Loading AI tools
যুদ্ধ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
খায়বারের যুদ্ধ (আরবি: غزوة خيبر, হিব্রু: קרב ח'ייבר) ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন আরবের মদিনা নগরী থেকে ১৫০ কিলোমিটার (৯৩ মা) দুরে অবস্থিত খায়বার নামক মরুভূমিতে বসবাসরত ইহুদিগণের সাথে মুসলিমগণের সঙ্ঘটিত একটি যুদ্ধ। মুসলিমদের ইতিহাস অনুসারে, মুসলিমগণ সেখানে দুর্গে আশ্রয় নেয়া ইহুদিদেরকে আক্রমণ করেছিল ।[4]
খায়বারের যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: মুহাম্মাদ সা. এর সামরিক অভিযানসমূহ | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
মুসলিম সেনাবাহিনী | খায়বার মরুভূমির ইহুদিগণ | ||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
আলী ইবনে আবি তালিব |
আল-হারিস ইবনে আবু জয়নব†[1] মারহাব ইবনে আবু জয়নব†[1] | ||||||
শক্তি | |||||||
১,৬০০ |
খায়বার ১০,০০০[2] বনু গাফতান ৪,০০০[2] | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
২০ জনের কম নিহত হন[3] ৫০ আহত | ৯৩ জন নিহত |
সপ্তম হিজরিতে খায়বারের ইহুদিরা পরিকল্পনা করে মদীনা আক্রমণ করার কারণে খায়বার যুদ্ধ হয়। খায়বার মদীনা থেকে ৮০ মাইল দূরের একটি বড় শহর। এখানে ইহুদীদের অনেকগুলো দুর্গ ও ক্ষেত খামার ছিল। মূলত খায়বার ছিল ইহুদীদের একটি উপনিবেশ। খায়বারের ইহুদীরা বনু কোরাইজা গোত্রের ইহুদীদেরকে বিশ্বাসঘাতকায় উদ্দীপিত করেছিল। মুহাম্মাদ সা. কে হত্যা করার পরিকল্পনা এই খায়বার থেকে করা হতো। খায়বারের ইহুদীরা গাতাফান গোত্র ও বেদুঈনদের সাথে মিলিত হয়ে মদীনা আক্রমণ করার ব্যাপারে পরিকল্পনা করছিল। খায়বার যুদ্ধে পরাজিত ইহুদীদেরকে মুহাম্মাদ সা. কোন নির্বাসন দেন নি। প্রতি বছর তাদের উৎপাদিত ফল ফসলের অর্ধেক ইহুদীরা মুসলমানদের কে দিবে এই শর্তে খায়বারের ইহুদীরা খায়বারে থাকার অনুমতি পায়। কিন্তু এই খায়বার যুদ্ধের পর পর এক ইহুদী মহিলা মুহাম্মাদ সা. কে আমন্ত্রণ করে ছাগলের মাংসের ভিতরে বিষ মিশিয়ে মুহাম্মাদ সা. কে হত্যা করতে চেয়েছিল। এই ঘটনার পরেও মুহাম্মাদ সা. খায়বারের সকল ইহুদীদের কে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।
আক্রমণের কারণ প্রসঙ্গে, স্কটিশ ঐতিহাসিক উইলিয়াম মন্টগোমারি ওয়াট খায়বার যুদ্ধে বনু নাদির গোত্রের উপস্থিতি উদ্ধৃত করেন, যারা মদিনার ইসলামী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী আরব গোত্রগুলোর মধ্যে শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা জাগিয়ে তুলছিল। ইতালীয় প্রাচ্যবিদ লরা ভেক্সিয়া ভ্যাগ্লিয়েরি ওয়াটের তত্ত্বের সাথে সহমত পোষণ করে দাবী করেন যে, যুদ্ধের পেছনে আরও কারণ থাকতে পারে, যেগুলো হল, ইহুদিদের উক্ত দুরভিসন্ধির প্রতিক্রিয়া মুহাম্মাদের সাহাবীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধ অভিযানসমূহের রসদ হিসেবে যুদ্ধলব্ধ মালামালসমূহ লুণ্ঠনের উপযোগিতা। [5][6]
পরিশেষে খায়বারের ইহুদিগণকে অবরোধ করা হয় এবং উক্ত উপত্যকায় তাদেরকে থাকার অনুমতি দেয়া হয় এই শর্তে যে, তারা মুসলিমগণকে তাদের উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক বাৎসরিকভাবে প্রদান করবে। খলিফা ওমররের সময়ে ওমর কর্তৃক বহিষ্কৃত হওয়ার আগ পর্যন্ত ওখানেই তাদের বসবাস অব্যাহত ছিল। এই বিজয়ের ফলাফলস্বরূপ বিজিত ইহুদিদের উপর ইসলামের বিধান অনুযায়ী জিজিয়া কর আরোপ করা হয় এবং তাদের অধিভুক্ত জমিসমূহ মুসলিমদের প্রশাসনিক দখলের অন্তর্ভুক্ত হয়।[5][7][8] বিনিময়ে, ইহুদিগণ তাদের ধর্মপালনের অনুমতি পায়, বৃহৎ পরিসরে নিজ সম্প্রদায়ের স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করে, মুসলিমদের কাছ থেকে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে প্রতিরক্ষা লাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করে এবং তাদেরকে সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ এবং যাকাত প্রদানের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়, যেগুলো মুসলিম নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক।
