Remove ads
আণবিক স্তরে বংশাণু বা জিনের কাঠামো ও কর্মপদ্ধতির বৈজ্ঞানিক গবেষণা উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
আণবিক বংশাণুবিজ্ঞান (ইংরেজি Molecular genetics) বলতে বংশাণুবিজ্ঞানের একটি শাখাকে বোঝায় যেখানে অতিক্ষুদ্র অণুর পর্যায়ে বংশাণুর গঠন ও কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করা হয়। বংশাণুসূত্র বা ক্রোমোজোম এবং বংশাণু অভিব্যক্তির (জিন এক্সপ্রেশন) উপর গবেষণা বংশগতি, বংশাণুর ভিন্নতা এবং পরিব্যক্তি (মিউটেশন) নিয়ে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারে। বিকাশমূলক জীববিজ্ঞানে এবং বিভিন্ন বংশগতিক রোগ ভালোভাবে বুঝতে আণবিক বংশাণুবিজ্ঞান বিজ্ঞানের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি ক্ষেত্র।
বংশাণু ক্রোমোজোমে অবস্থিত এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেলেও বিজ্ঞানীরা জানতেন না ক্রোমোজোমের দুই মূল উপাদান প্রোটিন ও ডিএনএ-এর মধ্যে কোন্ উপাদানটি বংশগত বৈশিষ্ট্যেরে ধারক ও বাহক। ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রেডেরিক গ্রিফিথ বংশগতিক রূপান্তর আবিষ্কার করেন (বিস্তারিত: গ্রিফিথের পরীক্ষা): মৃত ব্যকটেরিয়া তার বংশগতিক বস্তু জীবিত ব্যাকটেরিয়াতে পাঠিয়ে তাকে রূপান্তর করতে পারে। ষোল বছর পর ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে অসওয়াল্ড থিয়োডর এভারি, কলিন ম্যাকলিওড এবং ম্যাকলিন ম্যাককার্টি এই রূপান্তরের জন্যে দায়ী কণা হিসেবে ডিএনএকে শনাক্ত করেন। [১] ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে হার্শলে-চেজের পরীক্ষণও প্রতিপাদন করে যে ডিএনএ-ই (প্রোটিন নয়) হল ভাইরাসের সেই বংশগতিক বস্তু যা কিনা ব্যাকটেরিয়াকে সংক্রমণ করে। এই প্রতিপাদন বংশগত বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক হিসেবে ডিএনএ'র ভূমিকা আরো নিশ্চিত করে।[২]
জেমস ডি. ওয়াটসন এবং ফ্রান্সিস ক্রিক ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে মরিস উইলকিন্স ও রোজালিন্ড ফ্রাঙ্কলিনের এক্স-রে ক্রিস্টালোগ্রাফি ব্যবহার করে করা কাজ, যা ডিএনএ সর্পিলাকার (অর্থাৎ কর্ক-স্ক্রূর মত) নির্ধারণ করে তা থেকে ডিএনএ-র গঠন উদ্ঘাটন করেন।