ভারতীয় জাতীয়তাবাদী নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজনীতিবিদ উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক চিরস্মরণীয় নেতা, যিনি এই সংগ্রামে নিজের জীবন উৎসর্গ করেন। নেতাজি নামে সমধিক পরিচিত সুভাষচন্দ্র বসু পরপর দুবার ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে আদর্শগত সংঘাত, কংগ্রেসের বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা[টীকা ১][৬] এবং বিরুদ্ধ-মত প্রকাশ করার জন্য তাকে পদত্যাগ করতে হয়।
(২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ – ১৮ আগস্ট ১৯৪৫)নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু | |
---|---|
আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনাপ্রধান | |
কাজের মেয়াদ ৪ জুলাই ১৯৪৩—১৮ আগস্ট ১৯৪৫ | |
পূর্বসূরী | মোহন সিং এবং ইওয়াইচি ফুজিওয়ারার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ |
উত্তরসূরী | দপ্তরের বিলুপ্তি |
সভাপতি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস | |
কাজের মেয়াদ ১৮ জানুয়ারি ১৯৩৮—২৯ এপ্রিল ১৯৩৯ | |
পূর্বসূরী | জওহরলাল নেহরু |
উত্তরসূরী | রাজেন্দ্র প্রসাদ |
কাজের মেয়াদ ২২ জুন ১৯৩৯—১৬ জানুয়ারি ১৯৪১ | |
পূর্বসূরী | দপ্তর গঠন |
৫ম কলকাতার মেয়র | |
কাজের মেয়াদ ২২ অগাস্ট ১৯৩০ – ১৫ এপ্রিল ১৯৩১ | |
পূর্বসূরী | যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত |
উত্তরসূরী | বিধানচন্দ্র রায় |
ব্যক্তিগত বিবরণ | |
জন্ম | সুভাষচন্দ্র বসু ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭ কটক, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা ওড়িশা, ভারত) |
মৃত্যু | ১৮ আগস্ট ১৯৪৫ ৪৮)[১][২] তাইহোকু, তাইওয়ান[২] | (বয়স
মৃত্যুর কারণ | বিমান দুর্ঘটনা |
সমাধিস্থল | রেনকো-জি, টোকিও, জাপান |
নাগরিকত্ব | ভারতীয় |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
রাজনৈতিক দল | ফরওয়ার্ড ব্লক |
অন্যান্য রাজনৈতিক দল | ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস |
মাতা | প্রভাবতী বসু (জন্মসুবাদে দত্ত) |
পিতা | জানকীনাথ বসু |
আত্মীয়স্বজন | বসু পরিবার |
বাসস্থান | ৩৮/২ এলগিন রোড (অধুনা লালা লাজপত রায় সরণি), কলকাতা |
শিক্ষা |
|
প্রাক্তন শিক্ষার্থী |
|
যে জন্য পরিচিত | ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী আজাদ হিন্দ ফৌজের সংগঠক ও সর্বাধিনায়ক |
স্বাক্ষর |
সুভাষচন্দ্র মনে করতেন, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের নীতি ভারতের স্বাধীনতা লাভের জন্য যথেষ্ট নয়। সে কারণে তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র ফরওয়ার্ড ব্লক নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন এবং[৭] ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতের সত্বর ও পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানাতে থাকেন। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ তাকে এগারো বার কারারুদ্ধ করে। তার চির-অমর উক্তি— “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘোষিত হওয়ার পরেও তার মতাদর্শের বিন্দুমাত্র পরিবর্তন ঘটেনি; বরং এই যুদ্ধে ব্রিটিশদের দুর্বলতাকে সুবিধা আদায়ের একটি সুযোগ হিসেবে দেখেন। যুদ্ধের সূচনালগ্নে তিনি লুকিয়ে ভারত ত্যাগ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন, জার্মানি ও জাপান ভ্রমণ করেন ভারতে ব্রিটিশদের আক্রমণ করার জন্য সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে। জাপানিদের সহযোগিতায় তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ পুনর্গঠন করেন এবং পরে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই বাহিনীর সৈনিকেরা ছিলেন মূলত ভারতীয় যুদ্ধবন্দি এবং ব্রিটিশ মালয়, সিঙ্গাপুরসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলে কর্মরত মজুর। জাপানের আর্থিক, রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তায় তিনি নির্বাসিত আজাদ হিন্দ সরকার প্রতিষ্ঠা করেন এবং আজাদ হিন্দ ফৌজের নেতৃত্বদান করে ব্রিটিশ মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে ইম্ফল ও ব্রহ্মদেশে (বর্তমান মায়ানমার) যুদ্ধ পরিচালনা করেন।
ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নাৎসি ও অন্যান্য যুদ্ধবাদী শক্তিগুলির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের জন্য কোনো কোনো ঐতিহাসিক ও রাজনীতিবিদ সুভাষচন্দ্রের সমালোচনা করেছেন; এমনকি কেউ কেউ তাকে নাৎসি মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বলে অভিযুক্ত করেছেন। তবে ভারতে অন্যান্যরা তার ইস্তাহারকে রিয়েলপোলিটিক (নৈতিক বা আদর্শভিত্তিক রাজনীতির বদলে ব্যবহারিক রাজনীতি)-এর নিদর্শন বলে উল্লেখ করে তার পথপ্রদর্শক সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবাদর্শের প্রতি সহানুভূতি পোষণ করেছেন। উল্লেখ্য, কংগ্রেস কমিটি যেখানে ভারতের অধিরাজ্য মর্যাদা বা ডোমিনিয়ন স্ট্যাটাসের পক্ষে মত প্রদান করে, সেখানে সুভাষচন্দ্রই প্রথম ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে মত দেন। জওহরলাল নেহরু-সহ অন্যান্য যুবনেতারা তাকে সমর্থন করেন। শেষ পর্যন্ত জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক লাহোর অধিবেশনে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজ মতবাদ গ্রহণে বাধ্য হয়। ভগৎ সিংয়ের ফাঁসি ও তার জীবন রক্ষায় কংগ্রেস নেতাদের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ[টীকা ২] সুভাষচন্দ্র গান্ধী-আরউইন চুক্তি বিরোধী আন্দোলন[টীকা ৩] শুরু করেন। তাকে কারারুদ্ধ করে ভারত থেকে নির্বাসিত করা হয়। নিষেধাজ্ঞা ভেঙে তিনি ভারতে ফিরে এলে আবার তাকে কারারুদ্ধ করা হয়।
১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্টে জাপান-শাসিত তাইওয়ানে একটি বিমান দুর্ঘটনায় আগুনে দাহ হয়ে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু হয়েছিল। কিছু ভারতীয়রা এই বিমান দুর্ঘটনায় বিশ্বাস করেনি, কারণ তারা ভারতের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সুভাষচন্দ্রের প্রত্যাবর্তন আশা করেছিল। সুভাষচন্দ্রের উত্তরাধিকার মিশ্র। ভারতের অনেকের কাছে তিনি কিংবদন্তি হয়ে আছেন। ফ্যাসিবাদী জাপান ও নাৎসিবাদী জার্মানির সাথে তার সহযোগিতা তাকে এক ভয়ংকর নৈতিক উভয়সংকটে ফেলে দিয়েছিল, বিশেষ করে তিনি ১৯৩৮ সাল থেকে জার্মানদের ইহুদি-বিদ্বেষের প্রকাশ্যে সমালোচনা করতে বিরত ছিলেন।
১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি সুভাষচন্দ্র বসু ওড়িশার কটক শহরের এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তখন ওড়িশা বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত ছিল। তার পিতা জানকীনাথ বসু ও মাতা প্রভাবতী বসুর (জন্মসুবাদে দত্ত)।[ক][খ] উত্তর কলকাতার হাটখোলা দত্ত বাড়ির কন্যা প্রভাবতী বসুর ১৩ বছর বয়সে তার প্রথম সন্তান হয়েছিল, আর তার পর থেকে তিনি ১৩টি সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র সেই ১৪টি সন্তানের মধ্যে নবম এবং পুত্রদের মধ্যে ষষ্ঠ ছিলেন।[১০] দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার মাহীনগরের বসু পরিবারের সন্তান জানকীনাথ বসু একজন সফল আইনজীবী ও সরকারি প্লিডার ছিলেন।[৯] ব্রিটিশ ভারত সরকারের অনুগত জানকীনাথ ভাষা ও আইন সম্পর্কিত বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তাদের পৈতৃক নিবাস দক্ষিণ কলকাতার উপকণ্ঠে সুভাষগ্রামে (তখন কোদালিয়া) অবস্থিত,[১১] আর প্রতি বছর পূজার সময় তিনি সেই পৈতৃক নিবাসে ফিরে যেতেন।[১২]
