দুর্ভিক্ষের সময় ক্ষুধা নিবারণের জন্য ব্যবহার করা সহজলভ্য খাবার উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দুর্ভিক্ষের খাদ্য বা দারিদ্র্যের খাদ্য হলো এমন কোনো সস্তা বা সহজলভ্য খাবার যা ক্ষুধা ও অনাহারে মানুষের পুষ্টির জন্য ব্যবহৃত হয়। চরম দারিদ্রের কারণে যেমন দুর্ভিক্ষের বা যুদ্ধের সময় বা খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় এই খাবার ব্যবহার হয়।
দুর্ভিক্ষের সাথে যুক্ত খাবারে পুষ্টির ঘাটতি থাকা যেমন ঠিক নয় তেমনি আবার সেটি অস্বাস্থ্যকর হওয়াও চলবে না। যারা দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর পরিমাণে দুর্ভিক্ষের খাবার খান তারা সময়ের সাথে সাথে এই খাবারের প্রতি বিরূপ মনোভাবও পোষণ করতে পারেন। আপেক্ষিক সমৃদ্ধির সময়ে এই খাবারগুলিকে কখন কখন প্রত্যাখ্যানও করা হতে পারে।
সামাজিক কারণে খাদ্য হিসাবে কিছু খাদ্যদ্রব্য "দুর্ভিক্ষ" বা "দারিদ্র্য" এর বৈশিষ্ট্য হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, গলদা চিংড়ি এবং কিছু কাঁকড়া জাতীয় খাবার সময়কাল এবং পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে কিছু সমাজে সেটি দারিদ্র্যের খাদ্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। আবার এই সব খাবার অন্যদের কাছে বিলাসবহুল খাবার হিসাবেও বিবেচিত।
ইতিহাসের পাতা জুড়ে দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দূর্যোগের সময়ের সাথে বেশ কয়েকটি খাদ্যদ্রব্যের নাম নানা ভাবে যুক্ত হয়েছে:
ব্রেডনাট বা মায়া বাদাম প্রাচীন মায়ানরা চাষ করত কিন্তু আধুনিক কালে মধ্য আমেরিকাতে দারিদ্র্যের খাদ্য হিসাবে একে ব্যাপকভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়।
পলিনেশিয়ায়, জ্যান্থোসোমা গোত্রের গাছপালা, যা স্থানীয়ভাবে 'বানর' নামে পরিচিত, দুর্ভিক্ষের খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হতো এবং শুধুমাত্র তারো ফসল ব্যর্থ হলেই এটি ব্যবহৃত হতো।[1]
১৮৪৬-১৮৪৮ সালে আয়ারল্যান্ডে মহা দুর্ভিক্ষের সময় উপকূলবর্তী কৃষকরা ডালসে, চ্যানেলড র্যাক এবং আইরিশ মস ( চন্ড্রাস ক্রিস্পাস ) সহ ভোজ্য শৈবালের বেশ কয়েকটি প্রজাতি খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। এছাড়া দুর্ভিক্ষের খাবারের মধ্যে রয়েছে নেটল বা স্টিংগার নামে পরিচিত একটি ভেষজ বহুবর্ষজীবী ফুলের উদ্ভিদ, বন্য সরিষা, সোরেল এবং ওয়াটারক্রেস নামে একপ্রকার জলজ আগাছা । [2][3][4][5] আয়ারল্যান্ডের স্কিবেরিন এলাকার লোকেরা দুর্ভিক্ষের সময় গাধার মাংস খেতে শুরু করে। তাই ঐ এলাকার লোকেদের "গাধা আটারস" (গাধা খাদক) নামে ডাকা হতো। [6] অন্যরা কুকুর, বিড়াল, কর্নক্রেক, পচা শূকর এমনকি মানুষের মাংসও খেত। [7][8] সিলভারউইড, সামুদ্রিক অ্যানিমোন, বন্য গাজর, স্লোস, পিগনাট, সাধারণ লিম্পেট, শামুক, ডক পাতা, সিকামোর বীজ, লরেল বেরি, হলি বেরি, ড্যান্ডেলিয়ন, লাল ক্লোভারের রস এবং হিদার ফুলের ব্যবহারও দুর্ভিক্ষের সময়ের খাবার হিসাবে নথি করা হয়েছে। [9][10][11][12] দুর্ভিক্ষের অনেক বিবরণে উল্লেখ করা হয়েছে যে মানুষ ঘাস বা অন্যান্য সবুজ গাছপালা খাওয়ার জন্য মুখের চারপাশে সবুজ দাগ নিয়ে মারা যাচ্ছে। [13][14]
সেগো লিলি গাছের কন্দও দুর্ভিক্ষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
