ভারতীয় উপমহাদেশের দার্শনিক ঐতিহ্য উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
ভারতীয় দর্শন বলতে ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে উঠা দার্শনিক ঐতিহ্যকে বুঝানো হয়। এই দর্শনগুলোতে নানা রকম পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একটা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক একাত্মতা লক্ষ্য করা যায়। ধর্ম ও দর্শনের মাঝে গভীর সংযোগ থাকায় আধ্যাত্মিক পটভূমিকা ভারতীয় দর্শনের একটি বৈশিষ্ট্য। ভারতীয় দর্শনগুলো ধর্ম, কর্ম, সংসার, পুনর্জন্ম, দুঃখ, ত্যাগ, ধ্যানের মতো অনেকগুলো ধারণা প্রকাশ করে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিভিন্ন আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মাকে সংসার ও দুঃখ থেকে চিরমুক্তি (মোক্ষ বা নির্বাণ) লাভ করা।[২] একমাত্র চার্বাক দর্শন ব্যাতিত অপরাপর দর্শনগুলোতে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। জগৎ ব্যাখ্যার চেয়ে জীবন ব্যাখ্যায় অধিক গুরুত্ব পেয়েছে। এই দর্শনগুলোতে আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে মোক্ষ অর্জনই জীবনের পরম লক্ষ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয়। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা মোক্ষ অর্জনের মাধ্যমে অত্যন্তিক দুঃখমুক্তিই পুরুষার্থ। তবে আত্মার চৈতন্যের প্রকৃতি এবং দুঃখ মুক্তির চূড়ান্ত পথ কেমন হবে সেই ধারণা সম্পর্কে মত পার্থক্য রয়েছে।
|
সংস্কৃত ‘দৃশ’ ধাতু হতে ‘দর্শন’ শব্দের উৎপত্তি। ‘দৃশ’ ধাতুর অর্থ দেখা; অর্থাৎ সত্যকে দেখা ও সত্যের স্বরূপকে উপলব্ধি করাই হল দর্শন। দর্শন শব্দটি যদিও ইংরেজি 'Philosophy'-এর সমার্থবাচক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে এই কথা দুটি সম্পূর্ণ এক নয়। ইউরোপে ‘Philosophy’ হল জ্ঞানের জন্য অনুরাগ, বা শুদ্ধবুদ্ধির পক্ষে কঠোর যুক্তিবিচার দ্বারা সত্যে উপনিত হওয়ার পদ্ধতি। এটা নিতান্তই বুদ্ধিনির্ভর। কিন্তু ভারতীয় চিন্তায় “দর্শন” হল, মুনি ঋষিদের দ্বারা সাধনায় প্রাপ্ত সত্যের প্রত্যক্ষ অনুভূতি। কেবল ইন্দ্রিয়ের পথে বা বিচারের পথে পরিপূর্ণভাবে সত্যের সাক্ষাৎকার মেলে না।[৩]
ভারতীয় দর্শনালোচনার তিনটি ক্রম[৩]—
