}} হৈসল সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য কন্নড় সাম্রাজ্য। খ্রখ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১৪শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে অধুনা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রথম দিকে হৈসল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল বেলুরু শহর। পরে তা হৈলেবিডু শহরে স্থানান্তরিত হয়।
হৈসল সাম্রাজ্য ಹೊಯ್ಸಳ ಸಾಮ್ರಾಜ್ಯ | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
১০২৬–১৩৪৩ | |||||||||
![]() হৈসল সাম্রাজ্যের প্রসার, আনুমানিক ১২০০ খ্রিস্টাব্দ | |||||||||
অবস্থা | সাম্রাজ্য (১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পশ্চিম চালুক্য সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত) | ||||||||
রাজধানী | হৈলেবিডু বেলুরু | ||||||||
প্রচলিত ভাষা | কন্নড়, সংস্কৃত | ||||||||
ধর্ম | হিন্দুধর্ম, জৈনধর্ম | ||||||||
সরকার | রাজতন্ত্র | ||||||||
রাজা | |||||||||
• ১০২৬–১০৪৭ | দ্বিতীয় নৃপ কাম | ||||||||
• ১২৯২–১৩৪৩ | তৃতীয় বীর বল্লাল | ||||||||
ইতিহাস | |||||||||
• সর্বপ্রাচীন হৈসল নথি | ৯৫০ | ||||||||
• প্রতিষ্ঠা | ১০২৬ | ||||||||
• বিলুপ্ত | ১৩৪৩ | ||||||||
|
হোয়সল রাজন্যবর্গ (১০২৬-১৩৪৩) | |
দ্বিতীয় নৃপ কাম | (১০২৬-১০৪৭) |
হৈসল বিনয়াদিত্য | (১০৪৭-১০৯৮) |
এরিয়াঙ্গা | (১০৯৮-১১০২) |
প্রথম বীর বল্লাল | (১১০২-১১০৮) |
বিষ্ণুবর্ধন | (১১০৮-১১৫২) |
প্রথম নরসিংহ | (১১৫২-১১৭৩) |
দ্বিতীয় বীর বল্লাল | (১১৭৩-১২২০) |
দ্বিতীয় বীর নরসিংহ | (১২২০-১২৩৫) |
বীর সোমেশ্বর | (১২৩৫-১২৬৩) |
তৃতীয় নরসিংহ | (১২৬৩-১২৯২) |
তৃতীয় বীর বল্লাল | (১২৯২-১৩৪৩) |
হরিহর রায় (বিজয়নগর সাম্রাজ্য) |
(১৩৪২-১৩৫৫) |
হৈসল রাজাদের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মালেনাড়ু কর্ণাটক উচ্চভূমি অঞ্চলে। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে তৎকালীন শাসক পশ্চিম চালুক্য ও কলচুরি রাজ্যের মধ্যে ঘনীভূত যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হৈসলরা অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের ভূখণ্ড এবং অধুনা তামিলনাড়ু রাজ্যের কাবেরী নদীর উত্তর তীরস্থ উর্বর অঞ্চলগুলি অধিকার করেন। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর মধ্যেই তারা অধুনা কর্ণাটকের অধিকাংশ ভূখণ্ড, অধুনা তামিলনাড়ুর সামান্য অংশ এবং দাক্ষিণাত্যের অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা রাজ্যের পশ্চিম দিকের কিছু কিছু অঞ্চল নিজেদের অধীনে আনতে সমর্থ হন।
দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্মের বিকাশের ক্ষেত্রে হৈসল যুগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজ এই সাম্রাজ্যকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় এর মন্দির স্থাপত্যের জন্য। এই যুগে নির্মিত একশোরও বেশি মন্দির এখনও কর্ণাটকের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে।
যে সব বহুল পরিচিত মন্দির হৈসল সাম্রাজ্যের “বিস্ময়কর স্থাপত্য সৌকর্য প্রদর্শন” করে, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেলু্রুর চেন্নকেশব মন্দির, হৈলেবিডুর হৈসলেশ্বর মন্দির ও সোমনাথপুরার চেন্নকেশব মন্দির।[১] হৈসল শাসকেরা চারুকলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে উৎসাহ দান করতেন।
ইতিহাস
কন্নড় লোককথায় সল নামে এক যুবকের কাহিনি পাওয়া যায়। অঙ্গডির (অধুনা সোসেবুরু) বাসন্তিকা দেবীর মন্দিরে সল একটি সিংহকে আঘাত করে তার জৈন গুরু সুদত্তকে রক্ষা করেন। হৈলে কন্নড় (প্রাচীন কন্নড়) ভাষায় ‘আঘাত’ শব্দটির প্রতিশব্দ হল ‘হৈ’। তা থেকেই ‘হৈ-সল’ নামটির উৎপত্তি। বিষ্ণুবর্ধনের বেলুরু উৎকীর্ণ লিপিতে (১১১৭ খ্রিষ্টাব্দ) এই কিংবদন্তিটির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে সলের এই কাহিনিটির মধ্যে বেশ কয়েকটি অসংগতি থাকায় এটিকে নিছক একটি লোককথা বলেই ধরে নেওয়া হয়।[২][৩] সম্ভবত টালাকাডের যুদ্ধে রাজা বিষ্ণুবর্ধন চোলেদের পরাজিত করার পর এই কিংবদন্তিটির উদ্ভব ঘটে বা এটি জনপ্রিয়তা লাভ করে। কারণ হৈসল রাজপ্রতীকে দেখা যায় কিংবদন্তি যোদ্ধা সল একটি বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বাঘ ছিল চোলেদের রাজপ্রতীক।[৪]