৭ম শতাব্দীতে, খায়বার ছিল ইহুদিদের বাসস্থান। উক্ত ইহুদি অধিবাসীগণ খাইবারে তাদের একটি দুর্গে কামান, তলোয়ার, বর্শা, ঢাল এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র মজুদ করে রেখেছিল। অতীতের কিছু পণ্ডিত ব্যক্তিবর্গ দুর্গে অস্ত্রশস্ত্র জমা রাখার কারণ এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, উক্ত অস্ত্রশস্ত্রগুলো সম্প্রদায়ের পরিবারগুলোর মধ্যে বিবাদ জন্ম দেয়ার উদ্দেশ্যে জমা রাখা হয়েছিল। ভ্যাগ্লিয়েরি মনে করেন যে, "উক্ত অস্ত্রগুলো ভবিষ্যতে বিক্রির জন্য গুদাম হিসেবে সেখানে জমা রাখা হয়েছিল" এটা ভাবা পূর্বের অনুমিত কারণ থেকে অধিক যৌক্তিক। একইভাবে, ইহুদিগণ উক্ত দুর্গে ২০ বস্তা কাপড়, ৫০০টি আলখাল্লা এবং সাথে আরও অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র বিক্রির জন্য সেখানে জমা রেখেছিল। ভেগ্লিয়েরির মতে এ সকল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেভাবে তাদের মধ্যে প্রতিহিংসার জন্ম দিয়েছিল, ঠিক একইভাবে ইতিহাস জুড়ে অনেক দেশের নিপীড়নের পেছনে এরকম অর্থনৈতিক কারণের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।[5]
সমগ্র খায়বার মরুভূমি তখন তিনটি এলাকায় বিভক্ত ছিল: আল-নাতাত, আল-শিক্ক, এবং আল-কাতিবা, যেগুলো সম্ভবত মরুময়তা, আগ্নেয়গিরির খাদ এবং জলাধারের মত বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি এলাকাতেই একাধিক দুর্গ এবং আস্তানাসহ বাড়িঘর, গুদামঘর এবং ঘোড়াশাল ছিল। প্রতিটি দুর্গই একেকটি পৃথক পরিবারের অধীনে ছিল এবং আবাদি ফসল ও খেজুরবাগান দিয়ে ঘেরা ছিল। নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করার জন্য তারা পাহাড়ের চুড়ায় অথবা উঁচু পাথুরে এলাকায় তাদের দুর্গগুলো স্থাপন করত।[5]
৬২৫ সালে মুসলিমদের দ্বারা মদিনা থেকে নির্বাসিত হওয়ার পর, বনু নাদির গোত্র খাইবার ময়দানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। ৬২৭ খ্রিষ্টাব্দে খন্দকের যুদ্ধের সময় বনু নাদির গোত্রের প্রধান হুয়াই ইবনে আখতাব তার পুত্রকে সাথে নিয়ে মক্কাবাসী এবং মদিনা বিরোধী বেদুঈনদের সাথে যোগ দেয়।[9] উপরন্তু নাদির গোত্র অন্যান্য আরব গোত্রকে মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অর্থও প্রদান করে। এছাড়াও তারা বনু গাতাফান গোত্র থেকে ফসলের অর্ধাংশ ঘুষ নিয়ে তাদের ২০০০ পুরুষ এবং ৩০০ ঘোড়া সওয়ারীকে যুদ্ধে যাওয়া থেকে বাঁচিয়ে দেয় এবং একইভাবে বনি আসাদ গোত্রকেও ধোঁকা দিয়ে রাজি করে।[10][11][12] বনু সুলাইম গোত্রকেও তারা যুদ্ধে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নেয়, কিন্তু সুলাইম গোত্রের কিছু নেতা ইসলাম ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ার কারণে তারা তাদেরকে মাত্র সাতশত জন সেনা প্রদান করে। বনু আমির গোত্র মুহাম্মাদ সা. এর সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকার কারণে সম্যকভাবে যুদ্ধে যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।[13] যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, হুয়াই ইবনে আখতাব বনু কুরাইজা গোত্রকে চুক্তিভঙ্গ করে মুহাম্মাদ সা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচিত করে।[14] যুদ্ধে মিত্রবাহিনীর পরাজয় এবং বনু কুরাইজার আত্মসমর্পণের পর, হুয়াইকে (যে কিনা সেই সময়ে কুরাইজাদের দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল) এবং কুরাইজার পুরুষদেরকে হত্যা করা হয়। হুয়াইয়ের মৃত্যুর পর, আবু আল-রাফি ইবনে আল-হুকাইক খাইবারের বনু নাদির গোত্রের দায়িত্ব নেয়। অল্প সময় পরই হুকাইক মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান প্রস্তুত করার অন্য প্রতিবেশী গোত্রগুলোর সাথে যোগাযোগ শুরু করে।[15][16] এ ঘটনা জানার পর, মুসলিমগণ ইহুদিদের ভাষাভাষী এক আরবের সহায়তা নিয়ে হুয়াইকে গোপনে হত্যা করে।[17]
এরপর হুকাইকের স্থলাভিষিক্ত হন উসাইর ইবনে যারিম। একটি সূত্রে বলা হয়েছে যে,[18] উসাইর গাতাফান গোত্রের সাথে সলাপরামর্শ শুরু করেছিল এবং গুজব ছড়ায় যে সেও "মুহাম্মাদের রাজধানী" মদিনা আক্রমণের অভিপ্রায়ে ছিল। এই খবর পেয়ে নবী মুহাম্মাদ সা. আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহাকে আব্দুল্লাহ ইবনে উনাইস, বনু সালিমা গোত্রের একজন সদস্য এবং ইহুদি বিরোধী একটি গোত্রসহ আরও অনেককে সাথে নিয়ে উসাইরের কাছে প্রেরণ করেন। তারা উসাইরকে বলেন যে, সে মুহাম্মাদ সা. এর কাছে গেলে মুহাম্মাদ সা. তার সাথে সাক্ষাৎ করবেন এবং তাকে সম্মান দেবেন। সে রাজি না হওয়া পর্যন্ত তারা তাকে অনুরোধ করতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত সে কিছু ইহুদিকে সাথে নিয়ে তাদের সাথে রওয়ানা হয়। খাইবার থেকে ছয় মাইল দুরে কারারা নামক স্থানে আসার আগ পর্যন্ত উসাইর স্বাভাবিক ছিলেন, আচমকা তিনি তাদের সাথে যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। উসাইর আবদুল্লাহর তলোয়ার কেড়ে নিতে উদ্যত হলে আবদুল্লাহ তার দিকে ছুটে এসে তার পা কেটে দেন। আবদুল্লাহকে উসাইর তার হাতে থাকা কাঠের লাথি দিয়ে আঘাত করলে তিনি মাথায় চোট পান। এরপর সেখানে উপস্থিত মুসলিমগণ তার ৩০ জন ইহুদি সঙ্গীর মাঝে সকলকে হত্যা করে একজনকে বাদে যে কিনা দৌড়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল।[19] এছাড়াও আবদুল্লাহ ইবনে উনাইস খাইবার যুদ্ধের আগের দিন মুহাম্মাদ সা. এর অনুমতিতে স্বেচ্ছায় বনু নাদির গোত্রের সাল্লাম ইবনে আবু আল-হুকাইককে গোপনে হত্যা করেন।