১৯০২ সালের জানুয়ারিতে সুভাষচন্দ্র তার পাঁচ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার সঙ্গে ব্যাপটিস্ট মিশনের প্রটেস্ট্যান্ট ইউরোপিয়ান স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন,[৩] আর ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যায়ন করেছিলেন।[১৩] বিদ্যালয়ের সমস্ত শিক্ষাদানের মাধ্যম ইংরেজি ছিল, কারণ সেখানকার শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই ইউরোপীয় বা ইঙ্গ-ভারতীয়।[৮] বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে ইংরেজি ভাষা সঠিকভাবে লেখা ও বলা, লাতিন, বাইবেল, সহবত শিক্ষা, ব্রিটিশ ভূগোল ও ব্রিটিশ ইতিহাস ছিল। সেখানে কোনো ভারতীয় ভাষা শেখানো হতো না।[৮][৩] তার পিতা জানকীনাথ এই বিদ্যালয় বেছে নিয়েছিলেন, কারণ তিনি চেয়ছিলেন তার পুত্ররা যেন ত্রুটিহীনভাবে ও সঠিক স্বরভেদে ইংরেজি বলতে পারে, আর তিনি বিশ্বাস করতেন যে ভারতে ব্রিটিশদের সাথে সম্বন্ধ স্থাপনের জন্য এরকম ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন।[১৪] সুভাষচন্দ্রের জন্মভিটা ও বিদ্যালয়ের মধ্যে যথেষ্ট ফারাক ছিল, আর নিজ ঘরে কেবল বাংলা ভাষা প্রচলিত। সুভাষের মাতা প্রভাবতী ঘরে দুর্গা ও কালীর পূজা করতেন, মহাভারত ও রামায়ণের গল্প বলতেন আর বাংলায় ধর্মগীতি গাইতেন।[৩] তার কাছ থেকেই সুভাষচন্দ্র এক প্রতিপালনকারী মানসিকতা গ্রহণ করেছিলেন, বিপদগ্রস্ত লোকদের সাহায্যের উপায় খুঁজতেন, বাড়ির আশেপাশে বাগান পরিচর্যা করতেন আর অন্যান্য ছেলেদের সাথে খেলাধূলা করতেন।[৪] অন্যদিকে, জানকীনাথ গুরুগম্ভীর স্বভাবের ছিলেন আর পেশাদারি জীবনে ব্যস্ত থাকতেন। একান্নবর্তী পরিবারে তার অদৃষ্টিগোচর উপস্থিতির জন্য় সুভাষচন্দ্রের মনে হয়েছিল যে তার শৈশব ছিল অকৃতলক্ষণ।[১৫] তা সত্ত্বেও জানকীনাথ ইংরেজি সাহিত্যের একজন উৎসুক পাঠক ছিলেন, আর তার পছন্দের তালিকায় থাকত মিলটন, কাউপার, আর্নল্ড আর শেক্সপিয়রের হ্যামলেট।[১৪]
১৯০৯ সালে পাঁচ ভ্রাতার পর ১২ বছর বয়সী সুভাষচন্দ্র কটকের রাভেনশো কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন।[৪] সেখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃতও শেখানো হতো। এছাড়া বেদ ও উপনিষদের মতো হিন্দু ধর্মগ্রন্থের উপদেশও শেখানো হতো যা সচরাচর ঘরে শেখানো হতো না।[৪] তার পাশ্চাত্য শিক্ষার তৎপরতা অব্যহত থাকলেও তিনি ভারতীয় পোশাক পরতেন এবং ধর্মীয় ভাবনাচিন্তার সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি তার মাকে একাধিক দীর্ঘ চিঠি লিখতেন, আর সেখানে তিনি তাকে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দের উপদেশ এবং তখনকার হিন্দু যুবকদের কাছে জনপ্রিয় আনন্দমঠ উপন্যাসের সাথে পরিচিত করিয়ে দিয়েছিলেন।[১৭] ব্যস্ততা থাকলেও সুভাষচন্দ্র তার পড়াশুনায় মনোযোগ, প্রতিযোগিতা ও পরীক্ষায় সফল হওয়ার ক্ষেত্রে দক্ষতা প্রদর্শনে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯১২ সালে তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের (বর্তমান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) উদ্যোগে পরিচালিত ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছিলেন।[১৮]
১৯১৩ সালে পাঁচ ভ্রাতার পর সুভাষচন্দ্র কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে (বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হয়েছিলেন, যা বাংলার উচ্চবর্ণের হিন্দুদের কাছে এক ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী মহাবিদ্যালয় ছিল।[১৮][১৯] তিনি সেখানে দর্শন অধ্যায়ন করেছিলেন আর কান্ট, হেগেল, বের্গসন ও অন্যান্য পাশ্চাত্য দার্শনিকদের সম্পর্কে পড়েছিলেন।[২০] এক বছর আগে তিনি হেমন্তকুমার সরকারের সাথে বন্ধুত্ব করেছিলেন, আর ছিলেন সুভাষের অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ও ধার্মিক আকুলতার সঙ্গী।[২১] প্রেসিডেন্সিতে তাদের আবেগপ্রবণ সম্পর্ক আরও দৃঢ় হয়ে গিয়েছিল।[২১] ধার্মিক চিত্রের কল্পনাপ্রবণ ভাষ্যে পরস্পরের মধ্যে তারা তাদের বিশুদ্ধ ভালোবাসার কথা ঘোষণা করেছিলেন।[২১] ১৯১৪ সালের দীর্ঘ ছুটির সময়ে পথপ্রদর্শনের জন্য এক আধ্যাত্মিক গুরুর খোঁজে তারা কয়েক মাসের জন্য উত্তর ভারতে গিয়েছিলেন।[২১] সুভাষচন্দ্রের পরিবারকে এই ভ্রমণ নিয়ে পরিষ্কারভাবে অভহিত করা হয়নি, যার ফলে পরিবারের মনে হয়েছিল যে তিনি পালিয়েছেন। ভ্রমণের সময়ে বিস্মৃতিপ্রবণ গুরু পাওয়ার পর সুভাষচন্দ্র আন্ত্রিক জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন।[২১] সুভাষচন্দ্রের অনুপস্থিতি তার পিতা-মাতার কাছে বেদনাদায়ক হয়ে উঠেছিল, আর তার ফিরে আসার সময় তারা ভেঙে পড়েছিলেন।[২১] সুভাষচন্দ্র ও তার পিতা জানকীনাথের মধ্যে উত্তেজিত কথাবার্তা হতে লেগেছিল। এরপর সুভাষচন্দ্রের প্রিয় ভ্রাতা ও ইংল্যান্ডের আইনের শিক্ষার্থী শরৎচন্দ্র বসু এসে তাদের মেজাজ ঠান্ডা করেছিলেন। এরপর সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সিতে ফিরে এসেছিলেন আর পড়াশুনা, বিতর্কসভা ও ছাত্র সাংবাদিকতার সাথে নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন।[২১]
১৯১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে সুভাষচন্দ্র প্রেসিডেন্সিতে ইতিহাসের অধ্যাপক ই. এফ. ওটেনের সাথে জড়িত এক ঘটনা সাথে জড়িত ছিলেন বা সেই ঘটনায় পরিচালিত হয়েছিলেন বলে দাবি করা হয়।[৯][২২] ঘটনাটির আগে শিক্ষার্থীরা দাবি করত যে ওটেন ভারতীয় সংস্কৃতি নিয়ে রূঢ় মন্তব্য করেছিলেন আর কিছু শিক্ষার্থীদের ঘাড় ধাক্কা দিতেন; আর ওটেন দাবি করতেন যে শিক্ষার্থীরা তার ক্লাসের বাইরে অসহনীয় উচ্চৈঃস্বর কোলাহল করত।[২২] কয়েকদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি কয়েকজন শিক্ষার্থীরা সিঁড়িতে ওটেনকে উপর গায়ে পড়েছিল, তাকে ঘেরাও করেছিল, তাকে চপ্পল দিয়ে মারতে লাগল আর তারা পালিয়ে গিয়েছিল।[২২] এক অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছিল। যদিও অনাহত ওটেন তার হামলাকারীদের শনাক্ত করতে পারেননি, প্রেসিডেন্সির একজন ভৃত্য পালানো শিক্ষার্থীদের মধ্যে সুভাষচন্দ্রকে দেখতে পেয়েছিলেন। এর ফলে কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুজবের ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পেরেছিল।[২২] সুভাষচন্দ্রকে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল আর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিঃষ্কার করা হয়েছিল।[২৩] এই ঘটনা সারা কলকাতাকে নাড়া দিয়েছিল আর এই নিয়ে বসু পরিবারের মধ্যে মানসিক পীড়া সৃষ্টি হয়েছিল।[৯] তাকে কটকে ফিরে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তার পারিবারিক সম্পর্কের মাধ্যমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল।[২৩] এসব সত্ত্বেও ১৯১৭ সালের ২০ জুলাই অবধি সুভাষচন্দ্র বহিঃষ্কৃত ছিলেন, আর তার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক সমিতি তাকে অন্য মহাবিদ্যালয়ে ভর্তি করার অনুরোধ স্বীকার করেছিল।[২৪] তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন আর ১৯১৮ সালে শিল্পকলায় স্নাতক (বিএ) হয়েছিলেন আর দর্শনে অনার্স লাভ করেছিলেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য দর্শন শিক্ষার্থীদের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন।[২৫]
পিতার অনুরোধে সুভাষচন্দ্র ইংল্যান্ডে গিয়ে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস (আইসিএস) পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে রাজি হয়েছিলেন।[২৬] ১৯১৯ সালের ১০ অক্টোবরে লন্ডনে পৌঁছনোর পর সুভাষচন্দ্র আইসিএস-এর আবেদনপত্র প্রস্তুত করেছিলেন।[২৭] তার অভিসম্বন্ধে তিনি ভারতের উপ-রাষ্ট্রসচিব রায়পুরের লর্ড সিংহ এবং কলকাতার ধনী আইনজীবী ভূপেন্দ্রনাথ বসুর নাম উল্লেখ করেছিলেন।[২৬] সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মহাবিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন,[২৮] কিন্তু তখন এর শেষ দিন পেরিয়ে গিয়েছিল।[২৮] তিনি কিছু ভারতীয় শিক্ষার্থী ও নন-কলেজিয়েট স্টুডেন্টস বোর্ডের কাছে সাহায্য কামনা করেছিলেন। নন-কলেজিয়েট স্টুডেন্টস বোর্ড কোনো মহাবিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ভর্তি ছাড়াই মিতব্যয়ী খরচে কেমব্রিজের শিক্ষা প্রদান করত। ১৯ নভেম্বর সুভাষচন্দ্র কেমব্রিজের রেজিস্টারে ভর্তি হয়েছিলেন আর একইসঙ্গে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।[২৮] কেমব্রিজে তিনি মেন্টাল অ্যান্ড মরাল সায়েন্স ট্রাইপোজ বেছে নিয়েছিলেন,[২৮] আর তার ভারতীয় বিএ ডিগ্রির জন্য এটি সম্পূর্ণ করার ন্যূনতম সময় দুই বছরে কমে গিয়েছিল।[২৯]
আইসিএস-এ ছয়টি শূন্যস্থান ছিল।[৩০] ১৯২০ সালের আগস্টে সুভাষচন্দ্র উন্মুক্ত প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাটি নিয়েছিলেন আর সেখানে চতুর্থ স্থান লাভ করেছিলেন।[৩০] এটা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপ ছিল।[৩০] তারপরেও ১৯২১ সালে ভারতের আরও অন্যান্য বিষয় নিয়ে একটি শেষ পরীক্ষা বাকি ছিল, যেমন ভারতীয় দণ্ড বিধি, ভারতীয় সাক্ষ্য আইন, ভারতীয় ইতিহাস ও ভারতীয় ভাষা।[৩০] সফল পরীক্ষার্থীদের একটি রাইডিং টেস্ট সম্পন্ন করতে হতো। এইসব বিষয়ে ভয় না থাকার জন্য রাইডার হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র ভেবেছিলেন যে আইসিএস হাতের নাগালে এসে গিয়েছে।[৩০] কিন্তু, ১৯২০ সালের আগস্ট ও ১৯২১ সালের মধ্যে তিনি শেষ পরীক্ষা নেওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন,[৩১] বিশেষ করে অমৃতসর হত্যাকাণ্ড ও ১৯১৯ সালের দমনমূলক রাওলাট আইন ভারতীয় জাতীয়তাবাদীদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।[৩২] তখন কলকাতায় তার পিতা জানকীনাথ ও ভ্রাতা শরৎচন্দ্রের মধ্যে চিঠি আদান-প্রদান হচ্ছিল।[৩৩] শরৎচন্দ্রকে লেখা একটি চিঠিতে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন যে যাদের হৃদয়ে কোনো পার্থিব আকাঙ্ক্ষা নেই জীবনের অনিশ্চয়তা তাদের মর্মাহত করে না। এছাড়া সুভাষচন্দ্রের বিশ্বাস যে সিভিল সার্ভিসের শিকলে আবদ্ধ হয়ে নিজের দেশকে সম্পূর্ণভাবে সেবা করা সম্ভব নয়।[৩৩] পরে এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, "কোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হল তা থেকে (নিজেকে) প্রত্যাহার করে নেওয়া।"[৩২]
