নবীর উদ্দেশ্যে পাঠ করা বাক্যাংশ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
দুরুদ বা দুরুদ শরিফ (ফার্সি: درود) হলো একটি সম্ভাষণ যা মুসলমানরা নির্দিষ্ট বাক্যাংশ পড়ে ইসলামের শেষ পয়গম্বরমুহাম্মদের শান্তির প্রার্থনা উদ্দেশ্যে পাঠ করা হয়ে থাকে। এটি একটি ফার্সি শব্দ, যা মুসলমানদের মুখে বহুল ব্যবহারের কারণে ১৭শ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় অঙ্গীভূত হয়ে যায়। বৃহত্তর অর্থে মুহাম্মদের প্রতি এবং তার পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি এবং সহচরদের প্রতি আল্লাহর দয়া ও শান্তিবর্ষণের জন্য প্রার্থনা করাই দুরুদ।[1][2] দুরুদকে প্রায়ই সম্মানসূচকভাবে ইসলামি পরিভাষায় “দুরুদ শরিফ”-ও বলা হয়ে থাকে।
আরবিতে একে সালাওয়াত বলা হয় (আরবি: صَلَوَات, ṣalawāt, একবচন সালাত)। সালাওয়াত হলো সালাত (আরবি: صَلَاة) এর একটি বহুবচন এবং "সোয়াদ-লাম-ওয়াও" (ص ل و) বর্ণসমূহের ত্রিবাক্ষিক মূল স্-ল্-ওয়্ থেকে আগত, যার অর্থ "প্রার্থনা" বা "অভিবাদন"।[3] আরবি দার্শনিকরা মনে করেন যে "সালাওয়াত" শব্দের অর্থ কে ব্যবহার করছে এবং কার জন্য এটি ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে।[4]
হযরত মুহাম্মাদের নাম উচ্চারণের সময় সর্বদা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম্ বলা হয়, যার অর্থ: "তার উপর আল্লাহর শান্তি বর্ষিত হোক।" এটিও একটি একটি দুরূদ। একটি দুরুদের অর্থ এরকম: “হে আল্লাহ, মুহাম্মাদের প্রতি আপনি দয়া পরবশ হোন। তার আলোচনা ও নামকে আপনি এই পৃথিবীর সকল আলোচনা ও নামের মাঝে সর্বোচ্চ স্থানে রাখুন।”
"মুহাম্মাদ যখন বিশ্বাসীদের উপর দুরুদ পাঠ করেন, এটি তাঁদের কল্যাণ, আশীর্বাদ ও পরিত্রাণের জন্য তার প্রার্থনাকে নির্দেশ করে।"[5]
ইসলামি বিশ্বাসমতে যখন একজন মুসলিম বা ফেরেশতা (মালা'ইকাহ) দুরুদ পাঠ করে, এর অর্থ তারা নবির কাছে এটি প্রেরণ করছে এবং আল্লাহ নিকট মুহাম্মাদের প্রতি তাঁদের সম্মান প্রদর্শন করছে, একইভাবে যখন আল্লাহ নিজেই নবির প্রতি দুরুদ পাঠ করেন, এর অর্থ হচ্ছে নবি মুহাম্মাদ আল্লাহ দ্বারা আশীর্বাদ প্রাপ্ত হন।[1]
إِنَّ ٱللَّهَ وَمَلَـٰٓٮِٕكَتَهُ ۥ يُصَلُّونَ عَلَى ٱلنَّبِىِّۚ يَـٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ صَلُّواْ عَلَيْهِ وَسَلِّمُواْ تَسْلِيمًا
“আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ নবির প্রতি দয়া প্রেরণ করেন। হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা নবির জন্যে দয়ার তরে প্রার্থনা করো এবং তার প্রতি অভিবাদন প্রেরণ করো (অর্থাৎ সালাওয়াত/দুরুদ পাঠ করো)।”[6]
আবু আমামাহ কর্তৃক একটি হাদিস বর্ণনা করা হয়েছে যে মুহাম্মাদ (সা.) বলেন: "প্রতি শুক্রবার আমার উপর আরও দুরুদ পাঠ করুন, আমার উম্মতদের (অনুসারী) কাছে থেকে দুরুদ প্রতি শুক্রবার আমার কাছে পেশ করা হয়। যে ব্যক্তি আমার প্রতি বেশি দুরুদ পাঠ করেছে সে আমার তত বেশি নিকটবর্তী হবে।"[7]
এটি বর্ণিত হয়েছে যে মুহাম্মাদ বলেন: "সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি সে যে তার উপস্থিতিতে আমার নাম উল্লেখ করার সময় আমার নামে দুরুদ পাঠ করে না।"[8][9]
আল-হাসান বিন আলী থেকে ইবনে আসাকরি বর্ণনা করেছেন, মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন: "আমার উপর আরও দুরুদ পাঠ করো, কারণ তোমার প্রার্থনা তোমার পাপ ক্ষমা হওয়ার পক্ষে উপযুক্ত। এবং আমার জন্য উচ্চ মর্যাদা ও সুপারিশ প্রার্থনা করো, নিশ্চয়ই আমার সুপারিশ আল্লাহর নিকট তোমার পক্ষে প্রার্থনা করবে।"[10]
