Loading AI tools
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের যুদ্ধ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
কামালপুর যুদ্ধ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী কর্তৃক পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিপক্ষে সংঘটিত হওয়া অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার জন্যে নির্ভীক ঝাঁপিয়ে পড়ার অনন্য দৃষ্টান্ত এই কামালপুর যুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কামালপুরের সীমান্তে একটি সামরিক ঘাঁটি গড়ে তোলে (বর্তমানে জামালপুরের বক্সীগঞ্জ উপজেলা)। জেড ফোর্সের ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কর্তৃক ঘাঁটিটি দখলের জন্যে ৪ বার সরাসরি (সেটপিস) ও ২০ এর অধিক খন্ড যুদ্ধ (হিট অ্যান্ড রান) সংঘটিত হয়েছিল। ১২ই জুন ছিল শুরু, দ্বিতীয়টি ৩১শে জুলাই, তৃতীয়টি ১৪ নভেম্বর এবং শেষ হয় ৪ঠা ডিসেম্বরের আক্রমণের মধ্য দিয়ে, যখন কামালপুর ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচের কোম্পানিটি বেশ কয়েকজন রাজাকারসহ আত্মসমর্পণ করে। পরবর্তীতে মুক্তিবাহিনীর অপর এক আক্রমণে পাকিস্তানি সৈন্যদলকে পরাস্ত করে জামালপুরকে স্বাধীন করে।
কামালপুর যুদ্ধ | |||||
---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ | |||||
ধানুয়া কামালপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ | |||||
| |||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||
মুক্তিবাহিনী |
রাজাকার | ||||
জড়িত ইউনিট | |||||
জেড ফোর্স | ৯৩ ব্রিগেড | ||||
শক্তি | |||||
১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট | ৩১ বালুচ | ||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||
১৯৭ জন | ২২০ জন |
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এবং জামালপুর হয়ে ময়মনসিংহ সড়ক সংযোগে কামালপুর ছিল অন্যতম শক্ত সীমান্ত ফাঁড়ি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওয়ার ম্যাপে বৃহত্তর টাঙ্গাইল এবং ময়মনসিংহের দায়িত্বে ছিল মেজর জেনারেল জামশেদের ৩৬ অ্যাডহক ডিভিশন। ১৮৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এলাকাটিতে ২ টি রাস্তা ছিলো ঢাকার দিকে মুক্তিবাহিনীর অগ্রসর হওয়ার। একটি হালুয়াঘাট-ময়মনসিংহ হয়ে, অন্যটি কামালপুর-জামালপুর দিয়ে। এটি আটকানোর দায়িত্বে ছিলো ব্রিগেডিয়ার কাদিরের পাক আর্মির ৯৩ ব্রিগেড- যার দুটি রেজিমেন্ট যথাক্রমে : ৩৩ পাঞ্জাব এবং ৩১ বালুচ। ৩৩ পাঞ্জাব অবস্থান নিয়েছিলো হালুয়াঘাটে আর ৩১ বালুচ অবস্থান নিয়েছিলো কামালপুর, নকশী আর বারোমারিতে।
কামালপুরে ৩১ বালুচের সাথে ছিলো ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স আর ১ প্লাটুন রাজাকার। কামালপুর বিওপি (বর্ডার আউট পোষ্ট/বর্ডার অবজারভেশন পোস্ট) এর সিও ছিলো ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। প্রচুর শক্তিশালী অস্ত্র আর গোলাবারুদের পাশাপাশি ৮১ মি.মি. ৩ টি মর্টার ছিলো কামালপুর বিওপিতে। [1] সেখানে ছিল গোলা-নিরোধী ছাদ বিশিষ্ট কংক্রিট বাংকার, যেগুলো প্রতিটি গভীর নালার মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ ও সাহায্য বিনিময়ে সক্ষম ছিল। নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসাবে ছিল স্ব-নিয়ন্ত্রিত ফাঁদ ও ভূমিবিস্ফোরক। সন্ধ্যার পর পাকিস্তানের সৈন্যরা ভেতরের নিরাপদ স্তরে ঢুকে যেত। [2]