প্রথম দিকের উৎকীর্ণ লিপিগুলিতে (১০৭৮ থেকে ১০৯০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে উৎকীর্ণ) হৈসলদের যাদবের বংশধর এবং হৈসল বংশকে ‘যাদব বংশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কোনও প্রাচীন সূত্র থেকে উত্তর ভারতের যাদবদের সঙ্গে হৈসলদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় না।[৫][৬]
ইতিহাসবিদগণ হৈসল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতাদের মালেনাডু কর্ণাটকের আদি বাসিন্দা বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ, একাধিক উৎকীর্ণ লিপিতে এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতাদের ‘মালেপারোলগন্ড’ বা ‘মালে (পাহাড়) দলপতিদের (‘মালেপা’) প্রভু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৭][৮][৯][১০][১১][১২][১৩][১৪] এই কন্নড় উপাধিটি হৈসল রাজারা তাঁদের উৎকীর্ণ লিপির রাজসাক্ষরে সগর্বে ব্যবহার করতেন। সমসাময়িক কালের কন্নড় (জাতকতিলক) ও সংস্কৃত (গদ্যকর্ণামৃত) সাহিত্য থেকেও জানা যায় যে, তাঁরা অধুনা কর্ণাটক রাজ্য নামে পরিচিত ভূখণ্ডেরই আদি বাসিন্দা ছিলেন।[১৫][১৬]
হৈসলদের প্রথম পারিবারিক তথ্যসূত্রটি ৯৫০ খ্রিস্টাব্দের। এই সূত্র থেকে দলপতি হিসেবে আরেকাল্লার নাম পাওয়া যায়। এরপর মারুগা ও প্রথম নৃপ কাম (৯৭৬ খ্রিস্টাব্দ) রাজা হন। পরবর্তী শাসক মুণ্ডের (১০০৬-১০২৬ খ্রিস্টাব্দ) পর দ্বিতীয় নৃপ কাম রাজা হন। তিনি ‘পেরমনডি’ ইত্যাদি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। তা থেকে বোঝা যায়, পশ্চিম গঙ্গ রাজবংশের সঙ্গে গোড়ার দিক থেকেই তাদের মিত্রতা ছিল।[১৭] এই ধরনের সাধারণ সূচনা থেকে হৈসল রাজবংশ পশ্চিম চালুক্যদের এক শক্তিশালী সামন্ত শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।[১৮][১৯] বিষ্ণুবর্ধনের সুদূর প্রসারী সামরিক অভিযানগুলির ফলে হৈসল রাজ্য প্রথম সত্যকারের রাজ্যের মর্যাদা লাভ করেছিল।[২০][২১] ১১১৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চোলেদের কাছ থেকে গঙ্গবডি অধিকার করে নেন এবং বেলুরু থেকে হৈলেবিডুতে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন।[২২][২৩][২৪][২৫]
বিষ্ণুবর্ধন একটি স্বাধীন সাম্রাজ্য স্থাপনের ব্যাপারে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। তার এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন তার পৌত্র দ্বিতীয় বীর বল্লাল। তিনি ১১৮৭-১১৯৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে হৈসলদের চালুক্য অধীনতা থেকে মুক্ত করেন।[২৬][২৭][২৮] এই ভাবে পশ্চিম চালুক্যদের এক সামন্ত শক্তি হিসেবে হৈসলদের ইতিহাস সূচিত হলেও, ধীরে ধীরে বিষ্ণুবর্ধন, দ্বিতীয় বীর বল্লাল ও তৃতীয় বীর বল্লালের মতো শক্তিশালী রাজার হাত ধরে কর্ণাটকে তারা নিজস্ব সাম্রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হন। এই সময় উপদ্বীপীয় ভারতের একচ্ছত্র আধিপত্য লাভের উদ্দেশ্যে হৈসল, পাণ্ড্য, কাকতীয় ও দেবগিরির সেউন যাদব রাজবংশ – এই চারটি রাজশক্তির মধ্যে সংগ্রাম চলছিল –।[২৯] দ্বিতীয় বীর বল্লাল চোল রাজ্য আক্রমণকারী আগ্রাসী পাণ্ড্যদের পরাজিত করেন।[৩০][৩১][৩২][৩৩] তিনি ‘চোলরাজ্যপ্রতিষ্ঠাচার্য’ (‘চোল রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা’), ‘দক্ষিণ চক্রবর্তী’ (‘দক্ষিণের সম্রাট’) ও ‘হৈসল চক্রবর্তী’ (‘হৈসল সম্রাট’) উপাধি ধারণ করেছিলেন।[৩৪] কন্নড় লোককথা অনুসারে, তিনিই বেঙ্গালুরু শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[৩৫]
১২২৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ হৈসলরা অধুনা তামিলনাড়ু ভূখণ্ডে পদার্পণ করেন। এই সময় তারা শ্রীরঙ্গমের নিকটস্থ কন্নানুর কুপ্পাম শহরটিকে প্রাদেশিক রাজধানীর মর্যাদা দেন। এই ভাবেই দক্ষিণ ভারতের রাজনীতি হৈসল নিয়ন্ত্রণে আসে এবং দাক্ষিণাত্যের দক্ষিণাঞ্চলে হৈসলদের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপিত হয়।[৩৬][৩৭][৩৮][৩৯] দ্বিতীয় বীর নৃসিংহের পুত্র বীর সোমেশ্বর পাণ্ড্য ও চোলেদের থেকে ‘মামাডি’ (‘মামা’) সম্মান লাভ করেন। পাণ্ড্য রাজ্যেও হৈসলরা প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।[৪০] পরবর্তীকালে পাণ্ড্য বিদ্রোহের ফলে তামিল দেশের যে অঞ্চলগুলি হৈসলদের হাতছাড়া হয়েছিল, সেগুলি ১৩শ শতাব্দীর শেষ ভাগে তৃতীয় বীর বল্লাল পুনরায় অধিকার করেন। এর ফলে রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ অংশগুলি পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়।[৪১][৪২][৪৩][৪৪]