মুহাম্মাদ থেকে জাফর আল-সাদিক বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: "আল্লাহর নিকট সমস্ত প্রার্থনা আকাশ থেকে আবরিত থাকবে যতক্ষণ না মুহাম্মাদ (সা.) ও তার পরিবার-পরিজনের নিকট দুরুদ না পাঠানো হয় (অর্থাৎ তাঁদের নামে দুরুদ না পাঠ করা হয়)।"[11]
অন্য একটি স্থানে জাফর আল-সাদিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে: "যে ব্যক্তি নবি ও তার পরিবার-পরিজনের উপর দুরুদ পাঠ করে তার অর্থ ‘আমি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি তা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি যখন আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞাসা করেন, "আমি কি তোমার প্রভু নই?" এবং আমি উত্তর দিয়েছি, "হ্যাঁ আপনি তাই।"’[12]
আবদুর রহমান ইবনে আবি লায়লা হতে বর্ণিত। তিনি বলেন: "কা'ব ইবনে আজরা আমার সাথে দেখা করে বললেন, "আমি কি তোমাকে একটি উপহার দেবো না?" নবী করিম (স.) বের হয়ে আমাদের কাছে এলেন এবং আমরা বললাম, "হে আল্লাহর রাসুল, আমরা আপনাকে সালাম দিতে জানি, তাহলে আমরা কীভাবে আপনার জন্য অভিবাদন পেশ করতে পারি?" তিনি বললেন, "হে আল্লাহ, মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারের প্রতি শান্তি প্রেরণ করুন যেভাবে আপনি ইব্রাহিম ও ইব্রাহিমের পরিবারের প্রতি শান্তি প্রেরণ করেছিলেন। নিঃসন্দেহে আপনি সর্বাপেক্ষা প্রশংসিত, সর্বোত্তম।"[13]
এটি বিখ্যাত সূত্র, [14] কেননা আবু হুমাইদ আল-সাইদী আল-বুখারী ও মুসলিম থেকে বর্ণনা করেছেন।[15]
বিভিন্ন মত অনুসারে,[16] মুহাম্মাদ (সা.) নিম্নলিখিত দুরুদ পাঠ করতে বলেছেন, এখানে নবি ইব্রাহিমের প্রশংসা করা হয় বলে একে দুরুদে ইব্রাহিম-ও বলে:
“আল্লাহ, মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারকে পবিত্রতা দান করুন, যেভাবে আপনি ইব্রাহিম ও ইব্রাহিমের পরিবারকে পবিত্র করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসনীয় ও মহিমান্বিত। আল্লাহ, মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের পরিবারকে আশীর্বাদ দান করুন, যেভাবে আপনি ইব্রাহিম ও ইব্রাহিমের পরিবারকে আশীর্বাদ দিয়েছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসনীয় ও মহিমান্বিত।”[17]
মুহাম্মাদ (সা.) আরও বলেন: "আমার উপর অসম্পূর্ণ দুরুদ পাঠ করবে না"। তার সাহাবারা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন: "অসম্পূর্ণ দুরুদ কী?" জবাবে তিনি তাঁদের বললেন: "তোমরা যখন বলবে: 'হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করুন' এবং তারপরেই থেমে যাও। তার চেয়ে বরং বলো: اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ 'হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ ও মুহাম্মাদের বংশধরদের প্রতি আপনার আশীর্বাদ প্রেরণ করুন'"[18]
আরও কিছু দুরুদ
যায়েদ ইবনে হারেসা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, “আমি আল্লাহর রাসুলকে প্রশ্ন করলে তিনি বললেন, তোমরা আমার উপর দুরুদ পাঠ করো এবং বেশি বেশি প্রার্থনা করো আর তোমরা বলো,
অর্থ: "হে আল্লাহ্, আপনি মুহাম্মাদ ও তার পরিবারবর্গের প্রতি দয়া প্রেরণ করুন।"[19]