১৯৪৪-৪৫ সালে ডাচ দুর্ভিক্ষের সময় নেদারল্যান্ডসের জার্মান-অধিকৃত অংশে টিউলিপ গাছের কন্দ এবং বিটরুট খাওয়া হয়েছিল।
রাশিয়া এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি দুর্ভিক্ষের সময়, নেটল, ওরাচে এবং অন্যান্য ধরণের বন্য গাছপালা রুটি বা স্যুপ তৈরিতে ব্যবহৃত করা হয়। [15]
আইসল্যান্ডে, সুইডেনের গ্রামীণ অংশ এবং পশ্চিম ফিনল্যান্ডে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে মাশরুম ব্যাপকভাবে খাওয়া হত না। এগুলিকে গরুর খাদ্য হিসাবে দেখা হত। এগুলিকে যুদ্ধকালীন এবং দারিদ্র্যের খাদ্য হিসাবে দেখা হতো।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় দুর্ভিক্ষের সময়, পর্ণমোচী গাছের বাকল অর্থাৎ ক্যাম্বিয়াম ( ফ্লোয়েম ) শুকিয়ে, গুঁড়ো করে শস্যের আটার সঙ্গে মিশিয়ে এক ধরনের রুটি তৈরি করা হতো। একে বলা হতো বাকল রুটি। এটি একটি সামি ঐতিহ্য বলে মনে করা হয়।
আদিরন্ড্যাক শব্দটি নিউ ইয়র্কের আদিরন্ড্যাক পর্বতমালায় বসবাসকারী আদিবাসীদের বর্ণনা করতে ব্যবহার করা হয়। মনে করা হয় মোহাক শব্দ 'হা-ডি-রন-দাহ' থেকে এসেছে যার অর্থ 'গাছ ভক্ষণকারী'। এই নামটি ইরোকুইয়ানরা অ্যালগনকুইয়ানদের গোষ্ঠীর জন্য ব্যবহার করে। কখনও কখনও কঠোর শীতে বেঁচে থাকার জন্য এদেরকে গাছের ছাল খেতে হতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্ভিক্ষের সময় উত্তর ইতালীয় অঞ্চলে পিডমন্ট, এমিলিয়া-রোমাগনা এবং লিগুরিয়ায় বিড়ালের মাংস খাওয়া হতো। [16]
একইভাবে, ফ্রাঙ্কো-প্রুশিয়ান যুদ্ধে প্যারিস অবরোধের সময়, প্যারিসের ক্যাফেগুলির মেনুতে শুধুমাত্র বিড়ালের মাংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কুকুর, ইঁদুর, ঘোড়া, গাধা, উট এবং এমনকি হাতির মাংসও ব্যবহারর করা হয়।
মালয়ে জাপানী দখলের সময় যখন ধানের তীব্র ঘাটতি দেখা দেয় সেই সময় স্থানীয়রা শক্ত কন্দযুক্ত শিকড় যেমন কাসাভা, মিষ্টি আলু এবং ইয়াম খেয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিপাইনে রবাটানের যুদ্ধে, ফিলিপিনো এবং আমেরিকান সেনারা কুকুরের মাংস, বানরের মাংস, গোসাপ, অজগর, খচ্চর, ঘোড়ার মাংস তোতাপাখি, পেঁচা, কুমির প্রভৃতির মাংস খাবারের তালিকায় ছিল। [17]
ব্রাজিলের উত্তর-পূর্বের আধা-শুষ্ক অঞ্চলে, ক্যাকটাস ওপুনটিয়া কোচেনিলিফেরা- এর অঙ্কুর এবং পাতাগুলি সাধারণত গবাদি পশুদের ( গরু ও ছাগল ) খাওয়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। কিন্তু দীর্ঘ খরার সময়, লোকেরা শেষ অবলম্বন হিসাবে তাদের খাদ্যে এই সব ব্যবহার করত। [18]
ঐতিহাসিকভাবে মালদ্বীপে সমুদ্রতীরবর্তী গাছের পাতা যেমন অক্টোপাস গুল্ম এবং সৈকত বাঁধাকপি প্রায়ই দুর্ভিক্ষের খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হতো বলে জানা যায়। [19]
ক্যাপার, ক্যাপারিস স্পিনোসা প্রজাতির ফুলের কুঁড়ি এবং বেরি, দক্ষিণ ইথিওপিয়া এবং সুদানের পাশাপাশি ১৯৪৮ সালে পশ্চিম জেরুজালেমের অবরোধের সময় দুর্ভিক্ষের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হয়। [20][21]
কম্বোডিয়ার মানবিক সংকটের সময়, লোকেরা ট্যারান্টুলাস, বিছে, রেশম কীট এবং ফড়িংও খেয়েছিল। ভাজা ট্যারান্টুলাস পরে কম্বোডিয়ার শহর স্কুওনে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। [22]