১৪শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সূচিত হয়। এই সময় উত্তর ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি দক্ষিণ ভারতে নিজের আধিপত্য স্থাপনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন। তিনি তার সেনাপতি মালিক কাফুরকে দাক্ষিণাত্য অভিযানে প্রেরণ করেন। কাফুর ১৩১১ খ্রিষ্টাব্দে সেউন রাজধানী দেবগিরি লুণ্ঠন করেন।[৪৫] ১৮১৮ খ্রিষ্টাব্দে সেউন সাম্রাজ্য দিল্লি সুলতানির অধিকারভুক্ত হয়। ১৩১১ ও ১৩২৭ খ্রিষ্টাব্দে দুই বার হৈসল রাজধানী হৈলেবিডু (যার অপর নাম ছিল ডোরসমুদ্র বা দ্বারসমুদ্র) লুণ্ঠিত হয়।[৪৪]
১৩৩৬ সালে সুলতান মাদুরাইয়ের পাণ্ড্য, ওয়ারঙ্গলের কাকতীয় ও কাম্পিলির একটি ছোটো রাজ্য জয় করেন। হিন্দু সাম্রাজ্য হিসেবে একমাত্র হৈসল সাম্রাজ্যই আক্রমণকারী মুসলমান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বজায় রাখতে সক্ষম হয়।[৪৬] তৃতীয় বীর বল্লাল তিরুবন্নমালাই থেকে উত্তরের আক্রমণকারী বাহিনী এবং দক্ষিণের মাদুরাই সুলতানির বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।[৪৭] প্রায় তিন দশকের প্রতিরোধের পর ১৩৪৩ খ্রিষ্টাব্দে মাদুরাইয়ের যুদ্ধে তৃতীয় বীর বল্লাল নিহত হন।[৪৩] এরপর হৈসল সাম্রাজ্যের সার্বভৌম অঞ্চলগুলি তুঙ্গভদ্রা অঞ্চলে প্রথম হরিহর শাসিত অঞ্চলগুলির সঙ্গে যুক্ত হয়।[৪৮][৪৯] এই নতুন হিন্দু রাজ্যটি উত্তর ভারতের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বজায় রাখে এবং পরবর্তীকালে সমৃদ্ধ হয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্য নামে পরিচিত হয়।[৫০]
অর্থনীতি
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/c/c8/%E0%B2%97%E0%B2%9C%E0%B2%AA%E0%B2%A4%E0%B2%BF_%E0%B2%AA%E0%B2%97%E0%B3%8B%E0%B2%A1.jpg/320px-%E0%B2%97%E0%B2%9C%E0%B2%AA%E0%B2%A4%E0%B2%BF_%E0%B2%AA%E0%B2%97%E0%B3%8B%E0%B2%A1.jpg)
একটি কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি থেকে আদায় করা রাজস্বের মাধ্যমে হৈসল প্রশাসন পোষিত হত।[৫১] রাজারা প্রজাসত্ত্বভোগীদের পরিষেবার বিনিময়ে তাদের ভূসম্পত্তি অনুদান দিতেন। এই প্রজাসত্ত্বভোগীরা কৃষিপণ্য ও অরণ্যজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রজাদের ভূস্বামী হতেন। এই ভূস্বামী বা ‘গবুন্ড’দের দুটি শ্রেণি ছিল। যথা, ‘প্রজা গবুন্ড’ (‘প্রজাদের জমিদার’) এবং ‘প্রভু গবুন্ড’ (‘ধনী গবুন্ড’)। প্রভু গবুন্ডগণ উচ্চতর মর্যাদা ভোগ করতেন।[৫২] উচ্চভূমি অঞ্চলের (মালেনাডু অঞ্চল) নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু পশুপালন এবং ফল ও মশলা উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রশস্ত ছিল। ধান ও দানাশস্য ক্রান্তীয় সমভূমি (‘বৈলনাড’) অঞ্চলের প্রধান শস্য ছিল। হৈসলরা পুষ্করিণী, জলকপাট-সহ জলাধার, খাল ও কূপের উপর আরোপিত কর সংগ্রহ করতেন। এগুলি স্থানীয় গ্রামবাসীদের ব্যয়ে নির্মিত ও রক্ষিত হত। বিষ্ণুসাগর, শান্তিসাগর, বল্লালরায়সাগর প্রভৃতি সেচ পুষ্করিণীগুলি রাষ্ট্রের ব্যয়ে নির্মিত হয়েছিল।[৫১]
পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে সাধারণ পরিবহন ব্যবস্থা ও ভারতীয় রাজ্যগুলির সেনাবাহিনীর জন্য ঘোড়া আমদানি ছিল সেই যুগের উঠতি ব্যবসা।[৫৩] সেগুন প্রভৃতি দামি কাঠের জন্য বনসৃজন করা হত। এই কাঠ অধুনা কেরল রাজ্যের বিভিন্ন বন্দরের মাধ্যমে রফতানি করা হত। চীনের সুং রাজবংশের নথি থেকে দক্ষিণ চীনের বন্দরগুলিতে ভারতীয় বণিকদের উপস্থিতির কথা জানা যায়। এর থেকে অনুমিত হয় যে, ভারতীয় রাজ্যগুলি বৈদেশিক সমুদ্রবাণিজ্যে লিপ্ত ছিল।[৫৪] দক্ষিণ ভারত থেকে বস্ত্র, মশলা, ভেষজ উদ্ভিদ, মূল্যবান পাথর, মৃৎশিল্প, লবণপাত্র থেকে উৎপন্ন লবণ, রত্ন, সোনা, হাতির দাঁত, গণ্ডারের খড়্গ, আবলুস কাঠ, ঘৃতকুমারী কাঠ, সুগন্ধি দ্রব্য, চন্দনকাঠ, কর্পূর এবং গুঁড়োমশলা, আচার, চাটনি, কাসুন্দি প্রভৃতি চীন, দোফার, এডেন ও সিরাফে (মিশর, আরব ও পারস্যের প্রবেশবন্দর) রফতানি করা হত।[৫৫] প্রচুর মন্দির নির্মিত হয়েছিল বলে স্থপতি (‘বিশ্বকর্মা’), ভাস্কর, খনি শ্রমিক, স্বর্ণকার এবং মন্দির নির্মাণের কাজে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত অন্যান্য দক্ষ শিল্পীরা যথেষ্ট লাভবান হয়েছিলেন।[৫৬][৫৭]