অনেক ইসলামী পণ্ডিত উপরে উল্লেখিত চক্রান্তসমূহকে খায়বার যুদ্ধের কারণ বলে মনে করেন। মন্টগোমারি ওয়াটের বক্তব্য অনুযায়ী, তাদের এই কুচক্রী প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডের কারণে মুহাম্মাদ সা. এর কাছে আক্রমণ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।[20] ভ্যাগ্লিয়েরি আরও যোগ করেন যে, আক্রমণের আরেকটি কারণ হতে পারে যে , খাইবারের এই ইহুদিরাই উহুদের যুদ্ধে চুক্তিতে আবদ্ধ মিত্রবাহিনীর বিরোধিতার জন্য দায়ী ছিল।[5] শিবলী নোমানীও ভ্যাগ্লিয়েরির সাথে ঐকমত্য্য পোষণ করেন, এবং তিনি বনু নাদির গোত্রের হুয়াই ইবনে আখতাবকে এর জন্য দায়ী করেন, যে কিনা বনু কুরাইযা গোত্রকে খন্দকের যুদ্ধে মুহাম্মাদ সা. এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য প্ররোচিত করেছিল।[15]
৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে, মুসলিমগণ মক্কায় উমরাহ পালনের জন্য অগ্রসর হলে[21] কুরাইশদের সাথে দীর্ঘ আপোস ও আলোচনার পর মুসলিমগণ কুরাইশ-মুসলিম যুদ্ধ বন্ধ করার চুক্তিতে কুরাইশদের সাথে একটি সন্ধিচুক্তি স্থাপন করে। উক্ত সন্ধিচুক্তিতে মুসলিমদেরকে নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে তাদের এই ভবিষ্যত অভিযানে কুরাইশগণ পেছন থেকে কোন প্রকার আক্রমণ করবে না।[5]
মুহাম্মাদের সাথে যুদ্ধ আসন্ন বলে মনে হওয়ায় খায়বারের ইহুদিগণ ফাদাক মরুভূমির ইহুদিগণের সাথে একটি মৈত্রীবন্ধন বা জোট স্থাপন করে। এছাড়াও তারা বেদুঈন গাতাফান গোত্রকেও ফসলের অর্ধেক প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যুদ্ধে তাদের পক্ষে যোগ দেয়ার জন্য রাজি করিয়ে ফেলে। যাই হোক, উক্ত তিন শক্তির তুলনায় মুহাম্মাদের সৈন্যবাহিনীকে খায়বারবাসীর মুকাবেলা করার জন্য সেরকম শক্তিশালী ও প্রস্তুত বলে মনে হচ্ছিল না। মুহাম্মাদের সেনাবাহিনী ছোট জানতে পেরে তারা আসন্ন যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতি নেয়া প্রায় বন্ধই করে দিল, তাছাড়া তাদের পরিবারগুলোর মধ্যে চলমান পূর্ববর্তী ঝগড়া তাদেরকে তাদেরকে পূর্বের মতই বিশৃঙ্খল করে রাখল।[5] বনু গাতাফানের সাথে সংশ্লিষ্ট গোত্র বনু ফাজারাও মুসলিমদের সাথে সন্ধি স্থাপনে ব্যর্থ হওয়ার পর খায়বারবাসীকে যুদ্ধে সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব করে।[22]
যুদ্ধ চলাকালে, মুসলিমগণ গাতাফান গোত্রকে খায়বারবাসীর সহায়তায় ৪০০০ সেনা প্রদান করার গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন থেকে বিরত রাখতে সক্ষম হয়। এর একটি কারণ হিসেবে মনে করা হয় যে, মুসলিমগণ ইহুদিদের বেদুঈন মিত্রদের অর্থ দিয়ে কিনে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি ওয়াট আরও দাবি করেন যে, গাতাফানদের দুর্গে মুসলিমদের হামলা করার গুজবও এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।[23][24] তাবারির মতে, খায়বার যুদ্ধে মুহাম্মাদ আল রাযী উপত্যকায় প্রথম যাত্রাবিরতি করেন। টানা এক দিন সফরের পর গাতাফানের লোকেরা মুসলিম বাহিনীর আগমন টের পায় এবং নিজ পরিবার ও সম্পদ রক্ষা করার জন্য খায়বারবাসীকে সাহায্যের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে, যা মুহাম্মাদের সেনাবাহিনীর বিজয়ের পথকে আরও প্রশস্ত করে দেয়। [25] আরেকটি বর্ণনা প্রচলিত আছে যে, একটি রহস্যময় কণ্ঠ গাতাফান গোত্রকে বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে তাদেরকে নিজ নিজ ঘরে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রভাবিত করে।[26]
৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে, অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে মুসলিমগণ খাইবার যুদ্ধের জন্য রওয়ানা হয়।[27] বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, সে সময় মুসলিম বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৪০০ থেকে ১৮০০ জন এবং সাথে ঘোড়া ছিল ১০০ থেকে ২০০ টি। উম্মে সালামা সহ বেশ কিছু মুসলিম মহিলা আহত সৈন্যদের দেখাশুনা করার জন্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।[28] খায়বারের ১০০০০ সৈন্যের তুলনায় মুসলিম সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল নগণ্য, কিন্তু এই নগণ্য সদস্য সংখ্যাই মুসলিমদের সুবিধা করে দিয়েছিল। স্বল্প সংখ্যক হওয়ার কারণেই মুসলিমগণ নীরবে ও দ্রুতবেগে খায়বারের দিকে মাত্র তিনদিনের মধ্যে অগ্রসর হয়ে আকস্মিকভাবে নগরীতে প্রবেশ করতে পেরেছিল।[29]) এছাড়া বৃহৎসংখ্যক সৈন্য খাইবারবাসীকে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল।[30] ফলস্বরূপ, ইহুদিগণ কেন্দ্রীয়ভাবে সংগঠিত হয়ে মুসলিমদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়, এবং ইহুদি পরিবারগুলোর হাতে নিজ নিজ দুর্গ রক্ষা করার দায়িত্ব ছেড়ে দেয়।[5][23][23] খাইবারের ইহুদিগণ মুসলিমদের শক্তিকে ছোট করে দেখার কারণেই মুহাম্মাদের পক্ষে আপেক্ষিক স্বচ্ছন্দে একটির পর একটি করে প্রতিটি দুর্গ জয় করা সহজ হয়ে গিয়েছিল, এবং সাথে খাদ্য, যুদ্ধাস্ত্র এবং পারিপার্শ্বিক জমিসমূহ দখলও।[31] আনাস ইবনে মালিক বলেন:"আমরা খায়বারে পৌঁছে দেখতে পেলাম সকাল বেলা খাইবারের শ্রমিকরা কোদাল ও ঝুড়ি নিয়ে দিনের কাজে বেরুচ্ছিল। রাসূলুল্লাহ ও তাঁর বাহিনিকে দেখে তারা সবিস্ময়ে বলে উঠলো, “সর্বনাশ! মুহাম্মাদ তার বাহিনীসহ হাজির হয়েছে দেখছি”- বলেই তারা পালিয়ে পেছনে ফিরে যেতে লাগলো। সে দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ বললেন, “আল্লাহু আকবার! খাইবারের পতন ঘটেছে। আমরা কোন জনপদে আগমন করলেই তার অধিবাসীর সকাল বেলাটা দুর্ভাগ্যময় হয়ে ওঠে।”[32]
কোন একটি দুর্গের সম্মুখে একটি উল্লেখযোগ্য রক্তক্ষয়ী দাঙ্গার পর ইহুদিগণ প্রকাশে লড়াই এড়িয়ে যায়। লড়াইয়ের অধিকাংশ অংশই অনেক দূর থেকে তির নিক্ষেপণের মাধ্যমে চালিয়ে যাওয়া হয়। প্রতিটি দুর্গেই মুসলিমগণ কমপক্ষে একবার করে আক্রমণ করে। অবরুদ্ধ ইহুদিদের দুর্গের প্রতিরোধ ক্ষমতা অপেক্ষাকৃত দুর্বল হওয়ার কারণে তারা অন্ধকারের আশ্রয় নিয়ে দুর্গের লোকজনকে মালামালসহ এক দুর্গ থেকে আরেক দুর্গে সরিয়ে নেয়।[5]
ইহুদি এবং মুসলিমগণ কেহই এই দীর্ঘ সময়ের অবরোধের জন্য প্রস্তুত ছিল না, এবং এই অপরিণামদর্শিতার কারণে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রথমদিকে ইহুদিগণ তাদের লোকবল নিয়ে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কারণে একটি ক্ষুদ্র অবরোধের মধ্যে পরিমাণমত পানি সরবরাহ করতেও ব্যর্থ হয়।[33] অভিযানের শুরুর দিকে ক্ষুধার্ত মুসলিমগণ তাদের ক্ষুধা মেটাতে যুদ্ধের প্রয়োজনে নিয়ে আসা কিছু গাধা জবাই করতে বাধ্য হয়। পূর্বে মুহাম্মাদ ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধার গোশত খেতে নিষেধ করলেও উক্ত পরিস্থিতিতে একটি বতিক্রম নীতি প্রদান করেন যে, কোন পরিস্থিতিতে যদি কোন হালাল খাদ্য পাওয়া না যায় তবে জীবন বাঁচানোর তাগিদে কোন ব্যক্তির জন্য নিষিদ্ধ খাদ্যসমূহ খাওয়া বৈধ হবে।[26]
নাতাত ও শিক দুর্গ দখলের পর, অবশেষে কঠোরভাবে প্রহরায় পরিবেষ্টিত কামুস দুর্গ অবরোধ করা বাকি ছিল, যা মুসলিমগণ ১৩তম থেকে ১৯তম দিন পর্যন্ত অবরোধ করে রেখেছিলেন।[31]
উক্ত দুর্গ দখলের জন্য একাধিক একক দলে বিভক্ত হয়ে মুসলিমদের বেশ কিছু উদ্যোগ ব্যর্থ হয়।[34] নবী মুহাম্মাদ দুর্গটি অধিকার করার জন্য সর্বপ্রথম আবু বকর সিদ্দীককে পতাকা দিয়ে পাঠালেন। তিনি যুদ্ধ করলেন। অনেক চেষ্টা করেও তিনি দুর্গ জয় করতে না পেরে ফিরে এলেন। পরদিন উমার ইবনুল খাত্তাবকে পাঠালেন। তিনিও তুমুল যুদ্ধ করলেন। কিন্তু অকৃতকার্য হয়ে ফিরে এলেন। তখন মুহাম্মাদ বললেন, “কাল সকালে আমি এমন একজনকে পতাকা দেবো যিনি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসেন। আল্লাহ তার হাতেই দুর্গ জয় করাবেন।[35] তিনি যুদ্ধের ময়দান থেকে কখনো পালাবার মত লোক না।” নবী মুহাম্মাদ আলী ইবনে আবি তালিবকে ডাকলেন। [36] তিনি তখন চোখের রোগে ভুগছিলেন। মুহাম্মাদ তার চোখে থু থু দিলেন এবং বললেন, “এই পতাকা নিয়ে এগিয়ে যাও। আল্লাহ যতক্ষণ তোমার হাতে বিজয় না দেন ততক্ষণ লড়াই করে যাও।” এরপর তিনি এগিয়ে গেলেন। তিনি ছিলেন প্রচন্ড বলবীর্যবান ও পরাক্রমশালী। তিনি শুধু হেলেদুলে পায়তারা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি কিল্লার নিচে একটা পাথর স্তুপের মধ্যে পতাকা স্থাপন করলেন। ওপর থেকে একজন ইয়াহুদী তাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কে?” তিনি বললেন, “আমি আবু তালিবের পুত্র আলী।” ইয়াহুদী বললো “তাওরাতের শপথ! তোমরা বিজয়ী হয়েছো।” তিনি দুর্গের নিকট পৌঁছুলে ইহুদি সেনাদল দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো এবং যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ চলাকালে এক ইহুদির ধাক্কায় আলী তার ঢাল হারিয়ে ফেলেন। বিকল্প হিসেবে নিজেকে রক্ষা করার জন্য তিনি দেয়াল থেকে একটি দরজা তুলে নেন। বলা হয়ে থাকে, দরজাটি এতোই ভারি ছিল যে পুনরায় একে এর কব্জায় বসানোর জন্য আটজন লোককে মিলে এটিকে তুলতে হয়েছিল।