Loading AI tools
উইকিপিডিয়া থেকে, বিনামূল্যে একটি বিশ্বকোষ
খারবেল (সংস্কৃত: खारवेल) প্রাচীন কলিঙ্গ রাজ্যের মহামেঘবাহন রাজবংশের তৃতীয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিলেন। ভারতের উড়িষ্যা রাজ্যের রাজধানী ভুবনেশ্বর শহরের নিকটবর্তী উদয়গিরি পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত হাথিগুম্ফা নামক চৌদ্দ নম্বর গুহার দেওয়ালে প্রাকৃত ভাষায় ও ব্রাহ্মী লিপিতে উৎকীর্ণ একটি প্রাচীন শিলালিপি থেকে খারবেল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ভাবে এই লিপির বিশ্লেষণ করেছেন।[1][2]
হাথিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, চেত রাজবংশের কলিঙ্গাধিপতি মহারাজ মহামেঘবাহন খারবেল পনেরো বছর বয়সে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং চব্বিশ বছর বয়সে সিংহাসনলাভ করেন।[3] এই লিপিতে খারবেলের রাজত্বের প্রথম থেকে ত্রয়োদশ বছর পর্য্যন্ত রাজত্বের বর্ণনা রয়েছে।
খারবেল তার রাজত্বের প্রথম বছরে তিনি ঝড়ে বিনষ্ট নগর, প্রাসাদ ও তোরণ সংস্কার করেন ও জল সংগ্রহের আধার ও উদ্যান নির্মাণ করেন। লিপিতে একটি সংখ্যার উল্লেখ রয়েছে, যা বিভিন্ন ঐতিহাসিক বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ভগবানলাল ইন্দ্রজীর মতে, খারবেলের নগরীতে পঁয়ত্রিশ লক্ষ মানুষ বাস করতেন[3], আবার রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে খারবেল পঁয়ত্রিশ লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করে প্রজাদের সংস্কার ও নির্মাণ কার্য্য সাধন করেছিলেন।[1][4]
লিপির পরবর্তী অংশে সাতকনি বা সাতকামিনী নামক এক রাজার উলেখ রয়েছে, যিনি সম্ভবতঃ সাতবাহন সম্রাট সাতকর্ণী ছিলেন। খারবেল তার রাজত্বের দ্বিতীয় বছরে রাজা সাতকর্ণীকে অগ্রাহ্য করে অশ্ব, হস্তী, পদাতিক ও রথ বিশিষ্ট চতুরঙ্গ সেনা পাঠিয়ে মসিকনগর বা মুসিকনগর বা অসিকনগর নামক একটি শহর অবরোধ করেন। শাহুর মতে অসিকনগর অস্সক মহাজনপদমহাজনপদের রাজধানী ছিল।[5]:১২৭, আবার অজয় মিত্র শাস্ত্রীর মতে, অসিকনগর বর্তমান নাগপুর জেলার অদম গ্রাম যেই স্থানে অবস্থিত, সেখানেই অবস্থিত ছিল। এই গ্রাম থেকে আবিষ্কৃত একটি টেরাকোটা শীলমোহর থেকে অস্সক মহাজনপদের উল্লেখ রয়েছে।[6][7]
লিপির এই অংশে কাহ্নবেমনা বা কন্থবেণা শব্দের উল্লেখ রয়েছে। অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে, এটি একটি নদীর নাম, যে পর্য্যন্ত খারবেলের সেনাবাহিনী অভিযান করেছিল। বাসুদেব বিষ্ণু মিরাশী কহ্নান নদী ও বৈনগঙ্গা নদীর মিলিত স্রোতকে কাহ্নবেমনা নদীবলে চিহ্নিত করেছেন, যা কলিঙ্গ রাজ্যের পশ্চিমে প্রবাহিত হত।[8]