গ্রামসভাগুলি সরকারি ভূমিরাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। ভূমিরাজস্বকে বলা হত ‘সিদ্ধায়’। এর মধ্যে নিরুপিত সম্পত্তিমূল্য (‘কূল’) ও অন্যান্য উপকর অন্তর্ভুক্ত ছিল।[৫১] পেশা, বিবাহ, রথ বা যানবাহনে পরিবাহিত সামগ্রী এবং গৃহপালিত পশুর উপর কর ধার্য করা হত। গ্রাম্য তথ্যসূত্র থেকে দ্রব্যসামগ্রী (সোনা, মূল্যবান পাথর, সুগন্ধি, চন্দনকাঠ, দড়ি, সুতো, গৃহ, উনুন, দোকান, পশুখামার, আখ পেশাই যন্ত্র) এবং উৎপাদিত দ্রব্যের (কালো মরিচ, পান পাতা, ঘি, ধান, মশলা, তাল পাতা, নারকেল, চিনি) উপর আরোপিত করের কথা জানা যায়।[৫৪] গ্রামসভাগুলি সেচ পুষ্করিণী নির্মাণ প্রভৃতি বিশেষ উদ্দেশ্যে কর আরোপ করতে পারত।
প্রশাসন
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/8/85/Garuda_pillar_with_Old_Kannada_inscription_dated_1220_A.D_of_Kuvara_Lakshma%2C_a_body_guard_of_Hoysala_King_Veera_Ballala_II.jpg/640px-Garuda_pillar_with_Old_Kannada_inscription_dated_1220_A.D_of_Kuvara_Lakshma%2C_a_body_guard_of_Hoysala_King_Veera_Ballala_II.jpg)
প্রশাসনিক ক্ষেত্রে হৈসল সাম্রাজ্য তার পূর্বসূরিদের কয়েকটি সুপ্রচলিত ও প্রমাণিত পদ্ধতি অনুসরণ করত। এর মধ্যে ছিল ক্যাবিনেট সংগঠন ও সামরিক ব্যবস্থা, স্থানীয় শাসনসংস্থার পরিকাঠামো ও অঞ্চলের বিভাগ।[৫৮] নথিপত্র থেকে জানা যায়, বহু উচ্চপদস্থ কর্মচারী সরাসরি রাজার কাছে প্রতিবেদন দিতেন। প্রবীণ মন্ত্রীদের বলা হত ‘পঞ্চ প্রধান’। যে মন্ত্রীরা বৈদেশিক বিষয়গুলি দেখাশোনা করতেন, তাদের বলা হত ‘সন্ধিবিগ্রহী’। প্রধান কোষাধ্যক্ষকে বলা হত ‘মহাভাণ্ডারী’ বা ‘হিরণ্যভাণ্ডারী’। সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন ‘দণ্ডনায়ক’গণ এবং হৈসল বিচারালয়ের প্রধান বিচারককে বলা হত ‘ধর্মাধিকারী’।[৫৮]
ভৌগোলিক আয়তন অনুসারে হৈসল সাম্রাজ্য ‘নাড়ু’, ‘বিষয়’, ‘কম্পন’ ও ‘দেশ’ – এই চার শ্রেণির প্রদেশে বিভক্ত ছিল। ‘নাড়ু’ ছিল সর্বাপেক্ষা বৃহদায়তন প্রদেশ এবং তার অধোক্রমে ‘দেশ’ ছিল ক্ষুদ্রতম প্রাদেশিক বিভাগ।[৫৯] প্রত্যেক প্রদেশে একটি স্থানীয় শাসন পরিষদ ছিল। এই পরিষদে একজন মন্ত্রী (‘মহাপ্রধান’) ও একজন কোষাধ্যক্ষ (‘ভাণ্ডারী’) থাকতেন। এঁরা প্রদেশের শাসকের (‘দণ্ডনায়ক’) কাছে দায়বদ্ধ থাকতেন। এই স্থানীয় শাসকের অধীনে ‘হেগডে’ ও ‘গভুন্ড’ নামক আধিকারিকরা ছিলেন। এঁরা স্থানীয় কৃষক ও শ্রমিকদের জমিকর্ষণের জন্য ভাড়া করে এনে তাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন। অলুপা প্রভৃতি অধীনস্থ শাসক বংশগুলি তাদের নিজস্ব অঞ্চল শাসন করত। তবে তারা সাম্রাজ্যের নীতিই অনুসরণ করে চলত।[৬০]
‘গরুড়’ নামে পরিচিত এক অভিজাত ও সুপ্রশিক্ষিত দেহরক্ষী বাহিনী সর্বদা রাজপরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা দান করত। এই পরিচারকেরা তাদের প্রভুর নিকটে অথচ অলক্ষ্যে ঘুরতেন। তাদের আনুগত্য এতটাই গভীর ছিল যে, প্রভুর মৃত্যুর পর তারা আত্মহত্যা করতেন।[৬১] এই দেহরক্ষীদের স্মৃতিতে যে বীরপ্রস্তর (‘বীরগল’) স্থাপিত হত, সেগুলিকে বলা হত ‘গরুড় স্তম্ভ’। হৈলেবিডুর হৈসলেশ্বর মন্দিরে রাজা দ্বিতীয় বীর বল্লালের মন্ত্রী ও দেহরক্ষী কুবর লক্ষ্ম-র সম্মানে একটি গরুড় স্তম্ভ স্থাপিত হয়েছিল।
রাজা বিষ্ণুবর্ধনের মুদ্রায় হৈসল শৈলীর কন্নড় লিপিতে ‘নোলামববডি’ (‘নোলামববডির যুদ্ধে বিজয়ী’), ‘’তালাকাডুগোন্ডা’ (তালাকাডের যুদ্ধে বিজয়ী’), ‘মালেপারোলগন্ড’ (‘মালেপাদের প্রধান’), ‘মালপবীর’ (‘মালেপা বীর’) উপাধিগুলি খোদিত থাকত।[৬২][৬৩] তাদের স্বর্ণমুদ্রাকে বলা হত ‘হোন্নু’ ও ‘গড্যন’। এগুলির ওজন ছিল ৬২ গ্রেইন। ‘পণ’ ও ‘হণ’ ছিল ‘হোন্নু’র এক দশমাংশ, ‘হগ’ ছিল ‘পণে’র এক চতুর্থাংশ এবং ‘বিস’ ছিল ‘হগে’র এক চতুর্থাংশ। ‘বেলে’ ও ‘কানি’ নামে আরও দুই ধরনের মুদ্রা প্রচলিত ছিল।[৬০]
সংস্কৃতি
ধর্ম