ভারতীয় প্রতিটি দর্শন-সম্প্রদায়ের মনোভাব ভ্রাতৃসুলভ সহাবস্থানের মনোভাব, বৈরীসুলভ আগ্রাসী মনোভাব নয়। বিভিন্ন দর্শন-সম্প্রদায়ের একসাথে সহাবস্থান ভারতীয় দর্শনকে প্রতিটি সম্প্রদায় পরমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে উদার ও ব্যাপক করেছে। বিভিন্ন দর্শন-সম্প্রদায় (যথা— সাংখ্য, ন্যায়, বৌদ্ধ) ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আবির্ভূত হয়ে দীর্ঘকাল পরেও তারা পাশাপাশিভাবে অবস্থান করে জনমানসের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। এর কারণ হল, ভারতবর্ষে কোন এক দার্শনিক মতবাদের আবির্ভাবকাল থেকেই তার সমর্থকবৃন্দ তাদের জীবনযাত্রা প্রণালীকে সেই তত্ত্বচিন্তার আলোকে পরিচালিত করেছেন এবং তাদের উত্তরসূরীরাও একইভাবে ঐ চর্চা ও চর্যাকে অনুসরণ করেছেন।[৩]
ভারতীয় দর্শনসমূহকে প্রধানত আস্তিক ও নাস্তিক দুটি শাখায় বিভক্ত করা হয়। এই বিভক্তকরণ বেদকে নির্ভরযোগ্য জ্ঞানের উৎস হিসেবে সমর্থনের উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে। এখানে আস্তিক বলতে বেদ-বিশ্বাসী এবং নাস্তিক বলতে বেদ বিরোধী বুঝানো হয়। ঈশ্বরে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের উপর নির্ভর করে এই বিভক্তিকরণ করা হয়না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করেও সাংখ্য ও মীমাংসা উভয় দর্শনই বেদ-বিশ্বাসী হওয়ায় আস্তিক দর্শনের স্বীকৃতি পেয়েছে।[৪] বেদান্ত, মীমাংসা, বৈশেষিক, ন্যায়, সাংখ্য এবং যোগ এই ছয়টি আদি দর্শনগুলো আস্তিক্য দর্শন শাখার অন্তর্ভুক্ত; এবং বৌদ্ধ, জৈন ও চার্বাক বা লোকায়াত, আজীবিক, অজ্ঞান দর্শনগুলো হচ্ছে নাস্তিক্য দর্শন শাখার অন্তর্ভুক্ত।[৫][৬]
ভারতীয় দর্শন আস্তিক দর্শন (বেদ নিষ্ঠ) নাস্তিক দর্শন (বেদ বিরোধি) বেদের উপর সাক্ষাৎভাবে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বিচার-পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত চার্বাক কর্ম-মীমাংসা (মীমাংসা) জ্ঞান-মীমাংসা (বেদান্ত) বৌদ্ধ জৈন সাংখ্য যোগ ন্যায় বৈশেষিক
এই দর্শন মূলত ভারতীয় দার্শনিক চিন্তা ও ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহ্যগুলোর এক মিলিত প্রকাশ, যেগুলোর মধ্যে ছিল হিন্দু দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন ও জৈন দর্শন।
কখনও কখনও ঐতিহাসিক এবং ধারণাগত উভয় কারণেই আস্তিক দর্শনগুলোকে তিন শ্রেণীতে বিন্যাস করা হয়:
প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বেদ ও উপনিষদের প্রামাণ্যতার উপর নির্ভর করে ছয়টি সূত্র দর্শনের আবির্ভাব ঘটে। ব্রাহ্মণ্য-সংস্কৃত শিক্ষাবাদের মধ্যযুগে এই "ষড়দর্শনকে" আস্তিক্যবাদী দর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই সূত্র দর্শনের ক্রমবিকাশে তিনটি পর্যায় লক্ষ্য করা যায়। যথা—
এই শাখাগুলো ছাড়াও মাধব বিদ্যারণ্য আগম এবং তন্ত্রের উপর ভিত্তি করে উল্লিখিত আস্তিক দর্শনের নিম্নলিখিতগুলো অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:[৫]