বিভিন্ন পণ্ডিত বিভিন্ন ভাবে দ্বিতীয় বছরের ঘটনাকে বর্ণনা করেছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেছেন যে, খারবেল সাতকর্ণীর বিরুদ্ধে একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেছিলেন। শৈলেন্দ্রনাথ সেনের মতে, এই সেনা কৃষ্ণা নদী পর্য্যন্ত যাত্রা করে মুসিকনগর অবরোধ করে, যা কৃষ্ণা ও মুসী নদীর সংযোগস্থলে অবস্থিত ছিল।[9] ভগবানলাল ইন্দ্রজীর মতে, সাতকর্ণী খারবেলের আক্রমণ এড়ানোর উদ্দেশে তাকে চতুরঙ্গ সেনা উপহার প্রদান করেন। এই বছরই কুসুম্ব ক্ষত্রিয়দের সহায়তায় খারবেল মসিক নামক শহর অধিকার করেন।[3] অ্যালেইন দানিয়েলোউ মনে করেছেন যে, খারবেলের সঙ্গে সাতকর্ণীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং কোন রকম লড়াই ছাড়া খারবেল তার রাজ্যের সীমান্ত অতিক্রম করেছিলেন।[10] সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের মতে খারবেলের সেনা সাতকর্ণীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে সক্ষম না হলে অন্যদিকে যাত্রা করে আসিকনগর অবরোধ করে।[11]
গন্ধর্ববিদ্যা বা সঙ্গীতবিদ্যায় সুপণ্ডিত খারবেল তার রাজত্বের তৃতীয় বছরে নৃত্যগীত, নাট্যাভিনয়, উৎসব প্রভৃতি উপায়ে প্রজাদের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা করেন।[3][12]
খারবেলের রাজত্বের চতুর্থ বছরের কার্যকলাপের বর্ণনা লিপির যে অংশে রয়েছে, তা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক এই অংশের বিভিন্ন ধরনের বিশ্লেষণ করেছেন। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, তিনি পূর্ব কলিঙ্গ রাজাদের নির্মিত বিদ্যাধরা পয়ঃপ্রণালী অতিক্রম করলে রথিক ও ভোজকদের প্রধানদের মুকুট ও রাজছত্র ভূলুন্ঠিত হয়, তাদের ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত হয় এবং তার পদানত হতে বাধ্য হন।[4] অ্যালেইন দানিয়েলোউ মনে করেছেন যে, রথিক ও ভোজক সাতবাহন সাম্রাজ্যের সামন্তরা ছিল এবং খারবেল ক্রীড়াচ্ছলে তাদের পরাস্ত করেন কিন্তু তাদের রাজ্য অধিকার করেননি।[10] আবার ভগবানলালের মতে, খারবেল ধর্মকূট পাহাড়ে একটি পুরাতন চৈত্য সংস্কার করে তাতে ছত্র ও কলস প্রতিষ্ঠা করে পুজো করেন, যাতে রাষ্ট্রিক ও ভোজ নামক তার সামন্ত শাসকদের মধ্যে ত্রিরত্ন সম্বন্ধে বিশ্বাসের জন্ম হয়।[3]
খারবেলের রাজত্বের পঞ্চম বছরে নন্দরাজ কর্তৃক উদ্ঘাটিত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থার সংস্কার করেন। রামশঙ্কর ত্রিপাঠীর মতে, এই পয়ঃপ্রণালী তি-বস-সত বা তিনশো বছর[11] ধরে ব্যবহৃত হয়নি।[13] এই খাল তনসুলি (? তোসলি) থেকে উদ্ভূত হয়।[14] ভগবানলাল অবশ্য বলেছেন, যে লিপির এই অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সঠিক ব্যাখ্যা সম্ভবপর নয়।[3]
লিপির এই অংশের অধিকাংশ নষ্ট হয়েছে, তবে সম্ভবতঃ এই অংশে লক্ষাধিক মানুষের মঙ্গল সাধনের জন্য খারবেলের নাম করা হয়েছে।[3] রাখালদাসের মতে, এই বছর খারবেল রাজসূয় যজ্ঞ সম্পন্ন করেন এবং কর মকুব করেন।[1]
ভগবানলালের মতে খারবেলের রাজত্বের সপ্তম বছরের বর্ণনা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।[3] কিন্তু সামান্য অস্পষ্ট অক্ষত অংশ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে যে, এই বছর তার রাণী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন।[15]