[26] কিছু শিয়া সূত্র আরও দাবি করে যে, "দুর্গ ভেঙ্গে ফেলার সময় এসে পরলে আলী দরজাটিকে এমনভাবে ছুঁড়ে ফেলেন যার ফলে তা দুর্গের দেয়ালের উপর একটি সেতুর আকার নেয় এবং সৈন্যরা এর উপর দিয়ে গিয়ে দুর্গের ভিতরে প্রবেশ করার সুযোগ পায়।" এভাবে যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুসলিমদের বিজয় অর্জিত হয়। নবী মুহাম্মাদ আলীকে উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করে তার অনুসারী সাহাবীদের বিশ্বাসকে জাগিয়ে তুললেন এবং আলীকে আসাদুল্লাহ বা আল্লাহর সিংহ উপাধিতে ভূষিত করলেন।[37]
ইহুদিগণ আত্মসমর্পণের শর্তসমূহ আলোচনা করার জন্য তড়িৎ মুহাম্মাদের সাথে সাক্ষাৎ করল। [34] আল ওয়াতি এবং এবং আল সুলাইম গোত্রের লোকেরা মুসলিমদের কাছে এই শর্তে আত্মসমর্পণ করল যে তাদের প্রতি সদয় আচরণ করা হবে এবং মুসলিমগণ তাদের রক্তপাত করা থেকে বিরত থাকবে। মুহাম্মাদ উক্ত শর্তসমূহ মেনে নিলেন এবং উক্ত দুই দুর্গ থেকে কোন মালামাল ও সম্পদ অধিগ্রহণ করলেন না।[38]
ঐতিহাসিকগণ ইহুদি পালওয়ান মারহাবকে হত্যার ঘটনা সম্পর্কে বিভিন্নরকম বর্ণনা দিয়েছেন।[39][40][41] কিছু উৎসে বলা হয়েছে যে কামুস দুর্গের অভিযানের সময় অথবা নাইম দুর্গ দখলের সময় আলী ইবনে আবি তালিব মারহাবকে হত্যা করেন। অপরদিকে ইবনে হিশাম রচিত মুহাম্মাদের জীবনী সহ আরও কিছু উৎসে বলা হয়েছে যে, সাহাবী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা নবী মুহাম্মাদের নির্দেশে মারহাবকে হত্যা করেন এবং তা কামুস দুর্গ দখলের ঘটনার পূর্বেই সঙ্ঘটিত হয়[42]।
আলীর সাথে সম্পর্কিত বহুল প্রচলিত বর্ণনাটি নিম্নরূপ:
আলী কামুসের দরজায় এসে পৌঁছুলে ইহুদিদের অন্যতম দলপ্রধান এবং অভিজ্ঞ যোদ্ধা মারহাব তার সাথে দেখা করল। মারহাব বলে উঠলো: "খায়বার খুব ভাল করেই জানে যে আমি মারহাব, যার অস্ত্র ক্ষুরধার ও যুদ্ধের জন্য পরিক্ষিত। কখনো আমি বর্শা দ্বারা বিদ্ধ করি, কখনোবা তরবারি দ্বারা আঘাত করি, যখন আমার অগ্নিসম ক্রোধ সিংহের মত খেপে ওঠে।"[43]
উভয় যোদ্ধাই একে অপরকে আঘাত করলেন। দ্বিতীয় আঘাতের পর আলী তরবারি দিয়ে মারহাবের মস্তকবর্ম দু'টুকরো করে মাথা চিরে ফেললেন, এবং তার তরবারি মারহাবের দাঁতে গিয়ে ঠেকল। [44]
সহিহ মুসলিমেও উক্ত বর্ণনাটির উল্লেখ রয়েছে এভাবে: রাসুলুল্লাহ আলীর হাতে পতাকা দিলেন। এবারো মুরাহহাব (মারহাব) বেরিয়ে এল এবং কবিতা আওড়াতে লাগল “ খায়বার জানে যে, আমি মুরাহহাব, যুদ্ধের অস্ত্রে সজ্জিত এক অভিজ্ঞতাপূর্ণ বীর বাহাদুর ব্যক্তি। যখন যুদ্ধ তাঁর লেলিহান শিখা নিয়ে অগ্রসর হয়, তখন আলী বললেন, “আমি সে ব্যক্তি যাকে আমার মা ‘হায়দার’ (সিংহ) নাম রেখেছেন, যার দর্শন বন্য সিংহের মত ভয়ঙ্কর। আমি তাদের (দুশমনদের) প্রতিদান দেই বড় বড় পাত্র দিয়ে (অর্থাৎ তাদের অবলীলায়) হত্যা করি”। এরপর তিনি মুরাহহাবের মাথায় তলোয়ার মারলেন এবং তাকে হত্যা করলেন।[45]
ইবনে হিশামের সিরাত থেকে প্রাপ্ত মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা সম্পর্কিত বর্ণনাটি নিম্নরূপ:
“এক এক করে খাইবারের কিল্লাগুলো এবং তাদের ধনসম্পদ রাসূলুল্লাহ -এর হস্তগত হচ্ছিল। কেবল ওয়াতীহ ও সুলালিম নামক কিল্লা দুটি দখল করা তখনও বাকী ছিল। সবশেষে তিনি এ দুটি কিল্লা জয় করেন। এ দুটিকে তিনি দশদিনের অধিক সময় ধরে অবরোধ করে রাখেন।
ইয়াহুদ নেতা মরারহাব অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করে মুহাম্মাদের মুকাবিলায় এগিয়ে এসে একটি রণোদ্দীপক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলো। কবিতাটি হলোঃ
“সমগ্র খাইবার জানে যে, আমি মারহাব। (অর্থাৎ খুব প্রতাপশালী)
অস্ত্র দিয়ে আঘঅত করতে পারদর্শী, অভিজ্ঞ ও বহুদর্শী বীর।
কখনো এফোঁড় ওফোঁড় করে দিই আবার কখনো শক্ত আঘাত করি।
শার্দুলেরা যখন ক্রুদ্ধ হয়ে ধেয়ে আসে তখন আমার ধারে কাছেও
কেউ ঘেঁষতে পারে না।”
