Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আলকাপ মূলতঃ অবিভক্ত বঙ্গদেশের মুর্শিদাবাদ অঞ্চলের মুসলমান সম্প্রদায়ের নিজস্ব লোকসংগীত। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও বীরভূম,মালদহ, বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও বৃহত্তর রাজশাহীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই গান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এই গান পালা গান এরই একটি অঙ্গ। অনেকটা কবি গানের মতোই বিভিন্ন আসরে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে। এইধরনের গানের প্রধান উপজীব্য হলো ছড়া ও গান। আলকাপ যে বিশেষ কারণে উল্লেখযোগ্য তা হলো মুসলমানদের এই সংস্কৃতিতে সাম্প্রদায়িক মিলনের সূত্র রয়েছে। লৌকিক জীবনের প্রেম-ভালোবাসা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না নানান ধরনের বিষয় আলকাপ গানের মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। তবে রাধাকৃষ্ণের কথা আলকাপ গানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। লৌকিক জীবন নিয়ে যে ছড়া আলকাপের গানে স্থান পায় তা সব সময় শ্লীল হয় না। গ্রাম্য জীবনের সহজ সরলতা এই গানের সহজ বিশেষত্ব। মুসলমান সমাজের বিশাল অংশের মধ্যে একসময় এই গান আদৃত হলেও ধীরে ধীরে আধুনিক সভ্য সংস্কৃতির চাপে এর প্রচলন কমে আসছে।
আলকাপ গান অন্যান্য গানের মত না। একটু আলাদা। গানের দলের প্রধানকে সরকার বা মাস্টার বলা হয়।[1] আর তার সাথে থাকে এক জনভাঁড় যাকে আলকাপের ভাষায় “কাপ্যাল” বলা হয়। আলকাপ গানে সরকার এবং কাপ্যালের চরিত্র সব সময় দুই ভাই হিসেবে দেখা যায়। এই দলে আরও থাকে দুজন পুরুষ মানুষ যারা গানের সময় মেয়ে সেজে নাচ- গান আর অভিনয় করে। লোকজন এদেরকে “ ছোকরা”, “ ছুকরি”, “ছুরকি” নামে ডাকে। গানের দলে থাকে কয়েকজন যন্ত্র বাদক। তারা বিশেষ করে ঢোলক, হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলা, খঞ্জনি, বাঁশি ইত্যাদি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। সম্পূর্ণ গানের দল গানের আসরেই বসে থাকে। যন্ত্রীরা বসে থেকেই বাদ্যযন্ত্র বাজায় আর সরকার, কাপ্যাল, ছোকরা এবং আরও দুই একজন যারা অভিনয় করে তারা অভিনয়ের সময় আসরের মাঝখানে নির্ধারিত জায়গায় অভিনয় করে।
এই গানের আসর খুবই সুন্দর হয়ে থাকে। গ্রামের ফাঁকা জায়গায় বিশেষ করে উঠানে এই গানের আসর বসে। গানের দলের সবাই উঠানের মাঝখানে গোল হয়ে বসে এবং তাদের মাঝখানে একটা ফাঁকা জায়গা রাখে যেখানে তারা অভিনয় করে। আর সকল দর্শকের সেই গানের দলকে ঘিরে গোল হয়ে বসে। মহিলা দর্শকেরা পাশে একটু দূরে বসে। গানের আসরে আগে বিদ্যুতের অভাবে হ্যাজাগ বাতি ব্যবহার করা হত। এখন বিদ্যুতের আলো ব্যবহার করা হয়। সাথে হ্যাজাগও থাকে বিদ্যুৎ চলে গেলে ব্যবহার করা হয়। তবে বিদ্যুতের বাতির আলোর চেয়ে হ্যাজাগ ব্যবহারে আসরের ঐতিহ্য বেশি ফুটে উঠে।