ভগবানলালের মতে খারবেল তার রাজত্বের অষ্টম বছরে একজন যবন রাজাকে পরাস্ত করেন, যিনি অপর একজন রাজাকে হত্যা করেছিলেন এবং রাজগৃহের রাজাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। খারবেল তাকে মথুরা পর্য্যন্ত তাড়া করেন। ভগবানলাল অবশ্য এই রাজার নাম বলতে পারেননি কারণ তার মতে লিপির এই অংশ বিনষ্ট হয়ে গেছে।[3] রাখালদাস শিলালিপি বিশ্লেষণ করে মত দেন যে, লিপিতে যবন রাজার নাম রয়েছে দিমিত এবং ইন্দো-গ্রিক শাসক প্রথম দেমেত্রিওস ও দিমিত একই ব্যক্তি ছিলেন বলে মনে করেন।[4] রামপ্রসাদ চন্দ এই ব্যাখ্যা মানতে চাননি, কারণ তার মতে প্রথম দেমেত্রিওস ও খারবেল সমসাময়িক শাসক ছিলেন না।[11] শৈলেন্দ্রনাথ সেনের মতে, এই যবন রাজা প্রথম দেমেত্রিওসের পরবর্তীকালের কোন ইন্দো-গ্রিক শাসক ছিলেন।[11] অন্য ঐতিহাসিকদের মতে, খারবেল বিশাল বাহিনী নিয়ে গোরথগিরি আক্রমণ করে রাজগৃহ অধিকার করেন[10] ও আজীবিক ধর্মাবলম্বীদের বরাবর গুহা থেকে বিতাড়িত করে তাদের লিপি বিনষ্ট করেন।[16][17]
লিপির এই অংশের অধিকাংশ নষ্ট হয়েছে, তবে অক্ষত অংশ থেকে জানা যায় যে, খারবেল এই বছরে কল্পতরুর ন্যায় ব্রাহ্মণদের ঘোড়া, হাতি, রথ ও বাড়ি দান করেন। ভগবানলালের মতে, এই বছর তিনি ২,৮০,০০০ মুদ্রা ব্যয় করে মহাব্যায় নামক একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন।[3] অন্যমতে, এই প্রাসাদের নাম ছিল মহাবিজয় এবং এর নির্মাণে ৩,৮০,০০০ মুদ্রা ব্যয় হয়।[12]
লিপির এই অংশ অধিকাংশ নষ্ট হয়েছে, তবে অক্ষত অংশে ভারতবর্ষ কথাটির উল্লেখ রয়েছে।[9][18] ভগবানলালের মতে, খারবেল এই বছর ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশে যাত্রা করেন ও অন্যান্য রাজাদের বিরোধিতার কথা জানতে পেরে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।[3] অন্যমতে, তিনি ভারতবর্ষ জয় করার জন্য সামরিক অভিযান পাঠান এবং বিভিন্ন রাজাদের আক্রমণ করে তাদের নিকট হতে প্রভূত সম্পত্তি লাভ করেন।[12] শৈলেন্দ্রনাথ অবশ্য মনে করেছেন, এই অভিযানে খারবেল কোন উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেননি।[9]
ভগবানলালের মতে, খারবেল এই বছর গর্দভ নগরীর ওপর পূর্বতন রাজাদের জারি করা কর মকুব করেন।[3] অন্যমতে, তিনি রাজা অব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত পিথুড় নগরী আক্রমণ করেন এবং তার রাজ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হিসবে চিহ্নিত ১৩০০ বছরের পুরোনো তামির বা ত্রামির রাজ্যসমষ্টি ভেঙ্গে দেন।[12] শৈলেন্দ্রনাথের মতে, পিথুড় নগরী বর্তমান মছলিপত্তনম শহরের নিকটে কোন একটি স্থানে অবস্থিত ছিল। অ্যালেইন দানিয়েলোউ ত্রামির শব্দটিকে দ্রামির বা দ্রাবিড় শব্দ হিসেবে মনে করেছেন এবং তার মতে, লিপির এই অংশ থেকে বোঝা যায় যে, খারবেল পাণ্ড্য রাজ্যকে পরাজিত করেছিলেন,[9] অবশ্য রাখালদাস মনে করেন, এই রাজ্য তামিল রাজ্যসমূহের একটি সমষ্টি ছিল।[1]