১১শ শতাব্দীর প্রথম দিকে চোলেদের হাতে জৈন পশ্চিম গঙ্গ রাজবংশের পরাজয় এবং ১২শ শতাব্দীতে বৈষ্ণবধর্ম ও লিঙ্গায়েত ধর্মের অনুগামীদের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জৈনধর্ম সম্পর্কে মানুষের আগ্রহ কমে আসে।[৬৪] হৈসল অঞ্চলের দুটি উল্লেখযোগ্য জৈন উপাসনা কেন্দ্র ছিল শ্রবণবেলগোলা ও কম্বডহল্লি। আদি শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ৮ম শতাব্দীতেই দক্ষিণ ভারতে বৌদ্ধধর্মের পতন সূচিত হয়েছিল।[৬৫] হৈসল যুগে কেবল ডম্বল ও বল্লিগবি – এই দুটি বৌদ্ধ উপাসনা স্থল ছিল। বিষ্ণুবর্ধনের পত্নী শান্তলা দেবী ছিলেন জৈন। কিন্তু তিনি বেলুরে হিন্দু কাপ্পে চেন্নিগরায় মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন। এটি রাজপরিবারের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার নিদর্শন।
হৈসল শাসনকালে রামানুজ, বাসব ও মধ্ব নামে তিন দার্শনিকের প্রভাবে কর্ণাটক অঞ্চলে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল।
লিঙ্গায়েত ধর্মের উৎস সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে। ১২শ শতাব্দীতে বাসব এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর এটি প্রসার লাভ করেছিল।[৬৬] রামানুজ ছিলেন শ্রীরঙ্গমের বৈষ্ণব মঠের প্রধান। তিনি ভক্তিবাদ প্রচার করেছিলেন এবং আদি শঙ্করের অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সমালোচনা করেন শ্রীভাষ্য রচনা করেন।[৬৭] মধ্ব ছিলেন আদি শঙ্করের শিক্ষার বিরোধী। তিনি জগতকে সত্য মনে করতেন। তার মতে, জগত মায়া নয়।[৬৮] মধ্বের দর্শন জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তিনি উডুপিতে আটটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেন।
দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি, সাহিত্য, কাব্য ও স্থাপত্যে এই ধর্মীয় আন্দোলনগুলি গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল। পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে এই দার্শনিকদের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যগ্রন্থ ও কাব্য রচিত হয়েছিল। বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সালুব, তুলুব ও অরবিডু রাজবংশগুলি ছিল বৈষ্ণবধর্মের অনুগামী। বিজয়নগরের বিট্ঠলপুরা অঞ্চলে যে বৈষ্ণব মন্দির নির্মিত হয়েছিল, তাতে রামানুজের একটি মূর্তিও ছিল।[৬৯] পরবর্তীকালে মহীশূর রাজ্যের পণ্ডিতেরা রামানুজের শিক্ষা অনুসারে বৈষ্ণব গ্রন্থ রচনা করেন।[৭০] রাজা বিষ্ণুবর্ধন জৈনধর্ম থেকে বৈষ্ণবধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর অনেকগুলি মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন।[৭১][৭২] পরবর্তীকালে মধ্ব সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ত জয়তীর্থ, ব্যাসতীর্থ, শ্রীপদরাজ, বদীরাজতীর্থ এবং বিজয় দাস, গোপালদাস প্রমুখ ভক্ত (‘দাস’) এবং কর্ণাটকের অন্যান্য ব্যক্তিত্বেরা মধ্বের শিক্ষার প্রসার ঘটান।[৭৩] তার শিক্ষা পরবর্তীকালে গুজরাতের বল্লভ ও বাংলার চৈতন্য মহাপ্রভুকে অনুপ্রাণিত করেছিল।[৭৪] ১৭শ শতাব্দী-১৮শ শতাব্দীতে মধ্বের শিক্ষা অনুসারে আরেকটি ভক্তি আন্দোলনের সূচনা ঘটেছিল।[৭৫]
সমাজব্যবস্থা
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/b/bf/Shilabaalika_on_pillar_bracket_in_Chennakeshava_Temple_at_Belur2.jpg/640px-Shilabaalika_on_pillar_bracket_in_Chennakeshava_Temple_at_Belur2.jpg)
হৈসল সমাজব্যবস্থায় বহু ভাবে তৎকালীন উদীয়মান ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের প্রতিফলন ঘটেছিল। এই যুগে সমাজ ধীরে ধীরে আধুনিক হয়ে উঠছিল। সমাজে নারীর স্থান ছিল বিভিন্ন প্রকারের। রাজপরিবারের কয়েকজন নারী প্রশাসনিক কাজে অংশ নিতেন বলে জানা যায়। সমসাময়িক নথি অনুসারে, রাজা দ্বিতীয় বীর বল্লাল যখন সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে দীর্ঘকাল সামরিক অভিযানে রত ছিলেন, সেই সময় রানি উমাদেবী তার অনুপস্থিতিতে হৈলেবিডুর প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করতেন। তিনি কয়েকজন বিদ্রোহী সামন্তের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেন এবং তাদের পরাজিত করেন।[৭৬] নথিপত্র থেকে আরও জানা যায়, নারীরা চারুকলায় অংশ নিতেন। রানি শান্তলা দেবীর নৃত্য ও সংগীতে পারদর্শিতা বিখ্যাত ছিল। ১২শ শতাব্দীর ‘বচন’ কবি ও লিঙ্গায়েত সাধ্বী আক্কা মহাদেবী ভক্তি আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।[৭৭] দেবদাসী প্রথার (মন্দিরের নর্তকী) বহুল প্রচলন ছিল। কয়েকজন দেবদাসী ছিলেন সুশিক্ষিত ও শিল্পকলায় পারঙ্গম। সাধারণ শহুরে ও গ্রাম্য নারীদের দৈনন্দিন কাজকর্মে অনেক নিষেধাজ্ঞা মেনে চলতে হত। কিন্তু এই শিক্ষিত দেবদাসীরা অধিকতর স্বাধীনতা ভোগ করতেন।[৭৮] সতীদাহ প্রথা প্রচলিত থাকলেও সতী হওয়া ব্যক্তি ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল ছিল। বেশ্যাবৃত্তি সামাজিকভাবে গ্রহণীয় ছিল।[৭৯] ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো এই সাম্রাজ্যেও বর্ণভেদ প্রথা লক্ষ্যণীয়ভাবে উপস্থিত ছিল।