এখানে উল্লিখিত দর্শনগুলো শুধুমাত্র আস্তিক্য দর্শন নয়, তারাই প্রধান ও অন্যান্য আস্তিক্য শাখা রয়েছে। এই দর্শনগুলো, বেদের কর্তৃত্ব স্বীকার করে এবং হিন্দু দর্শনের নৈষ্ঠিক (আস্তিক) শাখা হিসাবে বিবেচিত হয়। এগুলো ছাড়াও, যে সমস্ত শাখাগুলো বেদের কর্তৃত্বকে স্বীকার করে না সেগুলো হল বৌদ্ধ, জৈন, আজীবিক এবং চার্বাকের মতো ভিন্নধর্মী (নাস্তিক) পদ্ধতি।[১১][১২][১৩]
খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীর আগে ভারতে বেশ কিছু শ্রমণ আন্দোলন বিদ্যমান ছিল এবং সেগুলো ভারতীয় দর্শনের আস্তিক এবং নাস্তিক উভয় ঐতিহ্যকে প্রভাবিত করে।[১৪][১৫] শ্রমণ আন্দোলন আত্মার ধারণাকে গ্রহণ বা অস্বীকার করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের বিপরীতধর্মী বিশ্বাসের জন্ম দেয়, পরমাণুবাদ, অ্যান্টিনোমিয়ান নীতিশাস্ত্র, বস্তুবাদ, নাস্তিকতা, অজ্ঞেয়বাদ, স্বাধীন ইচ্ছার বিপরীতে ভাগ্যবাদ, পারিবারিক জীবনের বিপরীতে চরম তপস্বীবাদের আদর্শীকরণ, কঠোর অহিংসা ও নিরামিষভোজনের বিপরীতে সহিংসতা ও মাংস খাওয়ার অনুমতি, প্রভৃতি।[১৬] শ্রামাণিক আন্দোলন থেকে উদ্ভূত উল্লেখযোগ্য দর্শনগুলো হল জৈনধর্ম, প্রাক-বৌদ্ধধর্ম, চার্বাক, অজ্ঞান এবং আজীবিক।[১৭] দর্শনের যে সকল শাখা বেদের প্রামাণ্যতা স্বীকার করে না, সেগুলোকে নাস্তিক দর্শন বলা হয়।[টীকা ১] নাস্তিক দর্শনগুলোর মধ্যে চারটি শাখা প্রধান:[২১]
চার্বাক দর্শন যা লোকায়ত দর্শন নামেও পরিচিত। এ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পর্কে ঐকমত নেই। সাধারণভাবে গুরু বৃহস্পতিকে এই দর্শনশাস্ত্রের প্রবর্তক হিসাবে মনে করা হয়। আবার অনেকের মতে চার্বাক ঋষি এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। জয়রাশিভট্টের ‘তত্ত্বোপল্লবসিংহ’ কে প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে গণ্য করা হয়। এটি ভারতীয় বস্তুবাদের একটি প্রাচীন দর্শন।[২২] ভারতীয় অন্যান্য দর্শনগুলোর সাধারণ বৈশিষ্ট্য- আধ্যাত্মিকতার বিপরীতে চার্বাক দর্শনই বস্তুবাদী চিন্তাধারাকে গ্রহণ করেছে। এই দর্শনটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। চার্বাক জ্ঞানের সঠিক উৎস হিসাবে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি, অভিজ্ঞতাবাদ এবং শর্তসাপেক্ষ অনুমানকে স্বীকার করেন, দার্শনিক সংশয়বাদকে গ্রহণ করেন এবং আচারবাদ ও অতিপ্রাকৃতবাদকে প্রত্যাখ্যান করেন।[২৩] এটি ছিল প্রাচীন ভারতে একটি জনপ্রিয় বিশ্বাস ব্যবস্থা।[২৫]
এই দর্শন আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে। এই দর্শনের ভিত্তি তীর্থঙ্কর বা সিদ্ধপুরুষ বলে পরিচিত চব্বিশজন ধর্মগুরুর উপদেশ ও বোধিলাভ। বেদ বিরোধি হলেও জৈনগণ তীর্থঙ্করদের উপদশকে প্রামাণ্য হিসেবে মান্য করেন। এই তীর্থঙ্করদের প্রথম হলেন ঋষভদেব এবং সর্বশেষ হলেন বর্ধমান বা মহাবীর।[২৬] মহাবীর বৌদ্ধদেবের সমসাময়িক ছিলেন।