১৯২১ সালের এপ্রিলে সুভাষচন্দ্র আইসিএস-এর শেষ পরীক্ষাটি না নেওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর শরৎচন্দ্রকে এই বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্তে তার পিতা, মাতা ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মনে সম্ভাব্য যন্ত্রণার কথা ভেবে তিনি তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন।[৩৪] ১৯২১ সালের ২২ এপ্রিলে ভারতের রাষ্ট্রসচিব এডুইন মন্টাগুকে তিনি ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের অবেক্ষণাধীনদের তালিকা থেকে তার নাম অপসারিত করার আবেদন করেছিলেন।[৩৫] পরের দিন তিনি শরৎচন্দ্রকে লিখেছিলেন, তিনি তার মায়ের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিলেন যে তার পিতা ও অন্যরা যা-ই ভাবুক তিনি মহাত্মা গান্ধীর পন্থাকে সমর্থন করেন, আর এই চিঠির জন্য সুভাষ আনন্দিত হয়েছিলেন এবং তার মন থেকে বোঝা অপসারিত হয়ে গিয়ে তিনি যেন খাজনা পেয়েছিলেন।[৩৬]
বাংলার রাজনীতির শীর্ষে থাকা আইনজীবী চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার কিছুক্ষণ আগে চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্রকে কলকাতায় আসার আহ্বান করেছিলেন।[৩৭] আইসিএস-এর এই দৃঢ় সিদ্ধান্তের পর সুভাষচন্দ্র আধা-হৃদয়ে কেমব্রিজের শেষ বিএ পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এতে উত্তীর্ণ হলেও তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে স্থান পেয়েছিলেন।[৩৬] ১৯২১ সালের জুন মাসে তিনি ভারতের উদ্দেশ্যে নৌযাত্রা সম্পন্ন করেছিলেন।[৩৭]
১৯২১ সালের ১৬ জুলাই ২৪ বছর বয়সী সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের বোম্বাইতে এসেছিলেন আর তৎক্ষনাৎ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের আয়োজন করেছিলেন। তখন ৫১ বছর বয়সী গান্ধী অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, যা পূর্ববর্তী বছরে ভারতের সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যে ভারতকে স্বাধীনতার পথে নিয়ে গিয়েছিল।[গ][ঘ] গান্ধীতে তখন বোম্বাইতে ছিলেন আর সেদিন অপরাহ্ণেই সুভাষচন্দ্রের সাথে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হয়েছিলেন। অনেক বছর পরে লেখা সাক্ষাতের একটি বিবরণে সুভাষচন্দ্র লিখেছিলেন যে তিনি গান্ধীকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করেছিলেন।[৪০] সুভাষচন্দ্রের মতে গান্ধীর উত্তরগুলি অস্পষ্ট, তার লক্ষ্যগুলি অস্পষ্ট আর লক্ষ্য অর্জনে তার পরিকল্পনা সঠিকভাবে পরিকল্পিত নয়।[৪০] গান্ধী ও সুভাষ প্রথম সাক্ষাতেই ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের উপায় সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। গান্ধীর মতে যেকোনো শক্তির বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন আপোষহীন, আর সুভাষচন্দ্রের মতে ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে যেকোনো উপায়ই গ্রহণযোগ্য ছিল।[৪০] তারা পরিণতির প্রশ্নেও ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র একচ্ছত্রবাদের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন আর গান্ধী এর ঘৃণা করেছিলেন।[৪১] তবে ঐতিহাসিক লিওনার্ড গর্ডনের মতে, 'গান্ধী অবশ্য বসুকে বাংলায় কংগ্রেস ও ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নেতা চিত্তরঞ্জন দাশের পথে পরিচালিত করেন এবং তার মধ্যে বসু তার কাঙ্ক্ষিত নেতা খুঁজে পান।' চিত্তরঞ্জন দাশ গান্ধীর চেয়ে বেশি নমনীয় ও চরমপন্থার প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল ছিলেন, যা সেসময় বাংলায় বসুর মতো আদর্শবাদী তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। চিত্তরঞ্জন সুভাষচন্দ্রকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে প্রবেশ করান। সুভাষচন্দ্র পরবর্তী প্রায় ২০ বছর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন।[৪২][৪৩]
ভারতে ফিরে সুভাষচন্দ্র 'স্বরাজ' নামক সংবাদপত্রে লেখালেখি শুরু করেন এবং বঙ্গীয় প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন বাংলায় মহান জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ।[৩২]
তিনি স্বরাজ পত্রিকা চালু করেন এবং বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির প্রচারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[৪৪] ১৯২৩ সালে সুভাষচন্দ্র সর্বভারতীয় যুব কংগ্রেসের সভাপতি এবং একইসাথে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসে র সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি চিত্তরঞ্জন দাশ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ফরওয়ার্ড পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও কর্মরত ছিলেন।[৪৫] ১৯২৪ সালে চিত্তরঞ্জন দাশ কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বসু কলকাতা পৌরসংস্থার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।[৪৬] ১৯২৫ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেফতার করে মান্দালয়ের কারাগারে পাঠানো হয়, যেখানে তিনি যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হন।[৪৭]
১৯২৭ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সুভাষ ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হন এবং জওহরলাল নেহেরুর সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার লক্ষ্যে কাজ শুরু করেন। ১৯২৮ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে বসু কলকাতায় ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক সভার আয়োজন করেন। তার সবচেয়ে স্মরণীয় ভূমিকা ছিল কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) হিসেবে।[৪২] এর কিছুদিন পরে, সুভাষচন্দ্র বসুকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় এবং আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য জেলে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৩০ সালে তিনি কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন।[৪৭]
১৯৩০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে সুভাষচন্দ্র বসু ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এসময় বিভিন্ন ভারতীয় ছাত্র ও বেনিতো মুসোলিনি সহ অন্যান্য ইউরোপীয় রাজনীতিবিদদের সাথে দেখা করেন তিনি। তিনি দলীয় সংগঠন এবং কমিউনিজম ও ফ্যাসিবাদের প্রয়োগ পর্যবেক্ষণ করেন। এই সময়ে তিনি তার, দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল বইয়ের প্রথম অংশ রচনা করেন, যাতে ১৯২০-১৯৩৪ সালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবরণ রয়েছে। যদিও এটি ১৯৩৫ সালে লন্ডনে প্রকাশিত হয়, কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ভয়ে ভারতে এই বই নিষিদ্ধ করে।[৪৮]
১৯৩৪ সালে লবণ সত্যাগ্রহ বন্ধ করলে তিনি ও বীঠলভাই প্যাটেল ইউরোপ থেকে সুভাষচন্দ্র -প্যাটেল ইস্তাহার দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বীঠলভাই প্যাটেল তার সম্পত্তির চার ভাগের তিন ভাগ নেতাজিকে দান করেন,পরবর্তীতে তার ছোটো ভাই বল্লভভাই প্যাটেল তা অস্বীকার করেন এবং তাকে জালিয়াত সহ নানা খারাপ আখ্যা দেন। কুড়ি বছরের মধ্যে সুভাষচন্দ্র মোট ১১ বার গ্রেফতার হয়েছিলেন। তাকে ভারত ও রেঙ্গুনের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হয়েছিল। ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ইউরোপে নির্বাসিত করা হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে ভিয়েনাতে তিনি তার প্রথম প্রেম এমিলি শেঙ্কলের সঙ্গে পরিচিত হন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তারা ব্যাড গ্যাস্টিনে বিয়ে করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সম্পর্কে তার অভিমত সম্বন্ধে বলেন যে, 'রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ এবং একটি সমাজতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার দ্বিমাত্রিক উদ্দেশ্য নিয়ে বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফ্রন্টে সংগঠিত হওয়া উচিত।'[৪৯] ১৯৩৮ সাল অবধি সুভাষচন্দ্র জাতীয় পর্যায়ের নেতায় পরিণত হয়েছিলেন এবং কংগ্রেস দলের সভাপতি হিসেবে মনোনয়ন গ্রহণ করতে সম্মত হন। তিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বল প্রয়োগসহ শর্তহীন স্বরাজের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। এর ফলে তার সাথে মোহনদাস গান্ধীর সংঘাত সৃষ্টি হয়, যিনি প্রকৃতপক্ষে বসুর সভাপতি পদের বিরোধিতা করেন। ফলশ্রুতিতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলটি বিভক্ত হয়ে যায়।[৫০]