আবু সায়িদ আল-খুদরী থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, “আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসুল, আপনার উপর সালাম পাঠানোর নিয়ম তো আমরা জানি, কিন্তু আপনার উপর দুরুদ কীভাবে পাঠ করবো? তিনি বললেন, তোমরা বলবে,
অর্থ: "হে আল্লাহ্, আপনার বান্দা ও পয়গম্বর মুহাম্মাদের উপর আপনি দয়া প্রেরণ করুন, যেরকমভাবে ইব্রাহিমের প্রতি দয়া প্রেরণ করেছিলেন। আপনি মুহাম্মাদ ও তার পরিবারবর্গের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করুন, যেরকমভাবে ইব্রাহিমের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করেছিলেন।"[20][21][22]
আমর ইবনু সুলাইম যুরাকী থেকে বর্ণিত: আবু হুমাইদ সাঈদী তাঁকে বলেছেন, তারা [নবি মুহাম্মাদের নিকট] বললেন, “হে আল্লাহর রাসুল, আমরা আপনার উপর দুরুদ কীভাবে পাঠ করবো? তিনি বললেন, তোমরা এইরূপ বলবে,
অর্থ: "হে আল্লাহ, মুহাম্মাদ এবং তার স্ত্রী ও বংশধরদের প্রতি দয়া প্রেরণ করুন, যেরকমভাবে ইব্রাহিমের প্রতি দয়া প্রেরণ করেছিলেন। আপনি মুহাম্মাদ এবং তার স্ত্রী ও বংশধরদের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করুন, যেরকমভাবে ইব্রাহিমের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসিত।"[lower-alpha 3][24][25][26][27][28][29][30][31]
অর্থ: হে আল্লাহ্! রহমতের কামেলা নাজিল করুন আমাদের নেতা হজরত মোহাম্মদ (সা.) ও ইমাম মাহ্দী এবং তাঁদের পরিবার-পরিজনের উপর।
যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও তার পরিবারের উপর ১০ বার দুরুদ পাঠ করে, আল্লাহ ও তার ফেরেশতাগণ সেই ব্যক্তির উপর ১,০০০ সালাওয়াত পাঠ করেন এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদ ও তার পরিবার-পরিজনের উপরে ১,০০০ সালাওত পাঠ করে, জাহান্নামের আগুন তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।[33]
মুহাম্মাদ ও তার বংশধরের প্রতি দুরুদ পাঠ বিচারের দিন তার সুপারিশের পথ প্রশস্ত করে।[34]
মুহাম্মাদ ও তার বংশধরকে দুরুদ প্রেরণ পাপের ক্ষতিপূরণ হিসাবে কাজ করে।[35]
মুহাম্মাদ ও তার পরিবারের প্রতি দুরুদ পাঠ করা কর্মের পাল্লায় সবচেয়ে ভারী কাজ।[36]
মুহাম্মদ (সা.) ও তার পরিবারের প্রতি দুরুদ পাঠ আল্লাহ ও তার রাসুলের স্নেহের দিকে পরিচালিত করে।[37]
মুহাম্মাদ ও তার পরিবারের উপর দুরুদ তার কাজকে বিশুদ্ধ করে।[38]
মুহাম্মাদ ও তার পরিবারবর্গের উপর দুরুদ ব্যক্তির কবরের জ্যোতি, পুল সিরাত ও জান্নাতের কাজ করবে। [39]
অর্থ: "হে আল্লাহ, মুহাম্মাদ এবং তার স্ত্রী ও বংশধরদের প্রতি দয়া প্রেরণ করুন, যেরকমভাবে ইব্রাহিমের প্রতি দয়া প্রেরণ করেছিলেন। আপনি মুহাম্মাদ এবং তার স্ত্রী ও বংশধরদের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করুন, যেরকমভাবে ইব্রাহিমের প্রতি আশীর্বাদ প্রেরণ করেছিলেন। নিশ্চয়ই আপনি অধিক প্রশংসিত ও মহিমান্বিত।"
Zubair, Khwaja Mohammed (২০১৭-০৫-৩১)। "Salutations on our dear Prophet"। Khaleej Times। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-১৭।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Muḥammad Muṣṭafá, Badawī (১৯৭৫)। A critical introduction to modern Arabic poetry। Cambridge University Press।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Muḥammad Muṣṭafá, Badawī (১৯৭৫)। A critical introduction to modern Arabic poetry। Cambridge University Press।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)