লিপির এই অংশ থেকে জানা যায় যে, খারবেল উত্তরাপথের রাজাদের মনে ত্রাস সঞ্চার করেন ও বহস্পতিমিত বা বৃহস্পতিমিত্র নামক মগধরাজকে তার পাদবন্দনা করতে বাধ্য করেন। হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্র অনুসারে, বহস্পতি বা বৃহস্পতি গ্রহ পুষ্য নক্ষত্রের অধিপতি বলে জয়সওয়ালের মতে, বৃহস্পতিমিত্র ও পুষ্যমিত্র শুঙ্গ একই ব্যক্তি। দিব্যাবদান গ্রন্থে বৃহস্পতি নামক একজন শাসকের উল্লেখ থাকায় হেমচন্দ্র রায়চৌধুরীর অবশ্য এই মত অগ্রাহ্য করেছেন। সুধাকর চট্টোপাধ্যায় মনে করেছেন, বহস্পতিমিত সম্ভবতঃ কৌশাম্বীর শাসক ছিলেন এবং তার রাজত্ব সম্ভবতঃ মগধ পর্য্যন্ত বিস্তৃত ছিল।[11] ভগবানলাল এই লিপি পড়ে বিশ্লেষণ করেছেন যে, খারোবেল গঙ্গা নদীতে জল দিয়ে তার হাতিদের পরিষ্কার করেছিলেন, অর্থাৎ তার বাহিনী গঙ্গা নদী পর্য্যন্ত যাত্রা করেছিল।
খারবেল তার রাজ্যে অগ্রজিনের একটি মূর্তি ফিরিয়ে আনেন, যা পূর্বে নন্দরাজ নিয়ে গেছিলেন। এছাড়া তিনি অঙ্গ ও মগধ থেকে প্রভূত সম্পদ নিজের রাজ্যে নিয়ে আসেন।[1][19]
লিপির এই অংশ বিশ্লেষণ করে ভগবানলাল জানিয়েছেন যে, 'যার শিখরে বসে বিদ্যাধররা আকাশ ছুতে পারবেন', খারবেল এরকম বেশ কিছু উঁচু প্রাসাদ নির্মাণ করেন। এরপরের অংশ থেকে জানা যায় যে, তিনি হাতি উপহার দেন ও কোন একটি অঞ্চলকে পদানত করেন।[3] রাখালদাসের মতে, তিনি একশত জন কর্মকারদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করেন ও তাদের জমি কর মকুব করেন।[1]
লিপির এই অংশ কিছুটা বিনষ্ট। এই অংশে খারবেলকে ভিক্ষুরাজা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাকে সমস্ত ধর্মের উপাসক, অপরাজেয় সৈন্যদলের প্রধান এবং একজন মহান রাজা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ভগবানলালের মতে, তিনি কুমারী পাহাড়ের ওপর অর্হত মন্দিরের নিকটে কোন কাজ করেছিলেন। এছাড়া তিনি পণ্ডিত ও সাধকদের সংগঠিত করে দক্ষ কারিগরদের দিয়ে কিছু একটা নির্মাণ করেছিলেন। তিনি পতলক ও চেতক নামক স্থানে বৈদুর্য্যগর্ভে স্তম্ভ নির্মাণ করান। খারবেলের দুইজন পূর্বপুরুষ খেমরাজা ও বৃদ্ধরাজার নামও এই অংশে উল্লিখিত রয়েছে।[3]
অন্যমতে তিনি কুমারী পাহাড়ে সাধকদের পূজা করেছিলেন এবং পণ্ডিত ও সাধকদের সংগঠিত করেছিলেন। তিনি সিংহপথের রাণী সিন্ধুলের জন্য বহুদূরের শ্রেষ্ঠ খনি থেকে তোলা পাথর আনিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন।[12] এই অংশে দাবী করা হয়েছে যে খারবেল ঋষি বসুর বংশধর ছিলেন।[1]
উদয়গিরি গুহাসমূহের মঞ্চপুরী গুহায় খারবেলের উত্তরসূরী কুদেপসিরি নিজেকে ঐরে মহারাজস কলিঙ্গাধিপতিনা মহামেঘবাহনস (সংস্কৃত: ऐरे महाराजस कलिंगाधिपतिना महामेघवाहनस) বলে বর্ণনা করেছেন। জেমস প্রিন্সেপ ও রাজেন্দ্রলাল মিত্র মনে করেছিলেন যে, ঐর প্রকৃতপক্ষে হাথিগুম্ফা শিলালিপিতে উল্লিখিত রাজার নাম। পরে ভগবানলাল ইন্দ্রজী মত দেন যে, এই রাজার নাম খারবেল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেছেন যে খারবেল একটি দ্রাবিড় শব্দ,[20] যদিও রিচার্ড ফায়ার এই মতের সমর্থক নন।[21] ব্রজনাথ পুরীও মনে করেছেন যে, খারবেলের বংশের দ্রাবিড় সাংস্কৃতিক যোগাযোগ স্থাপন করা খুবই দুরূহ।[22] শাহুর মতে, খারবেল ও কুদেপসিরি দ্বারা ব্যবহৃত ঐর শব্দটি মূলতঃ আর্য্য শব্দের অপভ্রংশ।[5]