বসু ঐক্য বজায় রাখার চেষ্টা করেন, কিন্তু গান্ধী সুভাষকে তার নিজস্ব পরিষদ গঠন করার পরামর্শ দেন। এই ঘটনায় বসু ও নেহেরুর মধ্যেও বিভাজন তৈরী হয়। সুভাষচন্দ্র একটি স্ট্রেচারে করে ১৯৩৯ সালের কংগ্রেস সভায় হাজির হন। তিনি গান্ধীর পছন্দের প্রার্থী পট্টভি সীতারামাইয়াকে পরাজিত করে পুনরায় সভাপতি নির্বাচিত হন।[৫১] মুথুরামালিঙ্গম থেভার আন্তঃকংগ্রেস বিতর্কে বসুকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। তার জন্য দক্ষিণ ভারতের সকল ভোট বসুর পক্ষে যায়।[৫২] যাহোক, কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিতে গান্ধী নেতৃত্বাধীন দলের বিভিন্ন কৌশলের কারণে, সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
১৯৩৯ সালের ২২ জুন বসু ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক সংগঠিত করেন মূলত বামপন্থী রাজনৈতিকদের মজবুত করার লক্ষ্যে কিন্তু এর প্রধান শক্তি ছিল তার নিজের রাজ্য বাংলায়।[৫৩] শুরু থেকে সুভাষচন্দ্রের একনিষ্ঠ সমর্থক, মুথুরামালিঙ্গম থেভার ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দেন। একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বসু যখন মাদুরাই গিয়েছিলেন তখন তার অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে মুথুরামালিঙ্গম একটি বিশাল র্যালির আয়োজন করেন।
মাদুরাই যাওয়ার পথে সুভাষচন্দ্র বসু, মুথুরামালিঙ্গমের আমন্ত্রণে ফরওয়ার্ড ব্লকের পক্ষে সমর্থন সংগ্রহে, মাদ্রাজ ভ্রমণ করেন এবং সেখানে তিন দিন অতিবাহিত করেন। তার চিঠিপত্র প্রকাশ করে যে, ব্রিটিশ পরাধীনতার প্রতি তার স্পষ্ট অপছন্দ সত্ত্বেও, তিনি তাদের পদ্ধতিগত ও নিয়মানুগ দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনের প্রতি তাদের দৃঢ় শৃঙ্খলামূলক মনোভাব দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ইংল্যান্ডে তিনি ব্রিটিশ লেবার পার্টির বিভিন্ন নেতা ও রাজনৈতিক চিন্তাবিদ যেমন লর্ড আরউইন, জর্জ ল্যান্সবারি, ক্লিমেন্ট এটলি, আর্থার গ্রীনউড, হ্যারল্ড লাস্কি, জে বি এস হ্যালডেন, আইভর জেনিংস, গিলবার্ট মারে, জর্জ ডগলাস হাওয়ার্ড কোল, স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস প্রমুখের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মত বিনিময় করেন।
তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে, স্বাধীন ভারতের অন্তত দুই দশক পর্যন্ত তুরস্কের কামাল আতাতুর্কের অনুরূপ সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্র প্রয়োজন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] আঙ্কারায় আতাতুর্কের সাথে তার দেখা করার অনুমতি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ রাজনৈতিক কারণে প্রত্যাখ্যান করে। ইংল্যান্ডে তার সফরের সময় সুভাষচন্দ্র বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদের সাথে সাক্ষাতের চেষ্টা করেন, কিন্তু শুধুমাত্র লেবার পার্টি এবং উদারনৈতিক রাজনীতিবিদরা তার সাথে সাক্ষাৎ করতে সম্মত হন। কনজারভেটিভ পার্টির কর্মকর্তারা তার সাথে দেখা করতে অপারগতা প্রকাশ করেন অথবা তিনি উপনিবেশ থেকে আসা একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন বলে তাকে সৌজন্য দেখাতে তারা অস্বীকার করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর, ব্রিটিশ ভারতের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল, লর্ড লিনলিথগো কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে আলোচনা না করেই ভারতের পক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।[৫৪] সুভাষচন্দ্র বসু এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করার জন্য গণ আইন অমান্য আন্দোলন আয়োজনের পক্ষে প্রচারণা শুরু করেন। কিন্তু গান্ধীকে এর অপরিহার্যতা বোঝাতে ব্যর্থ হলে, তিনি কলকাতার অন্ধকূপ হত্যা ঘটনার স্মরণে, ডালহৌসি স্কোয়ারের এক কোণে নির্মিত 'হলওয়েল মনুমেন্ট' অপসারণের দাবিতে গণ বিক্ষোভের আয়োজন করেন। এসময় তাকে গ্রেফতার করে কারারুদ্ধ করা হলেও সাত দিনের অনশন ধর্মঘটের পর ১৯৪০ সালের ডিসেম্বর মাসে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়।[৫৫]
১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্র বসুকে গৃহবন্দী করা হয়। এসময় সিআইডি তার বাড়ি নজরদারিতে রাখে।[৫৬] তবুও তিনি আফগানিস্তান এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানিতে পালাতে সক্ষম হন। পালানোর কয়েকদিন আগে, তিনি নিঃসঙ্গ থাকার অজুহাতে ব্রিটিশ রক্ষীদের সাথে দেখা করা এড়িয়ে চলেন এবং লম্বা দাড়ি রাখেন। ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি, গভীর রাতে পালানোর সময়, তিনি পাঠানদের বেশভূষা ধারণ করেন যাতে কেউ তাকে চিনতে না পারে। ১৯৪১ সালের ১৭ জানুয়ারি রাতে কলকাতায় তার এলগিন রোডের বাড়ি থেকে ব্রিটিশদের নজরদারি এড়িয়ে, তার ভাগ্নে শিশির কুমার বসুকে সঙ্গে নিয়ে সুভাষচন্দ্র বসু পালাতে সক্ষম হন। তারা পালিয়ে তৎকালীন বিহার রাজ্যের (বর্তমানে ঝাড়খণ্ড) গোমোহ্ রেলওয়ে স্টেশনে (বর্তমানে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু গোমোহ্ স্টেশন) পৌছান।[৫৭][৫৮][৫৯][৬০]
তিনি তৎকালীন জার্মান সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আবওয়ের সাহায্যে পেশোয়ার পৌঁছান। সেখানে তিনি আকবর শাহ, মোহাম্মদ শাহ এবং ভগত রাম তলওয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তাকে আকবর শাহের বিশ্বস্ত বন্ধু আবাদ খানের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি আফগানিস্তান সংলগ্ন ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে রাশিয়া পৌছানোর জন্য যাত্রা শুরু করেন। এর জন্য তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের তৎকালীন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মিঞা আকবর শাহ এর সাহায্য গ্রহণ করেন। শাহ তাকে একটি অভিনব ছদ্মবেশ ধারণের প্রস্তাব দেন। যেহেতু বসু পশতু ভাষার একটি শব্দও জানতেন না, ব্রিটিশদের জন্য কর্মরত পশতু বক্তাদের পক্ষে তাকে সহজেই শনাক্ত করা সম্ভব ছিল। এজন্য শাহ তাকে বধির এবং বোবা হওয়ার অভিনয় করার পরামর্শ দেন এবং সেখানকার উপজাতিদের অনুকরণে তার দাড়ি বৃদ্ধি করতে বলেন। তার পথপ্রদর্শক ভগত রাম তলওয়ার একজন সোভিয়েত গোয়েন্দা ছিল, যদিও সুভাষচন্দ্র বসু সে সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।[৫৯][৬০][৬১]
সুলতান মুহাম্মদ শাহ আগা খান এর সমর্থকরা তাকে সীমান্ত পেরিয়ে আফগানিস্তানে যেতে সাহায্য করে, যেখানে আবওয়ের এর একটি ইউনিট তার সাথে দেখা করে ও কাবুল হয়ে আফগানিস্তান পেরিয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সীমান্তে পৌঁছাতে তাকে সাহায্য করে। একজন পশতুন বীমা এজেন্ট ("জিয়াউদ্দিন") সেজে আফগানিস্তানে পৌছানোর পর, তিনি তার ছদ্মবেশ পরিবর্তন করেন এবং একজন ইতালীয় অভিজাত ব্যক্তি, "কাউন্ট অরল্যান্ডো মাজোত্তা" সেজে ইতালীয় পাসপোর্টে মস্কো পৌঁছান। মস্কো থেকে তিনি রোমে পৌছান, এবং সেখান থেকে জার্মানিতে পাড়ি দেন।[৫৯][৬০][৬২] রাশিয়ায় পৌছানোর পর, সোভিয়েত গোয়েন্দা সংস্থা, এনকেভিডি, তাকে মস্কোতে নিয়ে যায়। তিনি আশা করেছিলেন যে, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের প্রতি রাশিয়ার ঐতিহ্যগত শত্রুতার ফলস্বরূপ তারা তার ভারতে জন উত্থান ঘটানোর পরিকল্পনাকে সমর্থন করবে। তবে, সোভিয়েতদের প্রতিক্রিয়া দেখে তাকে হতাশ হতে হয়। তাকে দ্রুত মস্কোতে উপস্থিত জার্মান রাষ্ট্রদূত কাউন্ট ফন ডার শুলেনবার্গের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনি এপ্রিলের শুরুতে, একটি বিশেষ কুরিয়ার বিমানে করে সুভাষচন্দ্র বসুর বার্লিনে পৌছানোর ব্যবস্থা করেন।[৫৯][৬০][৬৩] .
