ব্রাহ্মধর্ম হল ১৯শ শতাব্দীর বাংলার একটি ধর্মীয় আন্দোলন৷ এই আন্দোলন থেকেই সেকালের বাংলার নবজাগরণ, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম পর্যায় এবং বৃহত্তর ক্ষেত্রে হিন্দু সংস্কার আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে৷ ব্রাহ্মধর্মের অনুগামীরা “ব্রাহ্ম” নামে পরিচিত৷ ব্রাহ্মরা মূলত ভারতীয় বা বাংলাদেশী হন৷ রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের প্রথম প্রবক্তা৷ যুক্তিবাদের প্রয়োগের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে তিনি হিন্দু ধর্ম ও সামাজিক রীতিনীতিগুলো সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিলেন৷ তিনি নিজে একেশ্বরবাদী ধর্ম ও আধুনিক বিজ্ঞানের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন৷[1]

ইতিহাস

রামমোহন রায় ধর্মীয় সত্যের অনুসন্ধানে খোলা মনে সকল প্রধান ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করেন৷ তিনি কেবল সংস্কৃত ভাষায় বেদ অধ্যয়নই করেননি, বরং আরবি ভাষায় কুরআনহিব্রুগ্রিক ভাষায় বাইবেলও পড়েন৷ প্রতিটি ধর্মের মূলনীতিগুলো অধ্যয়ন করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, প্রতিটি ধর্মের উদ্দেশ্যই এক৷ তা হল, মানবজাতির নৈতিক পুনর্জাগরণ৷ তাই প্রতিটি ধর্মের নীতিগুলো পরিবর্তিত যুগের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা ও পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন৷ সেই জন্যই তিনি ভেবেছিলেন হিন্দুধর্ম পরিত্যাগ করে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করার আবশ্যকতা নেই৷ তিনি প্রতিটি ধর্মের বিশ্বজনীন নীতিশিক্ষাগুলো সংশ্লিষ্ট ধর্মের গোঁড়ামি, আনুষ্ঠানিকতা ও কুসংস্কারগুলো বাদ দিয়ে গ্রহণ করেন৷[2]

রামমোহন রায় হিন্দুধর্মের ভিতর থেকেই উক্ত ধর্মকে সংস্কার করতে উদ্যোগী হলেও তার উত্তরসূরি মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৫০ সালে বেদের অভ্রান্ততা ও অপৌরুষেত্ব অস্বীকার করেন৷ এর মাধ্যমে ব্রাহ্মসমাজ মূলধারার হিন্দুধর্ম থেকে বেরিয়ে আসে৷ দেবেন্দ্রনাথ কিছু হিন্দু রীতিনীতি রক্ষা করেছিলেন বটে, কিন্তু ব্রাহ্মদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের ফলে ব্রাহ্মসমাজ ভেঙে যায় এবং ১৮৭৮ সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়৷

১৯০১ সালে ব্রিটিশ ভারতের প্রিভি কাউন্সিল ঘোষণা করে যে, “ব্রাহ্মদের অধিকাংশ হিন্দু নয়৷ তাঁদের নিজস্ব ধর্ম রয়েছে৷”[3]

দেবেন্দ্রনাথের ব্রাহ্মধর্মঃ বা ধর্মীয় ও নৈতিক বিধান ‘ব্রাহ্মধর্মের মৌলিক নীতি’তে পরিণত হয়৷ এই গ্রন্থে ব্রাহ্মদের কর্তব্যগুলো বিবৃত হয়েছে৷ সেই সঙ্গে ব্রাহ্মদের সভা বা উপাসনা সর্বদা ‘১৮৩০ সালের অছি নীতি’গুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার ব্যবস্থাও করা হয়েছে৷