এই দর্শন আত্মার অস্তিত্ব অস্বীকার করে।[২৭] বৌদ্ধ দর্শনের ভিত্তি গৌতম বুদ্ধের উপদেশ ও বোধিলাভ। বুদ্ধদেব এই দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তার দর্শন লিপিবদ্ধ করেন নি। তাই এই দর্শনের মূলগ্রন্থ বলে কিছু নেই। এই দর্শন দুইটি প্রমাণ স্বীকৃত - প্রত্যক্ষ ও অনুমান প্রমাণ।
একটি বস্তুবাদী শাখা যেটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অস্তিত্ব অস্বীকার করে।[২৮][২৯]
ভারতীয় দর্শন তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক উভয় দিকের প্রতি সমান গুরুত্ব দিয়েছে। পাশ্চাত্য দর্শন জীবনচর্চাকে তেমন প্রভাবিত করে না, কেবল জ্ঞানতৃষ্ণাকে চরিতার্থ করার প্রচেষ্ঠা হয়। সেই তুলনায় ভারতীয় দর্শন কেবল তত্ত্ব আলোচনাই নয়, সত্যের সন্ধান ও উপলব্ধির পাশাপাশি জীবনে সত্যের প্রতিষ্ঠা করাই এর প্রধান লক্ষ্য।[৩]
জীবন সম্বন্ধে গভীর অতৃপ্তবোধ বা দুঃখবোধ হচ্ছে দর্শন-জিজ্ঞাসার মূল উৎস। অজ্ঞানজনিত কামনাসক্ত জীবনই দুঃখময়। ভারতীয় দর্শনে দুঃখময় জীবনই চূরান্ত নয়, দুঃখমুক্তির উপায় কিরূপ হবে তা নির্ণয় করে অন্তিমে আশাবাদকেই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।[৩]
চার্বাক ব্যতীত ভারতীয় সকল দর্শন সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করে যে, সমগ্র বিশ্বজগৎ এক অমোঘ নৈতিক নিয়ম বা শক্তির দ্বারা নিয়ান্ত্রত ও পরিচালিত হয়। এই বিশ্বাসের জন্যই ভারতীয় দর্শনে অধ্যাত্ম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। জড়বাদ অনুসারে জড়ই হচ্ছে পরমতত্ত্ব। জগতের সকলকিছু—প্রাণ, মন, আত্মচেতনা, জড় ও জড়শক্তির রূপান্তর মাত্র। অধ্যাত্ম্যবাদ অনুসারে চেতনাই হচ্ছে পরমতত্ত্ব, চেতনা থেকেই জগতের সকলকিছুর উদ্ভব হয়েছে। ঋক্ বেদে এই অলঙ্ঘনীয় নৈতিক শক্তি বা নিয়মকে ‘ঋত’ নামে, মীমাংসা দর্শনে ‘অপূর্ব’ নামে, ন্যায়-বৈশেষিক দর্শনে ‘অদৃষ্ট' নামে এবং সাধারণভাবে ‘কর্মনীতি’ নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই অমোঘ নৈতিক নিয়মকে দেবতারাও অমান্য করতে পারেন না।[৩]
অমোঘ নৈতিক নিয়ম থেকে কর্মবাদ বা কর্মনীতির প্রতি বিশ্বাস, এবং কর্মনীতির প্রতি বিশ্বাস থেকে জন্মান্তরবাদে বিশ্বাস দেখা দেয়। কর্মবাদ একপ্রকার নৈতিক কার্যকারণবাদ। বাহ্যজগতের কার্য-কারণ নিয়মকে নৈতিক জগতে প্রয়োগ করে তাকেই ‘কর্মনীতি' বলা হয়েছে। কর্মবাদের সার কথা হল—জীবনে সুখদুঃখ ভোগ কর্মেরই ফল। কর্ম কারণ, সুখ-দুঃখভোগ কার্যফল। কর্ম করলে তদনুসারে ফল পেতেই হবে—ভাল কাজের ভাল ফল, মন্দ কাজের মন্দ ফল।