হাথিগুম্ফা শিলালিপির প্রথম পংক্তিতে চেতরাজ বস বধনেন (সংস্কৃত: चेतराज वस वधनेन)[23] কথাটি উৎকীর্ণ রয়েছে, যার অর্থ যিনি চেত রাজের বংশ বৃদ্ধি করেন। চেত তার বংশ বা পিতার নাম ছিল কিনা সেই নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। শিলালিপির যে অংশে चेत শব্দটি রয়েছে, তার ঠিক ওপরেই একটি ছোট ফাটল রয়েছে, যা হ্রস্ব ই-কারের ( ি) মতো মনে হয় বলে ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় শব্দটিকে চেতি (चेति) বলে মনে করেছেন, যার ফলে তার মনে হয়েছে, যে খারবেলের রাজবংশ চেদী রাজবংশ থেকে উদ্ভূত হয়েছে।[5]
উদয়গিরি গুহাসমূহের মঞ্চপুরী গুহায় খারবেলের উত্তরসূরী কুদেপসিরি নিজেকে ঐরে মহারাজস কলিঙ্গাধিপতিনা মহামেঘবাহনস (সংস্কৃত: ऐरे महाराजस कलिंगाधिपतिना महामेघवाहनस) বলে বর্ণনা করেছেন। ঐর শব্দটি আর্য্য শব্দের অপভ্রংশ[5] না এটি হিন্দু পুরাণের প্রাচীন ঐল রাজবংশকে সূচিত করে, সেই বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।[24]
হাথিগুম্ফা শিলালিপি থেকে জানা যায়, খারবেলের রাজত্বকালের সপ্তম বছরে তার রাণী গর্ভবতী হন ও পুত্র সন্তানের জন্ম দেন। উদয়গিরি গুহাসমূহের মঞ্চপুরী গুহার ওপরের তলায় একটি শিলালিপিতে উৎকীর্ণ রয়েছে যে, হস্তীসিংহের প্রপৌত্রী, ললাকের কন্যা তথা কলিঙ্গ চক্রবর্তী খারবেলের প্রধানা পত্নীর কলিঙ্গের শ্রমণদের উদ্দেশ্যে এই গুহা নির্মাণ করান।[পা 1] খারবেলের উত্তরসূরী কুদেপসিরি বা বক্রদেব এবং বধুকের শিলালিপিও আবিষ্কৃত হয়েছে। ভগবানলালের মতে, কুদেপসিরি বা বক্রদেব খারবেলের পুত্র ছিলেন।[3]
আনুমানিক ২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মৌর্য্য সম্রাট অশোক কলিঙ্গ অধিকার করে নেন, কিন্তু মনে করা হয় যে, তার মৃত্যুর পর কলিঙ্গ মৌর্য্য সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। খারবেল স্বাধীন কলিঙ্গ রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেন।[9] হাথিগুম্ফা শিলালিপি বিশ্লেষণ করে ঐতিহাসিকরা তাকে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম বা দ্বিতীয় শতাব্দীর মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু এই সঠিক রাজত্বকাল এখনও বিতর্কের উর্দ্ধে নয়।
ভগবানলাল ইন্দ্রজী মনে করেন যে, হাথিগুম্ফা শিলালিপির ষোড়শ পংক্তিতে যেখানে খারবেলের রাজত্বকালের ত্রয়োদশ বছরের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা ১৬৫ মৌর্য্যাব্দের সমকালীন। ভগবানলালের মতে, অশোকের রাজত্বকালের অষ্টম বছরে অর্থাৎ ২৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে যুদ্ধের মাধ্যমে কলিঙ্গ মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধীনস্থ হলে মৌর্য্যাব্দ শুরু হয়। সেই অনুযায়ী, খারবেল ১৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জন্মগ্রহণ করেন ও চব্বিশ বছর বয়সে ১০৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিংহাসন লাভ করেন।[3] বেশ কিছু পণ্ডিত ভগবানলালের বিশ্লেষণের সঙ্গে সহমত হননি।