[৩][৪] তাদের দ্বি-সর্পিল মডেলে দুটো সুতোর মতো অংশ থাকে, যাতে একট সুতোর নিউক্লিওটাইডগুলো ভেতরের দিকে অপর সুতোয় থাকা নিজ-নিজ সম্পূরক নিউক্লিওটাইডের সাথে যুক্ত হয়, যা দেখতে অনেকটা প্যাঁচানো সিঁড়ির ধাপের মতো হয়। [৫] এই গঠন নির্দেশ করে যে বংশগতিক তথ্য ডিএনএ'র সুতোয় নিউক্লিওটাইডের ক্রমের ওপর নির্ভর করে। এই মডেল ডিএনএ'র দ্বৈতকরণেরও (duplication) একটি সহজ ব্যাখ্যা দেয়: যদি সুতোগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে পূর্বের সুতোর গঠন অনুসরণ করেই নতুন সম্পূরক সুতো তৈরি হয়।
যদিও ডিএনএ'র গঠন থেকে বংশগতির ব্যাখ্যা প্রদান করা সম্ভব হয়, কিন্তু ডিএনএ কেমন করে কোষের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে তা জানা সম্ভব হয়নি। পরবর্তী বছরগুলোতে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ কী করে প্রোটিন তৈরির কাজটি নিয়ন্ত্রণ করে তা বুঝতে চেষ্টা করেন। জানা যায় ডিএনএ ছাঁচ হিসেবে ব্যবহার করে কোষ অনুরুপ বার্তাবাহক আরএনএ (messenger RNA) (নিউক্লিওটাইড যুক্ত অণু, অনেকটা ডিএনএ'র মতো) তৈরি করে। বার্তাবাহক আরএনএ'র নিউক্লিওটাইড ক্রম থেকে প্রোটিনে এমিনো এসিডের ক্রম তৈরি হয়; নিউক্লিওটাইড ও এমিনো এসিডের ক্রমের মধ্যে এই রূপান্তরকে বংশগতিক সঙ্কেত (জেনেটিক কোড) বলে।
বংশাণুবিজ্ঞানের এই ব্যাপক অগ্রগতির পর নতুন গবেষণার স্বর্ণদুয়ার খুলে যায়। এদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গবেষণা ছিলো ১৯৭৭ সালে ফ্রেডেরিক স্যাঙ্গারের ডিএনএ সিকুয়েন্সিং এর শৃংখল-পরিসমাপ্তি: এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা ডিএনএ অণুর নিউক্লিওটাইড অনুক্রম পড়তে সক্ষম হন। [৬] ১৯৮৩ সালে ক্যারি ব্যাংকস মুলিস পলিমারেজ শৃংখল বিক্রিয়া উদ্ভাবন করেন, যা কোন মিশ্রণ থেকে ডিএনএ'র নির্দিষ্ট অংশ আলাদা করার দ্রুত পথ দেখায়। [৭] মানব বংশাণুসমগ্র প্রকল্প (হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট)-এর সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং পাশাপাশি সেলেরা জিনোমিক্সের কাজ এবং অন্যান্য কৌশলের মাধ্যমে ২০০৩ সালে মানুষের বংশাণুসমগ্র বা জিনোমের নীলনকশা উদ্ঘাটনের কাজ সম্পন্ন হয়।[৮]
ডিএনএ প্রতিলিপিকরণ যে প্রক্রিয়ায় নির্দিষ্ট বংশাণু বা ডিএনএ একাধিকবার নিজের প্রতিরূপ (ডিএনএ রেপ্লিকেশন) তৈরি করে, তাকে বিবর্ধন বা এমপ্লিফিকেশন বলে। .