জার্মানিতে পৌঁছানোর পর, তিনি জার্মান পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত আজাদ হিন্দ রেডিওর সম্প্রচারের দায়িত্বে থাকা ভারতের স্পেশাল ব্যুরোর সাথে যুক্ত হন।[৬৪] তিনি বার্লিনে ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেন এবং ভারতীয় যুদ্ধবন্দীদের মধ্য থেকে সৈন্য নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করেন। অক্ষশক্তির হাতে বন্দী হওয়ার আগে এই সৈন্যরা উত্তর আফ্রিকায় ব্রিটিশদের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। ভারতীয় বাহিনী শুরুতে ভেরমাখট (নাৎসি জার্মানির ঐক্যবদ্ধ সামরিক বাহিনী) এর সাথে সংযুক্ত ছিল। পরে তা ওয়াফেন এসএস বাহিনীর সাথে সংযুক্ত করা হয়। এর সদস্যরা হিটলার এবং সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করে: "আমি ঈশ্বরের শপথ করে বলছি যে সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে, ভারতের জন্য যুদ্ধে আমি জার্মান জাতি ও রাষ্ট্রের নেতা আডলফ হিটলার কে জার্মান সামরিক বাহিনীর সেনাপতি হিসেবে মেনে চলব"। তিনি আজাদ হিন্দ বাহিনীর নেতৃত্বে নাৎসি সৈন্যদের দ্বারা সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে ভারত আক্রমণের পরিকল্পনা করতেও প্রস্তুত ছিলেন; অনেকেই তার এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, কারণ এই ধরনের আগ্রাসনের পর জার্মানদের সহজে ভারত ছেড়ে যেতে রাজি করানো যেত না, যার ফলে যুদ্ধে অক্ষশক্তির বিজয়ও ঘটতে পারতো।[৬২]
সব মিলিয়ে ৩০০০ ভারতীয় যুদ্ধবন্দী আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগদান করেন। তবে খুশি হওয়ার বদলে, সুভাষচন্দ্র বসু বেশ চিন্তিত ছিলেন। বামপন্থী রাশিয়ার একজন ভক্ত হিসেবে, হিটলারের ট্যাংক এর সোভিয়েত সীমান্ত অতিক্রম দেখে তিনি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয় যখন নাৎসি বাহিনীর পশ্চাদপসরণ শুরু হয়। কেননা এতে ভারত থেকে ব্রিটিশদের বিতাড়িত করতে সাহায্য প্রদান করার মত কোন অবস্থান জার্মান বাহিনীর থাকবে না। ১৯৪২ সালের মে মাসে হিটলারের সাথে তার সাক্ষাৎ এরপর, তার সন্দেহ আরও দৃঢ় হয় এবং তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন যে হিটলার তার সৈন্যদের ব্যবহার করে যুদ্ধক্ষেত্রের চেয়ে প্রচারণার জয়ী হতেই বেশি আগ্রহী। তাই, ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি একটি জার্মান ইউ-বোটে করে জাপান চলে যান। এর ফলে জার্মানিতে তার সৈন্যরা নেতৃত্বহীন এবং হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।[৬২][৬৫]
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৪১ থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত বার্লিনে বসবাস করেন। ১৯৩৪ সালে জার্মানিতে তার প্রথম সফরের সময়, তার সাথে একজন অস্ট্রীয় পশু চিকিৎসকের কন্যা, এমিলি শেঙ্কল এর পরিচয় হয়। তিনি এমিলিকে ১৯৩৭ সালে বিয়ে করেন। তাদের কন্যার নাম অনিতা বসু পাফ।[৬৬] বসুর দল ফরওয়ার্ড ব্লক এই তথ্য অস্বীকার করেছে।[৬৭]
১৯৪৩ সালে, জার্মানি ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য করতে পারবে না বুঝতে পেরে, সুভাষচন্দ্র বসু জাপান চলে যান। তিনি জার্মান ডুবোজাহাজ, ইউ-১৮০ তে করে মাদাগাস্কারের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পৌঁছান, যেখানে তাকে বাকি পথ পাড়ি দেওয়ার জন্য জাপানি ডুবোজাহাজ, আই-২৯ এ স্থানান্তর করা হয়। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দুটি ভিন্ন নৌবাহিনীর দুটি ডুবোজাহাজের মধ্যে ঘটা একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তির হস্তান্তর।[৫৯][৬০]
জাপানি গোয়েন্দা বিভাগ, ফুজিওয়ারা কিকান এর প্রধান, মেজর (এবং যুদ্ধোত্তর লেফটেন্যান্ট-জেনারেল) ইওয়াইচি ফুজিওয়ারা সর্বপ্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের কথা ভাবেন। ফুজিওয়ারার লক্ষ্য ছিল "একটি সেনা বাহিনী গঠন করা যা জাপানি সেনাবাহিনীর পাশাপাশি যুদ্ধ করবে।"[৬৮][৬৯] তিনি সর্বপ্রথম ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের ব্যাংকক অধ্যায়ের সভাপতি প্রীতম সিং ধিলনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং প্রীতম সিং এর যোগাযোগের মাধ্যমে ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে পশ্চিম মালয় উপদ্বীপে বন্দী ব্রিটিশ ভারতীয় সেনা অধিনায়ক মোহন সিং কে নিয়োগ দেন। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয়ার্ধে ফুজিওয়ারা ও মোহন সিং এর মধ্যে আলোচনার ফলে প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠিত হয়। ১৯৪২ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তারা যৌথভাবে এর নাম মনোনীত করেন।[৭০]
প্রবাসী জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর নেতৃত্বে পরিচালিত তৎকালীন ভারতীয় স্বাধীনতা লীগ এর সমর্থনেই এগুলো হয়। ১৯৪২ সালের ডিসেম্বরে হিকারি কিকান এবং মোহন সিং মধ্যে মতানৈক্য ঘটার পর প্রথম আজাদ হিন্দ ফৌজ ভেঙ্গে দেওয়া হয়। মোহন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, জাপানি হাইকমান্ড নিছক প্রচারণার হাতিয়ার হিসেবে আজাদ হিন্দ ফৌজকে ব্যবহার করছে। এসময় মোহন সিং কে আটক করা হয় এবং সৈন্যদের বন্দী শিবিরে ফেরত নেওয়া হয়। যাইহোক, ১৯৪৩ সালে সুভাষচন্দ্র বসুর আগমনের সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য সেনাবাহিনী গঠনের ধারণাটি আবারো পুনরুজ্জীবিত হয়। জুলাই মাসে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত একটি সভায় রাসবিহারী বসু, সুভাষচন্দ্র বসুর হাতে সংগঠনের নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করেন। সুভাষচন্দ্র বসু সেনাবাহিনী পুনর্গঠন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রবাসী ভারতীয় জনগণের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন সংগঠিত করতে সক্ষম হন। প্রবাসী ভারতীয়রা একইসাথে জাতীয় সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়ে এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগের আহ্বানে সাড়া দিয়ে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের সমর্থন ব্যক্ত করেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ এ একটি পৃথক নারী ইউনিট ছিল যার নাম ঝাঁসি রানী রেজিমেন্ট (রানী লক্ষ্মীবাঈ এর নামে নামকরণ হয়)। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সেহগল এর নেতৃত্বে এই বাহিনী গঠিত হয়। এটিকে এশিয়ায় এধরণের প্রথম দৃষ্টান্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৭১][৭২]
সামরিক প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও সুভাষচন্দ্র বসু আজাদ হিন্দ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন বজায় রাখতে সক্ষম হন। ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই, বর্মায় ভারতীয়দের এক সমাবেশে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর জন্য একটি ভাষণ প্রদানের সময় তার সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তিটি উচ্চারিত হয়: "তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেবো!" এর মাধ্যমে তিনি ভারতের জনগণকে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সৈন্যরা, অস্থায়ী সরকার আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ এর অধীনে ছিল। এই সরকার নিজস্ব মুদ্রা, ডাকটিকিট, আদালত এবং সিভিল কোড উপস্থাপন করে এবং অক্ষশক্তির নয়টি তৎকালীন রাষ্ট্র – জার্মানি, জাপান, ইতালীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, জার্মানি নিয়ন্ত্রিত ক্রোয়েশিয়া, চীন, বর্মা, মাঞ্চুকুও, জাপান নিয়ন্ত্রিত ফিলিপাইন একে স্বীকৃতি দেয়। এই রষ্ট্রগুলোর মধ্যে পাঁচটিই অক্ষশক্তির অধীনে প্রতিষ্ঠিত। এই সরকার ১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে পর্যবেক্ষক হিসেবে তথাকথিত বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।[৭২]