সে চ্যালেঞ্জ করলো,, “এসো আমার সাথে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করতে কে প্রস্তুত আছ?” কা’ব ইবনে মালিক রণসংগীত আবৃত্তি করেই তার জবাবে বললেন,
“খাইবার জানে যে আমি কা’ব। আমি দুঃখ দুর্দশা ঘুচাই, সাহসী ও অনমনীয়।
যখন যুদ্ধ বেঁধে যায় তখন যুদ্ধের পর যুদ্ধই চলতে থাকে।
আমার আছে বিজলীর আলোকচ্ছটার মত ধারালো তরবারীটা।
আমরা তোমাদেরকে পদদলিত করবো যাতে সব জটিলতার অবসান ঘটে।
এতে আমরা পুরস্কৃত হবো অথবা আমাদের কাছে
প্রচুর যুদ্ধলব্ধ সম্পদ চলে আসবে! (সে সম্পদ আসবে) বজ্রমুষ্ঠির আঘাতে
এবং তাতে কোন তিরস্কারের অবকাশ থাকবে না।”
মুহাম্মাদ বললেন, “এই লোকটির সাথে কে লড়তে প্রস্তুত আছে?” মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা বললেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, আমি তার সাথে লড়তে প্রস্তুত আছি। আল্লাহর কসম, আমি ভীষণ লড়াকু। আমি ওর থেকে স্বজন হত্যার প্রতিশোধ নিতে চাই। গতকাল সে আমার ভাইকে (মাহমুদ ইবনে মাসলামা) হত্যা করেছে।” মুহাম্মাদ বললেন “যাও। হে আল্লাহ, মারহাবকে পর্যুদস্ত করতে ওকে সাহায্য কর।” অতঃপর মুহাম্মদ ইবনে মাসলামা ও মারহাবকে মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হলো। একটি পুরনো বৃক্ষ তাদের মাঝখানে আড় হয়ে দাঁড়ালো। উভয়ে পালাক্রমে ঐ গাছের আড়ালে আশ্রয় নিতে লাগলো। এক সময় মারহাবের তরবারী মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ঢালে আটকে গেল। তৎক্ষণাৎ মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামা তরবারীর আঘাতে মরহাবকে হত্যা করলেন।[42]
যদিও, এ বিষয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোন সন্দেহ নেই যে, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাও খায়বারের যুদ্ধে সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেন এবং বেশ কিছু প্রসিদ্ধ ইহুদি নেতাকে হত্যা করেন।[39]
নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) খাইবারবাসীকে তাদের দুই দুর্গ ওয়াতীহ ও সুলালিমে অবরোধ করলেন। যখন তারা নিশ্চিতভাবে বুঝলো যে মৃত্যু ছাড়া আর কোন উপায় নেই তখন তারা তার কাছে প্রাণভিক্ষা চাইল এবং খাইবার থেকে তাদেরকে বহিস্কার করার প্রস্তাব দিল। নবী মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রস্তাব মেনে নিলেন ও প্রাণভিক্ষা দিলেন। ইতঃপূর্বেই তিনি তাদের আশঙ্কা আন্ নাতাহাহ ও আল কুতাইবার ভূমিসহ সমস্ত স্থাবর অস্থঅবর সম্পদ এবং ঐ দুটি দুর্গ ছাড়া সকল দুর্গ অধিকার করে নিয়েছিলেন। ফদাকবাসী যারা যুদ্ধের সময় খায়বারের মিত্র ছিল, তারা সমস্ত খবর জানতে পারলো। তারা মুহাম্মাদ কে তাদের প্রাণভিক্ষা দিয়ে বিতাড়িত করণ এবং জমিজমা ও ধনসম্পদ হস্তগত করার অনুরোধ জানালো। মুহাম্মাদ তাদের অনুরোধ গ্রহণ করলেন। ইয়াহুদীদের পক্ষ থেকে যারা এই অনুরোধ নিয়ে মুহাম্মাদ র নিকট গিয়েছিল তাদের মধ্যে মুহাইসা ইবনে মাসউদ ছিলো অন্যতম। সে ছিল বনু হারেসার লোক। খাইবারবসী এই ব্যবস্থা প্রথমে মেনে নেয়। কিন্তু পরে অনুরোধ করে যে আমাদেরকে বহিস্কার না করে অর্ধেক বর্গাভাগের ভিত্তিতে জমি চাষের কাজে নিয়োজিত করুন। তারা যুক্তি দেখাতে গিয়ে বলে যে এখানকার জমিজমা আমরাই ভাল আবাদ করতে সক্ষম এবং এ কাজে আমরাই সবচেয়ে অভিজ্ঞ ও পারদর্শী। মুহাম্মাদ এ প্রস্তাব মঞ্জুর করে তাদের সাথে আপোষরফা করলেন। তবে শর্ত আরোপ করলেন যে, আমরা ইচ্ছা করলেই তোমাদেরকে উচ্ছেদ করার অধিকার আমাদের থাকবে। ফাদাকবাসীও এই শর্তে তার সাথে আপোস করলো। এভাবে খায়বারবাসীর ন্যায় ফাদাকবাসীদের সাথেও একটি সন্ধিচুক্তি করা হল এবং খাইবার মুসলামানদের যৌথ সম্পদ এবং ফাদাক মুহাম্মাদ র ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হলো। কেননা ফাদাক জয় করতে সামরিক অভিযানের প্রয়োজন পড়েনি।[38]
‘কামূস’ দুর্গ বিজয়কালে মুহাম্মাদ কিছুসংখ্যক ইয়াহুদীকে আটক করেন। তাদের মধ্যে হুয়াই ইবনে আখতাবের কন্যা সাফিয়া অন্যতম। সে বনু নাদির গোত্রের কোষাধ্যক্ষ কিনানা ইবনে রাবীর স্ত্রী ছিল। তার দু’জন চাচাতো বোনও গ্রেফতার হয়। সাহাবীগণ নবীর কাছে সাফিয়াকে গ্রহণ করার অনুরোধ করলে মুহাম্মাদ সাফিয়াকে নিজের জন্য মনোনীত করেন এবং তাঁকে দাসত্ব হতে মুক্তি দিয়ে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।[46] দাহইয়া ইবন খালীফা কালবী মুহাম্মাদ র নিকট সাফিয়াকে চেয়েছিলেন। তিনি সাফিয়াকে নিজের জন্য গ্রহণ করে নিয়েছিলেন বলে দাহইয়াকে তার চাচাতো বোনকে দিয়ে দেন। ক্রমে খাইবারের গ্রেফতারকৃত লোকদেরকে সাহাবীদের সকলের মধ্যে বণ্টন করা হয়।