পশ্চিম উপকূলে বাণিজ্যের দৌলতে অনেক বিদেশি বণিক ভারতে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন আরব, ইহুদি, পারসি, চীনা ও মালয় উপদ্বীপের লোকেরা।[৮০] সাম্রাজ্যের বিস্তারের ফলে দক্ষিণ ভারতের স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিনিবেশ নতুন সংস্কৃতি ও দক্ষতার মিশ্রণ ঘটিয়েছিল।[৮১] দক্ষিণ ভারতে ‘পট্টন’ বা ‘পট্টনম’ নামে পরিচিত শহর ও বাজার এলাকা, ‘নগর’ বা ‘নগরম’ নামে পরিচিত শহর ও বাজার এলাকাগুলি ক্ষুদ্র মহানগরের অনুরূপ ছিল। ৭ম শতাব্দীতে ধর্মীয় বসতি অঞ্চল হিসেবে গড়ে ওঠা শ্রবণবেলগোলার মতো কিছু শহর ১২শ শতাব্দী নাগাদ ধনী ব্যবসায়ীদের আগমনের ফলে বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়। অন্যদিকে রাজা বিষ্ণুবর্ধন বেলুরুর মতো শহরগুলিতে চেন্নকেশব মন্দির নির্মাণ করার পর সেগুলি রাজকীয় শহরের মর্যাদা পায়। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা-প্রাপ্ত বৃহদাকার মন্দিরগুলি ধর্মীয়, সামাজিক ও বিচার-সংক্রান্ত কাজে ব্যবহৃত হত। এই মন্দিরগুলি রাজাকে ‘মর্ত্যে ঈশ্বরে’র পর্যায়ে উন্নীত করেছিল।
মন্দির নির্মাণ একাধারে ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য সাধন করত। এটি হিন্দুধর্মের কোনও নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। হৈলেবিডুর শৈব বণিকেরা বেলুরুর চেন্নকেশব মন্দিরের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে হৈসলেশ্বর মন্দির নির্মাণে অর্থসাহায্য করেন। এর ফলে বেলুরু একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়। যদিও হৈসল মন্দিরগুলি ছিল ধর্মনিরপেক্ষ। এই মন্দিরে সকল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে তীর্থযাত্রায় উদ্বুদ্ধ করত। কেবল সোমনাথপুরার কেশব মন্দিরটি ছিল কেবলমাত্র বৈষ্ণব ভাস্কর্যে শোভিত।[৮২] গ্রামাঞ্চলে ধনী জমিদারদের দ্বারা নির্মিত মন্দিরগুলি কৃষক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় প্রয়োজনগুলি মেটাতো। পৃষ্ঠপোষক যেই হোন না কেন, বৃহদাকার মন্দিরগুলি এমন সব প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করত, যেখানে বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংস্থা ও পেশার শতাধিক মানুষ কাজে জীবিকা অর্জনে নিযুক্ত থাকত এবং স্থানীয় জনগণ জীবিকা উপার্জন করতে পারত। এই ভাবেই হিন্দু মন্দিরগুলি ধনী বৌদ্ধ মঠের সমতুল্য হয়ে উঠেছিল।[৮৩]
সাহিত্য
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/2/26/Jain_Temple_at_Halebidu.jpg/640px-Jain_Temple_at_Halebidu.jpg)
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/e/e9/Old_Kannada_inscription_dated_1182_A.D._at_the_Akkana_Basadi_in_Shravanebelagola.jpg/640px-Old_Kannada_inscription_dated_1182_A.D._at_the_Akkana_Basadi_in_Shravanebelagola.jpg)
হৈসল শাসনকালে সংস্কৃত সাহিত্য জনপ্রিয়তা বজায় রাখলেও, স্থানীয় কন্নড় পণ্ডিতদের প্রতি রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৫১][৮৪][৮৫] ১২শ শতাব্দীতে কিছু কিছু রচনা ‘চম্পু’র আকারে রচিত হয়।[৮৬] কিন্তু স্বতন্ত্র কন্নড় ছন্দগুলি অধিক পরিমাণে গৃহীত হতে শুরু করে। গীত রচনার ক্ষেত্রে ‘সাংগত্য’ ছন্দের ব্যবহার শুরু হয়।[৮৭] কাব্যে ‘ষট্পদী’ (ছয় পঙ্ক্তি), ‘ত্রিপদী’ (তিন পঙ্ক্তি’) ছন্দ ও ‘রাগালি’ (গীতিকবিতা) প্রচলন লাভ করে। জৈন গ্রন্থগুলিতে তীর্থঙ্করদের প্রশস্তি বজায় থাকে।[৮৮]
জন্ন, রুদ্রভট্ট, হরিহর ও তার ভ্রাতুষ্পুত্র রাঘবাঙ্ক হৈসল রাজসভা অলংকৃত করতেন। এঁদের রচনা কন্নড় সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। ১২০৯ খ্রিষ্টাব্দে জৈন পণ্ডিত জন্ন যশোধরাচরিতে রচনা করেন। এই কাহিনিতে দেখা যায়, এক রাজা স্থানীয় দেবী মারিয়াম্মার সম্মুখে দুটি বালককে বলি দিতে যান। কিন্তু বালক দুটিকে দেখে রাজার মনের করুণার উদ্রেক হয়। তিনি তাদের মুক্তি দেন এবং নরবলি প্রথা তুলে দেন।[৮৯][৯০] এই রচনার জন্য রাজা দ্বিতীয় বীর বল্লাল জন্নকে ‘কবিচক্রবর্তী’ (‘কবিগণের সম্রাট’) উপাধি দিয়েছিলেন।[৯১]