আজাদ হিন্দ ফৌজ এর প্রথম দায়িত্ব ছিল পূর্ব ভারতীয় সীমান্তের মণিপুরের দিকে জাপানি আগ্রাসনে সহায়তা করা। জাপানিরা আরাকানে হামলার সময় এবং একই সাথে ইম্ফল ও কোহিমার দিকে আগ্রাসনের সময় আজাদ হিন্দ ফৌজ এর বিশেষ বাহিনী বাহাদুর গ্রুপ শত্রু রেখার পিছনে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেয়। জাপানিরা ১৯৪২ সালে আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ দখল করে নেয় এবং এর এক বছর পর সেখানে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ ডি লোগনাথন কে গভর্নর জেনারেল করে অস্থায়ী সরকার ও আজাদ হিন্দ ফৌজ প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বীপগুলির নাম পরিবর্তন করেশহীদ ওস্বরাজ রাখা হয়। যদিও, দ্বীপ প্রশাসনের মূল নিয়ন্ত্রণ জাপানি নৌবাহিনীর হাতেই ছিল। ১৯৪৪ সালের প্রথম দিকে দ্বীপে সুভাষচন্দ্র বসুর একমাত্র ভ্রমণের সময়, বোসের জাপানি নিমন্ত্রণকর্তারা সচেতনভাবেই তাকে স্থানীয় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখে যাতে জাপানিদের চূড়ান্ত স্বার্থ সম্পর্কে তিনি কোনো ধরনের জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম না হন। সে সময় দ্বীপের জাপানি প্রশাসন ওই দ্বীপের ভারতীয় স্বাধীনতা লীগের নেতা ডা. দিওয়ান সিং কে আটক রেখে নির্যাতন করছিল, যিনি পরে জেলে আহত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। দ্বীপে সুভাষচন্দ্র বসুর পরিদর্শন কালে বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যক্তি ডা. সিং এর দুর্দশা সম্পর্কে তাকে জানানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এসময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল লোগনাথন তার প্রকৃত প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের অভাব সম্পর্কে সচেতন হন এবং গভর্নর জেনারেলের পদ থেকে পদত্যাগ করে রেঙ্গুনে আজাদ হিন্দ সরকারের সদর দপ্তরে ফিরে আসেন।[৭৩][৭৪]
ভারতের মূল ভূখণ্ডে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুরের মৈরাং শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অনুকরণে তৈরীকৃত একটি ত্রিবর্ণ পতাকা প্রথমবারের মত উত্থাপিত হয়। এরপর ইম্ফল ও কোহিমার পার্শ্ববর্তী শহরগুলো জাপানি সেনাবাহিনীর কিছু বিভাগ, আজাদ হিন্দ ফৌজ এর গান্ধী ও নেহরু ব্রিগেড এর সহায়তায় ঘেরাও ও অবরোধ করা শুরু করে। অক্ষশক্তি ভারতের মূল ভূখণ্ড জয় করার এই প্রচেষ্টাকে অপারেশন ইউ-গো আখ্যায়িত করে।
এই অপারেশনের সময়, ১৯৪৪ সালের ৬ জুলাই, সিঙ্গাপুর থেকে আজাদ হিন্দ রেডিও কর্তৃক সম্প্রচারিত একটি বক্তৃতায়, সুভাষচন্দ্র বসু মহাত্মা গান্ধীকে "জাতির পিতা" বলে সম্বোধন করেন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তার আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা কামনা করেন। এই প্রথম গান্ধীকে এমন সম্বোধন করা হয়।[৭৫] এই দুই শহর দখল করার দীর্ঘ প্রচেষ্টায় জাপানি সম্পদ ক্রমাগত হ্রাস পেতে থাকে ও পরিশেষে অপারেশন ইউ-গো ব্যর্থ প্রমাণিত হয়। কয়েক মাস ধরে এই দুই শহরে জাপানিদের আক্রমণের সময় কমনওয়েলথ বাহিনী শহরের ভেতরে আটকে ছিল। কমনওয়েলথ বাহিনী তারপর পাল্টা আক্রমণ করে ও অক্ষশক্তির গুরুতর ক্ষতিসাধন করে। ফলে জাপানিরা বার্মিজ এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। কোহিমা ও ইম্ফলের যুদ্ধে জাপানিদের পরাজয়ের পর, ভারতের মূল ভূখণ্ডে আজাদ হিন্দ সরকারের একটি ঘাঁটি স্থাপনের লক্ষ্য চিরকালের জন্য ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
তবুও আজাদ হিন্দ ফৌজ বর্মায় ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মেইকটিলা, মান্দালয়, বাগো, মাউন্ট পোপা ইত্যাদি অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। যাইহোক, রেঙ্গুনের পতনের সঙ্গে সুভাষচন্দ্র বসুর সরকার একটি কার্যকর রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] এরপর লেফটেন্যান্ট কর্নেল লোগনাথনের অধীনে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর একটি বড়ো অংশ আত্মসমর্পণ করে। অবশিষ্ট সৈন্যরা সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে মালয়ে পশ্চাদপসরণ করে অথবা থাইল্যান্ডের দিকে যাত্রা করে। যুদ্ধ শেষে জাপানের আত্মসমর্পণ আজাদ হিন্দ ফৌজ এর সমাপ্তি ঘটায়। এরপর বন্দীদের ভারতে ফেরত পাঠানো হয় এবং কিছু সৈন্যকে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে দণ্ডিত করা হয়।
ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি) মূলত গড়ে উঠেছিল জাতীয়তাবাদী নেতা রাসবিহারী বসুর হাতে, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে রাসবিহারী বসু এই সেনাবাহিনীর দায়িত্ব সুভাষচন্দ্র বসুকে হস্তান্তর করেণ । একটি আলাদা নারী বাহিনী (রানি লক্ষ্মীবাঈ কমব্যাট) সহ এতে প্রায় ৮৫,০০০ (পঁচাশি হাজার) সৈন্য ছিল। এই বাহিনীর কর্তৃত্ব ছিল প্রাদেশিক সরকারের হাতে, যার নাম দেওয়া হয় "মুক্ত ভারতের প্রাদেশিক সরকার" (আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ)। এই সরকারের নিজস্ব মুদ্রা, আদালত ও আইন ছিল। অক্ষ শক্তির ৯টি দেশ এই সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। আইএনএ-র সৈন্যরা জাপানিদের আরাকান ও মেইক্টিলার যুদ্ধে সাহায্য করে।
সুভাষচন্দ্র বসু আশা করেছিলেন, ব্রিটিশদের উপর আইএনএ-র হামলার খবর শুনে বিপুল সংখ্যক সৈন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে হতাশ হয়ে আইএনএ-তে যোগ দেবে। কিন্তু এই ব্যাপারটি তেমন ব্যাপকভাবে ঘটলনা। বিপরীতদিকে, যুদ্ধ পরিস্থিতির অবনতির সঙ্গে সঙ্গে জাপান তার সৈন্যদের আইএনএ থেকে সরিয়ে নিতে থাকে। একই সময় জাপান থেকে অর্থের সরবরাহ কমে যায়। অবশেষে, জাপানের আত্মসমর্পণের সঙ্গে সঙ্গে আইএনএ আত্মসমর্পণ করে।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে বর্মার (বর্তমান মায়ানমার) মান্দালয়ের জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় সুভাষচন্দ্র গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ব্রিটিশ সরকার তাকে এক শর্তে মুক্তি দিতে রাজি হন যে, ভারতের কোনো ভূখণ্ড না-ছুঁয়ে তিনি যদি বিদেশে কোথাও পাড়ি দেন তবে মুক্তি পাওয়া যাবে। সুভাষচন্দ্র ইউরোপে যাওয়া মনস্থ করেন ও ভিয়েনা পৌঁছান। দু-বছর চিকিৎসাধীন থাকার সময়ে অবসরে তিনি দুটি বই লেখার সিদ্ধান্ত নেন, তার আত্মজীবনী 'Indian Pilgrim' আর 'India's Struggle for Freedom'। সেই সময়ে তার পাণ্ডুলিপি টাইপ করার জন্যে এক অস্ট্রিয়ান মহিলা এমিলি শেংকেল তাকে সাহায্য করেন যিনি পরবর্তীকালে তার সচিবও হন। এমিলি শেংকেল কখনো ভারতে আসেননি, কিন্তু বৃহত্তর বসু পরিবার ও নেতাজির সহযোগীদের সঙ্গে তার চিরকাল যোগাযোগ ও সুসম্পর্ক ছিল। ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রয়াত হন।
১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্টে সুভাষচন্দ্র বসুকে বহনকারী জাপানি বিমানটি জাপান-শাসিত তাইওয়ানে বিধ্বস্ত হওয়ার পর আগুনে দগ্ধ হয়ে তার মৃত্যু ঘটে।[১][২] কিন্তু বিশেষত বাংলায় তার সমর্থকগণ সুভাষচন্দ্রের এরকম মৃত্যু মানতে নারাজ।[৭৬][৭৭][৭৮] সুভাষচন্দ্রের মৃত্যুর পরে একাধিক ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ছড়িয়েছে এবং এগুলো অনেকক্ষণ ধরে বেঁচে আছে।[৭৬][ঙ][৭৯]