তবে, ভারতীয় দর্শনে কর্মনীতি কেবল সকামকর্মের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, নিষ্কামকর্মের ক্ষেত্রে নয়। ভারতীয়দর্শনে কর্মবাদের পরিণাম অদৃষ্টবাদ নয়। অদৃষ্টবাদ অনুসারে, মানুষ তার প্রচেষ্টার দ্বারা অদৃষ্টশক্তিকে লঙ্ঘন করতে পারে না, যা ঘটবার তা ঘটবেই। কিন্তু কর্মবাদ মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে, তার স্বাধীন ইচ্ছাকে, অস্বীকার করে না। কর্মবাদ অনুসারে, কর্মফলের আশা পরিত্যাগপূর্বক নিষ্কামকর্ম সাধন করে মানুষ তার অদৃষ্টকে জয় করতে পারে ।[৩]
অবিদ্যা বা অজ্ঞানতাই হচ্ছে বন্ধন বা দুঃখের কারণ। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা অবিদ্যার নাশ হয়, কর্মবন্ধন হতে মুক্তি হয়, পুনর্জন্ম নাশ হয়। তত্ত্বজ্ঞান হচ্ছে আত্মার স্বরূপ সম্বন্ধে জ্ঞান যা অর্জন হলে অবিদ্যা নাশ হয় ও দুঃখমুক্তি হয়।[৩]
বদ্ধমূল ভ্রান্তধারণাসমূহকে উৎপাটিত করে সত্যের প্রতি মনকে একাগ্রচিত্তে নিবিষ্ট করতে না পারলে কেবল সত্যজ্ঞান বা তত্ত্বজ্ঞান মুক্তিলাভের পক্ষে যথেষ্ট নয়। তাই সত্যজ্ঞানকে দৃঢ়মূল করার জন্য নিরন্তর ধ্যান আবশ্যক। এজন্য প্রত্যেকটি ভারতীয় দর্শনে সত্যসাধন-পদ্ধতি নির্দেশিত হয়েছে। সত্যের প্রতি ধ্যানস্থ হতে গেলে বাহ্যজগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়যোগ ছিন্ন করে মনকে অন্তস্থ করতে হয়।[৩]
আত্মজ্ঞানের জন্য সংযম বা নৈতিক সূচিতা প্রয়োজন। ‘সংযম’ হচ্ছে জৈবিক প্রবৃত্তিকে বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারা পরিচালনা করে যথাযথভাবে জীবনযাপন করা।[৩]
পুরুষ বা আত্মার যা কাম্য তাই পুরুষার্থ। চার পুরুষার্থ (ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ)-এর মাঝে মোক্ষ হচ্ছে পরম পুরুষার্থ। বৌদ্ধ দর্শনে একে বলা হয় নির্বাণ। অর্থাৎ যা প্রাপ্ত হলে আর কিছুই কামনার থাকে না। আর মুক্তির মাধ্যমে দুঃখের অত্যন্ত(অতি+অন্ত) নিবৃত্তি ঘটে। চার্বাক ভিন্ন অপরাপর দর্শনগুলো মোক্ষকে পুরুষার্থ হিসেবে গণ্য করে। অবশ্য মোক্ষের স্বরূপ সম্পর্কে সকলে একমত নয়।[৩]
আত্মোপলব্ধিই জগদ্দর্শনের ভিত্তি। সেকারণে সব ভারতীয় দর্শনই আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করে। আত্মার দুইটি অবস্থা- বদ্ধঅবস্থা ও মুক্তঅবস্থা। তবে আত্মার স্বরূপ বিভিন্ন দর্শনে নিয়ে মতভেদ রয়েছে।[৩]
যথার্থ জ্ঞানলাভের উপায়কে প্রমাণ বলে। আস্তিক দর্শনসমূহ শ্রুতিনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও যুক্তিতর্কের উপর প্রতিষ্ঠিত।[৩]