রুদ্রভট্ট ছিলেন একজন স্মার্ত ব্রাহ্মণ। তিনি ছিলেন প্রথম বিখ্যাত ব্রাহ্মণ্যবাদী লেখক যিনি রাজা দ্বিতীয় বীর বল্লালের মন্ত্রী চন্দ্রমৌলীর পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন।[৯২] তিনি তার পূর্ববর্তী রচনা বিষ্ণুপুরাণ অবলম্বনে চম্পু শৈলীতে জগন্নাথ বিজয় রচনা করেন। এই গ্রন্থটিতে বাণাসুর বধ পর্যন্ত কৃষ্ণের জীবন ধৃত হয়েছে।
হরিহর (অপর নাম হরীশ্বর) ছিলেন একজন লিঙ্গায়েতি লেখক। তার পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রাজা প্রথম নরসিংহ। হরিহর পুরনো জৈন ‘চম্পু’ শৈলীতে গিরিজাকল্যাণ রচনা করেন। এই গ্রন্থে দশটি অংশে শিব ও পার্বতীর বিবাহ বর্ণিত হয়েছে।[৯৩][৯৪] তিনি সেই প্রাচীনতম বীরশৈব লেখকদের অন্যতম, যাঁরা ‘বচন’ সাহিত্যধারার অন্তর্গত ছিলেন না। হরিহর হৈলেবিডুর এক হিসাবরক্ষক (‘করণিক’) পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি দীর্ঘকাল হাম্পিতে বাস করে বিরুপাক্ষের (শিবের একটি রূপ) স্তুতি করে শতাধিক ‘রাগালি’ (অমিত্রাক্ষর ছন্দের কবিতা) রচনা করেন।[৯৫] রাঘবাঙ্ক তার হরিশ্চন্দ্র কাব্য নামক গ্রন্থের মাধ্যমে প্রথম কন্নড় সাহিত্যে ‘ষট্পদী’ ছন্দ প্রবর্তন করেন। এই গ্রন্থটি স্থানে স্থানে কন্নড় ব্যাকরণের নিয়ম লঙ্ঘন করলেও এটিকে একটি ধ্রুপদি গ্রন্থ মনে করা হয়।[৯১][৯৩][৯৫]
সংস্কৃত ভাষায় দার্শনিক মধ্ব ব্রহ্মসূত্রের (হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদের ন্যায়সঙ্গত ব্যাখ্যা) উপর ঋগ্ভাষ্য রচনা করেন। তিনি বেদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতবাদকে খণ্ডন করে অন্যান্য গ্রন্থও রচনা করেছিলেন। তবে তিনি তার দর্শনের প্রমাণ হিসেবে বেদের পরিবর্তে পুরাণ সাহিত্যের উপর অধিক নির্ভরশীল ছিলেন।[৯৬] এই যুগের আরেকটি গ্রন্থ ছিল বিদ্যাতীর্থের রুদ্রপ্রশ্নভাষ্য।
স্থাপত্য
হৈসলদের সম্পর্কে আধুনিক কালের আগ্রহের কারণ তাদের সামরিক বিজয় নয়, বরং শিল্পকলা ও স্থাপত্যের ক্ষেত্রে তাদের পৃষ্ঠপোষকতা। দক্ষিণ দিক থেকে পাণ্ড্য এবং উত্তর দিক থেকে সেউন যাদবদের আক্রমণের ভয় থাকলেও সমগ্র রাজ্য জুড়ে এই যুগে দ্রুত মন্দির নির্মিত হয়ে চলেছিল। হৈসল স্থাপত্যশৈলী ছিল পশ্চিম চালুক্য স্থাপত্যশৈলীর উত্তরসূরি।[৯৭][৯৮] এতে একটি স্বতন্ত্র দ্রাবিড় প্রভাব লক্ষিত হয়।[৯৯] প্রথাগত দ্রাবিড় শৈলীর থেকে হৈসল স্থাপত্যকে পৃথক করার জন্য একে ‘কর্ণাট দ্রাবিড়’ স্থাপত্যশৈলী বলা হয়।[১০০] বহু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকায় এটিকে একটি স্বাধীন স্থাপত্যশৈলী মনে করা হয়।[১০১][১০২]
হৈসল মন্দির স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হল, সুন্দর বিস্তারিত দৃশ্যযোজনা ও শৈল্পিক দক্ষতা।[১০৩] মন্দিরের ‘বিমান’গুলি (মূল মন্দিরের উপরস্থ চূড়া) সূক্ষ্ম কারুকার্যে সুন্দরভাবে শোভিত রয়েছে। এক্ষেত্রে সাধারণ চূড়ার আকার বা উচ্চতার দিকে দৃষ্টি না রেখে জটিল ও বিস্তারিত দৃশ্যযোজনার দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।[১০৪][১০৫] বেদির ভিত্তির গায়ে তারকাকার নকশাগুলি এবং তার ছন্দোময় প্রদর্শনী ও খাঁজগুলি সুসজ্জিত আকারে ধাপে ধাপে চূড়া পর্যন্ত উঠে গিয়েছে।[১০৬][১০৭] হৈসল মন্দির ভাস্কর্যে নারীর সৌন্দর্য, মহত্ব ও শারীরিক গঠনের উপর সুচারুভাবে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।[১০৮] হৈসল শিল্পীরা মূল ভবন ও ভাস্কর্যের উপাদান হিসেবে সাজিমাটি (ক্লোরিটিক সিস্ট) নামে এক ধরনের নরম পাথর ব্যবহার করতেন।[১০৯][১১০]