তাইহোকুতে দুপুর আড়াইটার দিকে যখন সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে যাওয়া বোমারু বিমান যখন আকাশারোহণ শুরু করে, তখন ভিতরের যাত্রীগণ ইঞ্জিনের অন্তর্দাহের মতো বিকট শব্দ শুনতে পায়।[৮০][৮১] রানওয়ের অ্যাসফল্ট থেকে কারিগরেরা বিমান থেকে কিছু পড়ে যেতে দেখে।[৮২] পড়ন্ত বস্তুটি বামদিকের ইঞ্জিন (বা তার অংশবিশেষ) ও প্রপেলার ছিল।[৮২][৮০] বিমানটি ভীষণভাবে ডানদিকে আন্দোলিত হয়েছিল আর ভূমিতে পড়ে গিয়ে বিধ্বস্ত হয়ে দু-টুকরো হয়ে অগ্নিসহ বিস্ফোরিত হয়েছিল।[৮২][৮০] বিমানের ভিতরে মুখ্য চালক, সহচালক ও লেফটেন্যান্ট-জেনারেল ৎসুনামাসা শিদেই তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেছিলেন।[৮২][৮৩] ৎসুনামাসা শিদেই জাপানি কোয়ানতুং বাহিনীর উপপ্রধান স্টাফ আধিকারিক ছিলেন, যার সুভাষচন্দ্র বসুর পক্ষে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর সাথে মাঞ্চুরিয়ায় আলোচনা করার কথা ছিল।[৮৪] সুভাষচন্দ্রের সহচর রাজা হাবিবুর রহমান খান চমকে গিয়ে স্বল্পকালের জন্য অচেতন হয়ে গিয়েছিলেন। আর সুভাষ চেতনা না হারালেও তার দেহ পেট্রলে সিক্ত ছিল।[৮২] চেতনা ফিরে পাওয়ার পর হাবিবুর রহমান ও সুভাষচন্দ্র পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু সেটি মালপত্র দ্বারা অবরুদ্ধ ছিল।[৮৩] তারপর তারা অগ্নিশিখার মধ্য দিয়ে সামনের দরজা দিয়ে বেরনোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।[৮৩] বিমানবন্দরের কর্মীবৃন্দ বিমানের কাছে আসার পর দুজন লোককে তাদের দিকে ছুটে আসতে দেখেছিল। তাদের মধ্যে একজনের শরীরে আগুন জ্বলছিল।[৮২] জানা গেল সেই জ্বলন্ত ব্যক্তিটি সুভাষচন্দ্র, আর তার পেট্রলে সিক্ত পোশাকের জন্য ত্ৎক্ষনাৎ জ্বলে উঠেছিলেন।[৮৩] হাবিবুর রহমান ও অন্যরা মিলে আগুন নেভাতে সক্ষম হলেও লক্ষ করেন যে সুভাষচন্দ্রের মুখ ও মাথা গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়েছিল।[৮৩]
জয়েস চ্যাপমান লেব্রার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, একটা ট্রাককে অ্যাম্বুলেন্স হিসাবে কাজে লাগিয়ে তাতে করে সুভাষচন্দ্র এবং অন্য যাত্রীদের তাইহোকুর দক্ষিণে নানমন সৈনিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল।[৮২] বিমানবন্দরের কর্মচারীরা দুপুর তিনটা নাগাদ হাসপাতালের সার্জেন-ইন-চার্জ ডা. তানেয়োশি ইয়োশিমির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন।[৮৩] তারা হাসপাতালে পৌছানোর সময় ও তার কিছুক্ষণ পরও সুভাষচন্দ্র সচেতন ও সংহত ছিলেন।[৮৫] তার চারিদিকে জড়ানো কম্বল বাদ দিয়ে সুভাষচন্দ্রকে নগ্ন করা হয়েছিল। ডা. ইয়োশিমি এসে তৎক্ষণাৎ দেখলেন সুভাষের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ, বিশেষত তার বুকে তৃতীয় মাত্রার দহন হয়েছিল, আর এতে তার জীবিত থাকা নিয়ে সন্দেহ হয়েছিল।[৮৫] ডা. ইয়োশিমি তৎক্ষণাৎ সুভাষচন্দ্রের চিকিৎসা শুরু করেছিলেন আর ডা. ৎসুরুতা তাকে সাহায্য করেছিলেন।[৮৫] পরবর্তীতে হাসপাতালের কর্মচারীদের সাক্ষাৎকারী ঐতিহাসিক লিওনার্ড এ. গর্ডনের বক্তব্য অনুযায়ী, সুভাষচন্দ্রের শরীরের বেশিরভাগ জায়গায় একটি জীবাণুনাশক লাগানো হয়েছিল আর তারপর একটি সাদা মলম প্রয়োগ করে সুভাষচন্দ্রের শরীরের বেশিরভাগ জায়গায় পটি দেওয়া হয়েছিল। ডা. ইয়োশিমি সুভাষচন্দ্রকে হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতার জন্য কর্পূরের চারটে ইঞ্জেকশন ও ডিজিটামিনের দুটো ইঞ্জেকশন দিয়েছিলেন, আর এগুলো ৩০ মিনিট অন্তর করে দেওয়া হতো। যেহেতু দহনের জন্য সুভাষচন্দ্রের শরীরের প্রবাহী কমে গিয়েছিল সেহেতু তাকে ধমনীর মাধ্যমে রিঙ্গারের দ্রবণ দেওয়া হয়েছিল। তৃতীয় ডাক্তার, ডা. ইশিই তাকে তক্ত দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। তখনো সুভাষচন্দ্রের পরিপূর্ণ চেতনা ছিল যা এরূপ গুরুতর আহত ব্যক্তির পক্ষে চমকপ্রদ বলে ড. ইয়োশিমি মনে করেছিলেন।[৮৬]
এই চিকিৎসা সত্ত্বেও শীঘ্রই সুভাষচন্দ্র সংজ্ঞাহীন হয়ে গিয়েছিলেন[৮৬][৮২] আর কয়েক ঘণ্টা পর ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্টে, স্থানীয় সময়ে শনিবার রাত নয়টা থেকে দশটার মধ্যে ৪৮ বছর বয়সী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মৃত্যুবরণ করেছিলেন।[৮৬][৮২]
দুইদিন পর ২০ আগস্টে তাইহোকুর প্রধান শ্মশানে সুভাষচন্দ্রের শবদাহ করা হয়েছিল।[৮৭] ২৩ আগস্টে জাপানের এক সংবাদ সংস্থা কর্তৃক সুভাষচন্দ্র এবং শিদেইর মৃত্যুর খবর ঘোষণা করা হয়েছিল।[৮২] ৭ সেপ্টেম্বরে জাপানি আধিকারিক লেফটেন্যান্ট তাৎসুও হায়াশিদা সুভাষচন্দ্রের ভস্মকে টোকিওতে নিয়ে গিয়েছিলেন। পরদিন সকালে সেই ভস্ম টোকিও ভারতীয় স্বাধীনতা লিগের সভাপ্তি রমা মূর্তির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল।[৮৮] ১৪ সেপ্টেম্বরে জাপানের রাজধানীতে সুভাষচন্দ্রের জন্য একটি স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এর কয়েকদিন পরে সেই ভস্মকে টোকিও শহরের রেনকো-জি বৌদ্ধ মন্দিরের পুরোহিতকে দেওয়া হয়েছিল,[৮৯][৯০] আর তার পর থেকেই ভস্মটি সেখানে রয়ে গিয়েছে।[৯০]
আজাদ হিন্দ ফৌজের কর্মিবর্গের মধ্যে, বিশেষ করে মালয় ও সিঙ্গাপুরের প্রবাসী তামিল ভারতীয় যুবক-যুবতীদের মধ্যে সুভাষচন্দ্রের মৃত্যু নিয়ে অবিশ্বাস, উত্তেজনা ও বিহ্বলতা বিরাজ করছিল। ফৌজে তালিকাভুক্ত বেসামরিক নাগরিকদের সিংহভাগই মালয় ও সিঙ্গাপুরের প্রবাসী তামিল ভারতীয় যুবক-যুবতীরা।[৯১] এছাড়া ফৌজের পেশাদার পাঞ্জাবি সৈন্যরা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সম্মুখীন হয়েছিলেন, আর তাদের অনেকেই ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভয়াবহ প্রতিশোধ প্রত্যাশা করতে শুরু করেছিলেন।[৯১] ভারতে অমৃত কাউরের উদ্দ্যেশ্যে লেখা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর একটি চিঠির মাধ্যমে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দাপ্তরিক অবস্থান সংক্ষেপে প্রকাশ করা যায়।[৯১] গান্ধী বলেছিলেন যে সুভাষ ভালোভাবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আর বিপথগামী হয়েও তিনি একজন দেশপ্রেমিক ছিলেন।[৯১] তবে গান্ধীর সাথে বিবাদ এবং কংগ্রেসের চোখে জাপানি ফ্যাসিবাদের সাথে হাত মেলানোর জন্য তখন কংগ্রেসিদের অনেকেই সুভাষচন্দ্রকে ক্ষমা করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়া ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে প্রায় ২৫ লক্ষ সৈন্য আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে দ্বিধান্বিত ছিল। অনেকে ফৌজের সদস্যদের রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে দেখত ও তার শাস্তিকামনা করত; আবার অন্যরা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করত। ফৌজ দ্বারা গুরুতর হুমকির মুখে না পড়লেও ব্রিটিশ ভারত সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য ফৌজের ৩০০ জন আধিকারিকদের উপর বিচার শুরু করেছিল, কিন্তু পরে সরকার সেই বিচার থেকে পিছিয়ে গিয়েছিল।[৯১]
সুভাষচন্দ্র বসু বিশ্বাস করতেন যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা তাকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য যথেষ্ট অনুপ্রাণিত করেছিল।[৯২] স্বামী বিবেকানন্দের সার্বজনীনতাবাদী উপদেশ, তার জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা এবং সমাজ সেবা ও সংস্কারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ—সবই অতি যুব বয়সে সুভাষচন্দ্রকে অনুপ্রাণিত করেছিল।[৯৩] ভারতের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহের নব-বিশ্লেষণ তাকে অত্যন্ত আকর্ষিত করেছিল।[৯৪] কিছু পণ্ডিত মনে করে যে হিন্দু অধ্যাত্মবাদ তার রাজনৈতিক ও সামাজিক চিন্তাধারার এক অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল।[৯৫] ইতিহাসবিদ লিওনার্ড গর্ডনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ ধার্মিক অভিযান তার সাবালক জীবনের অঙ্গ হিসাবে রয়ে গিয়েছিল, যা তাকে ভারতের ময়দানে ক্রমবর্ধমান নাস্তিক সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের থেকে আলাদা রেখেছে।[৯৬]