[13] সুধাকর চট্টোপাধ্যায়ের মতে শিলালিপিটির ষোড়শ পংক্তিতে মৌর্য্য কাল নয় বরং মুখ্য কাল বলা হয়েছে। তিনি এই লিপিতে খারবেলের রাজত্বকালের পঞ্চম বছরের বর্ণনাকে প্রামাণ্য ধরেছেন, যেখানে নন্দরাজের তি-বস-সত বছর পরে খারবেলের সময়কাল বলা হয়েছে। চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে তি-বস-সত তিনশো অর্থে বলা হয়েছে। সেই অনুযায়ী, তিনি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর প্রথমার্ধ বা দ্বিতীয়ার্ধে খারবেলের সময়কাল বলে মনে করেছেন।[11] অ্যালেইন দানিয়েলোউ খারবেলকে ১৮০ থেকে ১৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যেকার কোন একটি সময়কালের ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেছেন, কারণ তার মতে খারবেল শুঙ্গ সম্রাট পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ও সাতবাহন সম্রাট সাতকর্ণীর সমসাময়িক ছিলেন।[10] রামশঙ্কর ত্রিপাঠী তাকে প্রথম শতাব্দীর শেষ চতুর্থাংশের ব্যক্তিত্ব বলে মনে করেছেন।[13]
উদয়গিরি গুহাসমূহের মঞ্চপুরী গুহার ওপরের তলায় একটি শিলালিপিতে খারবেলকে চক্রবর্তী সম্রাট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।[25] একথা অনস্বীকার্য্য যে, তিনি কলিঙ্গ অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী রাজাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন।[9][22] তার রাজ্য বর্তমান উড়িষ্যা রাজ্যের পুরী ও কটক জেলাজুড়ে অবশ্যই বিস্তৃত ছিল। সম্ভবতঃ বর্তমান বিশাখাপত্তনম ও গঞ্জাম জেলাও তার রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল।[9] ডিয়েটমার রথারমুন্ড ও হেরম্যান কুলকের মতে, তার সাম্রাজ্য মধ্য ও পূর্ব ভারতের বিশাল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল এবং তার মৃত্যুর কয়েক বছরে মধ্যে তার রাজ্য বিলুপ্ত হয়।[26]
হাথিগুম্ফা শিলালিপি জৈন নমোকার মন্ত্রের মত একটি শ্লোক[পা 2] দিয়ে শুরু হয়েছে। এই লিপি থেকে আরো জানা যায় যে, খারবেল তার রাজত্বের দ্বাদশ বছরে তার রাজ্যে অগ্রজিনের একটি মূর্তি ফিরিয়ে আনেন, যা পূর্বে নন্দরাজ নিয়ে গেছিলেন।[1][19] বহু ঐতিহাসিক অগ্রজিন বলতে প্রথম জৈন তীর্থঙ্কর ঋষভনাথকেই গণ্য করেছেন।[27] সেই কারণে খারবেলকে জৈন ধর্মাবলম্বী বলে মনে করা হয়, যদিও জৈন গ্রন্থ ও উৎসগুলিতে খারবেলের কোন উল্লেখ নেই।[28] হাথিগুম্ফা শিলালিপি থেকে আরো জানা যায় যে খারবেল সকল ধর্মের পূজা করতেন[পা 3] ও সকল দেবতার মন্দির সংস্কার করতেন।[পা 4][29][30] সেই কারণে, অনেকে খারবেলকে নিষ্ঠাবান জৈন ধর্মাবলম্বী হিসেবে সন্দেহ প্রকাশ করেন।[31]
Seamless Wikipedia browsing. On steroids.
Every time you click a link to Wikipedia, Wiktionary or Wikiquote in your browser's search results, it will show the modern Wikiwand interface.
Wikiwand extension is a five stars, simple, with minimum permission required to keep your browsing private, safe and transparent.