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও কালরেখা

  • ১৮২৮ : রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মসভা’ স্থাপন করেন।[4]
  • ১৮২৯ : এশিয়াটিক সোসাইটি প্রথম দুই ভারতীয়কে সদস্যপদ দেন। এঁরা হলেন দ্বারকানাথ ঠাকুরপ্রসন্নকুমার ঠাকুর[5]
  • ১৮৩০ : দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর ও অন্যান্যরা একটি আইনি অছি নথির মাধ্যমে প্রথম ব্রাহ্ম উপাসনা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন৷[6] এই উপাসনা মন্দিরটি কলকাতার চিৎপুর (জোড়াসাঁকো) অঞ্চলে অবস্থিত ছিল৷ রামমোহন রায় ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন৷
  • ১৮৩৩ : ব্রিস্টলে রামমোহন রায়ের মৃত্যু ঘটে৷
  • ১৮৩৯ :.৬ অক্টোবর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তত্ত্ববোধিনী সভা প্রতিষ্ঠা করেন৷[7]
  • ১৮৪৩ : তত্ত্ববোধিনী সভা ব্রাহ্মসভার সঙ্গে মিশে যায়৷[8] কলকাতা ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়৷ দ্বারকানাথ ঠাকুর রাজশক্তির বিরুদ্ধাচারণ করে গ্রেট ওয়েস্টার্ন রেলওয়ে কোম্পানি স্থাপন করেন৷[9]
  • ১৮৫০ : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই খণ্ডে ব্রাহ্মধর্মঃ গ্রন্থটি প্রকাশ করেন৷ ব্রাহ্মধর্ম বেদের অভ্রান্ততা অস্বীকার করে হিন্দুধর্ম থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং নতুন ধর্ম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে৷
  • ১৮৫৫ : কেশবচন্দ্র সেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি গঠন করেন৷ পরে তিনি জেমস লংচার্লস ডাল নামে দুই খ্রিস্টান মিশনারির সঙ্গে যুক্ত হন৷[10] ডাল ছিলেন একজন পর্যটক ইউনিটারিয়ান মিশনারি৷ তিনি বস্টনে ক্যারোলিন ওয়েলস হিলি ডাল নামে এক নারীবাদীর সঙ্গে বিবাহ-সংক্রান্ত সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন৷ পরে তিনি চিরকালের জন্য ভারতে চলে এসে তার পত্নীকে ‘বস্টন বিবাহবিচ্ছেদ’ অনুমোদন করেন৷ তিনিই প্রথম ইউনিটারিয়ান মিশনারি যিনি বিদেশে ধর্মপ্রচার করেছিলেন৷[11]
  • ১৮৫৬ : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিমলার পাহাড়ে যান৷
  • ১৮৫৭ : দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ইউনিটারিয়ান প্রচারক চার্লস ডালকে জানান যে, ডালকে আর কলকাতা ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না এবং “তিনিও সমাজে যিশুর নাম শুনবেন না৷” ডাল তখন রামমোহন রায় সোসাইটি গঠন করে উদারপন্থী ব্রাহ্মদের দেবেন্দ্রনাথের কাছ থেকে সরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন৷[12] কেশবচন্দ্র সেন কলকাতা ব্রাহ্মসমাজে যোগ দেন৷ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই সময় সিমলায় ছিলেন৷ সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হয়৷ ব্রাহ্মসমাজের অছি পরিষদের প্রায় সকল সদস্য ব্রিটিশ রাজশক্তিকে সমর্থন করেন এবং বিদ্রোহীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান৷
  • ১৮৬০ : চার্লস ডাল খোলাখুলি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আক্রমণ করেন এবং থিওডোর পার্কার ও উইলিয়াম চ্যানিঙয়ের হিন্দুদের খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার পদ্ধতি অনুসারে উদারপন্থী ব্রাহ্ম নব্য-খ্রিস্টান গোষ্ঠীটিকে অনুমোদন করেন৷[12]
  • ১৮৬৬ : প্রগতিশীল বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীটির থেকে নিজেদের পৃথক করার জন্য ব্রাহ্মসমাজের প্রথম অংশ ও কলকাতা ব্রাহ্মসমাজের নাম হয় ‘আদি ব্রাহ্মসমাজ’৷
  • ১৮৭১ : আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতারা বিতর্কিত ‘ব্রাহ্ম বিবাহ বিল, ১৮৭১’-এর পরিপ্রেক্ষিতে খোলাখুলিভাবে প্রগতিশীল গোষ্ঠীটির বিরোধিতা করেন৷ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “আমরা প্রথমে ব্রাহ্ম, পরে ভারতীয় বা হিন্দু৷”
  • ১৮৭২ : বিবাহ-সংক্রান্ত বিলটি বাহ্যিকভাবে ব্রাহ্মদের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ না করে ‘১৮৭২ সালের বিশেষ বিবাহ আইন (আইন তিন)’ হিসেবে পাস করা হয়৷ এই আইনে বলা হয় যে, এই আইনে বিয়ে করতে হলে ‘আমি হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান বা ইহুদি নই’ বলে ঘোষণা করা বাধ্যতামূলক৷ এর মাধ্যমে এটি একমাত্র ব্রাহ্মদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য করা হয়৷
  • ১৮৭৮ : ব্রাহ্মসমাজের বিভক্ত অংশটি আবার ভেঙে যায়৷ এই অংশের অধিকাংশ সভ্য মধ্যপন্থী সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ গঠন করেন৷ আদি ব্রাহ্মসমাজের দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রাজনারায়ণ বসু তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাগত জানান৷ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বিশিষ্ট নেতারা ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী, আনন্দমোহন বসুশিবচন্দ্র দেব[13]

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

বহিঃসংযোগ

Wikiwand in your browser!

Seamless Wikipedia browsing. On steroids.

Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.

Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.