১৯৩০ সালে কলকাতার এক বক্তৃতায় সুভাষচন্দ্র প্রথমে ফ্যাসিবাদ ও সমাজতন্ত্রের মিশ্র মতবাদের পক্ষপাতিত্ব করেছিলেন।[৯৭] পরে ১৯৩৩ সালে জওহরলাল নেহরু ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের সমঝোতার সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু সুভাষচন্দ্র একে "মৌলিকভাবে ভুল" বলে পাল্টা সমালোচনা করেছিলেন। সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে জাতীয়তাবাদ ও ধর্ম বিসর্জন দিয়ে সাম্যবাদ সম্ভব নয়, আর সেইজন্যই তিনি ফ্যাসিবাদ ও সাম্যবাদের মিশ্র মতবাদের প্রস্তাব করেছিলেন।[৯৮] ১৯৪৪ সালে তিনি নাৎসিবাদ ও সাম্যবাদের মিশ্র দর্শনের সমর্থন করেছিলেন।[৯৯]
সুভাষচন্দ্র বিশ্বাস করতেন যে কর্তৃত্ববাদ ভারতীয় সমাজে স্বাধীনতা ও পুনর্গঠন আনতে পারবে।[১০০] তিনি ১৯৩০-এর দশকের ইতালি ও জার্মানির কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতি মুগ্ধ হয়েছিলেন আর ভেবেছিলেন যে এর মাধ্যমে স্বাধীন ভারত গঠন সম্ভব।[১০১]
বহু কংগ্রেস নেতাদের চোখে সুভাষচন্দ্রের এই কর্মসূচির সঙ্গে জাপানের ফ্যাসিবাদের যথেষ্ট মিল ছিল।[১০২] কংগ্রেসের মধ্যে অবহেলিত হওয়ার পর সুভাষচন্দ্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রদের সঙ্গে মিত্রতার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর ভারত ত্যাগ করেছিলেন।[৭৯][১০৩] সুভাষচন্দ্র দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে ভারতে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হবে আর কয়েক বছরের মধ্যে এর শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা থাকবে।[১০৪]
প্রথমদিকে সুভাষচন্দ্র স্পষ্টভাবে বলেছিলেন যে গণতন্ত্র ভারতের পক্ষে সর্বশ্রেষ্ঠ বিকল্প।[১০৫] কিন্তু ১৯৩০-এর দশক থেকে তিনি সম্ভবত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে কোনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভারতের দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্যের মোকাবেলার জন্য উপযুক্ত নয়, আর তিনি বলেছিলেন যে জাতীয় পুনর্গঠনের জন্য় সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন।[১০৬] সেই সূত্রে কেউ কেউ মনে করে যে যুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সাথে সুভাষচন্দ্রের মিত্রতা কেবলমাত্রই কার্যসিদ্ধিমূলক ছিল না, আর তিনি সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী ছিলেন, যদিও তিনি নাৎসি বা ফ্যাসিবাদী ছিলেন না কারণ তিনি নারী ক্ষমতায়ন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও অন্যান্য উদারনৈতিক ধারণার পক্ষপাতী ছিলেন। অন্যরা মনে করে যে তিনি যুদ্ধার্থে সমবেত করার জন্য জনপ্রিয়তাবাদী পন্থা নিয়েছিলেন, যা অন্যান্য উত্তর-ঔপনিবেশিক নেতারাও অনুসরণ করেছিল।[১০১]
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভের আগে থেকেই সুভাষচন্দ্র বসু ভারতে ইহুদি শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়ের বিরোধিতা করেছিলেন।[১০৭][১০৮] ডিসেম্বরের শুরুতে হিন্দু মহাসভা-পন্থী পত্রপত্রিকাগুলি জার্মান ইহুদি-বিদ্বেষের পক্ষে নিবন্ধ প্রকাশ করছিল। এর ফলে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের মধ্যে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়েছিল। আবার কংগ্রেসের মধ্যেই কেবল সুভাষচন্দ্র দলের দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধিতা করেছিলেন। কয়েক মাস পর ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে সুভাষচন্দ্র ভারতে ইহুদিদের আশ্রয় নিয়ে কংগ্রেসের প্রস্তাবকে সমর্থন করতে নারাজ ছিলেন।[১০৯][১১০][১১১][১১২][১১৩][১১৪]
১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র প্রকাশ্যে নাৎসির বর্ণবাদী নীতি ও ইহুদি নিধনের নিন্দা করেছিলেন।[১১৫] আবার ১৯৪২ সালে তিনি আংরিফ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলেছিলেন যে ভারতীয়রা প্রকৃত আর্য জাতি এবং জার্মানদের ভ্রাতৃবর্গ। সুভাষচন্দ্র বলেছিলেন যে নাৎসি জার্মানির স্বস্তিক একটি প্রাচীন ভারতীয় প্রতীক। সুভাষচন্দ্র ইহুদি-বিদ্বেষকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অংশ হিসাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন, কারণ ভারতীয়দের লুট করার জন্য ইহুদিরা ব্রিটিশদের সাহায্য নিয়েছিল।[১১৬]
সুভাষচন্দ্র বসুর সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি হল, তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।[১১৭] তার আরও একটি বিখ্যাত উক্তি হল দিল্লি চলো যা তিনি আইএনএ সেনাবাহিনীকে অনুপ্রাণিত করার জন্য বলতেন। জয় হিন্দ তার ব্যবহৃত আরও একটি স্লোগান, যা পরবর্তিতে ভারত সরকার এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। তার উদ্ভাবিত আরও একটি স্লোগান ছিল "ইত্তেহাম, ইত্তেমাদ, কুরবানী"। এছাড়া আজাদ হিন্দ ফৌজে ইনকিলাব জিন্দাবাদ স্লোগানটি ব্যবহার করেছিলেন, এটি মওলানা হযরত মোহানি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল।[১১৮]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুভাষচন্দ্রকে "দেশনায়ক"[টীকা ৪] আখ্যা দিয়ে তাসের দেশ নৃত্যনাট্যটি তাকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গপত্রে লেখেন: "স্বদেশের চিত্তে নূতন প্রাণ সঞ্চার করবার পূণ্যব্রত তুমি গ্রহণ করেছ, সেই কথা স্মরণ ক’রে তোমার নামে ‘তাসের দেশ’ নাটিকা উৎসর্গ করলুম।"[১১৯] আজাদ হিন্দ ফৌজের অভিযান ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও, সুভাষচন্দ্রের শৌর্য ও আপোষহীন রণনীতি তাকে ভারতব্যাপী জনপ্রিয়তা দান করে। নেতাজির জন্মদিন বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও ওড়িশায় রাজ্য ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
স্বাধীনতার পর কলকাতার একাধিক রাস্তা তার নামে নামাঙ্কিত করা হয়। বর্তমানে কলকাতার বিখ্যাত একমাত্র ইন্ডোর স্টেডিয়াম নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়াম তার নামে নামাঙ্কিত। নেতাজির জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তিত করে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাখা হয়। তার নামে কলকাতায় স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও নেতাজি সুভাষ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং দিল্লিতে স্থাপিত হয় নেতাজি সুভাষ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। কলকাতা মেট্রোর দুটি স্টেশন বর্তমানে নেতাজির নামাঙ্কিত: "নেতাজি ভবন" (পূর্বনাম ভবানীপুর) ও "নেতাজি" (পূর্বনাম কুঁদঘাট)।
সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৬৪,১৯৯৩, ১৯৯৭, ২০০১, ২০১৬ এবং ২০১৮ সালে ভারতের ডাকটিকিটে নির্বাচিত ছিলেন।[১২০] এছাড়া তিনি ১৯৯৬ এবং ১৯৯৭ সালে ভারতীয় ₹২ কয়েনে নির্বাচিত ছিলেন।[১২১] এছাড়া তিনি ২০১৮ ₹ ৭৫ কয়েনে[১২২] এবং ২০২১ সালে ₹১২৫ কয়েনেও নির্বাচিত ছিলেন।[১২৩] কলকাতাতে রয়েছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দ্বীপ (রোস দ্বীপ) এবং কিছু ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের নাম তার নামে নামকরণ করা হয়েছিল। ২৩ আগস্ট ২০০৭ সালে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী, শিনজো আবে কলকাতায় সুভাষচন্দ্র বসুর স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন করেন।[১২৪][১২৫] আবে বসু পরিবারকে বলেছিল, "জাপানিরা বসুর দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি দ্বারা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতেন। নেতাজি জাপানে অনেক শ্রদ্ধেয় নাম।"[১২৪][১২৫]
২০২১ সালের ২৩ জানুয়ারি ভারত সরকার ঘোষণা দেয়, সুভাষচন্দ্র বসুর নেতাজি জয়ন্তী জন্মবার্ষিকী স্মরণের জন্য। রাজনৈতিক দল, বামফ্রন্ট এবং বামফ্রন্ট দাবি করেছিল যে, দিনটি দেশপ্রেম দিবস হিসাবে পালন করা উচিত।[১২৬]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.