরের প্রমাণাদি সরিয়ে ফেলার আগেই সেখানে সোভিয়েত বাহিনীর সৈন্যেরা সেগুলো উদ্ধার করে, যাদের নথিভুক্তকরণ নীতি এবং অকপটতা তাদের পশ্চিমা মিত্ররাষ্ট্রসমূহের থেকে ভিন্ন ধাঁচের ছিল।[78][79]
এছাড়া "অপারেশন ব্যাগরেশন"-এর সময় সোভিয়েত লাল ফৌজের অতিদ্রুত অগ্রসর হবার কারণে তারা মাজদানেক শিবিরটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।[78]
যুদ্ধপরবর্তী সময়ে স্বাধীন পোল্যান্ড প্রজাতন্ত্র তাদের মৃতদের স্মরণে নির্মূল শিবিরসমূহের স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করে। এসব স্মৃতিস্তম্ভে নাৎসি বাহিনীর গণহত্যার শিকার ব্যক্তিবর্গের আঞ্চলিক, ধার্মিক ও জাতীয় পরিচয় তুলে ধরা হয়। গত কয়েক দশক ধরে নির্মূল শিবিরের স্থানসমূহ জনসাধারণের পরিদর্শনের জন্যে উন্মুক্ত রয়েছে। সারা বিশ্ব থেকে পর্যটকগণ এই ঐতিহাসিক নিদর্শনটি পরিদর্শন করতে আসেন, বিশেষ করে সর্বাপেক্ষা কুখ্যাত শিবির অসউইত্জ্ শিবিরটি অনেকে দেখতে আসেন, যা পোল্যান্ডের অস্উইচিম শহরের নিকটে অবস্থিত। ১৯৯০ সালের দিকে ইহুদি গণহত্যাবিষয়ক সংগঠনগুলো পোলিশ ক্যাথলিক সংগঠনের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হয় যে, "অশউইত্জ্ এর মত নাৎসি হত্যা শিবিরগুলোতে কোন ধর্মীয় চিহ্ন ব্যবহার করা সমীচীন?", তারা অশউইত্জ্-১ এ খ্রীষ্টান স্মারকচিহ্ন হিসেবে ক্রুশ স্থাপনের বিরোধিতা করে যেখানে প্রধানত পোলগনকে হত্যা করা হয়। ইহুদিদেরকে মূলতঃ হত্যা করা হয় অশউইত্জ্-২ বিরকেনাউ শিবিরে।
১৯৮৮ সাল থেকে পোল্যান্ডে "জীবিতদের হন্টন" বা "March of the Living" নামে একটি প্রদর্শনী যাত্রার আয়োজন করা হয়ে আসছে,[80] যেখানে এস্তোনিয়া, নিউজিল্যান্ড, পানামা, তুরস্ক প্রভৃতিসহ বিভিন্ন দেশের জনসাধারণ হাঁটায় অংশ নেন।[81]
ইহুদি গণহত্যা অস্বীকারকারী বা ঐতিহাসিক অস্বীকারকারীগণ (negationists) হল এমন ব্যক্তিবর্গ কিংবা সংস্থা যাদের দাবি ইহুদি গণহত্যা আদৌ সংঘটিত হয়নি, অথবা সংঘটিত হলেও ঐতিহাসিক বর্ণনায় যেভাবে উল্লেখ করা আছে তা ঐ পদ্ধতিতে এবং ঐ পরিসরে সংঘটিত হয়নি।[82]
নির্মূল শিবিরসমূহ নিয়ে গবেষণা একটি দুঃসাধ্য বিষয় কেননা যুদ্ধের শেষ পর্যায় নাৎসি ও এস.এস. বাহিনী সকল নির্মূল শিবিরে গণহত্যার প্রমাণাদি ধ্বংস করার ব্যপক প্রয়াস চালায়।[78] নির্মূল শিবিরসমূহের অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় এর বেঁচে যাওয়া বন্দী এবং আটককৃত হত্যাকারীদের সাক্ষ্য থেকে, এছাড়াও বাস্তব প্রমাণ মেলে অবশিষ্ট শিবিরসমূহ ও অন্যান্য উপাদানসমূহ থেকে। তদুপরি নাৎসিদের তোলা আলোকচিত্র, উদ্ধারকৃত নথিসমূহ ইত্যাদি থেকেও গণহত্যার বিষদ প্রমাণ পাওয়া যায়।[83][84]
গণহত্যা অস্বীকারকারীরা তাদের বক্তব্যের শুরুতেই নির্মূল শিবির সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে বাস্তবেই যেসমস্ত ভুল ধারণা রয়েছে সেগুলো উল্লেখ করে। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকায় প্রকাশিত বহুল প্রচলিত কিছু ছবি প্রকৃতপক্ষে উকুনবাহিত টাইফাস-জ্বরে আক্রান্ত রোগীদের চিত্র ছিল এবং আমেরিকান সেনাবাহিনী কর্তৃক উদ্ধারকৃত বুকেনওয়াল্ড, বেলসেন ও ডাকাউ বন্দী শিবিরের চিত্র ছিল এবং এই চিত্রগুলোই আমেরিকাতে বহুল প্রচার পায়। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বহু বছর ধরে সংবাদ মাধ্যমগুলো ভুলক্রমে নির্মূল শিবিরে ইহুদিদের হত্যা-নির্যাতনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এই চিত্রসমূহ ব্যবহার করে। গণহত্যা অস্বীকারকারীরা এই প্রচলিত ভুল তথ্যকে নির্দেশ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চায় যে, নির্মূল শিবিরসমূহ বাস্তবে কোন অস্তিত্ব ছিল না এবং এগুলো গুজবমাত্র যা ইহুদিদের চক্রান্তের ফল।
গণহত্যার অস্বীকারকারীদের বক্তব্যকে পন্ডিতগণ ব্যপকভাবে ভুল বলে আখ্যা দেন এবং বহু রাষ্ট্রে গণহত্যাকে অস্বীকার করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হয়, এসব রাষ্ট্রের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, চেক প্রজাতন্ত্র, ফ্রান্স, জার্মানি, হাঙ্গেরি, ইসরায়েল, ইতালি, লিচটেনস্টেইন, লিথুয়ানিয়া, লুক্সেমবার্গ, নেদারল্যান্ড, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রোমানিয়া, রাশিয়া, স্লোভাকিয়া এবং সুইৎজারল্যান্ড।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.