ভারতীয় ঐতিহ্যগুলো বিভিন্ন দর্শনের প্রতিনিধিত্ব করে। দর্শনগুলোতে পরস্পরের সাথে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মতপার্থক্য থাকার পরও ভারতীয় নৈষ্ঠিক দর্শন ও হিন্দু দর্শনের ছয়টি শাখার মতবাদের সাথে মিল পাওয়া যায়। ভারতীয় নৈষ্ঠিক দর্শনগুলোতে যেখানে ব্যাক্তির আত্মার অস্তিত্বের সমর্থন করে, বিপরিতে আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে মতপার্থক্য তৈরি হয়, যেখানে বলা হয় আত্মা নেই;[৩০] তপস্বীর কঠোর তপস্বার বিপরিতে ভোগ-লালসাপূর্ণ সুখী জীবনের সমর্থন করা হয়; পুনর্জন্ম বিশ্বাসের বিপরীতে দাবি করা হয় পুনর্জন্ম নেই[৩১] - ইত্যাদি পার্থক্য পাওয়া যায়।
আজীবিক | চার্বাক | জৈনধর্ম | প্রাক বৌদ্ধধর্ম | হিন্দুধর্মের নৈষ্ঠিক দর্শন (অ-শ্রামাণিক) | |
---|---|---|---|---|---|
কর্ম | অস্বীকার করে[৩২] | অস্বীকার করে[৩৩] | সমর্থন করে[৩৩] | সমর্থন করে[৩৩] | সমর্থন করে |
সংসার, পুনর্জন্ম | সমর্থন করে | অস্বীকার করে[৩৪] | সমর্থন করে[৩৩] | সমর্থন করে[৩৫] | কিছু সমর্থন করে, কিছু করে না[৩৬] |
সন্ন্যাসী জীবন | সমর্থন করে | সমর্থন করে[৩৩] | সমর্থন করে | সমর্থন করে | সন্ন্যাস হিসেবে সমর্থন করে[৩৭] |
ভক্তি | সমর্থন করে | অস্বীকার করে | সমর্থন করে, ঐচ্ছিক[৩৮] | সমর্থন করে, ঐচ্ছিক[৩৯] (পালি: ভত্তি) |
আস্তিক শাখা: সমর্থন করে, ঐচ্ছিক[৪০] অন্যান্য: অস্বীকার করে[৪১] |
অহিংসা, সবজিভোজন | সমর্থন করে | বলপ্রয়োগের বিপক্ষে প্রাণীর প্রতি বলপ্রয়োগের বিপক্ষে[৪২] |
সমর্থন করে খাদ্য হিসেবে মাংস গ্রহণ অস্পষ্ট[৪৩] |
সমর্থন করে
সবজিভোজন নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী[৪৪] | |
মুক্ত কর্ম | অস্বীকার করে[৪৫] | সমর্থন করে | সমর্থন করে | সমর্থন করে[৪৬] | সমর্থন করে[৪৭] |
মায়া | সমর্থন করে[৪৮] | অস্বীকার করে | সমর্থন করে | সমর্থন করে (প্রপঞ্চ)[৪৯] | সমর্থন করে[৫০] |
আত্মা | সমর্থন করে | অস্বীকার করে[৫১] | সমর্থন করে[৫২] | অস্বীকার করে[৫৩] | সমর্থন করে[৫৪] |
সৃষ্টিকর্তা বা সৃষ্টিকারী দেবতা | অস্বীকার করে | অস্বীকার করে | অস্বীকার করে | অস্বীকার করে | আস্তিক শাখা: সমর্থন করে[৫৫] অন্যান্য: অস্বীকার করে[৫৬] |
জ্ঞানতত্ত্ব প্রমাণ |
প্রত্যক্ষ অনুমান শব্দ |
প্রত্যক্ষ[৫৭] | প্রত্যক্ষ অনুমান শব্দ[৫৮] |
প্রত্যক্ষ অনুমান[৫৮][৫৯] |
বিভিন্ন, বৈশেষিকা (দুইটি) ও বেদান্ত (ছয়টি)[৫৮][৬০] প্রত্যক্ষ অনুমান উপমা অর্থপত্তি অনুপলব্ধি শব্দ |
পরিত্রাণ | সংদ্রাশুদ্ধি[৬১] | সিদ্ধ[৬২] | নির্বাণশূন্যতা[৬৩] | মোক্ষ, নির্বাণ, কৈবল্য যোগ, অন্যান্য: জীবনমুক্তি[৬৪] | |
অধিবিদ্যা | অনেকান্তবাদ[৬৫] | শূন্যতা[৬৬][৬৭] | ব্রাহ্মণ[৬৮][৬৯] |
