Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
টোপ ভারতীয় বাঙালি লেখক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের রচিত একটি অসামান্য ছোটগল্প। তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলির মধ্যে সবথেকে বিখ্যাত হল টোপ। এই ছোটগল্পের মাধ্যমে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় মানুষের চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরেছেন অত্যন্ত মুনশিয়ানায়। তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরুর দিকেই রচিত এই ছোটগল্প তাঁকে বাংলা সাহিত্যের জগতে খ্যাতি এনে দিয়েছিল।[1] চলচ্চিত্রের জগতে বহু ব্যবহৃত ফ্ল্যাশব্যাক রীতিতে রচিত টোপ গল্পের মধ্যে সুদক্ষ শৈলীতে জনৈক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর আত্মকেন্দ্রিক সতর্কতা এবং বিবেকদংশনের দোলাচলতা একদিকে, অন্যদিকে কাঞ্চনগরী এবং প্রতাপদম্ভী এক অভিজাত পুরুষের দানবিক নির্মমতার রূঢ়, বাস্তবসম্মত চিত্রায়ণ করা হয়েছে। প্রথম থেকে অনেকদূর অবধি একটা আলতাে পরিহাসের মাধ্যমে কুণ্ঠিত আত্মসমালােচক ভীতে লেখক গল্পটিকে টেনে নিয়ে গেছেন। গল্পের শেষে আর লঘুতরল সেই পরিহাস মর্জিটুকুর অস্তিত্ব নেই। আত্মসমালােচনা তখন প্রায় এক ধরনের অনুক্ত অথচ তীব্র আত্মধিক্কারের রূপ ধরেছে বলা চলে।[2]
উত্তর বাংলার তরাই অঞ্চলের ঘন জালে ঘেরা একটি জমিদারী এস্টেট – রামগড়। তার মালিক রাজাবাহাদুর বলে পরিচিত এন. আর. চৌধুরীর সঙ্গে (গল্পের কথক) এক মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর আলাপ, এবং ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ঠতা হয় বস্তুতপক্ষে, মনিব-মােসাহেব ধরনের যেন একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাদের ভিতরে – যদিচ, আপাতভাবে তা বন্ধুত্বের মােড়কেই বাধা!
এই হলাে এ-গল্পের পটভূমিকা। এ-হেন রাজাসাহেবের আমন্ত্রণে তার জমিদারীতে কথক আমন্ত্রিত হলেন শিকার দেখতে। প্রভূত আদর-আপ্যায়নের মধ্যেও অহংকারী এই ভূম্যধিকারীর চরিত্রের আরাে নানা অন্ধকার তার সামনে উদ্ঘাটিত হতে থাকে। অন্যদিকে বেশ কয়েক রাত জঙ্গলে কাটানাের পরেও শিকার বলতে গেলে মেলে না কিছুই। সেই ‘ব্যর্থতা’ রাজাসাহেবের সামন্ততান্ত্রিক অহমিকাকে প্রবলভাবে আহত করে তােলে এবং তিনি কথা’ দেন যে, নায়কের অরণ্যবাসের শেষরাত্রে একটা অত্যাশ্চর্য শিকারের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হবেনই গল্পের কথক ।[3]
শিকারের বিলি-ব্যবস্থা হলাে সত্যিই অভিনব ভাবে। রাজাসাহেবের হান্টিং বাংলােটা চারশাে ফিট খাড়াই পাহাড়ের ওপরে। তার পিছন দিকে একটা কাঠের ঝুলবারান্দার মতাে লম্বা পাটাতন থেকে নিশুতি রাতের স্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে একজোড়া কপিকলের সাহায্যে সাদা পুঁটলিতে জড়ানাে কি যেন একটা নিচের নদীর পাড়ে, জলের ধারে নামিয়ে দেওয়া হলাে। দীর্ঘসময় কাটবার পর হঠাৎ স্তব্ধতা ভাঙে গুলির আওয়াজে – রাজাবাহাদুরের অমােঘ রাইফেলের বুলেট গিয়ে বিধেছে ঐ পুঁটলিবাঁধা ‘টোপ’-এর লােভে আসা বিশাল রয়্যাল বেল টাইগারের কপালে। ঠিক সেই মুহূর্তে মরণাহত ব্যাঘ্রের গর্জনের ভয়াল ধ্বনির মধ্য থেকেও ভেসে এল চারশাে ফিট ওপরে ঐ ঝুলন্ত মাচান অবধি একটি শিশুর অস্ফুট গােঙানির আওয়াজ। বিমূঢ় হয়ে, ও কিসের আওয়াজ, বাঘের জন্য কেমন ‘টোপ’ নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই প্রশ্ন শুধােতেই ‘রাজা’ এন. আর. চৌধুরীর বন্দুকের নল স্পর্শ করে কাহিনী কথকের মধ্যবিত্ত বুকের দুর্বল ছাতি আর তার কানে আসে চুপ করে থাকার জন্য প্রচণ্ড এক ধমক।
দীর্ঘ আটমাস পরে পার্শেলে পাঠানাে একজোড়া বাঘের চামড়ার মহার্ঘ চটি উপহার পেয়ে, গল্পকথক প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে না পারলেও, অচিরেই তার স্মরণে এল ঐ তরাই জালে ‘টোপ’ ফেলে বাঘ শিকারের ঘটনা। যদিও সেই স্মৃতি নাগরিক জীবনে বেমানান বলে তখন তাঁর থেকে মূল্যবান চটিজোড়ার দিকে মনোযোগ দেওয়াটাই শ্রেয় বলে মনে করেন কথক।[4]
‘টোপ’ – বিষয়ভাবনা ও রােমাঞ্চকর ঘটনার চমৎকারিত্বে সকলকে আকৃষ্ট করেছে। এ গল্পের কাহিনী উপস্থাপনায় গল্পের কথক, শিকার-বিলাসী রাজা-বাহাদুর ও গহন অরণ্যের ভয়াল পরিবেশ একটি অদৃশ্য সূত্রে আবদ্ধ। কাহিনীটি বিশেষ বড় না হলেও, ঘটনার অভাবনীয়তায় ও বর্ণনায় সৌকর্যে সংহত ও দৃঢ়পিনদ্ধ রূপ পেয়েছে। [5]
টোপ গল্পের নাম ব্যঞ্জনাধর্মী ও সবিশেষ মর্মান্তিক। রাজা বাহাদুরের শখ হােল শিকার। আর সে শিকারের জন্য, ছাগশিশু নয়, একটি জীবন্ত মানব-শিশুকে ব্যবহার করার মধ্যে যে অমানবিক নিষ্ঠুর মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা ভয়ঙ্কর। বাঘ শিকারের জন্য এই হিংস্রতম আয়ােজন কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে সম্ভব কিনা তা ভাববার বিষয়। কিন্তু সত্য অনেক সময় কল্পনার চেয়েও অদ্ভুত হয়।
গল্পটিতে লেখক মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজের রাজা-বাদশা-জমিদারদের বিকৃত খেয়ালি চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়। আরণ্য পরিবেশ ও ভাবমণ্ডল সৃষ্টিতে যে বর্ণনার সাহায্য নেওয়া হয়েছে তা অসাধারণ শিল্পপ্রতিভার স্বাক্ষর। গল্পটি লেখকের অসাধারণ শক্তিমত্তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।[6]
রেডিও মির্চির অডিও স্টোরি সিরিজ সানডে সাসপেন্সে 'টোপ' গল্পটিকে অডিওস্টোরি রূপ প্রদান করা হয়েছে।
পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত 'টোপ' অবলম্বনে 'টোপ' নামে ২০১৭ সালে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। [7]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.