কেনানা ইবনে রাবিকে প্রশ্ন করা হয় যে, মদিনা প্রস্থানের সময় তারা যে গুপ্ত সম্পদ নিয়ে গিয়েছিল তা কোথায় রেখেছে, তিনি উত্তরে ওই সম্পদের দাবি অস্বীকার করেন। তাকে বলা হল যে, যদি সেরকম কোন সম্পদ খুঁজে পাওয়া যায়, তবে মিথ্যে দাবির শাস্তিস্বরূপ তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। কেনানা তাতে রাজি হলেন। এরপর কোন এক সময় এক ইহুদি মুহাম্মাদ কে বললেন যে, লা রাবিকে প্রতিদিন সকালে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দেখা যেতো। যখন ওই স্থানটি খোঁড়া হল, তখন সেখানে ওই সম্পদের কিছু অংশ পাওয়া গেল। ফলশ্রুতিতে কেনানা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হল।[46][47][48] শিবলী নোমানী এই বর্ণনাকে অস্বীকার করে দাবি করেন যে, কেনানাকে হত্যা করা হয়েছিল কারণ পূর্বে সে মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামার ভাই মাহমুদ ইবনে মাসলামাকে হত্যা করেছিল।[49] কিন্তু আল ওয়াকিদির বর্ণনার সাথে নোমানীর এই দাবির পরস্পরবিরোধিতা খুঁজে পাওয়া যায়, যেখানে বলা হয় মারহাব নিজে নিহত হবার অল্প কিছুদিন আগে মাহমুদকে হত্যা করেছিলেন। [50]
আপোষরফার পর সাল্লাম ইবনে মুসকামের স্ত্রী যায়নাব বিনতে হারেস তাঁকে একটি ভুনা বকরী উপহার দিল। ভুনা ছাগলটি পাঠানোর আগে সে জিজ্ঞেস করে, “রাসূলুল্লাহ বকরীর কোন্ অংশ খেতে বেশি পছন্দ করেন?” তাকে জানানো হলো যে, তিনি উরু বা রানের গোশত বেশি পছন্দ করেন। তখন সে উরুতে বেশি করে বিষ মিশিয়ে দেয়। অতঃপর পুরো ছাগলটিকে মুহাম্মাদ র নিকট নিয়ে আসে। তা থেকে মুহাম্মাদ এক টুকরো গোশত চিবালেন কিন্তু গিললেন না। সাহাবী বিশর ইবনে বারা ইবনে মা’রুরও তাঁর সাথে বসে খাচ্ছিলেন। বিশরও এক টুকরো গোশত মুখে নিয়ে চিবালেন। তিনি গেলে ফেললেন। কিন্তু মুহাম্মাদ উগরিয়ে ফেলে দিলেন। তিনি বললেন, “এই হড্ডিটা আমাকে জানিয়ে দিচ্ছে যে, তা বিষাক্ত।” অতঃপর তিনি মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন। সে স্বীকারোক্তি করলো। তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এমন কাজ কেন করলে?” সে বললো, “আপনি আমার কওমের সাথে কি আচরণ করেছেন তা আপনার জানা আছে। আমি ভাবলাম আপনাকে এভাবে বিষ খাওয়াবো। আপনি যদি কোন রাজা-বাদশাহ হয়ে থাকেন তাহলে আপনার হাত থেকে উদ্দার পাবো আর যদি নবী হয়ে থাকেন হাহলে তো আপনাকে (আল্লাহর তরফ থেকে) সাবধান করে দেয় হবে।” এ কথা শুনে মুহাম্মাদ তাকে মাফ করে দিলেন। কিন্তু বিশর যে টুকরাটি খেয়েছিলেন তাতেই তিনি মারা গেলেন।[51][52] খাইবার বিজয় সম্পন্ন করার পর মুহাম্মাদ ওয়াদিউল কুরাতে চলে গেলেন। সেখানকার অধিবাসীদের কয়েকদিন অবরোধ করে রাখেলেন, অতঃপর মদীনা চলে গেলেন।
খায়বার বিজয়ের কারণে সাহাবীগণ এবং স্থানীয় বেদুঈন গোত্রগুলোর কাছে মুহাম্মাদের মর্যাদা অনেক বেড়ে যায়। স্থানীয় বেদুঈনগণ মুহাম্মাদের ক্ষমতা অনুধাবন করে তার আনুগত্য স্বীকার করে এবং ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়। খায়বার যুদ্ধের যুদ্ধলব্ধ মালামাল এবং অস্ত্রসমূহ তার সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করে, এবং খায়বার বিজয়ের মাত্র ১৮ মাস পরেই মুহাম্মাদ মক্কা দখল করতে সক্ষম হন।[5][23]
মূলধারার সুন্নিদের মতামত অনুযায়ী, সহিহ বুখারি গ্রন্থে খায়বার যুদ্ধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে মুহাম্মাদ কে বলতে দেখা যায়: "কাল আমি এমন একজনকে পতাকা দেবো যার নেতৃত্বে আল্লাহ (মুসলিমদের) বিজয় দান করবেন।" এরপর, তিনি আলীকে পতাকা দিলেন।[53] শিয়া বর্ণনা অনুসারে, মুহাম্মাদ আলীকে নির্বাচিত করলেন, যিনি কোন এক ইহুদি সর্দারকে তরবারির আঘাতে মস্তকবর্মের ভেতর দিয়ে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দু টুকরো করে তাকে হত্যা করলেন। আরও বলা হয় যে, নিজের ঢাল হারিয়ে ফেলার পর, আলী দুর্গের দুটি দরজাই কব্জা থেকে তুলে নিয়ে দুর্গের খাদ বেয়ে উঠে সাহাবীদেরকে তা দিয়ে একটি সেতু বানাতে সাহায্য করলেন যার ফলে মুসলিমগণ দুর্গে প্রবেশ করার সুযোগ পায়। দরজাটি এতোই ভারি ছিল যে পুনরায় কব্জায় বসানোর জন্য চল্লিশ জন লোক মিলে তা তুলে ধরতে হয়েছিল। এই ঘটনাটির উপর ভিত্তি করেই মূলত শিয়াগণ আলীর প্রতি একজন আদর্শ বীরের দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে থাকেন।[5][54]