মৌর্য মন্ত্রী চাণক্যের রচিত অর্থশাস্ত্র হচ্ছে রাজনৈতিক দর্শনে নিবেদিত প্রথম ভারতীয় গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দীর এবং রাষ্ট্রীয় শিল্প ও অর্থনৈতিক নীতির ধারণা নিয়ে আলোচনা করে।
আধুনিক ভারতের সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রাজনৈতিক দর্শন হল অহিংস এবং সত্যাগ্রহের একটি। এই দর্শন মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় জনপ্রিয় হয়েছিল। পরিবর্তে এটি পরবর্তী স্বাধীনতা এবং নাগরিক অধিকার আন্দোলনকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এবং নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে। এছাড়াও প্রভাত রঞ্জন সরকারের প্রগতিশীল ব্যবহার তত্ত্ব [৭০] একটি প্রধান আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক দর্শন।[৭১]
অখণ্ড মানবতাবাদ ছিল একগুচ্ছ ধারণার সমষ্টি যা উপাধ্যায় রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে তৈরি করেছিলেন এবং ১৯৬৩ সালে জনসংঘের সরকারি মতবাদ হিসেবে গৃহীত হয়েছিল।
উপাধ্যায় চিন্তা করেছিলেন যে, ভারতের জন্য একটি দেশীয় অর্থনৈতিক মডেল তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যেখানে একজন মানুষকে কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গি এই ধারণাটিকে সমাজতন্ত্র এবং পুঁজিবাদ থেকে আলাদা করেছে। অখণ্ড মানবতাবাদকে জনসংঘের রাজনৈতিক মতবাদ হিসাবে গৃহীত করা হয়েছিল এবং অন্যান্য বিরোধী শক্তির জন্য এর নতুন উন্মুক্ততা হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে চলমান বিশিষ্ট গান্ধীবাদী সর্বোদয় আন্দোলনের সাথে জোটবদ্ধ হওয়া সম্ভব করে তোলে। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য এটি জনসাধারণের প্রথম বড় অগ্রগতি বলে বিবেচিত হয়।
ভারতীয় দর্শনের জটিলতার প্রশংসা করে টি এস এলিয়ট লিখেছেন যে, ভারতের মহান দার্শনিকদের কাছে "অধিকাংশ মহান ইউরোপীয় দার্শনিকদের স্কুলগামী বাচ্চাদের মতো দেখায়"।[৭২][৭৩] আর্থার শোপেনহাওয়ার কান্তিয়ান চিন্তাধারার উন্নতির জন্য ভারতীয় দর্শন ব্যবহার করেছিলেন। শোপেনহাওয়ার তার বই দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাজ উইল অ্যান্ড রিপ্রেজেন্টেশনের ভূমিকায় লিখেছেন যে, যিনি "ভারতীয় প্রাচীন পবিত্র জ্ঞানও পেয়েছেন এবং আত্মীকরণ করেছেন, তাহলে আমি তাকে যা বলতে চাই তা শোনার জন্য তিনি সর্বিকভাবে প্রস্তুত।"[৭৪] ১৯ শতকের আমেরিকান দার্শনিক আন্দোলন তুরীয়বাদ ভারতীয় চিন্তাধারা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।[৭৫][৭৬]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.