ডিএনএ সিকুয়েন্সের অনেকগুলো অভিন্ন কপি তৈরির প্রক্রিয়াকে ক্লোনিং বলা হয়।ক্লোনিং ভেক্টরের মধ্যে টারগেট ডিএনএ সিকুয়েন্স প্রবেশ করানো হয়। কারণ এই ভেক্টরের মূল হলো নিজে নিজেই প্রতিরূপ তৈরিতে সক্ষম এক ধরনের ভাইরাস, প্লাজমিড অথবা উচ্চ পর্যায়ের প্রাণীর কোষ। যখন সঠিক আকারের ডিএনএ টারগেটের ভিতরে ঢোকানো হয়, তখন "টারগেট এবং ভেক্টরের ডিএনএ সূত্রক একে অপরের সাথে যুক্ত হয়ে" [১০] রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ মলিকুল তৈরি করে।
রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ মলিকুলগুলো এরপর ব্যাক্টেরিয়ার (সাধারণত ই. কোলাই ব্যাক্টেরিয়া) ভিতরে রাখা হয়, যা বেশ কিছু অভিন্ন নিজের প্রতিরূপী কপি ট্রান্সফরমেশন পদ্ধতিতে তৈরি করে। ট্রান্সফরমেশন এক ধরনের ডিএনএ মেকানিজম যা ব্যাক্টেরিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। যাইহোক, একটি সিঙ্গেল ব্যাক্টেরিয়া কোষ দিয়ে শুধুমাত্র একটি রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ অণু ক্লোন করা সম্ভব হয়। অর্থাৎ, প্রতিটি ক্লোনে শুধুমাত্র একটি ডিএনএ প্রবেশ করানো হয়।
আলাদাকরণ এবং শনাক্তকরণের জন্য সবার প্রথমে ডিএনএ এবং এমআরএনএ কোষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয় এরপর আইসোলেশন পুরোপুরিভাবে প্রক্রিয়াতে আলাদা করা হয়। আইসোলেশনের জন্য যথেষ্ট সংখ্যক কোষ সবসময় তৈরি রাখতে সেল কালচারের মাধ্যমে সবসময় কোষ উৎপাদন অব্যাহত রাখা হয়।
সেল কালচার হল আণবিক বংশাণুবিজ্ঞানের জন্য বিশেষভাবে তৈরি কোষ। ত্বকের কোষের মতো কিছু কোষ সেল কালচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খুব ভালো ভাবে তৈরি করা গেলেও কিছু কিছু কোষ আবার এইক্ষেত্রে কাজ করে না। কোষের ধরন বুঝে সেল কালচার করতে হয়। আণবিক বংশাণুবিজ্ঞানের জন্য কোষগুলোকে শীতল করে রাখা দরকার হয় যেন জীবের বংশগতিক বৈশিষ্ট্যের সবগুলো অনুলিপি বা কপি সংরক্ষিত থাকে।
দ্য হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট হল ১৯৯০ সালে শুরু হওয়া একটি প্রকল্প বা কর্মসূচি যা শেষ হতে ১৫ বছর লাগার কথা থাকলেও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে ২০০৩ সাল নাগাদ প্রকল্পটি মাত্র তেরো বছরেই শেষ হয়ে যায়। আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জী এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের যৌথ প্রচেষ্টায় ছয়টি লক্ষ্য নির্ধারনের মাধ্যমে প্রকল্পটি সম্পন্ন করা হয়। এগুলো হলঃ-
১. মানুষের ডিএনএর মাঝে উপলব্ধ ২০ হাজার থেকে ২৫ হাজার বংশাণু বা "জিন" শনাক্ত করা। (যদিও শুরুতে ধারণা ছিল বংশাণুর সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি না) ২. মানুষের ডিএনএর রাসায়নিক ক্ষার জড়ের ক্রম (বেস পেয়ার সিকুয়েন্স) নিবন্ধন করা। ৩. যত ধরনের তথ্য পাওয়া সব উপাত্তাধার বা ডাটাবেসে সংরক্ষণ করা। ৪. তথ্য এনালাইসিএর জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধন। ৫. ব্যবহৃত প্রযুক্তিসমূহকে বেসরকারি খাতে নিয়ে আসা। ৬. প্রকল্প করতে গিয়ে যে সামাজিক, আইনগত এবং নৈতিক সমস্যাবলি উঠে আসবে তুলে ধরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ফ্রান্স,জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ আঠারোটি ভিন্ন দেশ এই প্রকল্পে একসাথে কাজ করে। একত্রে পরস্পর সহযোগী প্রয়াসে প্রাপ্ত আবিষ্কার আণবিক বংশাণুবিজ্ঞানে অনেক অবদান রাখে। মলিকুলার মেডিসিনে আবিষ্কার, নতুন শক্তির উৎস এবং পরিবেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহারসহ ডিএনএ ফরেন্সিক ও পশুসম্পদের দিক দিয়ে আণবিক বংশাণুবিজ্ঞান বৃহৎ অবদান রাখতে সক্ষম।
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.