বেলুরুর চেন্নকেশব মন্দির (১১১৭ খ্রিস্টাব্দ),[১১১][১১২] হৈলেবিডুর হৈসলেশ্বর মন্দির (১১২১ খ্রিস্টাব্দ),[১১৩][১১৪] সোমনাথপুরার চেন্নকেশব মন্দির (১২৭৯ খ্রিস্টাব্দ),[১১৫][১১৬] আরাসিকেরের মন্দিরসমূহ (১২২০ খ্রিস্টাব্দ),[১১৭][১১৮] অমৃতপুরা (১১৯৬ খ্রিস্টাব্দ),[১১৯][১২০] বেলাবাডি (১২০০ খ্রিস্টাব্দ),[১২১][১২২] লক্ষ্মী-নরসিংহ মন্দির, নুগ্গেহল্লি (১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ),[১২৩][১২৪] লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, হোসহোলালু (১২৫০ খ্রিস্টাব্দ),[১২৫][১২৬] চেন্নকেশব মন্দির, অরলগুপ্পে (১২৫০ খ্রিস্টাব্দ),[১১৮][১২৭] বুকেশ্বর মন্দির, কোরাবাঙ্গালা (১১৭৩ খ্রিস্টাব্দ),[১২৮][১২৯] লক্ষ্মী-সরসিংহ মন্দির, হরনহল্লি (১২৩৫ খ্রিস্টাব্দ),[১২৬][১৩০] নাগেশ্বর-চেন্নকেশব মন্দির চত্বর, মোসৈল[১৩১][১৩২] ও মল্লিকার্জুন মন্দির, বাসরলু (১২৩৪ খ্রিস্টাব্দ)[১২২][১৩৩] হল হৈসল শিল্পকলার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্দির নিদর্শন। বেলুরু ও হৈলেবিডুর মন্দিরগুলি এগুলির ভাস্কর্য সৌকর্যের সর্বাধিক খ্যাত। অন্যদিকে ক্ষুদ্রতর ও অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিত মন্দিরগুলিতে হৈসল শিল্পকলার সম্পূর্ণতর অভিপ্রকাশ লক্ষিত হয়।[১৩৪] এই মন্দিরগুলির বহিঃপ্রাচীরে প্রস্তরনির্মিত সূক্ষ্ম ভাস্কর্য এবং স্তম্ভশীর্ষ ও কার্নিসের মধ্যবর্তী কারুকার্যময় অংশে হিন্দু মহাকাব্যের দৃশ্যাবলি খোদিত রয়েছে। এই চিত্রাবলি সাধারণত প্রথাগত ‘প্রদক্ষিণ’ পথের দিকে ঘড়ির কাঁটার ক্রমে বিন্যস্ত থাকে। হৈলেবিডুর মন্দির হিন্দু স্থাপত্যের অসাধারণ উদাহরণ। [১৩৫] ভারতীয় স্থাপত্যের ক্ষেত্রেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।[১৩৬] বেলুরু ও হৈলেবিডুর মন্দিরগুলি প্রস্তাবিত ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান।[১৩৭]
ভাষা
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/b/b1/Old_Kannada_inscription_dated_1115_AD_in_the_Lakshmi_Devi_temple_at_Doddagaddavalli.jpg/640px-Old_Kannada_inscription_dated_1115_AD_in_the_Lakshmi_Devi_temple_at_Doddagaddavalli.jpg)
![Thumb](http://upload.wikimedia.org/wikipedia/commons/thumb/4/43/Shasana_%28Inscription%29_at_Keshava_Temple%2C_Somanathapura.jpg/640px-Shasana_%28Inscription%29_at_Keshava_Temple%2C_Somanathapura.jpg)
হৈসল শাসকেরা কন্নড় ভাষার অত্যুৎসাহী সমর্থক ছিলেন। এমনকি তাঁদের শিলালিপিগুলিও গদ্যের পরিবর্তে মার্জিত কাব্যিক ভাষায় উৎকীর্ণ হত। এগুলির ধারে ধারে ফুলের নকশা করা থাকত।[১৩৮] ইতিহাসবিদ শেলডন পোলকের মতে, হৈসল যুগে সংস্কৃত ভাষার সম্পূর্ণ বিচ্যুতি ঘটেছিল। রাজসভার ভাষা হিসেবে কন্নড় নিজের স্থান সুদৃঢ় করেছিল।[১৩৯] মন্দিরগুলি ছিল স্থানীয় বিদ্যালয়। সেখানে পণ্ডিত ব্রাহ্মণেরা সংস্কৃতে শিক্ষাদান করতেন। অন্যদিকে জৈন ও বৌদ্ধ মঠগুলিতে নবাগত সন্ন্যাসীদের শিক্ষা দেওয়া হত। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে বলা হত ‘ঘটিকা’। ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তাগণ দেবতার প্রতি নৈকট্যের গভীর অনুভূতি ব্যক্ত করার জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্থানীয় কন্নড় ভাষা ব্যবহার করতেন (‘বচন’ ও ‘দেবরমণ’)। তালপাতায় সাহিত্য রচনা করা হত এবং সেগুলি এক সঙ্গে বেঁধে রাখা হত। পূর্ববর্তী শতাব্দীগুলিতে কন্নড় সাহিত্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল জৈন ধর্মগ্রন্থগুলি। হৈসল শাসনকালে শৈব ও ব্রাহ্মণ্যবাদী রচনাগুলি জনপ্রিয়তা অর্জন করে।[১৪০] সংস্কৃত ভাষায় কাব্য, ব্যাকরণ, অভিধান, অনুষ্ঠান পদ্ধতি, ছন্দ, প্রাচীন গ্রন্থের টীকা, গদ্য কথাসাহিত্য ও নাটক রচিত হত।[১৪১] শিলালিপি (‘শিলাশাসন’) ও তাম্রলিপিগুলি (‘তাম্রশাসন’) অধিকাংশ ক্ষেত্রে কন্নড় ভাষায় রচিত হলেও, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এগুলি সংস্কৃত ভাষাতেও রচিত হয়েছিল আবার কোনও কোনওটি ছিল দ্বিভাষিক। দ্বিভাষিক উৎকীর্ণ লিপিগুলির ক্ষেত্রে শিরোনাম, বংশলতিকা, রাজবংশের উৎস-সংক্রান্ত কিংবদন্তি ও আশীর্বচনগুলি সাধারণত সংস্কৃত ভাষায় লিখিত হত। অনুদানের শর্তাদি কন্নড় ভাষায় লিখিত হত। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল জমি-সংক্রান্ত তথ্য, তার সীমানা, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অংশগ্রহণের বিবরণ, অনুদানপ্রাপ্তের অধিকার ও বাধ্যবাধকতা, কর ও রাজার প্রাপ্তব্য অর্হের হিসেব এবং সাক্ষীদের বিবরণ। স্থানীয় মানুষ যাতে কোনওরকম বিভ্রান্তি ছাড়াই এই সব বিষয় অনুধাবন করতে পারেন, সেই জন্যই এগুলি কন্নড় ভাষায় লেখা হত।[১৪২]
আরও দেখুন
পাদটীকা
তথ্যসূত্র
বহিঃসংযোগ
Wikiwand - on
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.