সেই সময়ে, মুসলিম সৈন্যগণ মুহাম্মাদের মতামত ও অনুমতি ছাড়াই খামার থেকে পালিয়ে আসা একপাল গাধাকে মেরে রান্না করে খান। এই ঘটনার ফলে মুহাম্মাদ বৈধ খাদ্যের অভাব ব্যতীত ঘোড়া, খচ্চর এবং গাধার মাংস খাওয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা প্রবর্তন করেন। টানা দেড় মাস ব্যাপী অবরোধের পড় ইহুদিগণ আত্মসমর্পণ করে এবং মুসলিমগণ দুটি বাদে সকল দুর্গ দখল করে নেন।[5]
মুসলিম পণ্ডিতগণ ধারণা করেন যে ইসলামী কেন্দ্রীয় ও প্রধান ধর্মগ্রন্থ কুরআনের নিম্নোক্ত অংশে খাইবার দখলকে একটি ঐশী প্রতিশ্রুতি হিসেবে পরোক্ষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:
“ | "আল্লাহর তোমাদরকে অঢেল যুদ্ধলব্ধ সম্পদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন যা তোমরা লাভ করবে। তিনি তোমাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে এ বিজয় দিয়েছেন।" [কুরআন ৪৮:২০] | ” |
বহু সুন্নি হাদিস সংকলনে খায়বার যুদ্ধের ঘটনাটি উল্লেখিত হয়েছে। মুসলিম লেখক সাইফুর রহমান মোবারকপুরী উল্লেখ করেন যে, নিম্নোক্ত হাদিসটিতে বর্ণিত আমিরের দুর্ঘটনাজনিত আত্মহত্যার ঘটনাটি খায়বার যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত:
সালামা ইবনুল আকওয়া থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত: ...আল্লাহর কসম! এরপর আমরা তিনরাতের অধিক মদিনায় থাকতে পারিনি। এমনি সময় রাসুলুল্লাহ এর সঙ্গে আমরা খায়বারের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। তিনি বলেন, তখন আমার চাচা আমির প্রেরণামূলক কবিতা আবৃত্তি করতে লাগলেন। আল্লাহর কসম! আল্লাহর অনুগ্রহ না হলে আমরা হিদায়াত পেতাম না, সাদাকাও দিতাম না আর সালাতও আদায় করতাম না। আমরা আপনার অনুগ্রহ থেকে কখনও বেপরওয়া হতে পারি না, তাই আপনি আমাদের কদম দৃঢ় রাখুন, যখন আমরা শত্রুদের সম্মুখীন হই এবং আপনি আমাদের প্রতি প্রশান্তি বর্ষণ করুন। তারপর রাসুলুল্লাহ বললেনঃ এ ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, আমি আমির। রাসুলুল্লাহ বললেন, তোমার রব তোমাকে ক্ষমা করুন। রাবী বলেন, রাসুলুল্লাহ যখন কারো জন্য বিশেষভাবে দু’আ করতেন সে শহীদ হত। তিনি বলেন, তখন নিজ উটে বসা উমর ইবনুল খাত্তাব দূর থেকে আওয়াজ করে বললেন, ইয়া নাবী আল্লাহ্! আমিরকে দিয়ে যদি না আমাদের আরো উপকার করতেন? তিনি বলেন, তারপর যখন আমরা খায়বারে উপস্থিত হলাম, তখন খায়বার অধিপতি মুরাহহাব (মারহাব) তরবারি দোলাতে দোলাতে বেরিয়ে এল এবং বলল, “খায়বার জানে যে, আমি মুরাহহাব, পূর্ণ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত, অভিজ্ঞতাপূর্ণ এক বীরপুরুষ। রাবী বলেন, আমার চাচা আমির কবিতা আবৃত্তি করতে করতে বললেন, “খায়বার জানে যে, আমি আমির অস্ত্রে শস্ত্রে সুসজ্জিত যুদ্ধে অবতীর্ণ বীর বাহাদুর নির্ভীক ব্যক্তি”।
রাবী বলেন, তারপর তাদের মধ্যে আঘাত বিনিময় হল। আমির নিচে থেকে যখন তাকে আঘাত করতে চাইলেন, তখন তা ফিরে এসে তার নিজের উপরই লাগল। আর তাতে তার পায়ের গোছার সংযোগ শিরা কেটে গিয়ে মৃত্যু হল। (রাবী) সালামা বলেন, তখন আমি বেরোলাম। নাবী কারিম এর কয়েকজন সাহাবীকে বলাবলি করতে শুনলাম যে, আমিরের আমল বরবার হয়ে গেছে, সে আত্মহত্যা করেছে। তখন আমি কাঁদতে কাঁদতে নাবী এর নিকট এসে বললাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমিরের আমলগুলি কি বরবার হয়ে গেল? তখন রাসুলুল্লাহ বললেনঃ (একথা) কে বলেছে? রাবী বলেন, আমি বললাম, আপনারই কয়েকজন সাহাবী। তিনি বললেন, যারা এরুপ বলেছে তারা মিথ্যা বলেছে এবং তার প্রতিদান সে দু’বার পাবে।...সহীহ মুসলিম, ১৯:৪৪৫০ (ইংরেজি)[55][56]
আনাস ইবনু মালিক থেকে বর্ণিত, রাসূল (একদিন) ফজরের সালাত (নামায/নামাজ) অন্ধকার থাকতে আদায় করলেন। এরপর সাওয়ারীতে আরোহণ করলেন এবং বললেনঃ আল্লাহু আকবার, খায়বার ধ্বংস হোক! যখন আমরা কোন সম্প্রদায়ের এলাকায় অবতরণ করি তখন সতর্কীকৃত দের প্রভাত হয় কতই না মন্দ! তখন তারা (ইয়াহূদীরা) বের হয়ে গলির মধ্যে দৌড়াতে লাগল এবং বলতে লাগল, মুহাম্মাদ ও তাঁর খামীস এসে গেছে। বর্ণনাকারী বলেন, খামীস হচ্ছে , সৈন্য–সামন্ত। পরে রাসূল তাদের উপর জয়লাভ করেন। তিনি যোদ্ধাদের হত্যা করলেন এবং নারী-শিশুদের বন্দী করলেন। তখন সাফিয়্যা প্রথমত দিহইয়া কালবীর এবং পরে রাসূল -এর অংশে পড়ল। তারপর তিনি তাঁকে বিয়ে করেন এবং তাঁর মুক্তিদানকে মোহররূপে গণ্য করেন। আবদুল আযীয, সাবিত-এর কাছে জানতে চাইলেন, তাঁকে কি মোহর দেওয়া হয়েছিল, তা কি আপনি রাসূল -কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন? তিনি বললেন, তাঁর মুক্তই তাঁর মোহর, আর মুচকি হাসলেন। সহীহ বুখারী, ২:১৪:৬৮ (ইংরেজি)
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.