১৯৭১ সালের ৩১শে জুলাই দিবাগত রাতে (১লা অগাস্ট রাত) জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমান এর নির্দেশ মোতাবেক ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও (কমান্ডিং অফিসার) মেজর মইনুল হোসেন এর নেতৃত্বে উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ডেল্টা এবং ব্রাভো কোম্পানি শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেজর মইন এতো দ্রুত এমন মিশনে রাজি ছিলেন না। তার মতে কামালপুরের মত শক্তিশালী পাকিস্তানি ঘাঁটিতে সেটপিস যুদ্ধের মাধ্যমে আক্রমণ করার সক্ষমতা জেড ফোর্সের বা তার ব্যাটালিয়নের তখনো অবধি হয়নি। মেজর মইনের প্ল্যান ছিলো হিট অ্যান্ড রান (গেরিলা) পদ্ধতিতে পাকিস্তান ফোর্সকে দুর্বল এবং নাজেহাল করা। কিন্তু জিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না। এর মূল কারণ ছিল হাইকমান্ডের নির্দেশ এবং ঘাঁটিটির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব। মেজর মইনের ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে সৈন্য ছিলো সর্বসাকুল্যে ৮৫০ জন। জেড ফোর্সের ১ম সম্মুখ সমর কামালপুর অপারেশনে ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান নিজে উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধ সমন্বয় করার জন্য।
৩১ জুলাই রাত ৩:০০ এর দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়া এবং মেজর মইন ১ম বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি থেকে প্রায় ১১-১২শ' গজ দূরে অবস্থান নেন। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো।
জিয়ার অবস্থান থেকে কামানের গোলা বর্ষনের মাধ্যমেই যুদ্ধ শুরু হয়। রাত সাড়ে ৩ টায় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ তার ২ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রুঘাঁটিতে ঢুকে পড়েন। এটি ছিল জেড ফোর্সের ১ম অপারেশন। আর যোদ্ধাদের বড় অংশই ছিল স্বল্পপ্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে তারা শুরুর দিকে ময়দানে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারছিল না। তাদের গতি অপেক্ষাকৃত ধীর হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ অসামান্য নেতৃত্বের পরিচয় দেন। তিনি সামনে থেকে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান, তার উচ্চ এবং উদ্দামী কন্ঠ জোয়ানদের মাঝে নিয়ে আসে গতি। উচ্চ কন্ঠে বলতে থাকেন,
আভি তাক ওয়াক্ত হ্যায় , শালালোক সারেন্ডার কারো , নেহি তো জিন্দা নেহী ছোড়েঙ্গা
ইয়াহিয়া খান এখনও এমন বুলেট তৈরি করতে পারেনাই, যা মমতাজকে ভেদ করবে
যদি মরতেই হয়, এক পাকসেনাকে সাথে নিয়ে মরো। বাংলার মাটিতে শহিদ হও
সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসে আর তার কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে পাকিস্তানিদের ১ম ডিফেন্স কর্ডন শেল প্রুফ বাংকারে ঢুকে পড়ে। এ সময় সালাউদ্দিন মমতাজ আরও সাহসী হয়ে উঠে ২০-২৫ জনকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়েন। তিনি একসময় বুঝতে পারেন যে পাকিস্তানিরা সামনের সারির বাংকার পজিশনগুলো ক্লিয়ার করে পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সেকেন্ড লাইনে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তিনি ওয়্যারলেসে সুবেদার হাই এর প্লাটুনকে ডানদিকে যাওয়ার জন্য আদেশ দেন। প্রথমবারে সম্ভবত হাই তার নির্দেশ শুনতে পান নি, তাই সালাউদ্দিন পুনরায় ওয়্যারলেসে "হাই" বলেন। সাথে সাথেই তার সামনে একটি গোলা বিস্ফোরিত হয়। লুটিয়ে পড়েন বীরউত্তম ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ। দুর্ভাগ্য তার, স্বাধীন বাংলার সূর্য দেখে যেতে পারেন নি। সালাউদ্দিনের দেহ উদ্ধার করা যায় নি, তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে আরো তিনজন প্রাণ হারান। পরে তার ঘড়ি, স্টেনগান ও কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