আলকাপ গান বাংলাদেশের সংস্কৃতির একটি ঐতিহ্য । বহু আগে থেকে গ্রামীণ বাংলায় এই গান মানুষকে বিনোদন দিয়ে এসেছে এখন বিনোদন দিচ্ছে । মূলত আলকাপ গানের আয়োজন করা বাংলার হিন্দু ধর্মালম্বীদের পূজার সময় , গ্রামের মানুষের নতুন ধান মাঠ থেকে ঘরে তোলার পর । এছাড়া গ্রামের মানুষজন তাদের পারিবারিক কোন অণুষ্ঠান উপলক্ষেও গানের দল বায়না করে নিয়ে আসে । তবে বিশেষ করে পূজার সময় এই গানের আসর বেশি লক্ষ্য করা যায় । বিশেষ করে দুর্গা পূজা , লক্ষী পূজা, শ্যামা পূজা , জগৎধাত্রী পূজায় এইসব গানের দল বায়না করে নিয়ে আসা হয় । আলকাপ গান মূলত শুরু হয় গভীর রাতে ও বিকেলে । অর্থাৎ দুপুরের পর বিশেষ করে তিনটা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত একটা পালা হয় এবং রাত ১১ টার পর থেকে আর একটা পালা শুরু হয় এবং শেষ হয়ে একেবারে সকালে । সারারাত ধরে এই গান চলে । বাড়ির উঠানে গানের দল গোল হয়ে বসে এবং মাঝখানে ফাঁকা জায়গা রাখে অভিনয় করার জন্য । দর্শকের গানের দলকে ঘিরে গোল হয়ে বসে । এই গানে সরকার অত্যন্ত বিচক্ষন ও বুদ্ধিমান হয় । তিনি পুরো গান মূলত পরিচালনা করেন । আলকাপ গানে সরকারকে অনেক শিক্ষিত হিসেবে ধরা হয় । আসলেই সরকার যিনি হন তিনি একজন শিক্ষিত মানুষ । কারণ তাকে অনেক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয় । আর তার সাথে তার ভাই হিসেবে থাকে সেই ভাঁড় যে কাপ্যাল নামে পরিচিত । এই কাপ্যালকেও অনেক বিচক্ষন ও বুদ্ধিমান হতে হয় । তার কাজ দর্শককে হাসানো এবং সমাজের বিভিন্নও অসংগতিকে হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে তুলে নিয়ে আসে এবং সেগুলো বর্জন করে ভালো কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয় । মাঝে মাঝে এই গান চলার সময় কোন একটি পালা ( কাহিনী) পরিবেশন করা হয় । আলকাপ গানের ভাষা মূলত আঞ্চলিক । এই ক্ষেত্রে রাজশাহীর চাপাই নবাবগঞ্জ অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করা হয়। তবে গানের সরকার শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলেন । কারণ তাকে শিক্ষিত হিসেবে দেখানো হয় আর তার ভাইকে ( কাপ্যালকে) অশিক্ষিত হিসেবে দেখানো হয় । মূলত সরকার কাপ্যালকে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে সমাজের অসঙ্গতি তুলে নিয়ে এসে সেগুলো সমাধানে দিক নির্দেশনা দেয় । গানের সময় কাপ্যালকে তার ভাই “ পটলা” , “ মদনা” এমন বিশেষ ব্যঙ্গাত্মক নামে ডাকে । এই গানে দর্শকেরাও গানের দলের সাথে দোয়ার ( একজন গানের কলি গাওয়ার পর সেটা সমবেতভাবে গাওয়া ) ধরে । এই গানে মূলত গানের দল আর দর্শক দুই দলই বিনোদন লাভ করে । গানের সময় সরকারের হাতে একটি মোটা কাগজ সিলিন্ডারের মত করে প্যাঁচানো থাকে যেটা সরকার লাঠি হিসেবে ব্যবহার করে কাপ্যালকে পেটায় । আর কাপ্যালের হাতে চিকন ও পাতলা বাঁশের তৈরি একটা লাঠি থাকে যেটা সে সব সময় নিয়ে থাকে আর মাঝে মাঝে আসরের ব্যবহৃত টিনের ছাওনিতে আঘাত করে শব্দ করে । তবে এইভাবে টিনে আঘাত করার মধ্যেও এক ধরনের আর্ট বা শিল্প আছে । গানের শুরু ছোকরাদের নৃত্তের মাধ্যমে । ছোকরারা খেমটা ও ঝুমুর জাতীয় নাচ-গানে বেশ দক্ষ । তাদের এত সুন্দর নাচ দর্শকদের এতটাই মুগ্ধ করে যে মাঝে তারা ছোকরাদের প্রতি বিশেষ ধরনের শব্দ নিক্ষেপ করে, যেমন- “ বাহ !! রে কইট্যামুখী (কৌটামুখী) !!” , “ও !! রে সায়লার মাও (শায়লার মা)!!” আসলে আলকাপ গান এত হাসি আর বিনোদনমূলক যে আমি এই লেখাটি লিখতে লিখতেই গানের আসরের কথাগুলো মনে করে হাসছি । দর্শকদের বাক্যবানে সাড়া দিয়ে ছোকরাও নাচতে নাচতে দর্শকদের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে । মহিলা দর্শকেরা কেউ কেউ লাজ্জায় মুখে কাপড় দেয় । ছোকরারা এবং কাপ্যাল সহ যারা গান পরিবেশন করেন তারা কেউ কেউ পুরাতন হিন্দি ও বাংলা ছায়াছবির গান গায় ও নৃত্য পরিবেশন করে । গানের সাথে নাচের যা কম্বিনেশন সেটা সত্যিই দেখার মত তার সাথে দর্শকদের উত্তেজনা । সবকিছু মিলে ব্যপারটা এমন যে সরাসরি আসরে না গিয়ে দেখলে আমার এই লেখায় খুব একটা বিনোদন পাবেননা । তবে আমার কাছে ছোকরাদের খেমটা নাচ অসাধারণ লাগে । সবাই এমন নাচ নাচতে পারেনা । প্রথম নাচের শেষে সরকার মঞ্চে উঠে বোল বা ছড়া কাটে । যা সত্যি অসাধারণ ! ছড়া কাটার পর কাপ্যাল কে ডাকে, কইরে পটলা কথায় আছিস , এইরকম করে কাপ্যাল তখন দর্শকের মধ্যে কোথাও দূর থেকে বিভিন্নভাবে ভাড়ামু করে উত্তর দেয় । আর বলে, আসছি দাদা । এসে দাদাকে প্রণাম করে । প্রণামের ভঙ্গিটাও দেখার মত । মাঝে সরকার তার হাতে থাকা সিলিন্ডার আকৃতির মোটা কাগজ দিয়ে কাপ্যালকে তার বেয়াদবির জন্য ঠাস ঠাস করে বাড়ি দেই । কাপ্যাল কখনও লাফায় আবার দর্শকের মধ্যে দৌড় দেয় । সরকার ও কাপ্যালের স্ত্রী থাকে । ছোকরারা তাদের স্ত্রী সেজে অভিনয় করে । তাদের রঙ্গরস আসরে জমে উঠে । তাদের রঙ্গরসের গানগুলো অত্যন্ত সুন্দর আর বিনোদনমূলক। যেমন- “তুই যে আমার, তুই যে আমার নতুন রেডিও” অথবা “তুই যে আমার নতুন নতুন ট্রানজিস্টার” । এইগানগুলো কাপ্যাল তার স্ত্রীর সাথে গায় । আর সরকারের সাথে গানের মধ্যমেও মনের ভাব প্রকাশ করে । যেমন- “কি আর বলিব দাদা প্রাণে লাগে ভয়” । আর সরকারের ছড়া গান অতুলনীয় । ছড়া গানের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরে । এই ভাবে রাত গভীর হয় । গান চলতেই থাকে । কেউ ঢুলে , কেউ ঘুমায়। এইভাবে সারারাত পাড়ি দিয়ে সবাই নিজ নিজ বাড়ি ফিরে । একসময় রাজশাহী অঞ্চলে এই গানের ব্যাপক প্রচলন ছিল । এই গানের দলে যারা থাকেন তারা এই গানের উপরই নির্ভর করে থাকেনা । কারণ সারা বছর এই গানের আয়োজন করা হয়না। তবে গানের মৌসুমগুলোতে এরা বিভিন্ন জায়গায় গান করার জন্য যায় । এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা এই পেশা বাদেও অন্যান্য পেশার সঙ্গে যুক্ত থাকেন । এই গান মূলত টাকা উপার্জনের মানুষজনদের বিনোদন দেওয়ার জন্যই বেশি প্রচলিত । এরা নিজে হাসে অপরকে হাসায় । তবে যারা এই পেশার সাথে অনেকদিন ধরে যুক্ত ছিলেন তারা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছেন তাদের বয়সের ভারে । আর আমাদের ঐতিহ্যগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে । এখন যারা এইসব গানের সাথে যুক্ত আছেন তারা হয়ত একদিন হারিয়ে যাবেন । তাদের সাথে এই ঐতিহ্যবাহী আলকাপ গান । কারণ কেউ থাকবে না এই গান করার জন্য । কোন গ্রামে হয়ত বসবেনা আলকাপ গানের আসর ।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.