সালাউদ্দিন মমতাজ নিহত হবার খবর জানতে পেরে মেজর মইন ওয়্যারলেসে ক্যাপ্টেন মাহবুবকে কমান্ড করেন পেছন থেকে আক্রমণের জন্য। কিন্তু ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাড়া না পেয়ে তিনি ঝোঁপঝাড় ও গাছের আড়াল থেকে খোলা জায়গায় চলে আসেন যাতে ওয়্যারলেস ভালোভাবে কাজ করতে পারে। দুর্ভাগ্য, সাথে সাথেই একঝাক মেশিনগানের গুলি এসে তার ওয়্যারলেস অপারেটর শহীদ হন। এ সময় তার ওয়্যারলেস সেটটিও অকেজো হয়ে যায়। মেজর মইন হতভম্ব হয়ে এসময় চিৎকার করে নির্দেশ দিতে থাকেন। দ্রুত ভোরের আলো ফুটে ওঠে। চারদিকে তখন হতাহতের ছড়াছড়ি। ক্যাপ্টেন হাফিজ আহত হয়ে মাটিতে পড়ে আছেন। লেফটেন্যান্ট মান্নানও আহত। জিয়া এসময় উদ্ধারকাজে যোগ দেন। গোলাগুলি চলা অবস্থাতেই জিয়া, মইন, লিয়াকতরা মিলে হাফিজ, মান্নান সহ অন্য আহত যোদ্ধাদের উদ্ধার করে পিছু হটেন।
অন্যদিকে ২ টি ১২০ মি. মি. মর্টার আর বেশকিছু সেনা সহ বকশীগঞ্জ থেকে কামালপুরের দিকে আসতে থাকা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩ টি লরী উড়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাট অফ পার্টির পুঁতে রাখা মাইনে। তাঁদের অ্যামবুশে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং ১০-১১ জন আহত হয়। ১ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন, ২/৩ জন আহত হন [3]
যুদ্ধোত্তর বিশ্লেষণে মূলত ৪টি কারণ প্রতীয়মান হয় পরাজয়ের কারণ হিসাবেঃ
যুদ্ধে ১ম ইস্ট বেঙ্গলেের ৩০ জন নিহত বা নিখোঁজ হন। আহত হন ৬৬ জন। অন্যদিকে ৫০ এর অধিক পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। স্থানীয়রা জানায়, তারা পাকিস্তানিদের অন্তত তিন ট্রাক ভর্তি লাশ নিয়ে যেতে দেখেছে। আক্রমণটা শতভাগ সফল না হলেও এটা পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবলের উপর ছিল বড় ধরনের ধাক্কা। এই যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী একটা বার্তা দেয় যে তারা এখন কেবলই গেরিলা যুদ্ধ নয়, প্রয়োজনে সম্মুখযুদ্ধেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমানতালে লড়তে সক্ষম। কামালপুর যুদ্ধ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উৎসাহের প্রতীক।
এটি এতই শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল যে এই ঘাঁটিতে সর্বমোট ৪ বার নিয়মিত বাহিনী পর্যায়ে সরাসরি সেটপিস যুদ্ধ হয়েছে-
৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত হিট অ্যান্ড রান হয়েছে মোট ২০ বার!
পুরো মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর অভিযানে সর্বমোট ১৯৭ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য। অন্যদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচের একটি কোম্পানির কমান্ডার মেজর আইয়ুব সহ ২২০ জন সেনা নিহত হয়েছেন।
বীর উত্তম থেকে বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ২৯ জন মুক্তিযোদ্ধা সাহসীকতা পদক পেয়েছেন কেবল কামালপুর যুদ্ধের জন্যই, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এমন উদাহরণ আর একটিও নেই।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.